দেহ পট সনে নট সকলি হারায়

শঙ্কর সরণি - ৩৯
আগের পর্বে

উদয়শঙ্করের দলের সঙ্গে বিদেশে রওয়ানা হলেন আলাউদ্দিন খাঁ। প্রথম প্রথম তাঁকে কেবল একক যন্ত্রসঙ্গীতের দায়িত্ব দেওয়া হত। কিন্তু এতে তৃপ্ত হচ্ছিলেন না আলাউদ্দিন। একদিন নিজেই বসে পড়লেন নাচের সঙ্গে মহরায়। সেইসঙ্গে ভিন্ন দেশের ভিন্ন রুচিকেও ধরতে চেয়েছিলেন তিনি। এমনকি ইউরোপ আমেরিকার শ্রোতারা তৃপ্তও করেছিল তাঁকে। এসবের মধ্যেই একটু একটু করে শেখাতেন রবিশঙ্করকে। কিন্তু রবিশঙ্কর চেয়েছিলেন সঙ্গীতের দীক্ষা। ১৯৩৬ সালে দেশে ফিরলেন আলাউদ্দিন। রবিশঙ্কর দলের সঙ্গে ফিরলেন আরও ২ বছর পর। দেশে ফিরে হল উপনয়নের অনুষ্ঠান। উপনয়নের পর গুরুগৃহে রওয়ানা হলেন রবিশঙ্কর। দীর্ঘ ২ মাস একা থাকার পর বিলাস চিহ্নহীন রবিশঙ্কর দাঁড়ালেন আলাউদ্দিনের চৌকাঠে। কঠোর অনুশীলনে বিদ্যালাভ করতে চান তিনি।

১৯৩৬-এ নতুন দল আর ওস্তাদ আলাউদ্দিনকে নিয়ে ইউরোপ ট্যুরের সময় উদয়শঙ্কর আতিথেয়তা গ্রহণ করলেন ডার্টিংটন হল-এ। এই আতিথেয়তাই হয়ে রইল ভারতীয় সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য ধারক নির্মাণের ভিত্তি। ইংল্যান্ডের ডেভেনশায়ারে প্রায় বারো হাজার একর জমির ওপর মধ্যযুগ থেকে অবস্থিত ছিল ডার্টিংটন হল। এই জমি ছিল এক সামন্ততান্ত্রিক প্রভুর। ক্রমশ সে সম্পত্তি হাত বদলের ইতিহাস পেরিয়ে পরিণত হয় ধ্বংসাবশেষে। ১৯২৫-এ লেনার্ড এলমহার্স্ট ও তাঁর অগাধ প্রতিপত্তির অধিকারী স্ত্রী ডরোথির হাতেই সংঘটিত হল এর উদ্ধারপর্ব। পুনরুদ্ধার এবং অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে এর সংরক্ষণের বিষয়টিতে উদ্যোগী হলেন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দীর্ঘ সংশ্রবে শান্তিনিকেতনে ছিলেন এলমহার্স্ট, কাছ থেকে দেখেছিলেন তাঁর আদর্শ ও চিন্তাচেতনাকে। সেসব ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার ব্যাপারে অদ্বিতীয় ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি নিজেও। রবীন্দ্রনাথের পল্লীপুনর্গঠন, গ্রামোন্নয়ন এবং শিক্ষা-সংস্কৃতি চর্চাক্ষেত্রের আবাসস্বরূপ আশ্রম পরিকল্পনার ধারায় অনুপ্রাণিত হয়েই এলমহার্স্ট গড়ে তুললেন ডার্টিংটন হল-কে। কৃষি, বনপালন এবং বিভিন্ন শিল্পকলা চর্চা ও নিরীক্ষার এক অভূতপূর্ব উদাহরণ হয়ে রইল ডার্টিংটন হল। রবীন্দ্রচিন্তার এ এক অতুলনীয় আন্তর্জাতিক সম্প্রসারণ।

