শঙ্কর সরণি - ৩৪
আগের পর্বে
আলাউদ্দিনের পূর্বপুরুষ দীননাথ দেবশর্মা ছিলেন ব্রাহ্মণ। তিনিই ত্রিপুরায় থাকতে শুরু করেন। সেই সময় ত্রিপুরার রাজ দরবারে নানা শিল্পীর ভিড়। আছেন কাশিম আলি খান, যদু ভট্ট। ছোট থেকেই সন্ন্যাসীদের আখড়ায় ঘুরে ঘুরে সুরের খিদে মেটাতেন আলাউদ্দিন। তারপর ৮ বছর বয়সে পালিয়ে এলেন কলকাতায়। এখানে গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের কাছে শুরু হল সঙ্গীতশিক্ষা। কিন্তু একদিন দাদা এসে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন। বাড়ি গিয়েই দেখলেন তাঁর বিয়ের বন্দোবস্ত চলছে। বিয়ের রাতেই নববধুর গয়না খুলে নিয়ে আবার পালিয়ে এলেন। কিন্তু ততদিনে গুরু প্রয়াত হয়েছেন। শুনলেন বিবেকানন্দের জ্ঞাতি হাবু দত্ত ন্যাশনাল থিয়েটার্সে কনসার্ট তৈরি করেছেন। সেখানেই যোগ দিলেন প্রথমে। তারপর সেখান থেকে গিরিশ ঘোষের সভায়। এখানেই আলাপ হল আহমেদ আলির সঙ্গে। কিন্তু আহমেদ আলি নিজে হাতে তাঁকে কোনো সুর শেখাতেন না প্রথমে। চুরি করেই শিখেছিলেন আলাউদ্দিন।
আলাউদ্দিন আর তাঁর গুরু আহমেদ আলি একবার চললেন পাটনার নবাবের মনজিলে। গান-বাজনার নেওতা ছিল। রোজই গান-বাজনা হয়, আলাউদ্দিন শুধু সঙ্গত করেন তবলায়। একদিন ওস্তাদ তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিলেন নবাবের সঙ্গে। আমার শিষ্য। সরোদ শিক্ষা করে। বেহালাও বাজায় খুব ভালো। নবাব আদেশ করলেন, আলাউদ্দিনের কাছে শুনবেন সরোদ আর বেহালা। বাজালেন আলাউদ্দিন, ওস্তাদের সঙ্গেই। তাজ্জব বনে গেলেন নবাব। এমন বেহালা এমন বেহাগ তিনি কখনও শোনেননি এর আগে। দরবারে, হঠাৎ জেনানা মহল থেকে নবাবের কাছে হাজির হল এক লেফাফা। বেগম সাহেবারা পর্দার আড়ালে রয়েছেন এ মজলিশে। নবাব বাহাদুর ওস্তাদ আহমেদ আলিকে পেশ করলেন তাঁদের ফরমায়েস। বেগম সাহেবারা এবার শুনতে চান আলাউদ্দিনের বেহালা। একা আলাউদ্দিনকে। সেদিন সমস্ত রাত্রি জুড়ে বাজালেন আলাউদ্দিন। নিরন্তর। ভোরের আলো ফুটলে ভৈরবী দিয়ে শেষ হল মেহফিল।
মুজরো, দরবারের নজরানার যা কিছু অর্থ, আহমেদ আলি রাখতেন শিষ্যের কাছেই। একদিন সেইসব অর্থ আর নিজের যদ-যাবতীয় সঞ্চয়, আলাউদ্দিন সব তুলে দিলেন গুরুর হাতে। আহমেদ আলি অবাক মানলেন, তাঁর সঞ্চয় আছে নাকি কিছু? কই এর আগে তো কেউ ফেরত দেয়নি কখনও? সেই টাকা দিয়ে গুরুর নতুন বাড়ি উঠছে। গুরু আদেশ দিলেন গাড়ি থেকে ইঁট নামিয়ে পৌঁছে দিতে হবে যথাস্থানে। কুলিমজুরের মতো ছ মাস টানা বইলেন ইঁট, সুরকি, চুনের বস্তা। ভারি ভারি বস্তা বয়ে বয়ে একসময় পড়লেন কঠিন ব্যারামে। তায় গুরু শিক্ষাদান করাও ছেড়ে দিয়েছেন বহুদিন। উপর্যুপরি মনোকষ্ট আর কায়িক যন্ত্রণায় দিন যায় তাঁর। ভাবলেন টাকা দিতে গিয়ে কাল হল সব। একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন, ওস্তাদের মা। বললেন, একজন কবিরাজের কাছে তবিয়ত না সারলে ফের নতুন কবিরাজ ধরতে হয়। আমার ছেলের কাছে যা শিখেছ, শিখেছ, এবার আরেকজনের কাছে যাও। কার কাছে যাবেন তিনি? সে হদিশও দিলেন গুরুমা। বললেন, যাও উজির খান সাহেবের কাছে।
