নিজের প্রৌঢ়ত্বের সামনে উদয় দাঁড়ালেন দ্বিধাদীর্ণ

বারো-তেরোর এক গ্রামীণ কিশোরী তখন অমলা, যখন উদয় তাঁকে প্রথম দেখলেন প্যারিসে। যুবক উদয়শঙ্কর তখন উদীয়মান এক প্রতিভা। খ্যাতির অভ্রভেদী শিখর স্পর্শের অভিলাষে তিনি পথ পেরোচ্ছেন দ্রুত। তারপরেও  দেখা হত ক্বচিৎ-কখনও। সে সময়েও উদয় ধাবমান তাঁর লক্ষ্যে। আলমোড়ার উদয়, যেন এক রাজা। বিস্তার করেছেন তাঁর রাজ্যপাট। দুর্মূল্য কলারত্নখচিত তাঁর রাজসভা, স্বমহিমায় উজ্জ্বল সিংহাসন। সেখানে এলেন যে অমলা, তিনি এলেন নূতন বেশে। যৌবনের প্রারম্ভে অপরূপ, প্রাণোচ্ছল-গভীর তাঁর বিচরণ। অক্ষয় নন্দীর দীক্ষায়  প্রতিপালিত, যা তাঁর অস্তিত্বকে গেঁথেছে দুর্লভ ঐশ্বর্যে। সাহিত্য-ইতিহাস-পুরাণ জুড়ে তাঁর আগ্রহ। নিতান্ত কিশোরী তখন, রচনা করেছেন ভ্রমণকথা। কসরতহীন অনায়াস তাঁর বাংলা গদ্য। তেমনি নিঃশব্দ এক উপলব্ধি এঁকে তোলে তাঁর তুলি। নৃত্যঋদ্ধ সে মেয়ে, সংযত-থির। দেশ-বিদেশের আহ্বানও ধূসর হয়ে উঠল এ মেয়ের কাছে। কী প্রকাণ্ড-অতল সে আবেদন, টের পেলেন উদয়। উদয় আর অমলার বয়সের ব্যবধান উনিশ, অমলাশঙ্কর জানিয়েছিলেন তবু এ দাম্পত্য দীর্ঘদিন, কুড়ি বছর, রইল অক্ষত, নিবিড়।

বিবাহের পর অমলা রইলেন স্বামীর ছত্রছায়াতেই। স্বামীর বৃহত্তর পরিচয়ের চাঁদোয়ায় গৌণ আর রুদ্ধ হয়ে রয়েছে তাঁর আত্মযাপন, এ ভাবনা তখনও বিচলিত করেনি তাঁকে। প্রেম তাঁকে পরিপূর্ণ করেছে প্রতিপল, নির্মাণ করেছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু ধীরে বদলালো পরিস্থিতি। ততটা সহজ রইল না চারপাশ। চিরদিন উদয় ছুটেছেন তাঁর নিজের যাত্রায়। অমলা থেকেছেন পাশটিতে স্থির, তাঁর কর্মসহচরী হয়ে। কিন্তু সময় এবার দাঁড়াল প্রতিমুখ। প্রৌঢ়ত্বের গোড়াতেই এক অন্যরকম স্থবিরত্ব যেন ভর করল উদয়শঙ্করকে। আর অমলা এসে দাঁড়ালেন তাঁর আত্মানুসন্ধানের পথটিতে। ঘটল উলট-পুরাণ। আর সেই অবধারিত পালাবদলকে গ্রহণ করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল পুরুষের অহং, ক্রোধ।

কুড়ি বছর পর্যন্ত দাম্পত্যের একান্ত বৃত্তে হয়তো তখনও ছিল প্রাণময়তা। সময়কালের হিসেবেও ঠিক তারপরেই     প্রকটভাবে প্রকাশ্যে আসে দুজনের আদর্শগত বিভেদ। কিন্তু যদি মন দিয়ে খেয়াল করি, এ সময়ের উদয়শঙ্করের ভূমিকা-সিদ্ধান্তগুলিকে, অথবা তাঁর নিস্তেজ-ভগ্নমনোরথ মনোভাবের প্রকরণগুলিকে দেখতে পাব অশনি সংকেতটি দেখা দিয়েছিল ‘কল্পনা’র কাজ শেষ হবার ঠিক পর-পরই। এক বৃহত্তর পরিবর্তন আগাগোড়া বদলে দিচ্ছিল উদয়শঙ্করকে।

উদয়শঙ্কর আর অমলাশঙ্কর

 

