উদয়শঙ্করকে রাখা হল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে

‘কল্পনা’র আমন্ত্রণ এসে পৌঁছল বিদেশের নানান জায়গা থেকে। ১৯৬৫-তে উদয়শঙ্করকে যেতে হল একা। নিউ ইয়র্কের চলচ্চিত্র-উৎসবে এই ছবি তালিকাভুক্ত হলে, পাঠানো হল সাব-টাইটেল সমেত একটা প্রিন্ট। ইংল্যান্ডের কমনওয়েলথ চলচ্চিত্র উৎসবেও ডাক পেল উদয়শঙ্কর পরিচালিত ভারতীয় চলচ্চিত্রের দিগদর্শী এই সিনেমা। সারা বিশ্বজুড়ে এই ছবির স্বীকরণ প্রমাণ করে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ‘কল্পনা’ শুধু আঞ্চলিক বা দেশীয় মাত্রায় সীমাবদ্ধ  হয়ে থাকেনি। শিল্পভাষ্যেও তৈরি করতে পেরেছিল একটা বিশ্বজনীন ভাষা। এই সময় সুদূর বিদেশ থেকে উদয় চিঠি লিখলেন অমলাকে। তখন পঁয়ষট্টি বছরের উদয়। বিবাহের দেউড়ি পেরিয়েছে তেইশ বছর। অথচ তখনও সম্পর্ক নিজের মতো করে হতে চেয়েছে উষ্ণ, আন্তরিক। উদয় লিখলেন, ‘আমি ভাবতেই পারছি না যে তোমাকে ছাড়া আমি একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছি সব আনন্দ ভাগাভাগি না করে।’ তাঁদের প্রেমের শীর্ষমুহূর্তটি ধারণ করে রেখেছিল ‘কল্পনা’। হয়তো সেই স্মৃতি, অতীতের সেই মাধুর্যমণ্ডিত ক্ষণ উদ্বেজিত করে তুলছিল তাঁর পরিত্যক্ত প্রেমময় সত্তাটিকে। লিখলেন, ‘সত্যি, কী কষ্ট বলো তো। কিন্তু তুমি সব সময়ই আমার ভাবনাচিন্তার কেন্দ্রবিন্দু।’ অথচ স্থায়ী হল না এই অনুভূতি। দ্রুত বদলে গেল সময়।  ১৯৬৮-তে আমেরিকা যাবার আগেই অন্তর্হিত হল সমস্ত ভাবাবেগ।

দাম্পত্যে ঘোরতর দুর্যোগের দিনেও অমলা সনিষ্ঠ, পরিশ্রমী আর যত্নশীল ছিলেন সেন্টার প্রতিষ্ঠার যদযাবতীয় বিষয়ে। তেমনই সতর্ক মনোযোগী ছিলেন পুত্রের শিক্ষা, কাজকর্ম, তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছার জগৎটিকে নিয়েও। দূরে থাকলেও সন্তানের মনের খুঁটিনাটি বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকতেন সদা-সর্বদা। ইতিমধ্যে আনন্দশঙ্করকে আমেরিকা পাঠানো হয়েছিল রবিশঙ্করের কাছে, সেতারের শিক্ষাগ্রহণের জন্য। শঙ্করদের ধারা মেনে তাঁর ভেতরেও তৈরি হয়ে উঠছিল শিল্পভাবনার বিচিত্র সব আকাঙ্ক্ষা। ‘শঙ্করনামা’য় উল্লিখিত মা-কে লেখা তারিখহীন একটা চিঠিতে ব্যক্ত হয়েছে আনন্দশঙ্করের সেই চিন্তাজগৎ। লিখেছেন, ‘…আমি এক বিরাট পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি।… পরিবর্তন অর্থাৎ শিল্পকলা জগতে যা সব ঘটছে তা দেখে আমি এত উদ্দীপনা পাচ্ছি যে আমিও সেই স্রোতে গিয়ে একটা কিছু করতে চাই।’ ‘…একটা বিষয়ে আমি মনস্থির করে ফেলেছি যে আমি শুধু একজন ক্লাসিকাল সেতারবাদক হতে চাই না।…আমি যে ভাবে মানুষ হয়েছি তাতে অত্যন্ত বাঁধাধরা শিল্পের ভেতর চিন্তা করতে পারি না। তাই সেতার আমি বাজাব কিন্তু নতুন ভাবে— নতুন দল এবং বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে।’ শঙ্করদের ঐতিহ্যে আনন্দশঙ্করের অবস্থান আরেক স্বতন্ত্র খোঁজ।

