জীবন গড়াল যেন আরোহণ আর অবরোহণ। উজ্জ্বল এক নক্ষত্র কক্ষচ্যুত, ভূপতিত হচ্ছে তীব্র গতিতে। আর ঘরের মাটির প্রদীপখানি ধীরে উঠে এল উন্মুক্ত বিস্তৃত মঞ্চের আলোকবৃত্তে। হ্যাঁ, উদয় আর অমলার কথাই বটে। প্রৌঢ়ত্ব দেহাবয়বকে বিচ্যুত করে তার নিপুণতা থেকে, প্রত্যক্ষ সে রিক্ততা। কিন্তু প্রৌঢ়ত্বই সেই স্বর্ণমণ্ডিত সময়কাল অর্জন-অভিজ্ঞতার টানাপোড়েনে যে জমিয়ে বুনেছে গভীরতর ‘আমি’টিকে। তখনও প্রশস্ত সময় মানবজমিন আবাদে। বহুমুখী প্রতিভাধর উদয়শঙ্কর, কত বিচিত্র, একাগ্র তাঁর নিরীক্ষা, মাঝে-মাঝে মনে হয় নিজের অতিক্রান্ত যৌবনকেও যদি দেখতেন সেই সদর্থকতায়।
রাশিয়ায় উদয়-অমলার শো খারিজ করে অসুস্থ উদয়কে নিয়ে অমলা ফিরলেন কলকাতায়। চিকিৎসা শুরু হল, কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ, বিধিনিষেধকে বিন্দুবৎ আমল দিলেন না উদয়। অত্যধিক মদ্যপান থেকে কিছুতেই বিরত করা গেল না তাঁকে। শেষে স্বামীর স্বাস্থ্যরক্ষার্থে অমলাকে গ্রহণ করতে হল কৌশল। আনন্দশঙ্কর তখন মাদ্রাজে। সন্তানের কাছে যাবার ছলে উদয়কে তিনি নিয়ে গেলেন সেইখানে। কারণ মাদ্রাজে তখন নিষিদ্ধ অ্যালকোহলের বিপণন। যাবার সময় উদয়শঙ্কর সঙ্গে নিলেন এক ক্রেট জিন। অমলা প্রমাদ গুনলেন, এটুকু ফুরোলে তবে নিস্তার। অসুস্থ এই মানুষটাকে আরোগ্যে ফেরাতে চাইছিলেন অমলা। সে শুধু একটি মেয়ের তাঁর স্বামীকে শুশ্রূষায় ফিরিয়ে আনার গল্প নয়। আসন্ন ঝঞ্ঝা থেকে দু হাত দিয়ে অমলা আগলে রাখতে চাইছিলেন তাঁর দাম্পত্যকে। রক্ষা করতে চাইছিলেন তাঁর লক্ষ্যভ্রষ্ট গুরুকে। অমলিন রাখতে চাইছিলেন তাঁর কাব্যলোকের নায়ককে। ধরে থাকতে চাইছিলেন পৃথিবীর প্রতি তাঁর অমল বিশ্বাসকে। না, এর একটি ক্ষেত্রেও সফল হননি অমলা। চোখের সামনে একে-একে ধীরে-ধীরে ভেঙে গেছে, ভেসে গেছে সব। কিন্তু কী আশ্চর্য তাঁর প্রতিটি ব্যর্থতার মধ্যেও অপরূপ হয়ে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর গভীর আন্তরিক প্রচেষ্টা, তাঁর একান্ত সমর্পণ।
১৯৬৩-তে কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ ট্রুপ ভেঙে দিলেন উদয়শঙ্কর। চিঠি পৌঁছল সদস্যদের কাছে, দলে তাঁর আর কোনো প্রয়োজন নেই, এই বয়ানে। চিঠি পেলেন স্বয়ং আনন্দশঙ্করও।
১৯৬৪ সালে আমেরিকা থেকে ট্যুর করে ফেরার পর-পরই কলোরাডো থেকে অমলার সঙ্গে দেখা করতে এলেন পোর্শিয়া ম্যান্সফিল্ড। কলোরাডোতে তাঁর রয়েছে একটি মেয়েদের স্কুল, সাত সপ্তাহের জন্য অমলাকে তিনি নিমন্ত্রণ জানাতে এসেছেন সেইখানে। স্বামী-সন্তান ছাড়া কখনও বিদেশ-বিভুঁইয়ে যাননি অমলা। তাঁকে উৎসাহ দিলেন উদয়ই। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তখন প্রফুল্লচন্দ্র সেন, অমলা বিদেশ যাত্রার বিষয়ে তাঁর সাহায্য চাইলে, তিনি ব্যবস্থা করে দিলেন সব। এই দীর্ঘ জীবনে নিজের কাজকে নিয়ে, নিজেকে নিয়ে এই প্রথম একা দাঁড়ালেন অমলা। সেই একাকী ভ্রমণ বদলে দিল অমলার জীবন।
