মানুষের জীবনে সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক যদি কিছু হয়, অবধারিত তা জীবনভঙ্গির বাঁক-বদল। সমকালে দাঁড়িয়ে কোনো ঘটনাক্রমকে যেভাবে দেখে মানুষ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা অনুষঙ্গ জুড়তে-জুড়তে কখনো সেই ঘটনার প্রতিই বদলে যায় তার দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ অভিমুখ। হয়তো বদলে যায় একেবারে উল্টো দিশান্তরে। খুব অস্বাভাবিক নয়, মানবজীবনে অত্যন্ত নৈমিত্তিক এ ঘটনা। দীর্ঘ সময় জুড়ে অভিজ্ঞতার রোদ-ছায়ায় দাঁড়িয়ে একই ঘটনাকে মানুষ দেখতে চায় বহুকৌণিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে। তারপর বিস্মিত হয়ে দেখে সত্য দাঁড়িয়ে আছে একেবারে ভিন অবয়বে, ভিন্ন বেশে। আধখানা করে ভাবলে তা অবশ্যই প্রতিস্পর্ধী, আধখানা করে ভাবলে তা সুনিশ্চিত স্ববিরোধীও। কিন্তু তার চেয়ে খাঁটি আর রিয়্যাল বুঝি আর কিছু নেই। তবে মজার কথা, এই নতুনতর দেখা আর পুরাতন দেখা একে অপরকে বিদ্রূপ করে না, নিমজ্জিত হয় না হাহাকারে। দুটোই ঠায় দাঁড়ায় মসৃণ সহাবস্থানে। স্থান-কাল-পাত্রের নিরিখে মান্যতা পায় অতীতের বিশ্বাস আর বর্তমানের বিশ্লেষণ--- সবটুকু।
সমস্ত জীবনীও নিশ্চয়ই খুঁজছে সত্যকেই। তবে সর্বক্ষেত্রেই সাত-সাগর-ছেঁচে আনা সত্য সে নয়। কখনো সত্যসন্ধানের অভিলাষ হাঁটে অন্যপথে। সমস্ত অভিরুচি, সমস্ত বিশ্বাস, সমস্ত ক্রোধকে সাধ্যমতো সমান গুরুত্বে যদি দাঁড় করানো যায় প্রতিমুখে, সেই অমীমাংসাও বোধকরি আরো বড়ো সত্য।
তিন দশক আগে অমলাশঙ্কর ফিরে দেখছিলেন নিজের জীবনকথা, তখন তা প্রকাশিত হচ্ছিল ‘সানন্দা’ পত্রিকায় ‘শঙ্করনামা’ নামে। হয়তো পুঙ্খানুপুঙ্খ ধারাবাহিক জীবনকথা নয়, তবু নানা ঘটনার উল্লেখযোগ্য স্মৃতিচারণ লিপিবদ্ধ হয়েছিল সেইখানে। মুদ্রিত হয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ সব চিঠিপত্র। ১৯৩৯-এ আলমোড়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টার। ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হতে শুরু করে ১৯৪০-এ। আর মাত্র চার বছরের মধ্যে ১৯৪৪-এ বন্ধ হয়ে গেল সুপরিকল্পিত, বহুগুণিজন সমৃদ্ধ কলাকেন্দ্র। আলমোড়ার সেন্টার নির্মাণ আর ভাঙন দুটি সময়েই অমলাশঙ্কর ছিলেন সেইখানেই, উদয়শঙ্করের সঙ্গে। নিজের নতুন দাম্পত্যের সরহদ্দে দাঁড়িয়ে দেখেওছিলেন সে সময়কে। তখন তিনি মাত্র পঁচিশ। সে ঘটনার আঁচ এমনকি তোলপাড় করেছিল তাঁর আনকোরা