আরও পড়ুন
উদয়কে ভুলে যাও, উদয়শঙ্করকে মনে রাখো

‘কল্পনা’ ছবির শুটিং যখন শেষ হল, এডিটের সময় নিজের অভিনীত বিরাট অংশ নির্মমভাবে বাদ দিতে শুরু করেন উদয়শঙ্কর। বিশেষত ক্লোজ-আপ। আসন্ন সময়কাল তাঁর প্রৌঢ়ত্বের মূর্তিকেই চিনবে ‘উদয়শঙ্কর’ বলে, এ নামাঞ্জুর ছিল তাঁর। অমলার একান্ত অনুরোধে পুনর্বিবেচনা করা হল বেশ কিছু দৃশ্য। সৌম্যকান্তি, রূপবান, ধীরোদাত্ত উদয়শঙ্কর ‘কল্পনা’-র আয়নায় দেখলেন তিনি এসে দাঁড়িয়েছেন যৌবন-অতিক্রান্ত বেলাভূমিতে। যেন চমকে উঠলেন তিনি।  ‘কল্পনা’র প্রস্তুতির সময়ে মঞ্চ থেকে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল তাঁর। সাজ-সজ্জা-অবয়বচিন্তার পরিবর্তে মুখ্যত তাঁর মন বুঁদ হয়েছিল পরিচালনায়। তারপর আকস্মিক যেন দেখলেন নিজেকে, ক্যামেরার নিশ্ছিদ্র দৃষ্টিতে। জীবনের এই অত্যন্ত স্বাভাবিক পরিবর্তমানতা অত্যন্ত পীড়িত করে তুলল তাঁকে। ‘কল্পনা’র উদয়শঙ্করও সুন্দর, দৃপ্ত। অথচ তা সত্ত্বেও তাঁর এই বিচলন, এতটা স্পর্শকাতরতা বিস্মিত করে খানিক। অমলার যৌবনের অনতিদূরত্বে দাঁড়িয়ে বুঝি এক অনর্থক সংকটকে জন্ম দিচ্ছিলেন তিনি। সেই সংকটকেই করছিলেন লালন। প্রৌঢ়ত্ব তাঁকে জীর্ণ করার আগেই, ভাবলোকে তিনি ছারখার করলেন নিজেকে। এক নক্ষত্রের জীবনচর্যায় ছিলেন দীর্ঘসময়, যাপন করেছেন তারকার জীবন--- সে হাহাকারেরও আছে নিজস্ব রূপ, সেকথাই বা ভুললে চলে কী করে। ছবি তৈরি হয়ে গেলে উদয় ফিরতে চাইলেন না মঞ্চে। মঞ্চ থেকে দূরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় উদয়শঙ্কর দাঁড়ালেন প্রকাণ্ড এক দ্বিধার সামনে।     

আরও পড়ুন
কল্পনা: জন্ম দিতে চায় এক অখণ্ড ভারতবোধকে

ফেরার আশ্বাস পুনরুদ্ধার করলেন অমলাই। নতুন প্রজন্ম তখনও দেখেনি উদয়শঙ্করকে। স্মরণ করালেন তাঁর হৃতগৌরব। অমলার উৎসাহেই উদয়শঙ্কর পুনরায় ফিরলেন পাদপ্রদীপের আলোয়। ১৯৪৯-এ কলকাতার ‘নিউ এম্পায়ার থিয়েটার’ আর উত্তর কলকাতার ‘ছায়া’ সিনেমা হলে প্রায় পঁয়তাল্লিশ দিন ধরে চলল অনুষ্ঠান। সমস্ত পুরোনো নাচকেই ফিরিয়ে আনা হল। দেড়মাস প্রেক্ষাগৃহ রইল হাউসফুল।

আরও পড়ুন
কল্পনা: উদয়শঙ্করের ভারতজিজ্ঞাসা

'সামান্য ক্ষতি'-র দৃশ্যে উদয়শঙ্কর

 

আরও পড়ুন
শুরু হল ‘কল্পনা’র প্রস্তুতি

১৯৫৩-য় কলকাতা এলেন উদয় আর অমলা। শুরু হল তাঁদের জীবনের নতুন পর্ব। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় নিজের পাহাড়-প্রমাণ ব্যস্ততা নিয়েও দাঁড়াতে চাইলেন উদয়শঙ্করের পাশে। একবার ইর্ডেন গার্ডেনেস্-এ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘রামলীলা’ ছায়ানাট্য। সেজন্য বিশাল অঙ্কের বিনোদন করের দায় এসে পড়ে আকস্মিকভাবে। অমলাশঙ্কর জানিয়েছিলেন, একদিন মহাকরণে গিয়ে তিনি দেখলেন বিধান রায় মস্ত সব আইনজ্ঞদের সঙ্গে বসে অভিধানে খুঁজছেন একটি যথার্থ শব্দ, যাতে আইনানুগভাবে বাতিল করা সম্ভব হয় এই কর। ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যাকাডেমি অফ ডান্স ড্রামা অ্যান্ড মিউজিক’ থেকে পদত্যাগ করলেন উদয়। তারপরেও সাহায্যে কসুর করেননি মুখ্যমন্ত্রী তথা প্রবাদপ্রতিম সেই মানুষ বিধান রায়। পুনরায় সেন্টার প্রতিষ্ঠার জন্য বিহার-বাংলা সীমান্তে ঝিলিমিলি নামে খুব ছোট্টো এক পাহাড়ি জায়গা দিতে চাইলেন। উদয় বললেন, বহু দূর। তারপর সল্টলেকে সুভাষ নগর, উদয় বললেন কলকাতার যত আবর্জনা জমেছে এখানে, মশা হবে। বিধান রায় পাঠালেন কল্যাণী-তে। উদয়ের মনে হল, দূর এটাও। শেষে কলকাতার সার্দান অ্যাভিনিউ-তে বিবেকানন্দ পার্কের কাছে ব্যবস্থা করলেন এক বিঘে জমি। উদয় বললেন, এক বিঘে দিয়ে কী হবে? শেষে হাল ছেড়ে কখনও উদয়কে বলতেন বিধান রায়, ‘তুমি সব সময় মাটি থেকে ছ’ ইঞ্চি উপর দিয়ে চলো। মাটিতে পা ফেলতে শেখো, প্র্যাকটিকাল হও।’