আরও পড়ুন
নিজের প্রৌঢ়ত্বের সামনে উদয় দাঁড়ালেন দ্বিধাদীর্ণ
আরও পড়ুন
উদয়কে ভুলে যাও, উদয়শঙ্করকে মনে রাখো
কলোরাডো গিয়ে এক অদ্ভুত স্বর্গীয় পরিবেশের সম্মুখীন হলেন তিনি। আমেরিকা তখন যান্ত্রিক উন্মাদনায় মত্ত অথচ তারই ভেতর এখানে তৈরি হয়েছে এক নিঝুম তপোবন। চারিদিক গাছে ঘেরা মনোরম পরিবেশ, ভরে আছে রঙবাহারি ফুলে। চড়ে বেড়াচ্ছে হরিণ। গাছের ডালে পুলি লাগিয়ে নীচের ঝরনা থেকে মেয়েরা তুলছে জল। সব ধনকুবের পরিবারের কন্যা এরা। অথচ খালি পায়ে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে দিনভর। কাজ বলতে গান-নাচ আর লেখাপড়া। দুজন ভদ্রমহিলা মাত্র দুশো ডলারের পুঁজিতে বানিয়েছিলেন এই সামার স্কুল। এমন নিরাভরণ আয়োজনশূন্য সাজ, বিদ্যাচর্চা আর কলাচর্চার এমন আশ্রমিক বাতাবরণ অভিভূত করে দিল অমলাকে।
আরও পড়ুন
কল্পনা: জন্ম দিতে চায় এক অখণ্ড ভারতবোধকে
ফিরে এসে অমলা ঠিক করলেন খুবই ছোট্টো করে, কিন্তু তিনি নিজে, খুলতে চান একটি নৃত্যকেন্দ্র। এতদিন উদয়ের স্বপ্নকেই ধ্রুব জেনেছেন অমলা, বেঁচেছেন তাঁর মধ্যেই। স্ত্রীর খোলসটির বাইরে তাঁর যদযাবতীয় আত্ম- উদবোধনের যাত্রাটিকে ফেলে রেখেছিলেন তীব্র অনাগ্রহে। আজ সেটি নাড়া দিল প্রবলভাবে। উদয় অনুৎসাহিত করলেন, বিদেশ থেকে ঘুরে এলে, এমন হয় তারপর সব নিভে যায়। টাকার জোগাড়ই বা হবে কীভাবে? অবিচল রইলেন অমলা। সাড়ে তিনহাজার টাকা ছিল তাঁর নিজস্ব পুঁজি। উদয় যেসব মিউজিশিয়ানদের বিতাড়িত করেছিলেন, ফিরিয়ে আনলেন তাঁদের। জানালেন, তিনমাস তাঁর পক্ষে কোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়া সম্ভব নয়, শুধু দিতে পারবেন যাতায়াতের জন্য পঁচিশ টাকা। তাঁরা সম্মতি জানালেন এই সামান্য প্রস্তাবেই।
আরও পড়ুন
কল্পনা: উদয়শঙ্করের ভারতজিজ্ঞাসা
প্রতিষ্ঠান খুলতে গিয়ে অমলা ইতস্তত বোধ করলেন, এত ছোট্টো একটা উদ্যোগ, তার সঙ্গে উদয়শঙ্করের মতো একটা প্রকাণ্ড নামকে, যুক্ত করা ঠিক হবে না। কোথায় ‘আলমোড়া’, কোথায় তাঁর ‘কল্পনা’, তাঁর ভুবনমোহিনী যশ-খ্যাতি-পরিচিতি, তাঁকে কি চাইলেই জুড়ে দেওয়া যায়, নিদেন একখানা মেয়েদের নাচের স্কুলের সঙ্গে? কিন্তু উদয়শঙ্করের প্রতিক্রিয়া হল উল্টো। তিনি জানালেন, তাঁর নাম না থাকলে এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে তাঁর কোনো আগ্রহ থাকবে না। নিজের অস্তিত্বকে দেদার ভুলে চিরদিন স্ত্রী যাপন করেছেন স্বামীর জীবন। স্বামীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা-খেয়াল-খুশি, শুধু তাই নয়, থেকেছেন স্বামীর অবিবেচনা আর অপরিণামদর্শিতাতেও। উদয়ের সুখকে গ্রহণ করেছিলেন অমলা, গ্রহণ করেছেন তাঁর অ-সুখকেও। উদয়ের উত্থানের সঙ্গে হেঁটেছেন অমলা, সঙ্গে থেকেছেন তাঁর পদস্খলনেও। অথচ এতটা পথ হেঁটেও শুধু অমলাকে ভালোবেসে, নিষ্কাম শুধু তাঁর পাশটিতে এসে দাঁড়ালেন না উদয়। তিনি দাঁড়ালেন নিজের গৌরবোজ্জ্বল নামটির সঙ্গে।