আনন্দশঙ্কর ও রবিশঙ্কর

 

১৯৬৮-র আমেরিকার ট্যুর পরিকল্পনার সময় সেন্টারের নিয়ম-শৃঙ্খলার কথা বিবেচনা করে অমলা বাদ দিতে চেয়েছিলেন দু-একজনকে। সেই মতামতকে গুরুত্ব দিলেন না উদয়শঙ্কর। ট্যুরের আগে অমলা দেখলেন, তারা যাচ্ছে। অমলা জানিয়ে দিলেন, তিনি যাবেন না আমেরিকা, এমনকি ট্যুরে যাবে না তাঁর ছাত্রীরাও। কারণ ছাত্রীদের বিদেশ যাত্রার উদ্বেগ থেকেই তিনি গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন এই সিদ্ধান্ত। ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বললেন অমলা। কথা বললেন অভিভাবকদের সঙ্গেও। তাঁর অনুপস্থিতিতে ছাত্রীরা এই বিদেশ যাত্রায় অংশগ্রহণ করুক, তা চান না তিনি, জানালেন সেকথা। কিন্তু স্ত্রীর সিদ্ধান্তকে মর্যাদা দিলেন না উদয়শঙ্কর। হ্যুরককে জানিয়ে দিলেন, অমলা আসছে না। স্কুল বা অমলার নাম ব্যবহার কোরো না। সেইসঙ্গে তাঁর আরো একটি পদক্ষেপ তীব্র আঘাত হানল অমলার ওপর। অমলার স্কুলের অভিভাবকদের সঙ্গে আলাদা কথা বলে, সেন্টারের ছ-সাতটি ছাত্রীকেও সঙ্গে নিলেন উদয়শঙ্কর। ছাত্রীদের এবং উপর্যুপরি স্বামীর ব্যবহারে স্তব্ধ হয়ে রইলেন অমলা। নৈঃশব্দ্যের চেয়ে বড়ো প্রতিকার কী? স্ত্রীর কর্তব্যে ত্রুটি রাখলেন না অমলা, যাত্রাকালে এয়ার পোর্টে সি-অফ করে এলেন উদয়কে।

আরও পড়ুন
একাকী ভ্রমণ বদলে দিল অমলার জীবন

স্বামীর কাছে তাঁর অনুরোধ ছিল সামান্যই। দীর্ঘদিনের কর্ম-সহযোগী তাঁরা। এখন শুধু উদয়শঙ্করই গুরু নন, গুরু তিনি নিজেও। বিবেচক আর দূরদর্শী হতে হয় গুরুকে। দখল রাখতে হয় পরিস্থিতির কোণায়-কোণায়। সেই ভূমিকাই পালন করছিলেন তিনি। অথচ এই সামান্য কারণে অবলীলায় অমলাকে তাঁর শিল্পভ্রমণ থেকে বাদ দিলেন উদয়। বিঘ্নিত হল স্ত্রীর সম্মান, বিঘ্নিত হল গুরুর পদমর্যাদাও। কন্যার বঞ্চনা, শোক, আদর্শের সঙ্গে সেই নিরন্তর লড়াই টের পেতেন অক্ষয়কুমার নন্দী। চিরদিন সত্যনিষ্ঠার উদার প্রাঙ্গণে দেখেছেন জীবনকে। অবিচলিত, শান্ত রইলেন এখনও। এই যুদ্ধে সন্তানের সম্ভাব্য দৃষ্টিভঙ্গিটি যে হতে পারে তার অস্ত্র, হয়তো প্রশমিত করতে পারে তার ক্ষত, অনুমান করেছিল তাঁর প্রজ্ঞা। এ সময়েই একদিন পায়চারি করতে-করতে প্রগাঢ় সেই উপলব্ধিকে কী সহজ ভঙ্গিতে অক্ষয় নন্দী জানালেন অমলাকে, ‘অম, তুমি উদয়কে ভুলে যাও, উদয়শঙ্করকে মনে রাখো’। বাবার এই অমোঘ নির্দেশকেই মনেপ্রাণে পালন করেছেন অমলা। প্রত্যহের ম্লানস্পর্শ-লাগা ধূলিমলিন উদয়ের সামনেও অমলা প্রাণপণ দেখতে চেয়েছেন ফেলে-আসা উদয়শঙ্করের সেই উজ্জ্বল মূর্তিটিকে, তাঁর প্রতিভার অলংকারমণ্ডিত চালচিত্রটিকে। কারণ ব্যক্তি উদয় তখন অস্তমান। ট্যুর ছিল দশ সপ্তাহের। তখনও দু সপ্তাহ বাকি, সান দিয়াগো থেকে খবর এল উদয়শঙ্করের হার্ট আ্যাটাক হয়েছে আবার। এবারেরটা গুরুতর। সমস্ত কিছু পেছনে ফেলে, ফের ছুটলেন অমলা। সঙ্গে গেলেন ভূদেবশঙ্কর।