ডার্টিংটন হল বিশ্বাসী ছিল প্রগতিশীল মুক্ত শিক্ষাকেন্দ্রের ধারণায়। no punishment, no prefects, no uniforms, no segregation of sex, no compulsory games, no compulsory religion। সুন্দর ও সামঞ্জস্যময় জীবনচর্যার সঙ্গে শিল্প-পরিবেশ ও সামাজিক ন্যায়বোধের সামঞ্জস্যস্থাপন এই ছিল ডার্টিংটনের লক্ষ্য। এর সাংস্কৃতিক দিকটির দায়িত্ব বহন করতেন ডরোথির কন্যা বিয়াত্রিচে স্ট্রেইট। তবে এর  উত্থানের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন প্রখ্যাত জার্মান নৃত্যশিল্পী কুর্ট য়ুস আর সিন্ডর্ড লিডার। প্রথিতযশা আরো এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন এর পুরোভাগে। নাট্যকার আন্তন চেকভের ভাইপো মাইকেল চেকভ। তিনি সেখানে তৈরি করেন ‘দ্য চেকভ স্টুডিও’। মাইকেল ছিলেন মস্কো আর্ট থিয়েটারে মস্ত অভিনেতা। কাজ করার অভিজ্ঞতা হয় স্তানিস্লাভস্কির সঙ্গে। পরে স্তালিনের প্রতাপে রাশিয়া ছেড়ে চলে আসেন পশ্চিমে। তারপর বিয়াত্রিচের উদ্যোগে মাইকেল কিছুকাল যুক্ত ছিলেন এই কেন্দ্রে।

ডার্টিংটন হল-এ ডরোথি ও লেনার্ড এলমহার্স্ট।

 

উদয়শঙ্কর প্রথম বিদেশ যান ১৯২০-তে। লন্ডনের ওয়েমব্লে স্টেডিয়মে সেই সময় তিনি প্রথম পরিবেশন করেন তাঁর নৃত্যানুষ্ঠান। তারপর কেটে গেছে ষোলোটা বছর। কখনও একা, কখনও দল নিয়ে পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তে ঘুরে বেরিয়েছেন তিনি। বিরামহীন এই দীর্ঘ শিল্পভ্রমণের পর সম্ভবত নিজেকে নতুন করে দেখতে চাইলেন তিনি। ১৯৩৬ এ উদয়শঙ্কর নিশ্চয়ই অনুভব করছিলেন, সমস্ত পৃথিবী জুড়ে তাঁর এই দুর্বার খ্যাতি অথচ তাঁর নৃত্য এখনও সীমাবদ্ধ তাঁর দলের গুটিকয় মানুষের মধ্যেই। এখনও তৈরি হয়নি তাঁর ধারা। পরম্পরা। ‘দেহ পট সনে নট সকলি হারায়’ গিরিশচন্দ্র ঘোষের এই অমোঘ পঙক্তি কাল থেকে কালাতীত হয়ে আলোড়িত করেছে সমস্ত আর্টিস্টের  অন্তরমহলকে। পারফর্মিং আর্ট বা পরিবেশন নির্ভর শিল্পে স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীর বয়স, শরীরের ওপর তাঁর দখল। শরীরের পটে চিত্রিত যে মূর্তি, পট ভিন্ন অস্তিত্বহীন সেই শিল্পবাসনা। উদয়শঙ্কর তখন ছত্রিশ। সুদর্শন, সৌম্য, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। যৌবনের মধ্যগগনে অবস্থিত। শিল্প আর শিল্পী উভয়েরই অবস্থান পূর্ণলগ্নে। সময়ের মূল্যটিকে তিনি অনুভব করেছিলেন অব্যর্থভাবে। অনাগতের কাছে নিজের কারুবোধকে অবিনশ্বর করে রাখতে চাওয়া, এ তো শিল্পীমাত্রেরই আকাঙ্ক্ষা। লক্ষ করব, ঠিক এই বিন্দু থেকেই উদয়শঙ্কর সমান্তরালভাবে মনোনিবেশ করলেন দুটি বিষয়ে। ‘উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা এবং ‘কল্পনা’ চলচ্চিত্র নির্মাণের ভাবনাচিন্তা। ‘কল্পনা’য় তিনি ধরে রাখতে চেয়েছিলেন নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্করকে। নৃত্য আর পরিবর্তিত সমাজকে  নিয়ে তাঁর যদযাবতীয় বিশ্বাসকে। আর কালচারাল সেন্টারে সেই ভাবনাকেই দেখতে চেয়েছিলেন মূর্ত করে।

