শঙ্কর সরণি - ৬
আগের পর্বে
শ্যামশঙ্কর দেশে না থাকলে হেমাঙ্গিনী দেবী সন্তানদের নিয়ে কাশীতে থাকতেন। সেখানে হিন্দু কলেজিয়েট স্কুলের পাশেই ছিল অ্যানি বেসান্তের থিওজফিক্যাল সোসাইটি। শ্যামশঙ্কর ফিরে এলে পরিবার নিয়ে ঝালোরে চলে যান। সেখান থেকে উদয়শঙ্কর মুম্বাই যান পড়াশোনার উদ্দেশ্যে। এরপর বাবার ইচ্ছায় ১৯২০ সালে পাড়ি দিলেন লন্ডন। ভর্তি হলেন রয়্যাল আর্ট কলেজে। কলেজের চারপাশ সহ গোটা লন্ডন শহরকে চিনলেন ছবির মতো। এখানেই অধ্যক্ষ রটেনস্টাইনের সূত্রে দেখা হয়ে গেল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। দেশে থাকতে যাঁর প্রতিভার কথা শুনেছেন, তাঁর সঙ্গেই আলাপ বিদেশের মাটিতে। রটেনস্টাইন উদয়শঙ্করের ছবির প্রশংসা করলেও বললেন তাঁর ছবিতে ভারতের শিল্পকলার ছাপ নেই। লন্ডনের মিউজিয়ামেই শুরু হল ভারতীয় শিল্পের অনুশীলন।
পিতার ঔদাসীন্যকে দেখতে দেখতে বড়ো হয়েছেন উদয়। কাজের সূত্রেই কত কতদিন বাইরে কেটেছে শ্যামশঙ্করের। সংসার-সন্ততির সঙ্গে যোগাযোগের তাগিদ অনুভব করেননি তিনি। তাদের নিত্যনৈমিত্তিকতার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নেননি কখনও। বরং পড়াশোনা আর জীবনকে দেখতে চাওয়ার নিরন্তর খোঁজে, সংসারকে তার প্রতিস্পর্ধীই মনে করেছেন আগাগোড়া। এমনকি দ্বিতীয় বিবাহেও হেমাঙ্গিনীর প্রতি তাঁর শর্তভঙ্গ-বিশ্বাসভঙ্গও কি বিচলিত করেছিল তাঁকে, কে জানে। পিতার প্রতি সন্তানদের অভিমান ছিল প্রগাঢ়। কিন্তু এ ব্যাপারে ছেলেরা পেয়েছিল মায়ের ধাত। অভিমান ছিল সংহত, মূক।
রাজকীয় আধারে গড়া ছিল শ্যামশঙ্করের জীবন। অথচ শুনতে অদ্ভুত হলেও হেমাঙ্গিনী তাঁরই সন্তানদের লালন করেছেন গ্রামীণ অস্বচ্ছলতায়। সন্তান পালনের জন্য ধার করার সময় বনেদি বাড়ির অহংকে ধুয়ে ফেলতে হয়েছে তাঁকে। হ্যাঁ, জমিদার-কন্যা ছিলেন তিনি, আশ্রয় আর অন্নাভাব তাঁর ছিল না সে-অর্থে। তবে সেটুকু বাদেও জীবনযাপনের কত সহস্র হাঁ-করা প্রয়োজন তার হিসেব রাখেনি কেউ। এতগুলি সন্তান, তাদের রোগ-ভোগ একাই সামলেছেন হেমাঙ্গিনী। সন্তান-হারানোর বারংবার শোকেও বুঝি নিঃসঙ্গই ছিলেন তিনি। অনেক পরে ছেলেরা বিদেশে, তিনি নিজে ফিরেছেন তখন বিদেশ থেকে। এমন সময় পুত্র দেবেন্দ্রশঙ্করকে লেখা একটা চিঠিতে রয়েছে সেই করুণমূর্তি। লিখেছেন, বিশেষ কোনো সংকটে টাকা খরচ হওয়ায় তিনি বাবা অভয়চরণের কাছে ধার করেছেন ছাব্বিশ টাকা। লিখেছেন, এবারে কুয়োর একান্তই প্রয়োজনীয়তার কথা। যদি তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় সুরাহা। অথচ জীবনের শেষ পর্বে এসে জীবনের কোন অত্যাশ্চর্য জাদুতে বদলে যাবেন শ্যামশঙ্কর। পাহাড়ি পথের মতো কোন বাঁকে, কোন পাকদণ্ডীতে জীবন সেজেছে কোন অভাবিত মুহূর্তে। পুত্রদের সান্নিধ্যলাভই হয়ে উঠবে তাঁর একমাত্র আকাঙ্ক্ষা।