এইসময় উদয়শঙ্করের মুখ্যত আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠল ছায়ানাটিকা এবং নৃত্যনাট্য। ছোটো ছোটো নৃত্যাংশের বদলে নির্মাণ করতে চাইলেন নৃত্যনাট্য। অমলার কাব্যবোধ ও সাহিত্যানুরাগ সহায়ক হয়ে উঠল এ নৃত্যভাবনায়।  ‘রামলীলা’ ও ‘বুদ্ধ’ ছায়ানাটিকা, ‘দ্য গ্রেট রিনানসিয়েশান’, ‘সামান্য ক্ষতি’-তে টের পাওয়া যায় অমলার উপস্থিতি। ২৯ নভেম্বর ১৯৫৪-য় আনন্দশঙ্করকে লেখা অক্ষয়কুমার নন্দীর একটি চিঠিতে উল্লিখিত রয়েছে, ‘রামলীলা’র একটি শো-তে দর্শক হয়েছিল বারো হাজারের বেশি।

রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ‘সামান্য ক্ষতি’-র প্রথম শো হল মহাজাতি সদনে। রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতাকে নৃত্যনাট্যের রূপ দিলেন উদয়শঙ্কর। একটি বিশেষ শো করা হয়েছিল দিল্লিতে। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বহু বিশিষ্টজন। উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এবং ডাঃ রাধাকৃষ্ণন।  

উদয়শঙ্কর আর অমলাশঙ্কর

 

১৯৬২-তে উদয়শঙ্কর ‘সামান্য ক্ষতি’ নিয়ে গেলেন আমেরিকা। পৌঁছলেন কানাডা হয়ে ইউরোপে। ইউরোপ ট্যুরের আয়োজন করেছিল ভারত সরকার। স্থির হয়েছিল রাশিয়াতেও যাবে দল। কিন্তু নিরুপায় অমলা ফিরে এলেন উদয়কে নিয়ে। ফিরতে হল অত্যন্ত বেদনাবহ এক পরিস্থিতিতে। অপরিমিত মাত্রায় মদ্যপানের কারণে এসময় উদয়শঙ্করের শরীরের অবনতি হতে শুরু করে ক্রমশ। কিন্তু নিষেধ শুনতেন না কিছুতেই। এক-এক সময়ে তাঁকে স্টেজে তুলতে হত হাত ধরে। যদিও তাঁর নৃত্যের মাত্রাজ্ঞানে তিলপরিমাণ বিচ্যুতি ঘটেনি কখনও। এর আগে ‘কল্পনা’ গিয়েছিল রাশিয়ায়। ‘কল্পনা’র মধ্যে শৌর্য, দেশ-শিল্পকলা-সমাজ গঠনের স্বপ্নে মগ্ন উদয়শঙ্করের এক মূর্তিকে দেখেছিল রাশিয়া। অস্থির, হতোদ্যম, ভগ্নস্বাস্থ্য, দ্বিধাদীর্ণ এই নতুন উদয়শঙ্করকে মঞ্চে আনতে অসহায় অমলা যেন সময়ের কাছে দাঁড়ালেন নিথর, পরাহত।

একটি ব্যক্তিগত পত্র লিখলেন অমলা, এ বিষয়ে ভারত সরকারের তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রখ্যাত হুমায়ুন কবীরকে। লিখলেন, কতকটা এইরকম, ‘আমি জানি আপনারা সকলেই শঙ্করকে ভালোবাসেন। ওঁর জন্যে আমি যতটা গর্ব অনুভব করি, আপনারা ঠিক ততটাই গর্বিত। উনি শরীর খারাপ হয়ে এখন এমন একটা অবস্থায় এসে পৌঁছেছেন যে যদি আপনারা ওঁকে জীবিত দেখতে চান, তা হলে এখনই দেশে ফেরার ব্যবস্থা করুন। আমি নিতান্ত অসহায় হয়ে আপনাকে ব্যক্তিগত চিঠি লিখছি।’ দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করলেন হুমায়ুন কবীর। ঠিক তখনই খবর এসে পৌঁছল অক্ষয় নন্দীর অসুস্থতার। দল রইল, উদয়ের ভাবমূর্তিকে অবিচল রেখে উদয়কে নিয়ে ফিরে এলেন অমলা।

Powered by Froala Editor