আরও পড়ুন
রঙ আর রাঙতার সাজ খসে বেরিয়ে এল এক ছাঁচ-ভাঙা মূর্তি

এইসূত্রে আরো একটি বিষয় ভেবে দেখবার। তা হল, উদয়শঙ্করের ‘উদয়শঙ্কর’ হয়ে ওঠার পশ্চাতে সুনিশ্চিতভাবে রয়েছে তাঁর প্রতিভা, পরিশ্রম, ধৈর্য, একাগ্রতা। কিন্তু তার সঙ্গেই যুক্ত হয়ে আছে যথাযথ সময়ে যোগ্য মানুষের সংযোগ। বিভিন্ন ক্ষেত্রের অসম্ভব সব গুণীজনের সংস্পর্শে তিনি এসেছেন সারাজীবন। নানান ক্ষেত্রের অধিগত বিদ্যা পরম্পরাকে কাছ থেকে জানার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। ফলত শিল্পকলার সমন্বয় এবং শিল্পীর সমন্বয়ের বিষয়গুলি আদ্যন্ত গুরুত্ব পেয়েছিল তাঁর ভাবনায়। 

আরও পড়ুন
শঙ্করদের জীবনে এসে দাঁড়াল প্রবল শোক

ডার্টিংটন হল-এ উদয়শঙ্কর।

 

আরও পড়ুন
গাড়িতে উঠে চমকে গেলেন, ভেতরে বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ

আলমোড়ায়   শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান  বিষয়ে রবিশঙ্কর বলেছিলেন একটা গল্প। একথাও বলেছিলেন, সেই গল্পটিকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন উদয়শঙ্কর। গল্পটা খানিকটা এইরকম। একবার এক রাজা, এক সাধুকে বললেন আমাকে মূর্তি গড়তে শিখিয়ে দিন। সাধু বললেন, সে কী, ভাস্কর্যের জন্য তো অঙ্কনবিদ্যার জ্ঞান প্রয়োজন। রাজা বললেন, বেশ, তবে তাই শেখান। সাধু বললেন, তার আগে প্রয়োজন নৃত্যশিক্ষার। প্রকৃতির মধ্যে যত আকৃতি আর গতি সেই ছন্দকে, সেই পরিমিতিকে তো ধারণ করে আছে নৃত্যই। রাজা বললেন, তাহলে নৃত্য দিয়েই শুরু হোক শিক্ষা। সাধু ফের বলেন, কিন্তু নৃত্যের জন্য তাল-লয়-সুরের ধারণা থাকা দরকার, দরকার বাদ্যযন্ত্রের চর্চা। রাজা তাতেও সম্মতি প্রকাশ করলেন। তখন সাধু বললেন, বাদ্যযন্ত্র কণ্ঠসংগীতের সম্যক জ্ঞান ব্যতীত অসম্ভব। আর সাংগীতিক শিক্ষার জন্যও সাহিত্য, গণিত এবং অন্যান্য শিল্পের বোধ থাকাও অত্যন্ত জরুরি। রাজা কিছুক্ষণ বিরত রইলেন। তারপর বুঝতে পারলেন সাধুর কথার অন্তর্নিহিত অর্থ। কোনো শিল্পই আসলে বিচ্ছিন্ন নয়। প্রতিটি শিল্প আত্যন্তিক লগ্ন হয়ে রয়েছে আরো একটি বিদ্যা বা ধারণার সঙ্গে। শিল্পের সেই সংহতি আর ঐকতান, সেই পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়েই সাধু সচেতন করে তুলতে চাইছিলেন রাজাকে।