লন্ডনে, আয়ার্লান্ডের মেয়ে আঠারো বছরের ভেরার সঙ্গে আলাপ হল উদয়ের। তাঁর বাবা ফ্রি লান্স মিনিয়েচার পেন্টার। মাও ভারি স্নেহবৎসল। এই পরিবারের সঙ্গে এক আন্তরিক যোগ তৈরি হল তাঁর। আর কলেজের সহপাঠী ছিল হিঞ্চ ক্লিফ। শিল্পকলায় বেশ আগ্রহ সে ছেলের। লন্ডনের দিনগুলো সুন্দর, নির্ভার কাটছিল এঁদের সঙ্গে। এর মধ্যে ঝালোয়ারের মহারাজা ফিরে গেলেন দেশে। রাজারই জরুরি দায়িত্বে রয়ে গেলেন শ্যামশঙ্কর। ফলে তাঁদের বাসা বদলাতে হল। শ্যামশঙ্কর রইলেন কেনসিংটনেরই অন্যত্র। আর উদয়কে ব্যবস্থা করে দিলেন, তাঁর কলেজের কাছে আর্লস কোর্টে। লন্ডনের এই দিনগুলিতেই, এই ঘোরতর বিভুঁইয়েই, উদয় আবিষ্কার করলেন তাঁর পিতাকে আর তাঁর পাণ্ডিত্য ও তাঁর গতিবিধিকে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় লন্ডনে আটকে পড়ে শ্যামশঙ্কর লিখেছিলেন ‘লাইট অব এশিয়া’ এবং ‘ইন্ডিয়ান উইট অ্যান্ড হিউমার’ নামে দুটি গ্রন্থ। লন্ডনের প্রকাশকই দায়িত্ব নেন সে বইয়ের। এছাড়াও তিনি লিখেছিলেন অ্যানি বেসান্ত বিষয়ক প্রবন্ধ। বেসান্তের জন্মভূমিতেই তাঁর প্রতিভার অনন্যতা চিনিয়ে দিচ্ছেন এক ভারতীয় লেখক। বিশ্বের বিশিষ্টজনের কাছে ভারতীয় শিক্ষা-দর্শন-সংস্কৃতিকে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি অতি সন্তর্পণে শুরু করেছিলেন শ্যামশঙ্কর। নানান বিষয়ে বক্তৃতাও দিতেন তিনি। একদিন উদয় গেলেন সেই বক্তৃতা শুনতে।
আরও পড়ুন
রয়্যাল আর্ট কলেজ, রটেনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথ
সেদিন তিনি কথা বলবেন, বিশ্বভ্রাতৃত্ব বিষয়ে। উদয় দেখলেন লন্ডনের বিখ্যাত ক্যাক্সটন হলে পূর্ণ জনসমাগম। জ্ঞানী-মানী মানুষেরা ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করছেন তাঁর কথা শুনবেন বলে। শ্যামশঙ্কর সেদিন বললেন, যুদ্ধই যে ইউরোপে মানুষের সর্বৈব ক্ষতি করেছে তা নয়। বরং যুদ্ধের আগেও এবং পরেও তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন আরো ভিন্নতর ক্ষয়। সেই ক্ষয় হল নিরন্তর, নিরলস মানুষকে ধ্বংস করার প্রস্তুতি। আধুনিক কালে যন্ত্রসভ্যতার ওপর নির্ভর করছে বিশ্বের বিধান। আর সেই যন্ত্রসভ্যতা মেতে আছে মানুষ-হত্যার