শঙ্কর সরণি - ৩৬
আগের পর্বে
একদিন কলকাতার ভবানীপুরে একটি সঙ্গীত সম্মেলনে আহ্বান পেলেন আলাউদ্দিন। শৌখিন শিল্পীদের মধ্যে বেমানান তাঁর গ্রাম্য পোশাক। তবু সুরের মূর্ছনায় অবাক করলেন সকলকে। ওস্তাদ লছমীপ্রসাদ তাঁকে শিক্ষকতার কথা বললে রাজি হলেন না আলাউদ্দিন। গুরুর আদেশ মেনে তাঁকে দেশভ্রমণ করতে হবে। শেষে শ্যামলাল ক্ষেত্রীর উদ্যোগে গেলেন মাইহার। সেখানে রাজা তাঁকে গুরু বলে মেনে নিলেন। কিন্তু রাজার গলায় সুর নেই। আলাউদ্দিন তাঁকে প্রথম সংযমের শিক্ষা দিলেন। ধীরে ধীরে সুর ফিরল রাজার গলায়। এদিকে রাজা ব্রীজনাথ সিং চান রাজ্যের ছেলেপুলেরা গান শিখুক। আলাউদ্দিনের আবাসেই শুরু হল শিক্ষা। গড়ে উঠল মাইহার ব্যান্ড। রাজা চান, তাঁর রাজ্যের সমস্ত পথ দিয়েই যেন সুর শুনতে পাওয়া যায়।
উদয়শঙ্করের দল থেকে হেমাঙ্গিনীর সঙ্গে দেশে ফিরে এসেছিলেন অমলা। বহু দেশ বহু মানুষ, নৃত্যগীত, অনুষ্ঠান, আয়োজন সমস্ত উত্তেজনার বিপরীতে ফিরে এলেন এক শান্ত সময়ের কাছে। নিজের দেশে। এই সময় অমলার বাবা অক্ষয়কুমার নন্দী তাঁকে ভর্তি করে দিলেন স্কুলে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে। অক্ষয় চাইলেন, শিক্ষার মধ্যে থিতু হোক অমলার মন। তা বলে নৃত্যের প্রতি তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহকে আগল দিয়ে রাখলেন না তিনি। রুচিশীল নানান উৎসব-অনুষ্ঠানে নৃত্যচর্চা অব্যাহত রইল অমলার। বয়সে অর্বাচীন হলেও, অমলার নৃত্য যাঁরা দেখলেন, তাঁরা খেয়াল করলেন, অমলার তালিম অথবা নৃত্য ঠিক সাধারণ বা গতানুগতিক নয়। তাঁর নৃত্যভঙ্গিমায় রয়েছে এক স্বাতন্ত্র্য। শরীরের ওপর তাঁর দখল, মুদ্রার তীক্ষ্ণতা, লয়ের রেশ ধরে অভিনয়, ভারি একটা অনন্যতা তৈরি করে দেয় তাঁর পরিবেশনে। খবর গেল খোদ মানুষের কাছে। প্রশান্তচন্দ্র মহালনবিশ ছিলেন অক্ষয় নন্দীর বন্ধুস্থানীয়। তিনি আগে দেখেছেন অমলার নাচ। একদিন ফোন এল প্রশান্তচন্দ্রের, অক্ষয়ের কাছে। জানালেন, তাঁদের বরাহনগরের ‘আম্রপালী’ বাড়িতে আসছেন রবীন্দ্রনাথ। সেদিন সারাদিন অমলাকে তিনি এনে রাখতে চান তাঁর কাছে। অক্ষয় নন্দী অত্যন্ত সম্মানিত আর আনন্দবোধ করলেন।
রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ প্রশান্তচন্দ্র মহালনবিশ প্রখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ। তবে পদার্থবিদ্যা, নৃতত্ত্ব এবং আবহাওয়াতত্ত্বেও তাঁর অধিকার ছিল সুবিদিত। সাহিত্য, সংস্কৃতি আর ধর্ম নিয়েও ছিল প্রখর, বৌদ্ধিক সচেতনতা। রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন মহালনবিশ দম্পতি। ১৯২৬-এ রবীন্দ্রনাথের ইউরোপ ভ্রমণের সঙ্গী ছিলেন তাঁরা। কথামতো একদিন প্রশান্তচন্দ্রের গাড়ি এসে দাঁড়াল অমলাকে নিয়ে যেতে। প্রশান্তচন্দ্রের স্ত্রী রানি (নির্মলকুমারী) মহালনবিশকে অমলা ডাকতেন, ‘রানিমাসি’। তাঁদের বাড়ি ছিল রয়ে-রয়ে চেয়ে দেখবার মতো। নান্দনিক। পরিপাটি। নিপুণ দেশীয় ছাঁদে গড়া। রানি মহালনবিশ সারাদিন অমলাকে রাখলেন খুব যত্ন করে। খাওয়ালেন কত ভালোবেসে, সাজিয়ে-গুছিয়ে। বিকেলে বললেন, এবার এসো।
বাড়ির সেই অন্য ঘরটিতে গিয়ে অমলা দেখলেন, কী স্নিগ্ধ এক রুচিমানতায় মোড়া চারধার। তারই মাঝে বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ। অমলা হাঁ হয়ে রইলেন, কী অপূর্ব, ঋষির মতো চেহারা। যেন আলো ঠিকরে পড়ছে চতুর্দিকে। অমলাকে দেখে তিনি ডাকলেন খুব মৃদু স্বরে। বললেন, আমি শুনেছি তুমি খুব সুন্দর নাচ করো। আমাকে একটু দেখাবে সেই নাচ? অমলা পড়লেন অথৈ সাগরে। নাচ তো তিনি কতদিন ধরেই করছেন, কত কত দেশ আর কত কত মানুষের সামনে, অকাতরে। কিন্তু এখন যেন থমকে রইলেন তিনি। ভাবছেন পোষাক, সংগীত, আনুষঙ্গিক তো নেই কিছুই। ভাবতে ভাবতে শাড়ির আঁচলটা জড়িয়ে নিলেন কোমরে। তারপর গুনগুন করে নিজেই গান গেয়ে-গেয়ে নাচলেন, তাঁর প্রিয় ‘দেবদাসী’ নৃত্য। রবীন্দ্রনাথ স্থির মনোযোগে দেখলেন। নাচ শেষ হলে অমলাকে বললেন, তুমি যাবে শান্তিনিকেতনে? অমলা তাঁকে প্রণাম করলেন ভক্তিভরে।
অমলাকে জানালেন তাঁর রানিমাসি, গাড়ি তাঁকে পৌঁছে দিয়ে আসবে বাড়িতে। তৈরি হয়ে গাড়িতে উঠতে গিয়ে চমকে গেলেন অমলা। ভেতরে বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ। কালো সিল্কের কুর্তা পাঞ্জাবি। মিশমিশে কালো। কালোর ওপর ব্রোকেট সুতোর কাজ। হায়দারবাদি নকসা। কোথাও যাচ্ছিলেন বোধহয়। চশমার সঙ্গে সোনার চেন লাগানো। একবার পকেটে রাখছেন, আবার চোখে। মিহি কালো পাড়ের গিলে করা ধুতি। অমলার স্মৃতির এ আখ্যান বড়ো মধুর। অমলা লক্ষ করলেন, পায়ে কী সুন্দর জুতো। কিন্তু ওঁর পা সবসময় ঢাকা থাকত। চেয়ে চেয়ে দেখছেন তাঁকে। হাতের ওপর হাতটা রাখা। গাঢ় গোলাপির আভা মেখে আছে আঙুলগুলো। যেন রাখা দুটো পদ্মফুল। গাড়ি চলছে। ধীরে-ধীরে। রাস্তার লোক সব চমকে যাচ্ছে। পাশের লোককে ডেকে বলছে, অ্যাই রবীন্দ্রনাথ, অ্যাই রবীন্দ্রনাথ। রাস্তার লোক দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। হতবাক, নিশ্চল, থমকে দাঁড়াচ্ছে। অমলা তাকিয়ে দেখছেন পাশে বসা অবিচল ওই মানুষটিকে, যেন রয়েছেন কোন অগম তীরে। অমলা ভাবছেন, বাপরে এমন একটা লোকের সঙ্গে চলেছি, যাঁকে সবাই-ই চেনেন, দেখে থ বনে যান মুহূর্তে।