আরও পড়ুন
আলাউদ্দিন: যে-পথ দিয়ে যাবেন রাজা, সে-পথেই বাজবে সুর

প্রথমে ঠিক হয়েছিল কাশীতেই নির্মিত হবে এই প্রতিষ্ঠান, পরে ব্যবস্থা হল উত্তরপ্রদেশের কুমায়ুন অঞ্চলে আলমোড়ার পাহাড়ে হবে ‘উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টার’। আবাসিক হবে এই শিক্ষাকেন্দ্র, ফলে ভাবনা চিন্তা চলল বিস্তর। এলমহার্স্ট নিজে এসে দেখে গেলেন আলমোড়া। কুড়ি হাজার পাউন্ড দিলেন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজে। এই অর্থমূল্য ভিন্ন নিশ্চয়ই অসম্ভব ছিল আলমোড়া গঠনের ইচ্ছা। কিন্তু উদয়শঙ্করের এই বৃহত্তর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে তোলার ব্যাপারে এলমহার্স্টের উদ্যোগ, ভরসা আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসাটি ছিল একেবারে অমূল্য। বাবা আলাউদ্দিন জানিয়েছিলেন, উদয়শঙ্করের নাচে অর্থ সঞ্চয় হত বটে, তবে দলের খরচে হাতে থাকত না কিছুই। তিনিই জানিয়েছিলেন, সবার আগে তিনি যখন ফেরেন দেশে, তখন বিয়াত্রিচে আলমোড়ার জন্য তাঁর সঙ্গে পাঠালেন কয়েক লক্ষ টাকা, রেকর্ড, বাজনা, সাজ-পোষাক আরো কত কী।

বিয়াত্রিচে স্ট্রেইট।

 

জীবন একরৈখিক নয়, বিচিত্র তার গড়ন, চলন। প্রতিটি অস্তিত্বে সে নিতুই নব। আকারা জীবনকেই যদি দেখতে চাই, তবে পরিহার করতে হয় অভ্যাসের সংকীর্ণ দেখাকে। পরিমার্জনের বালাই দিয়ে খণ্ডিত না করে, জীবনকে যদি মিলিয়ে দেখি সমগ্রের সঙ্গে, তবে সুনিশ্চিত দেখতে পাব তার মীমাংসাকে তার নিজস্ব দ্যুতিকেও। উদয়শঙ্করের জীবনে এলেন বহু নারী। একথা অবশ্য স্বীকার্য প্রথারহিত সে সম্বন্ধ, একথাও অবশ্য স্বীকার্য ত্যাগ, কর্তব্য, নিখাদ প্রেমের সাপেক্ষে অসামান্য-তুলনারহিতও সে সম্বন্ধ। জীবনের বয়ে চলায় স্বাভাবিক ত্রুটি-বিচ্যুতি নিশ্চয়ই ঘটেছে সমস্ত তরফে কিন্তু তাতেও অমলিন হয়ে থাকে তাঁদের সম্বন্ধের উদার, বিশালকায় চালচিত্রটি। নিজের ঘর-বাড়ি-দেশ সমস্ত কিছু পেছনে ফেলে সিমকি মূর্ত করে তুলতেন উদয়শঙ্করের কারুকল্পনাকে, উদয়কে ভালোবেসে তাঁর চিন্তাকে আকৃতি দেওয়ার বাসনা, সেইখানেই তাঁর নিত্য-বসবাস। উদয়সংলগ্ন যেকোনো ভূমিকেই, তিনি করে তুলেছিলেন তাঁর ‘স্বদেশ’। অগাধ প্রতিপত্তিশালী অ্যালিস বোনার, বিপুল পৃথিবীতে সুবৃহৎ তাঁর কর্মকাণ্ড। রঙ-রেখা-আকারের খোঁজে ঘুরে বেড়াত জগৎবিখ্যাত এই ভাস্করের অভিনিবেশ। কঠিন পাথরের গায়ে রূপ ফোটাতেন, ভাবলোকে থাকা উদয়ের দল গড়ার স্বপ্নটিকে তিনিই করে তোলেন মূর্ত। মূর্তিকার তিনি, শুধু জগদ্দল পাথরে রূপ আঁকেননি, উদয়ের ভাবলোকে থাকা অসম্ভব সব ইচ্ছাকেও দিয়েছেন বাস্তব চেহারা। ভালোবেসে দক্ষ ভাস্করের সীমানাকে করেছেন বিস্তৃততর।