স্কুল খোলা হল, ফিরিয়ে আনা হল সেই পুরোনো নাম ‘উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টার’। অধ্যক্ষ হলেন উদয়শঙ্কর। প্রথম দিনের ক্লাসটি নিলেন তিনিই। সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করে প্রকাশ করা হল সংবাদটি। তৈরি হল কার্যনির্বাহী কমিটি, রইলেন লেডি রানু মুখার্জি, রবিশঙ্কর, খগেন দাসগুপ্ত, সুকোমলকান্তি ঘোষ প্রমুখ। ছিলেন প্রতাপচন্দ্র চন্দ্রও। ১৯৬৫ সালের মার্চ মাসে প্রথম ক্লাস শুরু হল রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামের হল-এ। তারপর তা উঠে এল তাঁদের গল্ফ ক্লাব রোডের বাড়ির বারান্দায়। উদয় অধ্যক্ষ হলেন বটে, কিন্তু এত সামান্য একটা প্রয়াসে উৎসাহ বোধ করলেন না এতটুকু। এর সম্ভাবনা বিষয়ে আগাগোড়া কখনও পোষণ করেননি কোনো উচ্চ ধারণাও। হাল ছাড়লেন না অমলা। প্রতিজ্ঞা করলেন, যতদিন এই প্রতিষ্ঠানের মেয়েদের নাচ তাঁকে অশ্রুসিক্ত না করবে, ততদিন মঞ্চে উঠবেন না তিনি। ‘সামান্য ক্ষতি’-র পর অমলাশঙ্করের খ্যাতি তখন আকাশচুম্বী। তবু অটল রইলেন নিজের সিদ্ধান্তে। মঞ্চ থেকে দূরে রাখলেন নিজেকে। উদয়শঙ্কর বললেন, কী পাগলামি হচ্ছে! উদয়শঙ্কর করালেন ‘প্রকৃতি ও আনন্দ’ নৃত্যনাটিকা, অমলা অংশগ্রহণ করলেন না তা-ও। সাঁইত্রিশ জন ছাত্রী নিয়ে শুরু হয়েছিল এই স্কুল, ছাত্র সংখ্যা দাঁড়াল পাঁচশোয়। ধীরে ধীরে সর্বজনসমক্ষে প্রতিষ্ঠা পেল এই স্কুল।
আলমোড়ার ‘উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টার’ যুক্ত করেছিল অমলা এবং উদয়কে। আর কলকাতার এই ছোট্টো ‘উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচার সেন্টার’ চুরমার করে দিল তাঁদের সম্পর্ককে। পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা থেকে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ব্যাপার শুরু থেকেই দৃঢ়ভাবে অমলা ধরতে চেয়েছিলেন রাশ, কিন্তু তাঁর সিদ্ধান্তে সহমত হলেন না উদয়। তুঙ্গে উঠল অশান্তি, কথা কাটাকাটি, মনোমালিন্য। তারপর একদিন রইল না সেই অবকাশটুকুও। পড়ে রইল নৈঃশব্দ্য।