ওস্তাদ উজির খান ছিলেন তানসেনের কন্যাবংশের উত্তরাধিকার। তাঁর পিতা আমির খান ছিলেন, রামপুরের নবাব কালবে আলি খাঁয়ের দরবারের নামজাদা বীণকার। আর তাঁর মামা হলেন ওস্তাদ কাশিম আলি খাঁ। ত্রিপুরার রাজসভার প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ। যাঁর কাছেই তালিম পেয়েছিলেন আলাউদ্দিনের পিতা সদু খান। উজির খান বিদগ্ধ আর আশ্চর্য এক মানুষ। সংগীতশাস্ত্র, ধর্ম, পুরাণ, ভাষা বিষয়ে তিনি ছিলেন পণ্ডিত। চিত্রাঙ্কন এবং নাটক-কবিতা রচনাতেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। সংগীত ও বাদ্যের গুপ্তবিদ্যার তালিম পেয়েছিলেন দুর্লভ সব ঘরানা থেকে। রামপুরে তিনি ছিলেন নবাব হামিদ আলির সংগীতাচার্য। সেই উজির খানের সঙ্গে দেখা করতে চান আলাউদ্দিন। নবাবের দরবারের খাস ফনকার তিনি। দরোয়ান-প্রহরী পেরিয়ে মোলাকাত না-মুমকিন। ছ মাস গেল পেরিয়ে, চেষ্টাচরিত্র কিছু কম করলেন না আলাউদ্দিন। কিন্তু না, উজির খানের সঙ্গে দেখা হওয়ার কোনো উম্মিদ রইল না।
আরও পড়ুন
যন্ত্র বেঁধে যেই না ছাড়লেন সুর, শিউরে উঠলেন আলাউদ্দিন
হতাশ্বাস হয়ে দু-তোলা আফিম কিনলেন আলাউদ্দিন, জান দেবেন তিনি। ভোরে নমাজ পড়ছেন, মুখে বিষাদ। মৌলবি জানতে চাইলেন। কী বলবেন? আল্লাহ্-র কাছে মিছে কথা গুনাহ্। স্বীকার করলেন সব, মরতে যাচ্ছেন তিনি। বাজনা শেখা হল না, সুর-ই যদি না থাকে, কী হবে সে জীবন নিয়ে? মৌলবি বললেন, জাহের আদমি, হিম্মতে মর্দানা, মদতে খুদা। তুমি হিম্মত করো, খুদা কার্যসিদ্ধ করবেন। একদিন নবাব হামিদ আলি চলেছেন মোটরে। স্বয়ং নবাবও মস্ত গাইয়ে, সংগীতবোদ্ধা। ছুটে গিয়ে দু হাত মেলে পথ আটকে দাঁড়ালেন আলাউদ্দিন। সিপাই সান্ত্রী লম্ফঝম্ফ। হুলুস্থুলু ব্যাপার। এক বাঙালি পথ রোকা। আলাউদ্দিনের আর্জি শুনলেন নবাব। আফিমের গুলি দুটি নিয়ে লোফালুফি খেলতে-খেলতে নবাব ডাকলেন তাঁকে, হামিদ প্যালেসে, তাঁর মনজিলে।
আরও পড়ুন
আপ্লুত উদয়শঙ্কর জাপটে ধরলেন তাকে
রামপুর দরবারে সাতশো গাইয়ে-বাজিয়ে। সবাই মস্ত। বিরাট দাপট। নবাব আলাউদ্দিনের শিক্ষা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। শুনলেন সব মন দিয়ে। আলাউদ্দিনকে ধরতে বললেন সুর। আলাউদ্দিন প্রথমে সুরসাধনার প্রণালী গেয়ে শোনালেন। তারপর বাজালেন সরোদ। ইমন আলাপ করে, জোর, ঝালা, ঠুক, লরি সব বাজালেন। নবাব প্রীত হলেন। বেহালা শুনে যার-পর-নাই আশ্চর্য হলেন। এমন স্বর্গীয় বাজাতে কাউকে শোনেননি তিনি। নবাবেরও গুণের অন্ত নেই। অগণিত ধ্রুপদ শিখেছেন তিনি, উঁচু দরের গায়ক। বললেন, আমার গানের সঙ্গে