গুণী, উদ্যমী, সুন্দর ও প্রবল ব্যক্তিত্বময় উদয়শঙ্করকে ভালোবাসলেন বিয়াত্রিচেও। অত্যন্ত ধনাঢ্য পরিবেশের বিলাস আর বৈভবে লালিত হয়েছিলেন বিয়াত্রিচে। অপার স্নিগ্ধতায় চোখ-জুড়ানো ছিল তাঁর রূপ-ঐশ্বর্য। গুণী ছিলেন, ছিলেন শিল্পোৎসাহী। ছবি আঁকার হাত ছিল নিপুণ। অভিনয়ে মুগ্ধ করেছিলেন সাধারণ দর্শক থেকে তাবৎ বোদ্ধাদেরও। তবুও বিয়াত্রিচে ছিলেন নম্র, আন্তরিক, সৎ এবং পরিশ্রমী। এই বিয়াত্রিচেকে ভালো না বাসে সে সাধ্য কার?

উদয়শঙ্কর ও বিয়াত্রিচে।

 

বিয়াত্রিচেকে ভালোবাসলেন উদয়শঙ্করও। কিন্তু শ্যামশঙ্কর আর হেমাঙ্গিনীর রিক্ত নিঃস্ব দাম্পত্যের আবর্তে বড়ো হয়েছিলেন তিনি, দীর্ঘ যৌথজীবনে দুটি মানুষের সহৃদয় সহযাত্রী হওয়ার শর্তগুলি সম্পর্কে দ্বিধাদীর্ণ ছিল তাঁর মন। বিবাহের প্রাতিষ্ঠানিকতা বিষয়ে তখনও বিন্দুবৎ নিঃসংশয় হতে পারেনি তাঁর চিন্তাচেতনা। অথচ বিদেশের মাটিতে শৃঙ্খলাহীন বাতাবরণে অঢেল ধন-সম্পত্তির মধ্যে বড় হয়েও, বিয়াত্রিচে তাঁর প্রেমকে দেখতে চাইলেন  বিবাহের চৌহদ্দিতেই। একবার চিঠিতে জানিয়েছিলেন জোহরাকে, প্রবৃত্তিনির্ভর যে-প্রেম তাকে আশ্রয় অসম্ভব তাঁর পক্ষে। প্রেমকে তিনি দেখতে চান, একটা নিবিড় গার্হস্থ্যের মধ্যে, সন্তানধারণের পূর্ণতায়। যখন উদয়কে জানালেন বিবাহের কথা, তিনি সাধ্যমতো নিরস্ত করলেন তাঁকে। দুটি ভিন্ন সমাজ দুই ভিন্ন জীবন, এ নিয়ে তো খেলা চলে না, এই বন্ধনে সুখী হওয়া অসম্ভব বিয়াত্রিচের পক্ষে। জানালেন উদয়। তবুও অপেক্ষা করেছিলেন বিয়াত্রিচে। উদয়শঙ্করের সন্তানধারণ করে একটি পূর্ণ সংসার পেতে চান তিনি, এই অনুনয়ে সুদূর বিদেশ থেকে পাঠিয়েছিলেন চিঠি। নিরুত্তর রইলেন উদয়শঙ্কর।   

হয়তো আরো অপেক্ষা করতেন বিয়াত্রিচে। কিন্তু ভারতে আসা সম্ভব হল না তার পক্ষে, ঘনিয়ে উঠল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দুটি মানুষের জীবনেই এল নতুন মানুষ।

বৈভব শুধু বিয়াত্রিচের রূপে আর জীবনে ছিল তাই-ই নয়, বৈভব ছিল তার স্বভাবজুড়েও। উদয়ের দিক থেকে আশাহত হয়েও বিয়াত্রিচে জোহরাকে জানালেন চিঠিতে, উদয়কে তিনি ভালোবাসবেন চিরকাল, হয়তো এটাই হবে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ভালোবাসা। সম্পর্ক শেষ হল কিন্তু উদয়-অমলা বিবাহের পরেও এমনকি অপরিবর্তিত রইল সম্বন্ধের মাধুর্য।  আলমোড়া সম্পর্কে তাঁর নির্ধারিত কর্তব্যগুলিকে বিয়াত্রিচে তখনও পালন করলেন যথাবিধ।

Powered by Froala Editor