‘কল্পনা’ ছবিটির কাহিনিকার-নির্দেশক উদয়শঙ্কর আর সে গল্পের প্রধান চরিত্র হল উদয়ন। উদয়নেরও জীবনের স্বপ্ন সে নির্মাণ করতে চায় এক কলাকেন্দ্র। এইটুকুতেই আমরা ‘কল্পনা’-কে উদয়শঙ্করের জীবন ধরে নিয়ে এর অযুত সম্ভাবনাগুলি সম্পর্কে ক্রমে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ি। মিল তো অবশ্যই আছে। তবে সেই সাদৃশ্যের একটা বাইরের দিক আছে, অন্যটা ভেতর-ঘরের।
ছোটো উদয়নও রয়েছে তার মামা আর মাতামহের আশ্রয়ে। কঠোর শাসনের নামে তার জীবনেও নেমে আসছে কঠিন প্রহার। নুর নামেই তারও রয়েছে এক সহৃদয় মুসলিম বন্ধু। ইস্কুলে মামার ভর্তি করতে নিয়ে যাওয়ার দিনটিও উদয়ের সঙ্গে উদয়নের জীবনে তফাত নেই কোনো। প্রথম শিক্ষকের কদর্য ব্যবহার আর বাড়িতে নির্মম আচরণে আশাহত, হতাশ উদয়নকে উদ্ধার করছেন তার চিত্রকলার শিক্ষক। অম্বিকাচরণের আদলে গড়া সেই শিক্ষক তাকে জুড়ে দিচ্ছেন জীবনের নানা ঔৎসুক্যের সঙ্গে। খাপছাড়া, হরবখত হাঙ্গাম-বাধিয়ে-বেড়ানো উদয়ন বদলে যাচ্ছে দ্রুত। আছে এক বালিকা, শৈশব পেরিয়ে বহুদিন পর উদয়নের কাছে যখন ফেরে সে, তখন পূর্ণ যুবতী। উদয়নের মতোই সেও চিত্রকলা আর নৃত্যকলা পারঙ্গম দুটিতেই। জীবনের অমলা ছবিতে সেজেছেন উমা। আর আছে কামিনী। মন্বন্তর-বিধ্বস্ত এক মেয়ে। সদ্য মায়ের মৃত্যুতে শোকোন্মাদ, কাকতালীয়ভাবে সে জুড়ে যায় উদয়নের জীবনের সঙ্গে। হয়ে ওঠে তার নৃত্যসঙ্গিনী। মনে পড়ে সিমকির কথা। যুদ্ধ-আক্রান্ত এক দ্বিধাদীর্ণ শৈশব, অণুক্ষণ মায়ের জন্য উৎকণ্ঠা, অমলাকে নিয়ে তীব্র ঈর্ষাকাতর, অন্য পুরুষের প্রতি আসক্তি ধাপে-ধাপে মিলে যায় অনেকখানি। আর বাকি থাকে অব্যর্থ একটি সমাপতন। তা হল কলাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আর তার বাস্তবায়ন।
যেকোনো সৃষ্টির ভেতর ঝলকে উঠবে তার স্রষ্টার জীবন, সে আর কী এমন বড়ো ব্যাপার? কিছুটা তাঁর জীবনের আদল আর কিছুটা তাঁর কল্পনা, এভাবেই তো মূলত চেহারা পায় সৃষ্টি। কিন্তু যে-দর্শক তন্নিষ্ঠ, এটুকুতে তাঁর তৃপ্তি নেই, তাঁর খোঁজ অন্যত্র। উদয়ের সঙ্গে উদয়নের সাদৃশ্যসূত্রের যে বহির্জগৎ এতক্ষণ সেসব কথাই বললাম আমরা। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কথাখানা হল, এক গভীর অন্তর্জগৎ অন্তর্লীন হয়ে আছে উদয় আর উদয়নের বোধে। সন্ধান প্রয়োজন সেই বিষয়টির। অনুসন্ধান প্রয়োজন এ ক্ষেত্রটিরও যে, উদয়ের জীবনের কোন গভীর বিশ্বাস প্রকাশিত হয়েছে উদয়ন চরিত্রটির নির্মাণে, যা হয়তো প্রকারান্তরে বেরিয়ে এসেছে স্রষ্টারও অগোচরে। ‘কল্পনা’র মধ্যে রয়েছে উদয়শঙ্করের ভারতজিজ্ঞাসা। তল্লাশ প্রয়োজন সেই বিষয়টিরও।