সঙ্গত করবে? নবাব সুর ধরলেন, একটা বেহাগের হোরি, ‘যমুনা জলে সখি, ক্যয়সে যায়ুঁ’। বাজাবেন কি, গান শুনে থ আলাউদ্দিন। হুজুর, আরেকটা গান। নবাব সুরসিক। বললেন, হুকুম কর রহা হ্যায়? বাজনা শুনে খুশি হয়ে নবাব বললেন, আমার দরবারে নৌকরি নাও। খাওয়া-পরা, চাল-চুলো কিচ্ছুটি নেই। তবু আলাউদ্দিন শুধান, না হুজুর। বিদ্যাশিক্ষা করব। সুর সাধব। সুর আরো সুর। আরো সুর। সুরের বাইরে কী যাচনা, আলাউদ্দিন বোঝেননি এ জীবনে।
আরও পড়ুন
দল ভেঙে দিলেন উদয়শঙ্কর
নবাব এবার টপ্পা বাজাতে বললেন। তেমন জমল না। নবাব বাহাদুর হেসে বললেন, এই মরা মরা। আলাউদ্দিন বুঝি ছল করেন। হুজুর আমি ত মরাই, তবে এসব শেখান। বার্তা গেল, উজির খানের কাছে। বড়ো বড়ো থালে মেঠাই এল, সাদা পাগড়ি এল। নাড়া বাঁধা হল। গুরু প্রতিশ্রুতি নিলেন, কুপাত্রে দেবে না বিদ্যা। যাবে না কুসঙ্গে। বিদ্যা ভাঙিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করবে না। কখনও গান শেখাবে না বাইজি-বেশ্যাকে। কবুল করলেন আলাউদ্দিন। এদিকে পুলিশে সন্দেশ গেছে নবাবের গাড়ি আটকেছে এক বান্দা। পুলিশ শুরু করলে পুছতাছ। বাঙালি, তাই সন্ধান করলে বোমা মারে কি না। পুছতাছের বহর জেনে তাঁর শৌকিন, শাহি মেজাজে নবাব বাহাদুরও রাখলেন সওয়াল, বোমা মারো না তো হে? আলাউদ্দিন নবাবের সুর বোঝেন। জবাব করলেন, না হুজুর, তবে যদি শেখান, সুরের বোমা মারতে পারি।
আরও পড়ুন
উদয়শঙ্করের নাচ, ঢিলে কাঁচুলিতে ষোড়শী, বললেন ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ
গুরুর কাছে প্রার্থনা জানালেন আলাউদ্দিন। বীণার তালিম পেতে চান। ওস্তাদ বললেন, বীণাশিক্ষা তিনি প্রদান করেন সুদ্ধমাত্র বংশের পুত্র এবং নাতিকে। উত্তরাধিকার ভিন্ন এ বিদ্যায় অধিকার নেই কারোর। সরোদ, রবাব আর সুরশৃঙ্গারের তালিম দেবেন তিনি। নতমস্তকে, করজোড়ে গুরুবাক্য গ্রহণ করলেন আলাউদ্দিন। গুরু সাগরেদ করলেন বটে, কিন্তু বিদ্যাশিক্ষা দিলেন না। রোজ সকাল ছটা থেকে দশটা গুরুর ঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতেন আলাউদ্দিন, আবার বিকেলে দু ঘন্টা, কিন্তু আদেশ এসে পৌঁছয় না ভিতরে প্রবেশের। খাওয়া-পরার সন্ধান নেই। এস্টেটে এক ব্যান্ড ছিল। বারো টাকায় এক বেহালা বাদকের কাজ জোটালেন। সেখানকার ব্যান্ড-মাস্টার রাজা হুসেন খাঁর কাছে ছিল ধ্রুপদের অঢেল খাজানা। তাঁর কাছে সংগীতচর্চা শুরু করলেন। আরো এক ওস্তাদকে ধরে ধ্রুপদ, ধামার, দাদরা, তারানা, পুরোনো বন্দিশের গৎ প্রভৃতি শিখলেন। গুরুদক্ষিণা ছিল পাঁচ টাকা। দু-আড়াই বছর কাটল কিন্তু উজির খান ভুলে রইলেন আলাউদ্দিনকে।