আরও পড়ুন
নিজের প্রৌঢ়ত্বের সামনে উদয় দাঁড়ালেন দ্বিধাদীর্ণ

অমলাশঙ্কর, রবিশঙ্কর, উদয়শঙ্কর ও আনন্দশঙ্কর

 

আরও পড়ুন
উদয়কে ভুলে যাও, উদয়শঙ্করকে মনে রাখো

জাপান হয়ে অমলা পৌঁছবেন সান দিয়াগো। টোকিও থেকে দুই সন্তানের উদ্দেশে চিঠিতে লিখলেন তিনি, ‘এমন করে তোমার বাবাকে বোধহয় কখনও কাছে পেতে চাইনি। তার পাশে আমি সশরীরে এক এক সময় কাছে না থাকলেও মনে প্রাণে থেকেছি। আজ যেন মনে হচ্ছে আমাদের দুজনকে দুইখানা করে ছিঁড়ে আলাদা করে রেখেছে— মনে মনেও তার কাছে পৌঁছবার ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছি।’ কী গভীর দুঃখানুভূতি অথচ কী গভীর স্থৈর্যে  কথা বললেন অমলা। কত রকমের দূরে থাকাকে মানিয়ে নিয়েছেন তিনি, মেনেও নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর মন চিরদিন আত্যন্তিক জুড়ে থাকতে চেয়েছে প্রার্থিত মানুষটির সঙ্গে। অথচ প্রচণ্ড এই দুর্দিনে উদয় রয়েছেন যোজন দূরে। এক দেশ থেকে এক দেশ ছুটছেন তিনি, সময়ের পাহাড় ঠেলে তবে পৌঁছনো যাবে তাঁর কাছে, তীব্র সে বেদনা সেই ব্যাকুলতা তাঁকে করে তুলছে অসহায়। লস অ্যাঞ্জেলিস থেকে অমলা পৌঁছলেন সান দিয়াগোর নার্সিং হোম। উদয়শঙ্করকে রাখা হয়েছে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। দু ঘন্টা অন্তর মাত্র দশ মিনিটের জন্য রয়েছে রোগীকে দেখবার অনুমতি। অপেক্ষা ফুরোতেই উদয়ের কাছে ছুটলেন অমলা। চারিদিকে চিকিৎসার আয়োজন, যন্ত্রপাতি তার মধ্যে শুয়ে আছেন উদয়শঙ্কর। ব্রেন হেমারেজ হয়েছে তাঁর। অর্ধ-চেতন। ভূদেবশঙ্কর কাছে গেলেন, অমলাশঙ্করকে দেখিয়ে বললেন, কাকা, দেখুন তো কে—চিনতে পারেন কি? একবার চোখ খুলে তাকালেন উদয়, তারপর ধীরে-ধীরে বললেন, ‘সহধর্মিণী’। ব্যাধি যেন পরিশুদ্ধ করেছে তাঁকে। আচ্ছন্নতা ঘুচিয়ে দিয়েছে সময়ের যত গ্লানি, স্পর্শ করে আছে অনাদি অনন্ত সত্যকে। স্বামীর স্বধর্মকে তিনি আগলেছেন একা হাতে, তাকে প্রতিষ্ঠা করেছেন পুনরায়, নতুন প্রজন্মের কাছে পুনর্জন্ম দিয়েছেন উদয়শঙ্করকে। কী অব্যর্থ এক শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন উদয়, সহধর্মিণী। 