জীবনকেও। সময়কে তখন দেখেছিলেন উদয়শঙ্করের পাশে দাঁড়িয়ে। তারপর ছেচল্লিশ বছরে বয়ে গেছে সময়ের উপল-ব্যথিত স্রোত। দীর্ঘ পথ আর অভিজ্ঞতা পেরিয়ে, সেই অতীতকে, সেই সুনির্দিষ্ট ঘটনাকেই ফিরে দেখতে এবার দাঁড়ালেন এক নিরপেক্ষ জমিনে। দেখলেন দাঁড়িয়ে আছেন উদয়শঙ্করের বিপ্রতীপে। ভারি আশ্চর্যের সে বিষয়। সম্পর্ক, মানুষ, মানুষের অন্তর্গূঢ় ধাতুস্বভাব, সত্যের অনির্ণীত রঙের বিস্ফোরণে একই ঘটনা কত নতুন চেহারায় এসে দাঁড়ায় সামনে। সত্তর-উত্তীর্ণ বয়সে সেই ঘটনার পর্যবেক্ষণে ধরা দিল অন্য উদয়শঙ্কর। জীবন আর জীবনী দুটির কাছেই সৎ থাকতে চেয়েছিলেন অমলা। পাঠকের কাছে দাঁড়ালেন অকপট। মানবপ্রকৃতি বড়ো বিচিত্র। মানবপ্রকৃতির অনুধাবন সেও বড়ো বিচিত্রতর।
আরও পড়ুন
অসম্মানিত অমলা ছেড়ে দিতে চাইলেন নাচ
জোহরার চারিত্র্য সম্বন্ধে বরাবর সপ্রশংস ছিলেন অমলাশঙ্কর। শিক্ষিত, হাসিখুশি জোহরার প্রশাসনিক দক্ষতা, ক্লাসে শেখাবার কৌশল, ডান্স কম্পোজ করতে পারার গুণপনায় মুগ্ধ ছিলেন তিনি। এইসকল কথার সূত্রে অমলা এও জানিয়েছিলেন, তার নাচে লাবণ্যের অভাব ছিল ‘কিন্তু কোন মুভমেন্টটা ঠিক সেটা যদি কখনও জানার দরকার হত, তা হলে আমরা জোহরার কাছে যেতাম। সবই ছিল ওর নখদর্পণে, যেন রেকর্ড করা। তখন মনে হত যে মিস্টার শঙ্করের পর আলমোড়ার সেন্টারটা বোধহয় জোহরাই চালাতে পারবে।’ সেন্টার ভেঙে যাওয়ার শতসহস্র সমস্যা প্রসঙ্গে বিয়াত্রিচেকে লেখা উদয়শঙ্করের চিঠিতে উল্লিখিত হয়েছিল জোহরার কথাও। উল্লিখিত হয়েছিল তাঁর হাবভাব ‘দৃষ্টিকটু’ হয়ে ওঠার প্রসঙ্গ এবং তা নিয়ে ‘কেলেঙ্কারি’ হওয়ার বিষয়টিও।
আরও পড়ুন
উদয়শঙ্করের প্রশাসনিক ব্যর্থতার খবর পৌঁছল বিদেশে
যে অভিযোগ উদয়শঙ্কর করেছিলেন জোহরার প্রতি, অতি দীর্ঘ ব্যবধানে, তাতে অসম্মত হলেন অমলা। ব্যক্ত করলেন তাঁর অভিমত। জানালেন, সমস্যার সূচনা হয়, কামেশ্বর সেহগালের সঙ্গে জোহরার সম্পর্ক সূত্রে। কিন্তু যে নিয়মানুবর্তিতা বিষয়ে সওয়াল করলেন উদয়শঙ্কর, সর্বক্ষেত্রে দলপতি নিজেও আপনি-আচরি-ধর্ম রক্ষা করেননি সেইসব বিধি-নিষেধকে। যে অপরাধে তিনি দোষী সাব্যস্ত করলেন জোহরাকে, সে অপরাধে অপরাধী ছিলেন স্বয়ং তিনিও। বললেন, জোহরাকে ‘কতকটা ‘স্কেপগোট’ করা হয়েছিল, কারণ উনি নিজেও তো খানিকটা দোষী ছিলেন!’ জোহরার মতো ‘ভালো মেয়ের’ যে ‘কঠোর সমালোচনা’ হয়েছিল, তাতে ‘অত্যন্ত ব্যথা’ পেয়েছিলেন অমলা। স্বীকার করলেন ধীর ‘আমি তখন যথেষ্ট matured ছিলাম না, ভালোমন্দ বুঝলেও কখনও প্রতিবাদ করতাম না— চুপ করে থাকতাম।’
