তখন ১৯৪১, চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আলমোড়ায় উদয়শঙ্কর কালচারাল সেন্টারে ব্যস্ততা স্তিমিত। অমলা আর উদয় প্রতীক্ষায় রয়েছেন তাঁদের প্রথম সন্তানের। পূর্ণগর্ভের অন্তঃসত্ত্বা অমলা, নাচ থেকে নিয়েছেন সাময়িক বিরতি। সেই সময়েই সুনিয়ন্ত্রিতভাবে শুরু হল ‘কল্পনা’র পরিকল্পনা। এই চলচ্চিত্র-নির্মাণের প্রস্তুতিপর্ব চলেছিল প্রায় সাত বছর। ‘কল্পনা’ রিলিজ করে ১৯৪৮-এ।
একবার উদয়শঙ্করের একটি প্রেস কনফারেন্স চলছিল কলকাতায়। সাংবাদিক বৈঠক চলাকালীন নানা প্রশ্নোত্তর পর্বে উদয়শঙ্কর লক্ষ করছিলেন, ওই ভিড়ের মধ্যেই প্রশ্ন করে চলেছে, ভারি চমৎকার একটি ছেলে। যেমন সপ্রতিভ, তেমনই বুদ্ধিদীপ্ত। নিতান্তই কম বয়স, চোদ্দো কি পনেরো হবে। সৌম্যসুন্দর চেহারা, শিক্ষিত, সুভদ্র। সকলের চেয়ে আলাদা করে চোখে পড়ে। উদয়শঙ্করের চোখ বলে কথা, সেই কিশোরের উদ্দেশে বললেন তিনি, ‘Why don’t you join our Centre?’। ১৯৪২-এ সতেরো বছর বয়সে সেই কিশোর এলেন আলমোড়ায়। আসন্ন ভবিষ্যতে ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসের দিগনির্দেশক হয়ে উঠবে যে নাম, প্রখ্যাত অভিনেতা-নির্দেশক সেই গুরু দত্ত (১৯২৫-১৯৬৪)। ‘রামলীলা’ শ্যাডো প্লে-তে গুরু দত্ত সাজতেন লক্ষ্মণ। লেখার হাত ছিল খাসা। দক্ষিণ ভারতীয় হয়েও, কলকাতার ভবানীপুরে শৈশব-কাটানো গুরু, যথেষ্ট পরিচিত ছিলেন বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতির সঙ্গে। কাহিনি উদয়শঙ্করের, কিন্তু তাঁর হাতেই শুরু হল ‘কল্পনা’-র হিন্দি ভাষায় চিত্রনাট্য লেখার কাজ।
একদিন বসে আছেন অমলা, উদয় আর গুরু দত্ত। উদয়শঙ্কর জিজ্ঞাসা করলেন অমলাকে, ইম্যাজিনেশনের ভালো বাংলা কী হতে পারে? অমলা উত্তর দিলেন, ‘কল্পনা’। স্থির হল, তাই হবে ছবির নাম। গুরু দত্তকে নির্দেশ দিলেন, চিত্রনাট্যের কাজে হাত দিতে। ‘কল্পনা’-র গল্পটা খানিকটা আত্মজৈবনিক। নিজের জীবনের আধারে আখ্যানকে গড়েছিলেন উদয়শঙ্কর, কিন্তু উদয়শঙ্করের জীবনী তা নয়। বরং দেশ-শিল্প-সময়-রাজনীতি-মানবিক অবক্ষয় সম্পর্কিত তাঁর যদযাবতীয় ধারণাকেই গেঁথে রাখা হয় এই ছবিতে। ‘কল্পনা’ ভারতের প্রথম আদ্যন্ত নৃত্যবিষয়ক ছবি। সমগ্র দেশের অজস্র-অসংখ্য নৃত্যধারাকে অসমান্য শিল্পিত বিন্যাসে ধরা রয়েছে এই ছবিতে। নৃত্যশিল্প এবং চলচ্চিত্রশিল্পের আশ্চর্য এক সুষম বন্ধনকে আবিষ্কৃত হতে দেখি এ প্রচেষ্টায়। অমলাশঙ্কর জানিয়েছিলেন, ‘উনি [উদয়শঙ্কর] বলতেন এটা ওঁর ইম্যাজিনেশন an artist’s imagination! উনি যে যে বিষয় নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতেন, যা হয়তো জীবনে কখনও করে উঠতে পারবেন না, ওঁর সেই স্বপ্নের আলমোড়ার সেন্টারের পূর্ণ রূপ রেখে যেতে চেয়েছিলেন এই ছবিটির ভেতরে।’ সাধারণত মানুষ তাঁর ভাবনাকে, স্বপ্নকে মনোলোক থেকে বাস্তবায়িত করে তোলে জীবনে। কিন্তু এক্ষেত্রে বিষয়টি ঈষৎ উল্টো। আলমোড়া প্রতিষ্ঠানের সমকালে সমান্তরালভাবেই উদয়শঙ্কর শুরু করেছিলেন সিনেমা বিষয়ে ভাবনা। কিন্তু সিনেমার উদ্যোগ হয়ে ওঠার আগেই সংকট ঘনিয়ে ওঠে কলাকেন্দ্রে, অচিরেই ভেঙেও যায় তা। ফলত তখন সিনেমাই হয়ে উঠল তাঁর বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যম। মানবজীবন, শিল্পসত্তা ও শিল্প-ঐতিহ্য বিষয়ে উদয়ের ভাবনা-চিন্তা, যা প্রায়োগিকভাবে ব্যর্থ হল আলমোড়ার বস্তুবিশ্বে, ‘কল্পনা’ ধারণ করে রইল তারই তত্ত্ববিশ্ব।
স্যর চিনুভাই ব্যারনেট, ধনী-অভিজাত এই পরিবারের লোকহিতে খ্যাতি ছিল খুব। তিনি ছিলেন আলমোড়া সেন্টারের ট্রাস্টিও। নানান জায়গায় ছবি প্রযোজনার ব্যাপারে যোগাযোগ করছিলেন উদয়শঙ্কর। শেষে এলেন আমেদাবাদে। ছবিটিকে যেভাবে দেখতে চাইছিলেন নির্দেশক উদয়শঙ্কর তাতে বাজেট দাঁড়ায় দু লাখ থেকে বারো লাখ। শেষে দাঁড়ায় বাইশ লাখে। দরাজ চিনুভাই দিয়েছিলেন বারো লক্ষ টাকা। উদয়শঙ্কর মহাকাব্যিক দ্যোতনায় ভাবছিলেন সেট-এর বিষয়গুলি। সে সব শুনে শিল্পনির্দেশক জানালেন, তেমন সেট বানাতে হলে প্রতি সেট-এ খরচ পড়বে তিন লাখ। এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল তখন। আনন্দশঙ্করের বয়স তখন আড়াই-তিন। ব্লকস্ নিয়ে চলছিল খেলা। হঠাৎ উদয়শঙ্করের মনে হল, সেট-এর জন্য যদি নানান মাপের ব্লকস্ বানানো যায়, তবে সুবিধামতো তা পরিবর্তন করলেই বিচিত্র আকৃতির ব্যাকড্রপ তৈরি করা যেতে পারে। সেইমতো কী অসামান্য নৈপুণ্যে নির্মিত হল সেট।
ছবির জন্য উদয়শঙ্কর চাইছিলেন একেবারে আনকোরা মুখ। প্রতিষ্ঠিত, বহুপরিচিত চেহারাকে তাঁর সিনেমার চরিত্রাভিনেতা হিসেবে দেখতে চাননি তিনি। মেধাবী-খ্যাতমান অভিনেত্রী রেখার মা পুষ্পাবল্লী এবং প্রতিভাশালী অভিনেত্রী বৈজয়ন্তীমালার মা বসুন্ধরাও আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন এই ছবিতে অংশগ্রহণের ব্যাপারে। যুক্ত হতে চেয়েছিলেন প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী সাধনা বোসও, কিন্তু সমর্থন মেলেনি উদয়শঙ্করের। এমন সংরূপে ছবি ভারতে ইতিপূর্বে হয়নি। সেই অভিনবত্বকে সম্ভবত উদয় বজায় রাখতে চেয়েছিলেন বাকি ক্ষেত্রগুলিতেও। উষা কিরণ, ত্রাভাঙ্কোর রাজপরিবারের মেয়ে ললিতা, রাগিনী এমন পঁয়ত্রিশ জনকে বেছে নেওয়া হয় অভিনয়ের জন্য। নির্বাচন চলে মূলত মাদ্রাজ এবং মহারাষ্ট্র থেকেই। কামিনীর চরিত্রে অভিনয় করেন লক্ষ্মীকান্তা। মালাবার থেকে নিয়ে আসা হয় পঞ্চাশজন কথাকলি শিল্পীকে। ভারতীয় সিনেমায় বিষয়বৈভব ও দৃশ্যবৈভবে ‘কল্পনা’ জন্ম দিল গ্র্যাঞ্জার।