উদয় আলাদা দল করলেন, নাম দিলেন ‘উদয়শঙ্কর ব্যালে ট্রুপ’। ১৯৬৭ সালে কিছু প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে উদয় আসাম এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলের ট্যুরে গেলেন। যাবার আগে অমলাকে জানালেন না পর্যন্ত। তীব্র আঘাত পেলেন অমলা। বিয়ের পর এত বছরে এই প্রথম উদয় গেলেন ট্যুরে, সঙ্গে রইলেন না অমলা। এইসময় উদয়শঙ্করের একক পরিবেশন থাকত একটি। নৃত্য-পরিকল্পনাও যে সমস্তটা নিজে করতে পারতেন, তেমনটা নয়। হঠাৎ দিমাপুর থেকে খবর এসে পৌঁছল, হার্ট অ্যাটাক হয়েছে উদয়শঙ্করের। অমলা ছুটলেন। সেবার অ্যাটাক ছিল মাইল্ড, সাতদিন পর খানিক সুস্থ হলে উদয়কে নিয়ে অমলা ফিরলেন কলকাতায়।
আমেরিকা থেকে ভারত সফরে এসেছিলেন পল টেলার, পলাইন কনর এবং বিশিষ্ট সব নৃত্যশিল্পীরা। তখন তাঁরা এসেছিলেন অমলার নাচের স্কুলেও। ফিরে গিয়ে একটি অত্যন্ত সম্মাননীয় নৃত্যোৎসবে তাঁরা আমন্ত্রণ জানালেন অমলাকে। হোসে লিমোন, মার্স কানিংহ্যাম, মারে লুইসের মতো বিশিষ্টজন তথা আমেরিকার প্রথিতযশা শিল্পীরা জড়ো হলেন এই আধুনিক নৃত্য উৎসবকে কেন্দ্র করে। নিউ ইয়র্কে সলোমান হ্যুরক অমলাকে প্রস্তাব দিলেন বড়ো ট্রুপ নিয়ে আবার আসতে। অমলা জানালেন, তিনি ছেড়ে দিয়েছেন নাচ। উদয়শঙ্করও আর নাচেন না সেইভাবে। রাঁচির একটা অনুষ্ঠানে উনি শুধু হাতের মুভমেন্টস দেখিয়েছিলেন। ওই মাপের শিল্পীর পক্ষে এ বড়ো বেদনাদায়ক। কিন্তু হ্যুরক নাছোড়, উদয়শঙ্কর মঞ্চে এসে দাঁড়ালেই দর্শকের পক্ষে যথেষ্ট। অমলা ফিরে এসে জানালেন উদয়কে, উদয় রাজি হলেন।
আমেরিকা যাত্রার প্রস্তুতি শুরু হল জোরকদমে। উদয়ের ব্যালে ট্রুপ এবং অমলার স্কুল, নৃত্যশিল্পী বাছাই চলল দুটি ক্ষেত্র থেকেই। নির্বাচন-পর্বে স্বামীর কাছে অমলা রাখলেন একটি শর্ত। যেহেতু অমলার দায়িত্বে ছাত্রীরা দেশের বাইরে যাবে, ফলত ব্যালে ট্রুপের দু-একজন সদস্য সম্পর্কে তিনি প্রকাশ করলেন তাঁর আপত্তি। উদয় শুনলেন, চুপ করে রইলেন। ২৯ মে ১৯৬৮-তে আনন্দশঙ্করকে একটি চিঠি লিখলেন অমলা, ‘…আমি যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করি তবে ভগবান আমাকে ক্ষমা করবেন না। আমি কাউকে কোনও কাজের পথে বাধা দেবো না, তবে যে পথে অন্যায় আছে সে পথকে বন্ধ করতে হবে। আজ অভিভাবকরা আমাকে বিশ্বাস করে যে ভাবে তাদের মেয়েদের নির্বিঘ্নে ছেড়ে দিয়েছেন আমি তা ঠিকঠাক পালন করেছি— কিন্তু আমাকে middleman করে যদি কেউ অন্যায়ের সুযোগ নেয় সে কথা হয়তো guardian–রা ভাবতে পারেননি। তারা ভাববেন আমি যতক্ষণ আছি তাদের কোনো ক্ষতি হবে না। তাই আমি তাদের জানাতে চাই যে আমার সম্বন্ধ আছে কিন্তু আমি তাতে নেই— অর্থাৎ they should not be misguided by my social relationship. অন্যায় করা যেমন পাপ— অন্যায় সহ্য করা তার চেয়ে বেশি পাপ। Institution-কে বড় এবং আদর্শ করে তুলতেই হবে তার জন্য যদি আমাকে আমার personal সব কিছু (ছাড়তে হয়) ছাড়তে হবে। ভাল এবং মন্দের ভেতর কোনও বোঝাপড়া হতে পারে না… ।’ উদয়শঙ্কর ট্রুপ নিয়ে আমেরিকা গেলেন, বাদ পড়লেন অমলা।
Powered by Froala Editor