আরও পড়ুন
অমলার গায়ে হাত তুললেন সিমকি
সময়-সম্পর্ককে দেখার প্রস্তুতিতে অমলা এলেন দৃষ্টিভঙ্গির এক সুবিস্তৃত ভূমিতে। জানালেন, সেন্টার ভেঙে যাওয়ার অযুত কারণের একটি, উদয়ের ‘অহং’-ও। ‘উদার’ ছিলেন তিনি, ছিল ‘মানবিকতাবোধ’ও। কিন্তু ‘আমিই সব’, এ দুর্বলতাও তাঁর ছিল। চিরদিন ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’ ছিলেন, সেই বোধটা কাজ করত সেন্টারেও। বললেন, ‘এ ধরনের প্রতিষ্ঠান সফল করতে গেলে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। সেটাই উনি করতে পারেননি। সেন্টারের ছেলেমেয়েদের প্রতি ওঁর ভাবটা ছিল ‘আমি সব কিছু করতে পারি, আমার বেলায় সাত খুন মাপ, কিন্তু তোমরা কিছু করতে পারবে না।’’
আরও পড়ুন
বিয়ের আড়াই ঘন্টা আগেও উদয় চিঠি লিখলেন অমলাকে
একদিন আসক্তির বেড়িতে দেখেছিলেন অমলা, আজ নিরাসক্তির বেদিতে। কিন্তু জীবন বড়ো সহজ জিনিস নয়। কখনো তীব্র নিরাসক্ত হওয়ার ঘনঘোর বাসনাও তৈরি করে নিতে পারে অন্যতর আসক্তি। উদয়শঙ্করের প্রৌঢ়ত্বের স্ববিরোধ দিয়ে তাঁর পরিণত যৌবনকে বিচার, সেও তাঁর প্রতি সুবিচার নয়। ততটা কঠোরতা হয়তো প্রাপ্য নাও হতে পারে উদয়শঙ্কররের। সেই ভাবনা নিশ্চয়ই কাজ করেছিল অমলার অন্দরে। তিনি নিলেন এক নতুন পদক্ষেপ। সেন্টার, ছাত্রদের অসন্তোষ, উদয়শঙ্করের ভূমিকা সমস্তটা যাচাই করতে চাইলেন পুনরায়, তবে নিজেকে সরিয়ে রেখে। অন্য প্রেক্ষিত থেকে সত্যের চেহারাটি পরখ করতে চেয়ে এবার তিনি দাঁড়ালেন দর্শকের ভূমিকায়। নিজের জীবনী-তে এই অস্বচ্ছতাকে দূর করতে ১৫ জুন, ১৯৯০, অমলাশঙ্কর চিঠি লিখলেন তাঁর খুড়তুতো দেওর শচীনশঙ্করকে। জানতে চাইলেন সেন্টার বন্ধের প্রকৃত কারণ। শচীনশঙ্কর তাঁর আত্মীয় বটে, তবে তিনি ছিলেন সেন্টারের ছাত্রও। পরে নৃত্যপরিচালক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও।
১৯৪৪ সাল নাগাদ একটি ট্যুরের আগে আলমোড়ার অশান্তি পৌঁছয় চূড়ান্ত পর্বে। তখন ট্যুরের ঠিক আগে প্রস্তুতি চলছে শ্যাডো প্লে ‘রামলীলা’র। হঠাৎই স্ট্রাইক করেন অধিকাংশ ছাত্র এবং দলের কয়েকজন বিশিষ্ট সদস্যও। আমেদাবাদের মিল শ্রমিকদের কল্যাণার্থে ১ ফেব্রুয়ারির সেই অনুষ্ঠানে দ্রুত বাতিল করা হয় শ্যাডো প্লে-র সমস্ত পরিকল্পনা। দল ছাড়া অসম্ভব ছিল সে পরিবেশনা। পরিস্থিতি সামলাতে ‘তড়িঘড়ি’ ব্যবস্থা করতে হয় ‘পাঁচমেশালি বিনোদনের’। ‘শঙ্করনামা’-য় উল্লিখিত রয়েছে, ‘তাৎক্ষণিক মুখরক্ষা হলেও এই স্ট্রাইকের দরুণ উদয়শঙ্করকে যে বিব্রত অবস্থায় পড়তে হয়েছিল তা তাঁর পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি। আলমোড়ার সেন্টার বন্ধ করে দেওয়ার উপলক্ষ হয়ে দাঁড়াল এই স্ট্রাইক।’ তার সঙ্গে ছিল বহুতর ‘গুজব’, ‘স্ক্যান্ডাল’ যার হদিশ দিতে পারেননি, স্বয়ং অমলাশঙ্করও। সেই সুবাদেই চিঠি পৌঁছল শচীনশঙ্করের কাছে।
শচীনশঙ্করের চিঠি এসে পৌঁছল ২০ জুলাই, ১৯৯০। উদয়শঙ্করের জীবন প্রসঙ্গে এ চিঠির তাৎপর্য বহুগুণিত। তীক্ষ্ণ, কঠিন অথচ সংযত এক অভিব্যক্তি প্রকাশ পেল শচীনশঙ্করের চিঠিতে। লিখলেন, নিজের প্রতিভাকে, নিজের নৃত্যকলাকে অমরত্ব দানের ইচ্ছায় খুব ‘পরিকল্পিত’ভাবেই মঞ্চশিল্পের বদলে উদয়শঙ্কর সরে আসতে চাইছিলেন চলচ্চিত্রশিল্পে। ভারতীয় নৃত্য, শিল্প আর তাঁর সুস্বাস্থ্যের তুঙ্গ মুহূর্তটির গুরুত্ব বিবেচনা করেই, সেন্টার বন্ধের ‘অজুহাত’ হিসেবে খাড়া করা হয়েছিল ছাত্রদের স্ট্রাইকটিকে। শুধু উদয়শঙ্করকেই নয়, অমলাকে লেখা চিঠিতে, ঋজু বক্তব্যে শচীন কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন এমনকি অমলাকেও। জানালেন, এই সমস্যাসঙ্কুল পরিস্থিতিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ হতে পারত অমলাশঙ্করের ভূমিকা, দুভার্গ্যজনকভাবে তা হয়নি। জীবনের নানা সময়ে যাঁরা সাহায্য করেছেন উদয়কে অথচ দলচ্যুত হয়েছেন তাঁদের সংঘবদ্ধ করার সামান্য প্রচেষ্টাটুকুও গ্রহণ করেননি তিনি।
শচীনশঙ্করের মূল বক্তব্যটি আমরা জানালাম বটে, তবে এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি তাঁর চিঠির বয়ানে তাঁর ‘কণ্ঠস্বর’টিকে ‘শোনা’। চিঠিতে শচীন বললেন, ‘কালচার সেন্টার কখনই সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়নি। ওটা ছিল একটা সাময়িক পর্যায়; এক ধাপ থেকে আরেক ধাপ (যাবার বিরতি)— মঞ্চশিল্প থেকে চলচ্চিত্রশিল্প, যেটা আমরা সে সময়ে বুঝতে পারিনি। দাদা ছিলেন দূরদর্শী মানুষ। ওঁর দেহ এবং প্রতিভার ঐশ্বরিক গুণ উনি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন। এবং তার সাক্ষ্য রেখে যেতে চেয়েছিলেন ভবিষ্যতের জন্য। উনি বুঝতে পেরেছিলেন যে যদি উনি চিরকাল মঞ্চে আবদ্ধ থাকেন তা হলে ওঁর অসাধারণ নৃত্য পরিকল্পনার কোনও রেকর্ডই আর থাকবে না।’ ‘‘কল্পনা’-তে উদয়শঙ্কর চিরকালের জন্য মুদ্রিত হয়ে আছেন।’