একবার ঝিন্দের রাজা এসেছিলেন আলমোড়ায়। তাঁর সম্মানার্থে প্রস্তুত করা হয় বিশেষ অনুষ্ঠান। রাজ-আগমনে অত্যন্ত যত্নে সুসজ্জিত করে তোলা হয় শৈল-প্রাঙ্গণ। সেদিন মহারাজের সম্মুখে নৃত্য পরিবেশন করবেন স্বয়ং গুরু শঙ্করণ নাম্বুদ্রি। তারপর উদয়শঙ্কর। অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে কী তিনি অনুভব করেছিলেন কে জানে, উদয় আর অমলাকে বললেন গুরু নাম্বুদ্রি, শিল্পযোগে শিল্পীর যবনিকাপতন, অতুলনীয় সে মৃত্যু। গুরু সেইদিন অনুষ্ঠানে পরিবেশন করলেন তাঁর বিখ্যাত শিল্পকর্ম ‘দুঃশাসন বধ’। ধন্য ধন্য রব উঠল চারধারে। গুরু এসে উপবেশন করলেন রাজ-সন্নিকটে। এবার উদয়ের ‘ইন্দ্র’ নৃত্য। আজীবন যাঁকে সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞ-মুগ্ধতায় বেঁধেছেন সেই গুরুকে প্রণাম করে মঞ্চে উঠলেন উদয়। শুরু করবেন নৃত্য, কীসের কোলাহলে তিনি উৎসুক-চিন্তায় দাঁড়ালেন ক্ষণিক। খবর এল অসুস্থ হয়ে পড়েছেন গুরু। মঞ্চ থেকে দৌড়ে এলেন উদয়। দেখলেন কারুতিলক কপালে এঁকে তাঁর গুরু, এক শিল্পঋত্বিক চলছেন মহাপ্রস্থানের পথে। আকস্মিক এই মৃত্যুর সন্তাপ গভীর আঘাত হেনেছিল তাঁর মনে। নিজের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘কল্পনা’কে উদয়শঙ্কর উৎসর্গ করলেন তাঁর গুরু শঙ্করণ নাম্বুদ্রিকে।
সিনেমায় সেন্টারের ছাত্র-ছাত্রীদেরও চেয়েছিলেন উদয়, যোগ দিয়েছিলেন কেউ কেউ। পরিস্থিতির কারণে চলচ্চিত্র নির্মাণের বিষয়টিকে অনেকেই গ্রহণ করেননি সহজভাবে। বিষ্ণুদাস শিরালী যোগ দিলেন সংগীত পরিচালক এবং সহকারী প্রযোজক হিসেবে। সংগীতে তাঁর সঙ্গে ছিলেন রবিশঙ্কর এবং আলি আকবর খান। অভিনয়, নৃত্যের সঙ্গে অমলা দায়িত্ব নিলেন কস্টিউমেরও। রইলেন আলমোড়ার মণিপুরি নৃত্যগুরু অমোবি সিং। ছিলেন সুমিত্রানন্দন পন্থ (১৯০০-১৯৭৭) হিন্দি সাহিত্যের বিশিষ্ট কবি। পেয়েছিলেন পদ্মভূষণ এবং জ্ঞানপীঠ পুরস্কার। সুমিত্রানন্দন উদয়ের বয়সি, যোগ দিয়েছিলেন আলমোড়ার সেন্টারে। বিশিষ্ট হিন্দি কথাসাহিত্যিক অমৃতলাল নাগর (১৯১৬-১৯৯০), কেলকার, ব্রজবিহারী বন্দ্যোপাধ্যায়, নগেন দে, দুলাল সেন, শিশিরশোভন ছিলেন এঁরাও। ছাত্রদের মধ্যে যোগ দেন অনিল চোপড়া, দেবীলাল সামার (জন্ম ১৯১২)। পরে রাজস্থানের উদয়পুরে দেবীলাল প্রতিষ্ঠা করেন ‘ভারতীয় লোক কলামণ্ডল’। সক্রিয় ছিলেন এর পরিচালনায়। সম্মানিত হন পদ্মশ্রী পুরস্কারে। পাপেট্রি এবং পাপেট উৎসবকে জনপ্রিয় করায় অদ্বিতীয় ছিল তাঁর ভূমিকা।