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে পরের বছর ডবল প্রোমোশন পেলেন অমলা। ১৯৩৫-এ উঠলেন নবম শ্রেণিতে, সেই বছরই দিলেন ম্যাট্রিক। ১৯৩৬ এ বি.এ পড়ার জন্য ভর্তি হলেন আশুতোষ কলেজে। প্যারিস, উদয়শঙ্করের স্মৃতি কাজে-কর্মে-ব্যস্ততায় আর সময়ের নিয়মে ধীরে-ধীরে হয়ে উঠল ঈষৎ ধূসর। অক্ষয় নন্দী প্রতিষ্ঠিত স্বর্ণব্যবসায়ী ছিলেন, তবু গ্রামেই রেখেছিলেন পরিবারকে। আদর্শবাদী ছিলেন। মনে করতেন, গ্রামকে ঠিক মতো না-জানলে নিজের দেশকে জানা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। অক্ষয় চাইতেন অমলা লেখিকা হোক। পড়াশোনার আবর্তেই কাটুক তাঁর জীবন। উদ্যোগী হোন মেয়েদের জীবনের মান উন্নয়নে। চোদ্দো বছর বয়সে অমলা পড়তে শুরু করলেন তিনশো বছরের বাংলা সাহিত্য--- নবীন সেন, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, পড়লেন কালিদাসও। বাবার প্রগাঢ় ইচ্ছেতেই অমলা হাত দিলেন লেখায়। শুরু হল ‘সাত সাগরের পারে’ গ্রন্থ রচনার কাজ। নৃত্যের বিষয়টা অক্ষয় পড়াশোনার চেয়ে অধিক গুরুত্ব দিয়ে ভাবেননি বলে অমলাকে আর পাঠানো হল না শান্তিনিকেতনে।
১৯৩৫-এ যখন উদয়শঙ্কর এলেন ভারতে, নতুন দল গড়ার সময় ডাক দিলেন অমলাকেও। কিন্তু তখনও পাওয়া গেল না অক্ষয়ের সম্মতি। সেসময় দলে যোগ দেওয়ার জন্য ডেকেছিলেন কথাকলি-শিল্পী গোপীনাথ ও রামগোপাল, এবার রাজি হলেন না অমলা। তবুও নাচ জড়িয়ে রইল, তাঁর জীবনে, প্রাত্যহিকতায়। অমলা নন্দীর জীবনে এল এক নূতনতর অধ্যায়।
মিতবাক এক প্রেম এসে দাঁড়াল অমলার নিভৃত কৈশোরের শামিয়ানায়। ১৯৩৫ সালে অমলা যোগ দিতে গেলেন এলাহাবাদ মিউজিক কনফারেন্সে। সঙ্গে গেলেন অক্ষয়। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দক্ষিণারঞ্জন ভট্টাচার্য ছিলেন এই কনফারেন্সের প্রধান অধ্যক্ষ। কথা ছিল ওঁরই দুই পুত্র তবলায় সঙ্গত করবেন অমলার নৃত্যে। কিন্তু মহড়া চলাকালীন কী হল, তাঁরা দুজনেই এ ব্যাপারে প্রকাশ করলেন তাঁদের অনিচ্ছা। জানালেন, এমন নাচের সঙ্গে সঙ্গত করা সম্ভব নয় তাঁদের পক্ষে। এ ঘটনায় বিমর্ষ বোধ করলেন অমলা। অপমানিতও বোধ করলেন তাঁদের আকস্মিক প্রত্যাখ্যানে। অমলার নাচকে ঘিরে তাঁদের