আরও পড়ুন
শুরু হল ‘কল্পনা’র প্রস্তুতি
বিশ্রুত, প্রতিভাশালী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় উদয়শঙ্কর সম্পর্কে জানিয়েছিলেন, তাঁর ‘শোম্যানশিপ ছিল অসাধারণ। তারপর উদয়শঙ্কর শ্যাডো প্লে করেছিলেন। সেসবও দেখেছি। ৪৩-৪৪ সালে শোনা গেল, তিনি ছবি তুলছেন। একটু সন্দেহ হয়েছিল যে, সিনেমার ব্যাপারটা তিনি ঠিক আয়ত্তে আনতে পারবেন কি না! তাঁর ‘কল্পনা’ দেখে মুগ্ধ হলাম। বার-দশেক দেখেছি সে ছবি। আবার যদি আসে তো আবার দেখব। নাচকে ছবিতে কীভাবে ব্যবহার করা যায় সেটা এদেশে তিনিই প্রথম দেখালেন।’ বোঝা যায়, যে শিল্পকলা তাঁর নিত্য চর্চার বিষয়, সেইক্ষেত্রে যতই খ্যাতনামা তিনি হোন-না-কেন, জরুরি যে-শিল্পে তিনি বিস্তৃত করতে চান তাঁর অধিকার, আদৌ আয়ত্ত করতে পেরেছেন কি না সেই ভাষাটিকে। ‘কল্পনা’র সার্থকতা এইখানেই। হতে পারে তা নৃত্যবিষয়ক ছবি, হতে পারে নৃত্যের আধারে তা প্রকাশ করতে চায় যাবতীয় বক্তব্য; কিন্তু লক্ষণীয় তা প্রকাশিত চিত্রভাষাতেই। অভিনয়-দেহভাষা-সেট-আলো-ফ্রেম এবং ফ্রেমের পার্সপেক্টটিভ মূর্ত করে তুলছে রূপদক্ষতাকে। জন্ম দিচ্ছে চলমান ছবির অর্থময়তাকে। ভারতে চলচ্চিত্রশিল্পের প্রায় জন্মলগ্নেও তাকে দেখতে চাইছে এক পূর্ণ পরিণত আধারে।
আরও পড়ুন
আমিই সব, এ দুর্বলতা ছিল উদয়শঙ্করের
আরও পড়ুন
অসম্মানিত অমলা ছেড়ে দিতে চাইলেন নাচ
একটি কন্যাসন্তানের ইচ্ছা অপূরণ থাকায় উদয়ের মা হেমাঙ্গিনী ছোটোবেলায় মাঝে-মাঝে উদয়কেই সাজিয়ে দিতেন মেয়ের সাজে। তারপর গ্রামোফোন চালিয়ে উৎসাহ দিতেন নাচার ব্যাপারে। অমল-শৈশবে নাচের সঙ্গে তাঁর প্রথম সম্বন্ধের সেই গুরুত্বপূর্ণ চিহ্নটি দিয়েই শুরু হয় ছোটো উদয়নের গল্প। বন্ধুরা মিলে তৈরি মঞ্চে মেয়ে সেজে নাচছে বালক উদয়ন। আর এই রকমই কখনো থিয়েটার-করা আবার কখনো সহপাঠীদের সঙ্গে মারামারির কারণে উদয়নকে পড়তে হয় মামা আর মাতামহের রোষে। সহ্য করতে হয় মাতামহের নির্মম প্রহার। ওই অমানবিক মারের ঠিক আগে একটা ভয়েস ওভার থাকে, এমন বয়োজ্যেষ্ঠ লাখ-লাখ আছে আমাদের দেশে। এ ছবি আগাগোড়া কথা বলবে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার অসারত্ব নিয়ে। শুধু আখ্যানে নয়, অদ্ভুত এক সিনেমাটিক ল্যাঙ্গোয়েজ তৈরি করেন উদয়। দাদুর প্রহার-দৃশ্যে ফ্রেম জুড়ে থাকে অতিকায় দুটো পা আর সেই পায়ের ফাঁকটিতে কুঁকড়ে থাকা সন্ত্রস্ত এক শিশু। অথবা স্কুলে ভর্তি হওয়ার দিন ছাত্রদের সঙ্গে প্রবেশ করতে দেখা যায় সারি সারি ভেড়া। ছাত্র-পিটিয়ে ‘ভেড়া’ বানাবার কৃতিত্ব উপভোগ করেন এক শিক্ষকও। সন্তান প্রতিপালনের নামে ভারতীয় শৈশব-হত্যার মতো বিষয়টিকে মনে রাখতে হবে উদয়শঙ্কর তুলে ধরেন সদ্য স্বাধীনতা-উত্তর সময়েই।
আরও পড়ুন
উদয়শঙ্করের প্রশাসনিক ব্যর্থতার খবর পৌঁছল বিদেশে
যুবক উদয়ন নির্মাণ করতে চায় এক কলাকেন্দ্র। আর সেই অর্থসঞ্চয়ের খোঁজে তাকে পৌঁছতে হয় উচ্চবিত্ত শিল্পপতিদের সমাজে। দেশের ধারণা সম্পর্কে অস্বচ্ছতায় আচ্ছন্ন, ধনক্লিষ্ট, বোধহীন, নির্লজ্জ মানুষগুলোকে একটি দীর্ঘ পার্টির দৃশ্যে কী আশ্চর্য নৈপুণ্যে প্রকাশ করেন উদয়শঙ্কর। মন্বন্তর-দারিদ্র্য-ক্ষুধা যাদের কাছে শৌখিন আলোচনা-বিলাস। তাদের বাচন আর আচরণের স্ববিরোধ, অর্থশূন্য মেকি শোকপ্রকাশ, দ্বিচারিতা, ভণ্ডামিকে কখনো লঘু হাস্যরসে, কখনো তির্যক সংলাপে বিদ্ধ করেন নির্দেশক। সেইসূত্রেই ছবিতে আসে উদয়শঙ্করের বিখ্যাত ‘লেবার অ্যান্ড মেশিনারি’- কম্পোজিশনটি। এক শিল্পপতি যিনি নিজেকে বলেন, শ্রমিকবন্ধু, অথচ ভেতর ভেতর শ্রমিকের ইস্পাতের মতো পেশিশক্তিকেই যন্ত্র করে তোলবার অভিসন্ধি তার। যন্ত্রসভ্যতা শ্রমলাঘব করবে, নাকি মানুষকেই করে তুলবে যন্ত্রবৎ গভীর সেই বিতর্কটিকেই সেদিন ঘনিয়ে তুলছিলেন উদয়।
১৯২৪-এ ‘প্রবাসী’-র পাতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন তাঁর অসামান্য নাটক ‘রক্তকরবী’। পরে এই নাটকের ভূমিকায় তিনি লেখেন, ‘কর্ষণ-জীবী আর আকর্ষণ-জীবী এই দুই জাতীয় সভ্যতার মধ্যে একটা বিষম দ্বন্দ্ব আছে’। ‘কৃষিকাজ থেকে হরণের কাজে মানুষকে টেনে নিয়ে কলিযুগ কৃষিপল্লীকে কেবলই উজাড় করে দিচ্ছে। তাছাড়া শোষণ-জীবী সভ্যতার ক্ষুধাতৃষ্ণা দ্বেষহিংসা বিলাসবিভ্রম সুশিক্ষিত রাক্ষসেরই মতো।’ যক্ষপুরীতে ছিবড়ে হয়ে-যাওয়া সেইসব মানুষগুলোকে মাটির পৃথিবীর সহজ খুশির হদিশ দেয় নন্দিনী। ১৯৩৬-এ তৈরি হয় চার্লি চ্যাপলিনের বিখ্যাত ছবি ‘মডার্ন টাইমস’। ছবিতে আমরা দেখি শিল্পকারখানার অদ্ভুতুড়ে পরিস্থিতি। যন্ত্রের হাতে নাকাল হতে হতে কেমন যন্ত্র হয়ে উঠছে মানুষ। যন্ত্রের কঠিন চলনের সঙ্গে নিজের অঙ্গসঞ্চালনাকে খাপ খাওয়াতে গিয়ে মানবশরীরটাই হয়ে উঠছে যন্ত্রবৎ। প্রবল হুল্লোড়ে সেদিন সেকথা আমাদের মগজে গেঁথে দিয়েছিলেন চ্যাপলিন।