বিবিধ অস্ত্রের নির্মাণকৌশলে। এর চেয়ে বড়ো ক্ষত মানবসভ্যতায় আর কী হতে পারে। তাই এই সময়ের আশু কর্তব্য, মানব-সম্বন্ধের সংরক্ষণ। যা কিছু আত্মিক তার সংরক্ষণ। শ্যামশঙ্করের কথনভঙ্গি, সমকালকে নিয়ে তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত বিচার-বিবেচনা মুগ্ধ করে তুলল উদয়কে। তিনি দেখলেন কী শ্রদ্ধার সঙ্গে সমস্ত মানুষ শুনছেন শ্যামশঙ্করের ভাবনা। শ্রোতাদের অভিবাদন, প্রশংসা যেন অনড় বিস্ময়ে দেখলেন তিনি। এক অন্যতর আবেগ আর আনন্দে সেদিন ধীরপায়ে বাড়িতে ফিরলেন তিনি।
ভারতীয় সংস্কৃতি বিষয়ে শ্যামশঙ্করের বক্তৃতা থাকলে তিনি অনেক সময় ভাবনাটিকে মূর্ত করে তোলার জন্য সামান্য কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। বিদেশি দর্শকদের কাছে বক্তব্যগুলি যাতে একটা রূপ পায়, একটা চেহারা বা আদল তৈরি হয় তাঁদের কাছে। এইসব অনুষ্ঠানে নৃত্যই থাকত সিংহভাগ জুড়ে। অনুশীলনের মাধ্যমে ইংরেজ মেয়েদের দিয়েই কোনোক্রমে তা শিখিয়ে তোলার চেষ্টা করা হত। অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা দায়-দায়িত্ব তিনি একপ্রকার একা-হাতেই সামলেছেন এতদিন। এইবার এই কাজে তাঁর সঙ্গে থাকার জন্য তিনি ডেকে নিলেন উদয়কে। লন্ডনে ভারি অন্যরকম একখানা কাজ পেয়ে খুশি হয়ে উঠলেন তিনি।
আরও পড়ুন
একটা ফোটোগ্রাফ, গ্লানিবোধ আর মাস্টারমশাই
রামস্বামী সঙ্গত করবেন তবলায়। লন্ডনে তাঁর বহুদিনের দেশি মসলা আর আচারের দোকান। তবে তাঁর অন্য পরিচয়টি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি তবলা বাজাতেন বিখ্যাত এবং সাহসী নৃত্যশিল্পী মাতাহারির নাচের সঙ্গে। যেমন ছিল মাতাহারির রূপ তেমনি তাঁর নৃত্য। বাকি গুণপনার কথা তো ইতিহাসই জানে। গুপ্তচরবৃত্তির সত্য বা মিথ্যা অভিযোগে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে ইতিমধ্যে। বাঁশি, হারমোনিয়ম তো জানতেনই উদয়, ঝালোয়ারে এসে বেহালাও শিখেছিলেন। ফলে রামস্বামীর মতো গুণী আর আমুদে মানুষের সঙ্গে তাঁর জোট বাঁধতে সময় লাগল না। কাজ করতে গিয়ে উদয় খেয়াল করলেন লন্ডনের কয়েকটি ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ইংরেজ পরিবারগুলির কাছে শ্যামশঙ্কর যথেষ্ট আদরণীয়। এমনকি লন্ডনে বসবাসকারী সম্ভ্রান্ত ভারতীয় পরিবারগুলির কাছেও তাঁর গুরুত্ব ছিল প্রশ্নাতীত। ফলত পিতার সূত্রেই লন্ডনে তাঁর আলাপ-পরিচয় হয়ে উঠল ঈষৎ বিস্তৃত। আনকোরা শহরটা ধীরে ধীরে হয়ে উঠল সজীব।