আরও পড়ুন
কল্পনা: জন্ম দিতে চায় এক অখণ্ড ভারতবোধকে

সান দিয়াগো থেকে দেশে ফেরার সময় উদয়শঙ্কর ও অমলাশঙ্কর

 

একমাস চিকিৎসার পর উদয়শঙ্করকে নিয়ে অমলা ফিরলেন কলকাতায়। অসুস্থ উদয়কে দেখতে গল্ফ ক্লাব রোডের বাড়িতে এলেন বিখ্যাত সব মানুষরা। এলেন পুরোনো বন্ধু স্বয়ং এলমহার্স্ট এবং লেডি রানু মুখার্জিও। অসুস্থতা অশান্তির ওপর বিছিয়ে রেখেছিল সাময়িক প্রলেপ। দিন যেতেই যথাস্থানে ফিরে এল পুরোনো অশান্তি। সেই সঙ্গে ইন্ধন হয়ে এল আরো একটি ঘটনা। উদয়শঙ্করের এবারের বিদেশযাত্রার পরিবেশন নিয়ে এতটুকু সন্তুষ্ট ছিলেন না সে দেশের দর্শক-সমালোচক। কয়েকটি সংবাদপত্র স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করে তাঁদের অসন্তোষ। পূর্বপরিচয়ের কথা মাথায় রেখে কেউ কেউ রূঢ় হননি ঠিকই, কিন্তু প্রশংসাবাক্যের অভাব ছিল চোখে পড়ার মতো। অনুষ্ঠান যে তাঁদের প্রত্যাশামাফিক হয়নি, ব্যক্তিগতভাবেও কেউ-কেউ জানান সেকথা। এই স্রোতেই ফিরে এল অমীমাংসিত সেন্টারের সমস্যাও।

অমলার ইচ্ছাকে অমান্য করে বিদেশ গিয়েছিল যেসব ছাত্রী, নিয়ম ভেঙে পুনরায় তাদের স্কুলে গ্রহণ করার ব্যাপারে অসম্মতি প্রকাশ করলেন অমলা। গোল বাধল সেসব নিয়ে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রীরা গেল সংবাদমাধ্যমে। সেটা তত বড়ো নয়, বিষয়টা জটিল হয়ে উঠল, কারণ তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন স্বয়ং উদয়শঙ্কর। দুঃখ আর অসম্মানের অবধি রইল না অমলার। তবু হার মানলেন না তিনি। কথা বললেন সংবাদ মাধ্যমে। রিপোর্ট বের হল, যথাযথ। যা সত্য, তাই-ই। রিপোর্টে উদয়শঙ্করের নামটুকুও উল্লিখিত হল না। যার-পর-নাই ক্ষুব্ধ হলেন উদয়শঙ্কর। চিরদিন একচ্ছত্র অধিকার আর সাফল্যে অভ্যস্ত উদয়শঙ্কর মানতে পারলেন না ব্যর্থতা আর উপেক্ষাকে। নিজের জীবনে বহুস্বরকে আমল দেননি কখনও, অমলার ঋজু আদর্শের কাছে অস্বস্তি বোধ করলেন তিনি। তখনই নতুন কিছু করবেন মনস্থির করলেন। নিজের অস্তিত্বকে দুর্বার প্রমাণ করতে চেয়ে অনবরত এক আসনের সন্ধানে যেন মত্ত হতে চাইলেন উদয়শঙ্কর। একদিকে এক স্রষ্টা যিনি নিরন্তর খুঁজছেন শৈল্পিক প্রকরণ, আরেকদিকে এক বিধ্বস্ত মানুষ। সেই জটিল পরিস্থিতিতে জন্ম নিল ‘শঙ্করস্কোপ’।

Powered by Froala Editor