প্রথমে ঠিক হয়েছিল কলকাতার ইন্দ্রপুরীতে হবে ছবির শুটিং। পরে সিদ্ধান্ত বদলে কাজ শুরু হয় মাদ্রাজের জেমিনি স্টুডিওতে। ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৫ একবছর ধরে চলে শুধু রিহার্সাল। অনুশীলন চলত দেড়শো আর্টিস্ট নিয়ে। ছবিতে একটা দৃশ্য ছিল ঘাঘরা পরে মেয়েরা হাঁটছে প্রদীপের থালা হাতে। সমস্ত দৃশ্যকে নিখুঁত করার তাগিদে এরও প্রস্তুতি চলেছিল দীর্ঘসময় ধরে। সেসময় জেমিনি স্টুডিওতে চলছিল বিশাল প্রযোজনা ‘চন্দ্রলেখা’র কাজ। ‘চন্দ্রলেখা’র শ্যুট চলত দিনের বেলায়, রাতে হত ‘কল্পনা’র চিত্রগ্রহণের কাজ। ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৭ দুবছর ধরে চলেছিল শুটিং। অমলাশঙ্কর জানিয়েছিলেন, ‘প্রতিদিন বিকেল চারটেয় যেতে হত স্টুডিয়োতে, সন্ধে ছ’টা পর্যন্ত চলত মেক-আপ, তারপর শুটিং। সারারাত শুটিং হত, আর আমরা বাড়ি ফিরতাম ভোর চারটেতে।’
ছবিতে একটি দৃশ্য ছিল, যেখানে কলাকেন্দ্রে পুজো করছেন এক নৃত্যগুরু। পূজা শেষে শুরু হবে তাঁর নৃত্য। চরিত্রটি করেছিলেন স্বয়ং গুরু অমোবি সিং। সেদিন ঘটল এক কাণ্ড। দৃশ্যগ্রহণ শুরু হবে। কিন্তু গুরু তো পুজো করে চলেছেন রীতিমতো নিষ্ঠাভরে। দীর্ঘ সময় নিয়ে। ছবির জন্য যে তাঁকে পুজোর অভিনয় করতে হবে, বা মিথ্যে পুজো করতে হবে একথা তাঁকে বিশ্বাস করানোও কঠিন। তাঁর কাছে পুজো তো পুজোই। সে সত্যি হোক অথবা সিনেমা। এই পুজোর জন্য এমনকি তিনি উপবাসও করেছেন নিয়মমতে। সকলে ব্যস্ত হয়ে উঠল, এত লোকজন, প্রস্তুতি, অপেক্ষা। ধৈর্য রাখা দায় হল ফ্লোরে। কিন্তু কারোর কথা শুনলেন না উদয়শঙ্কর। কোনোমতেই বাধা দিতে দিলেন না গুরু অমোবি সিংকে। বললেন, ‘ওঁর কাছে তো আর এটা ফিল্ম নয়!’ জীবনের এইসব অনুপুঙ্খের প্রতি এতটা সংবেদনশীন ছিলেন বলেই না, অনাদৃত ছড়িয়ে থাকা কত দেশীয় আঞ্চলিক লোকশিল্পকে উদয়শঙ্কর গাঁথতে পেরেছিলেন অমন রাজকীয় ভঙ্গিমায়। দেশেরই মাটিতে দাঁড়িয়ে শিল্প ঐতিহ্যে মানুষের চেতনায় জন্ম দিয়েছিলেন তাদের স্ব-দেশকে।
উদয়-অমলার প্রথম সন্তান আনন্দশঙ্করের জন্ম হয়েছে ১১ ডিসেম্বর ১৯৪২। ফলে শুটিংয়ের সময় আনন্দ এক্কেবারেই ছোটো। মশারি টাঙিয়ে তার ঘুমের বন্দোবস্ত হত গাড়ির ভেতর। সেসময় হঠাৎ মারা গেলেন শঙ্করদের সুজন, মাতুলের স্ত্রী। মারা গেলেন সন্তান জন্মের চারঘন্টার মধ্যে। সেই ছোট্টো নানার তখন ভার নিলেন অমলা। গাড়িতে আনন্দশঙ্করের সঙ্গে থাকত সেই সদ্য মাতৃহারা সন্তানও। তাদের কাছে আয়া থাকত বটে, কিন্তু শিশুদের নাওয়া-খাওয়া-ঘুম পাড়ানোর দায়িত্ব অমলা রাখতেন নিজের হাতেই। শুটিং-এর ফাঁকে ফাঁকে এইভাবে চলত সন্তানপালন।
এই ছবিতে অমলার একটি নাচ অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। তিনাক-নাতিন-তিনা, তিনাক-নাতিন-তিনা। একবার ছবির কাজ করতে-করতে ক্লান্ত তাঁরা তিনদিনের ছুটি নিয়ে তিনজন উঠলেন মাদ্রাজেরই একটি হোটেলে। ঘরে তখন চলছে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া, হঠাৎ মাথায় এল আইডিয়াটা। উদয় আর অমলা মেতে উঠলেন সেই মুদ্রার নির্মাণে। একটা মুভমেন্ট উদয় করছেন তো আরেকটা অমলা। সেই ভঙ্গিতে আজও মজে আছে বাঙালি।
ছবির কাজ চলাকালীন দ্বিতীয়বার অন্তঃসত্ত্বা হলেন অমলা। সেন্টারের ঘনঘোর দুর্যোগ, ছবির কাজে চূড়ান্ত ব্যস্ততার মাঝে এল এই আনন্দ সংবাদ। সকলের মনে মনে এবার প্রতীক্ষা একটি কন্যাসন্তানের। উদয়, অমলা এমনকি ছোট্টো আনন্দরও। দায়িত্বশীল সব ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে রাখা হল অমলাকে। পরিণত গর্ভাবস্থায় তাঁর শারীরিক অবস্থার খেয়াল রাখতে সেটে সবসময় তাঁর সঙ্গে থাকতেন একজন চিকিৎসক। ‘কল্পনা’-র কাজ তখন প্রায় শেষের দিকে। সেসময় অমলার জন্য সাজানো হত ছোটো-ছোটো শট। লঙ শট বাদ দিয়ে মূলত মিড শটে চলত শ্যুট। অমলা ডান্সার বলে গোড়াতে ডাক্তাররা অস্ত্রোপচার এড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন স্বাভাবিক প্রসবের জন্য। অথচ সমস্তরকম সাবধানতা সত্ত্বেও ঘনিয়ে উঠল বিপদ। শরীরে দেখা দিল নানারকম জটিলতা। শেষপর্যন্ত অস্ত্রোপচারই হল। অতিরিক্ত পরিশ্রম না কি অনুন্নত অস্ত্রোপচার, অমলা জানিয়েছিলেন তাঁদের কাছেই অস্বচ্ছ ছিল বিষয়টি। জন্ম নিল কন্যাসন্তানই, কিন্তু রক্ষা পেল না তার প্রাণটা।
অমলা অ্যানেস্থেসিয়ায় আচ্ছন্ন রইলেন তিনদিন। আকস্মিক শোকের বিপদ এড়াতে এগারো দিন পর্যন্ত তাঁর সদ্যোজাত সন্তানের মৃত্যুসংবাদকে রাখা হল আড়ালে। যখন জানলেন জীবন দাঁড়াল স্তব্ধ-মূক। চলে যাওয়া সন্তানটিকে চোখে পর্যন্ত দেখেননি তিনি। পরে দেখলেন তাকে। একান্ত আদরের সেই থমকে-থাকা-প্রাণ, একরত্তি শরীরটাকে ছেড়ে দেওয়ার আগে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন শিশুর পিতা উদয়শঙ্কর। তারপর শোকের রাশ টেনে ওই মুহূর্তটুকুকে অন্তত নিজের কাছে রাখতে চেয়ে তুলেছিলেন একটা ছবি। সেই ছবি দেখে ডুকরে উঠেছিলেন অমলা। এক বছর পর্যন্ত কোনো বাচ্চাকে আদর করে তুলে নিতে পারেননি কোলে। তারপর কেটে গেল অনেকগুলো দিন। মাদ্রাজে সমুদ্রের ধারেই ছিল শ্মশান। কোনো কাজে ওই পথে যাওয়ার বেলা ধীর হয়ে আসত উদয়শঙ্করের গাড়ির গতি, বলতেন, Here lies a part of us। আরো পরে এড়িয়ে যেতেন ওই পথটুকুও।
Powered by Froala Editor