শচীন এবার কথা বললেন তাঁর বৌদি অমলাশঙ্করের ভূমিকা বিষয়ে। ‘কিছু লোকের ধারণা যে গ্রুপ এবং সেন্টারের ভিত্তি দুর্বল করে দেওয়ার পেছনে আপনার একটা বিরাট ভূমিকা আছে।’ ‘যাঁরা দাদাকে সাহায্য করেছিলেন— সিমকি, জোহরা, শান্তি বর্দ্ধন, রাজেন্দ্রশঙ্কর, লক্ষ্মী এবং অন্যান্যরা সকলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। আপনি, তাঁদের সঙ্ঘবদ্ধ করার পরিবর্তে, স্ত্রী হিসেবে সবাইকে দলচ্যুত করেন। এটাই সবথেকে দুঃখদায়ক। এরপর দাদা আর আপনি সুবিধাবাদী এবং অতি সাধারণ শিল্পী এবং কর্মীদের খপ্পরে পড়ে যান, যারা কখনই দাদাকে (সেন্টার) গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারতেন না। এখানে আপনাদের ব্যক্তিগত জীবন অনেকটা বাধা হয়ে দাঁড়ায় (সকলে তো তাই বলে)…’। ‘(আমার মতে আপনাদের) সেন্টার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার কোনও ইচ্ছাই ছিল না। ছাত্রদের স্ট্রাইক একটা অজুহাত মাত্র। ‘কল্পনা’-র পরে অর্থ এবং অন্য ধরনের শিল্পের প্রতি আকর্ষণ হওয়ার জন্য দাদার সেন্টারের প্রতি আসক্তি কমে যায় (যেখানে সংগ্রাম ছিল অনেক বেশি), তাছাড়া দাদার বয়সও হয়ে যাচ্ছিল আর ছিল সাংসারিক ঝামেলা।’
তিনি না চাইলে এ ব্যক্তিগত চিঠি কখনোই নজরগোচর হত না জগৎমাঝে। তাঁর বিরুদ্ধে তীব্র, শাণিত সব অভিযোগ চাইলেই অবলীলায় গোপন করতেই পারতেন তিনি। কিন্তু তেমনটি করেননি অমলাশঙ্কর। এ লেখাকে তিনি দিলেন প্রকাশের অনুমতি। জীবনীর বিশ্বাসযোগ্যতাকে রক্ষা করতে চেয়ে এমন যন্ত্রণাবিদ্ধ, তবু দাঁড়ালেন প্রকাশ্যে। উদয় আর অমলার বিরুদ্ধে শচীনশঙ্করের সেই ক্ষুরধার অভিযোগ সম্বলিত হয়ে প্রকাশ পেল অমলার জীবন-কথা। মধ্য নব্বুই-তে যখন অমলাশঙ্কর, তখন সুযোগ হয়েছে কাছ থেকে তাঁকে শোনবার, দেখবার। উদার প্রসন্নতা ছিল তাঁর যাপনের ভঙ্গি। মধ্য নব্বুই তখন তবু বার্ধক্য শব্দটা মনে হয়নি কখনও জেনেছে তাঁর শরীর-সাজ, বোধ বা বিচরণ। জীবনের চড়াই অথবা ঢালুপথে ধীরে নেমে আসায় কী শান্ত, বৌদ্ধিক বোঝাপড়া, কী পরম অভিজাত। ওঁর জীবনের পেছনে ছুটতে-ছুটতে মনে হত, যেন এসে পড়েছি এক সময়ের রাজপ্রাসাদে। জীবনটা বড়ো, জীবনকে গ্রহণ করার পদ্ধতিটা আরো বড়ো।
জীবনীর খোঁজে নেমে সত্য-মিথ্যার নিক্তি মেপে পথ চললে হাতে থাকবে শূন্য। জরুরি নয়, কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যে। জরুরি নয়, কোনটা ঠিক কোনটা ঈষৎ বেঠিক। জরুরি এইটা, একটা ঘটনা কীভাবে বহু স্তরে আর বহু ব্যবধানে পৌঁছে তৈরি করে নিচ্ছে বিচিত্র স্বর আর বিচিত্র মাত্রা।
Powered by Froala Editor