লন্ডনের ওয়েমব্লে স্টেডিয়মে তখন আয়োজন করা হয়েছে এক মস্ত প্রদর্শনীর। প্রদর্শনীর সঙ্গে সঙ্গেই পৃথিবীর নানা দেশ সংস্কৃতিমূলক অনুষ্ঠান নিয়ে অংশগ্রহণ করবে তাতে। যে দেশ যেইদিন অংশগ্রহণ করবে সেই দিনটিকে ডাকা হবে সেই দেশেরই নামে। ভারতের অনুষ্ঠানের দিন স্বাভাবিকভাবেই নাম হবে 'ইন্ডিয়া ডে'। লন্ডনের ভারত দপ্তরে সে সময় শিক্ষা বিভাগের অধিকর্তা ছিলেন কেশবচন্দ্র সেনের পুত্র নির্মলচন্দ্র সেন। তাঁর স্ত্রী রানী মৃণালিনী সেন এ বিষয়ে উদ্যোগী ছিলেন খুব। সঙ্গে ছিলেন সেই সময়ের বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও পরবর্তীকালে ভারতে শিশুকন্যার বিবাহ-রদ আইন প্রণয়নে উদ্যোগী লেডি ডোরাবজি টাটা। টাটাদের মতো ধনাঢ্য পরিবারের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের সম্পর্ক ছিল মধুর। ফলে ইন্ডিয়া ডে-র জন্য মেতে উঠলেন সকলে। রানী মৃণালিনী দেখেছিলেন উদয়কে। প্রস্তাবটা তিনিই দিলেন, লেডি ডোরাবজিও সমর্থন করলেন, ইন্ডিয়া ডে-তে উদয়কে অংশগ্রহণ করতে হবে নৃত্যে। তাঁর ব্যবস্থাপনায় শ্যামশঙ্করের অনুষ্ঠান যে নতুন মাত্রা পেয়েছে তা নজর এড়িয়ে যায়নি তাঁদের। মঞ্চসজ্জা, পোশাক, মেয়েদের নাচের মুদ্রা সমস্ত কিছুতেই এসেছে অভিনবত্ব। তাই এবার তাঁকেই হতে হবে যজ্ঞের হোতা। ভারতের ধ্রুপদি, লোকায়ত নৃত্যকলার বাইরে আর এক নতুনতর ধারা সেদিন পদক্ষেপ করল মঞ্চে। পাদপ্রদীপের আলো এসে পড়ল এক আসন্ন ইতিহাসে।
আরও পড়ুন
বাবার পাঠানো উপহার হাতে পেলেন না উদয়
তাঁর মনের মধ্যে অনিবার আনাগোনা চলছে ছবির। ভেসে উঠছে হারিয়ে গিয়ে আরেকটা মেলে দিচ্ছে। তাঁর স্মৃতির সময়কে রাঙিয়ে দিয়ে যাওয়া সেইসব পদচিহ্ন। আলোর ফুলকি ঝরা নিকষ রাতে নেচে উঠেছিল যে ছেলেটা, ওই মাতাদিন। নাচ তার অস্তিত্বের আনন্দটুকু নিঙরে নিয়েছিল। অথবা নসরতপুরে ঘাগরা চোলিতে গোলাপের গন্ধ জড়ানো সেই মেয়ের দুর্মূল্য ভ্রু-ভঙ্গি, ইশারা। ভাসতেই থাকে, ঝালোয়ারের রত্ন-খচিত রাতের গায়ে এলিয়ে পড়ছে রাজপুরোহিতের শ্বেতশুভ্র চামর। আর রাজনর্তকীর নৃত্য কোন আত্মনিবেদনে হয়ে উঠছে পূজা। মানুষের সমস্ত লীলা সংগীতের মতো, চিত্রের মতো মূর্ত হয়ে উঠতে চাইছে ওই দেহ-ভঙ্গি-অভিনয়কে অবলম্বন করেও।
উদয় ঠিক করলেন, ইন্ডিয়া ডে-র অনুষ্ঠানে তিনি সাজবেন শিব। খালি গা। ভারি নকশা-তোলা আভূষণ। সেদিন শ্রোতারা মন্ত্র-মুগ্ধ হয়ে রইলেন। ‘জন্ম’ নিলেন উদয়শঙ্কর।
আরও পড়ুন
হেমাঙ্গিনী দেবী: মনের দিক থেকে একলা রেখেছিলেন নিজেকে
Powered by Froala Editor