‘লেবার অ্যান্ড মেশিনারি’-র ক্ষেত্রে এই দুই ভাবনারই শরিক হলেন উদয়। তবে তিনি তাঁকে রূপ দিলেন নৃত্যে। তৈরি করলেন কয়েকটি দৃশ্যখণ্ড। প্রথম পর্যায়ে শ্রমিকের নিষ্পেষণ, তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে আসার প্রবল ইচ্ছায় ঘনিয়ে উঠছে বিদ্রোহের স্বপ্ন। অন্যদিকে সেই প্রতিবাদকে নিকেশ করতে শিল্পপতির সঙ্গে রাষ্ট্রশক্তির করমর্দন। আছে অন্নচিন্তায় দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের বিরোধকেও অর্থের বিনিময়ে ধূলিসাৎ করার চেষ্টা। কিন্তু তা-ও বিকিয়ে যাচ্ছে না মনুষ্যত্ব। ওই যন্ত্রগুহায় আটকে থাকা বিবরে আকস্মিকভাবে ক্ষণিকের জন্য ফুটে উঠছে মাটি- আকাশ আর উন্মুক্ত পৃথিবী। ঠিক যেভাবে নন্দিনী যক্ষপুরীতে বইয়ে দিয়েছিল স্বাভাবিক জীবনের আনন্দকে। ‘কল্পনা’ ছবিতে এই দৃশ্যের একটি অভিনব প্রয়োগ লক্ষ করব। সিনেমার ভেতর চলছে একটা দীর্ঘ ডান্স-ড্রামা। আর সেই ডান্স-ড্রামার ব্যাকড্রপে হঠাৎ ফুটে উঠছে একটা পর্দা। বদ্ধ যন্ত্রঘরের পশ্চাৎপটে, কারখানার কেজো আর কেঠো জীবনের বিপরীতে যেখানে জেগে উঠছে আকাশ-মাটির পৃথিবী। কারুকৌশল আর কারিগরি কৌশল ‘কল্পনা’ ছবিতে ছড়িয়ে রয়েছে বহুধামাত্রায়।
খেয়াল করব উদয়ন নিজে শিল্পী বলে এই সংকটে, ধনাঢ্যের পার্টির ভেতরে থাকার অস্বস্তিতে তার মনের মধ্যে তৈরি হয়ে উঠছে এই নৃত্যপরিকল্পনা। শিল্পের হাতিয়ারে সে দেখতে চায় সমাজবদলকে। চিত্তবিনোদন আর মনোরঞ্জনের জন্য যে-নৃত্যকে এতদিন ব্যবহার করা হয়েছে, সেই প্রয়োগক্ষেত্র থেকে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের উদ্যোগে গণনৃত্যের সৃজন হয়েছিল চারের দশকের গোড়ায়। সাধারণ মানুষকে জাগিয়ে তুলতে, তাদের অধিকার সম্পর্কে অবহিত করে তুলতে গড়ে উঠেছিল ওই প্রকল্প। তবে গণনাট্যের ইতিবৃত্তে সেভাবে সফল হয়নি গণনৃত্য। সেই হারিয়ে থাকা নৃত্যধারাকেই উদয় সফল করে তুললেন নিজের ভাবনায়। ‘কল্পনা’র এই কাহিনিখণ্ডে জনমানুষের অস্তিত্বের দাবিতে সোচ্চার হতে চেয়ে উদয়শঙ্কর প্রয়োগ করলেন সেই গণনৃত্যকেই। মজা আছে আরো একটা। যন্ত্রযুগ হরণ করছে মানুষের স্বাভাবিক দেহবিভঙ্গকে, তার বেঁচে থাকাকেই করে তুলেছে যান্ত্রিক-- তাকে যেমন প্রকাশ করলেন উদয়, ঠিক তেমনই সেই যান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার মুহূর্তেও তিনি ব্যবহার করলেন দেহভাষারই নৃত্যময়তাকে। একদিকে যন্ত্রবিদ্ধ দেহ অন্যদিকে বাহুর স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। যেন যন্ত্রের বিরুদ্ধে গর্জে উঠল মানুষের অস্তিত্বের নিজস্ব ছন্দ।
‘কল্পনা’ দেখতে চায় আশাকে, বিশ্বাসকে। দেখব ওই মনুষ্যত্ববিবর্জিত পার্টির ভেতরেই থাকে ছাঁচভাঙা এক ধনিক। স্বদেশ-দরদি সেই শিল্পপতিই কলাকেন্দ্রের জন্য বাড়িয়ে দেন নিঃশর্ত সাহায্যের হাত। এই ছবির প্রায় গোড়াতেই রয়েছে উদয়শঙ্করের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি ডান্স-পিস। ‘ডান্স অব্ রিদম্’। উদয়ন স্বপ্নে দেখে ভুল করে তাকে এনে ফেলা হয়েছে স্বর্গে। স্বর্গের দূত তার প্রতি আঘাত হানছে এই বলে যে, তালের অপপ্রয়োগের এই পরিণাম। তারপরই ভুল শুধরে নেয় তারা। উদয়ন দেখতে পায় স্বর্গের ছন্দোময়তাকে। বিচিত্র বাদ্য-তাল-ছন্দের এক স্বর্গীয় সমাহার। শুনতে পায়, সেই তাল, যার লয়ের ওপরেই নির্ভর করে স্পন্দিত হয় বিশ্বের হৃদয়। যা প্রাণসঞ্চার করে সৃষ্টিতে। এই সৃজনে দর্শক মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখে উদয়শঙ্করের বাহুতরঙ্গের সেই আশ্চর্য সিগনেচার স্টাইল।
‘কল্পনা’ একজন জগৎবিখ্যাত নৃত্যশিল্পীর শিল্পবোধ থেকে নির্মিত ছবি বলে, এই নৃত্যাংশের খণ্ডটিকে শুধুই একটি অতুলনীয় নৃত্যপরিকল্পনা বলে চিহ্নিত করে এর আলোচনা সেরে ফেলি আমরা। অথচ এর সঙ্গেই মনে রাখা দরকার ‘কল্পনা’ মাধ্যম-হিসেবে নাচকে গ্রহণ করেও কথা বলে দেশ- রাজনীতি- গ্রামোন্নয়ন- অর্থবৈষম্য- বৈদেশিক প্রভাব- সমাজভাবনা- শিল্পসমন্বয় প্রভৃতি আরো কত কিছু নিয়ে। ‘কল্পনা’ যেন কেন্দ্রীয়-সংস্কৃতি আর প্রান্তিক-সংস্কৃতির সম্মিলনের এক বৃহৎ চালচিত্র। সেখানে ধ্রুপদি নৃত্যশৈলীর সঙ্গে আঞ্চলিক লোকনৃত্য অন্বিত হয় যে গুরুত্বে, সেই গভীর তাৎপর্যেই অন্বিত হয়ে থাকে উচ্চবর্গীয় মানুষের সঙ্গে নিম্নবর্গীয় মানুষ, উচ্চবিত্ত জনজীবনের সঙ্গে নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনচর্যা। ‘ডান্স অব্ রিদম্’ তাই একটা নৃত্যাংশ নয়, উদয়শঙ্করের বিশ্বাসলোক। সমাজগঠন ও সাংস্কৃতিক সমন্বয়কেও তিনি দেখতে চান ওই সুষম সামঞ্জস্যপূর্ণ তাল-লয়ের যুগলবন্দিতে, ওই স্বর্গীয় রিদম্-এ।
Powered by Froala Editor