অনাগ্রহ আহত করল তাঁকে। সেসময় এলহাবাদে যাঁর আশ্রয়ে ছিলেন তাঁরা, তাঁরও ছিল দুই গুণী পুত্র। তাঁরা এগিয়ে এলেন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই। নিদেন মানবিক তাগিদেই তাঁরা বুঝেছিলেন অমলার সংকট আর অসম্মান। অনুষ্ঠানে তাঁর নাচের সঙ্গে একজন বাজালেন তবলা, অন্যজন হারমোনিয়াম। অমলা নাচলেন, ‘দেবদাসী’ আর ‘বসন্ত’। অনুষ্ঠান শেষ হলে দর্শকের কাছ থেকে লাভ করলেন, প্রবল উচ্ছ্বাস। দর্শকের কণ্ঠস্বর তালে-তালে বলে চলেছে, we want Amala, we want Amala। সেবার মোট আটটি সোনার মেডেল পেয়েছিলেন অমলা। তবে তার চেয়েও বড় কথা এ ঘটনায়, জোরালো হয়ে উঠল তাঁর আত্মবিশ্বাস। জীবনের চড়াই-উৎরাই কখনও আত্মানুসন্ধানের রাজপথটির সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দেয় অকস্মাৎ, অমলা এসে দাঁড়ালেন সেইখানে।
এই কনফারেন্সের ফল হল সুদূরপ্রসারী। আসতে শুরু করল সম্মানিত ক্ষেত্রের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ। নিজের সমস্ত কাজ-কর্ম ফেলে অমলাকে পুরোদস্তুর সঙ্গ দেওয়া সম্ভব হল না অক্ষয়ের পক্ষে। এলাহাবাদের ওই বাড়ির মানুষজন ছিলেন ভারি আন্তরিক আর অতিথিবৎসল। তাঁদের অনুরোধে অমলা কিছুদিন রইলেন সেখানে। দ্বিমত করলেন না অক্ষয়। অমলা তখন নিতান্তই ষোলো। কিশোরী। নানা অনুষ্ঠান, দৌড়ঝাঁপ, মহড়ার আনন্দ-আয়োজনের মাঝে, ধীরে এসে দাঁড়াল এক যুবক। যিনি সেদিন তাঁর অনুষ্ঠানে বাজিয়েছিলেন হারমোনিয়াম। নিত্যদিনের স্বভাবেও যে পৌরুষ হতে পেরেছে বিস্তৃততর, কী আশ্চর্য মহিমতর সেই উপস্থিতি। সহৃদয়, সংযত সেই মানুষটিকে ভালো লাগল অমলার। কিন্তু কিশোরীর প্রেমানুভূতি নিশ্চুপ। প্রকাশ অকল্পনীয় তাঁর কাছে। নিজের কাছে অজানিত সেই অনুভূতিলাভেই বিভোর রয়েছে সে। অনতিস্ফূট এক অনুভব। একদিন যুবকটি এসে জানালে তাঁর হৃদয়ের কথা। কী অপরিমেয় সে আনন্দ। কী উচ্ছ্বসিত মূক। কৈশোরে প্রেমের প্রতাপ দুর্নিবার, কিন্তু অমলার মধ্যে জেগে উঠল এক দ্বিধা। বাবার দেওয়া নিঃশর্ত স্বাধীনতা কি ক্ষুণ্ণ হল তাঁর পদক্ষেপে? পারিবারিক মূল্যবোধের দস্তুর কি বিঘ্নিত করল তাঁর আচরণ? কৈশোরের প্রেম নির্ভার। স্বচ্ছতোয়া স্রোতের মতো নির্মল। তবু থমকে দাঁড়ালেন অমলা।
তারপর কেটেছে কিছুটা সময়। একদিন খবর এল, সেই যুবকের বিবাহ। স্থির করেছেন তাঁর বাবা। উক্ত দিন-ক্ষণ- তারিখ জানিয়ে এসে পৌঁছল বার্তা। সেদিন কী হল, অমলা একা একা কাঁদলেন খুব।
Powered by Froala Editor