ইতিমধ্যে আরেক কিসসা বাধল আলাউদ্দিনের বাড়িতে। বিয়ে-শাদি তো আলাউদ্দিনের হয়েছিল একটা। ফুলসজ্জার রাত্রে বালিকা বউকে ফেলে, তাঁর গয়না নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন তিনি। ওই পয়সায় সুর সাধবেন, এই ছিল সাধ। তারপর কেটে গেছে কতগুলো বছর। সেদিক পানে মন টানেনি তাঁর। হাল ছেড়ে বউয়ের বাড়ির লোক ঠিক করলে পুনর্বার দেবে তাঁর নিকাহ। অসম্মতি প্রকাশ করলেন মদিনাবেগম। আলাউদ্দিনকেই শওহর মেনেছে তাঁর মন। নিকাহর বন্দোবস্ত হল তা সত্ত্বেও। সেকথা শুনে একদিন গলায় দড়ি দিতে গেলেন মদিনাবেগম, কোনোক্রমে রক্ষা পেলেন মায়ের হাতে। বাপের বাড়ির লোক তাঁকে সহি সলামত রেখে গেল শ্বশুরের ভিটেয়। আবার খোঁজ-তল্লাশ শুরু হল আলাউদ্দিনের। সন্ধান পেলেন আফতাবউদ্দিনই, তাঁর মেজদা।
খবর গেল ওস্তাদের কাছে। উজির খানের স্মরণ হল আলাউদ্দিনকে। নিজের বিস্মরণে নিজেই ব্যথিত হলেন তিনি। অনুতাপ করলেন। যখন ডাক পাঠালেন, আলাউদ্দিন এসে জড়িয়ে ধরলেন তাঁর চরণদুটি। আজও উথলে উঠছে তাঁর হৃদয়, তাকে থামায় কে! গুরু তাঁকে টেনে নিলেন বুকে। আলাউদ্দিনের সব কথা শুনলেন তিনি। জানতে পারলেন কাশিম আলি খান, উজির খানের ছোটো মামা, তাঁর কাছেই আলাউদ্দিনের পিতা সদু খান নিয়েছেন তালিম। বললেন, তবে তো তোমার পিতা আমাদের ঘরেরই শাগরেদ। ছেলেদের ডেকে হুকুম দিলেন, পিয়ারা মিঞা, মজলা সাহেব, ছোটা সাহেব যা তালিম দিয়েছি তোমাদের, ওকে শেখাবে। আমিও দেব তালিম। দরজা আঁটা ঘরে সবার অন্তরালে এই বিদ্যা দান করেন গুরু। এই রেওয়াজ। নিজের ঘরানার দুর্লভ সব সুর গুরু দিলেন তাঁকে। কত কত বছর তাঁর রাত্রি ছিল নিদ্রারহিত। সাঁঝসন্ধে থেকে ভোরের আলো ফুটে সাদা হয়ে উঠত আকাশ, চলত সাধনা। গুরুর মাও সেতার বাজাতেন। মহরমে মর্সিয়া গাইতেন, কাঁদিয়ে দিতেন রসিককে। গুরু বাজাতে বসতেন রাত বারোটার পর। সেই সুরে আলাউদ্দিনের মনে হত, ভগবান আ গয়া।
তালিম শেষে গুরুজি বললেন, শিক্ষা, দীক্ষা আর পরীক্ষা এই তিনে বিদ্যা সম্পূর্ণ। যাও এখন দেশভ্রমণ করো। বহু মানুষজন, সমঝদারকে শোনাও তোমার সুর। যদি দেখো তোমার চেয়েও গুণী কেউ, তবে পরখ করো নিজেকে। যদি ওস্তাদ তোমার চেয়ে বেশি গুণী হয়, তবে আরো শিক্ষা করো তাঁর কাছে। ‘রাগ-অনুরাগ’ বইতে রবিশঙ্কর ধরিয়ে দিয়েছিলেন, ওস্তাদদের ঘরে এ কথার যথার্থ, পারিভাষিক অর্থ। ‘আমাদের গান-বাজনার মহলে ওস্তাদীর ভাষাতে বলে শিক্ষা-দীক্ষা-পরীক্ষা। আমরা হয়তো এটার অন্য মানে করব। কিন্তু ওস্তাদের কথায় দীক্ষা মানে হল দেখা। অর্থাৎ শিখা, চারো তরফ দেখা, অউর পরীক্ষা কিয়া।’
শিক্ষার ওইসব রাজকীয় খাস ঘরানায় এতদিন বাস করে আলাউদ্দিন এলেন কলকাতায়। কিন্তু গুরুবাক্য পালন করতে গিয়ে বিমূঢ় হয়ে রইলেন তিনি। সমস্ত সুর যেন কেটে গেল নাগরিক উন্নাসিকতায়। গায়ক-বাদক তাঁদের হুজুগ, দলাদলি, নিন্দাচর্চা। ওস্তাদ কই, ওস্তাদিতে ছেয়ে আছে সবখান। শিক্ষা-সহবত, সুরকে যেন আবিল করে রেখেছে চতুর্দিক। চিরদিন সুর খুঁজতে পালিয়ে বেরিয়েছেন, এবার কোথায় ছুটবেন আলাউদ্দিন?
Powered by Froala Editor