দল ভেঙে দিলেন উদয়শঙ্কর

শঙ্কর সরণি - ৩১
আগের পর্বে

উদয়শঙ্করের ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু তাঁর নৃত্য কবিগুরুকে মুগ্ধ করতে পারল না। যদিও অনুষ্ঠানের শেষে অতিথিসুলভ সৌজন্য বজায় রাখতে মালা দিয়ে বরণ করে নিলেন উদয়শঙ্করকে। কবিগুরুর আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনেও গেলেন উদয়। সেখানে কবি প্রশংসার পাশাপাশি উদয়ের নৃত্যের মৃদু সমালোচনাও করলেন। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল সেই সমালোচনা। যদিও উদয়শঙ্করের প্রতিভা ও দক্ষতার বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু তাকে শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে নিয়ে যেতে আরও কিছুটা সাধনার প্রয়োজন অনুভব করলেন তিনি। এই সমালোচনার পিছনে ছিল নৃত্য সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ অনুরাগের প্রেক্ষাপটটিও। প্রকাশ্যের মৃদু সমালোচনাই আরও তীব্র হয়ে উঠল ধূর্জটিপ্রসাদ এবং প্রমথ চৌধুরীকে লেখা চিঠিতে। তবে এই সমালোচনার ফলে রবীন্দ্রনাথের প্রতি উদয়ের কোনো বিদ্বেষ তৈরি হল না। বরং তিনি আমেরিকা ফিরে নতুন করে শিক্ষায় ব্রতী হওয়ার কথা জানালেন।

সলোমান হ্যুরকের সঙ্গে উদয়শঙ্করের চুক্তি হয়ে রয়েছে আমেরিকা ভ্রমণের। ফলে দল নিয়ে পুনরায় বিদেশ প্রত্যাবর্তন করলেন উদয়শঙ্কর। এবার দলে যোগ দিয়েছেন দুজন নতুন শিল্পী। তিমিরবরণের ছোটোভাই শিশিরশোভন ভট্টাচার্য। আর নগেন দে। শিশিরশোভন মূলত বাজাতেন তবলা, নগেন বাজাতেন বাঁশি। তবে এবারের বিদেশ ভ্রমণ হাজির হল একেবারে স্বতন্ত্র পরিস্থিতি নিয়ে। গতবারের হই-হুল্লোড়, আনন্দ-উত্তেজনা, শিল্প-নির্মাণের অনাবিল বাসনা, ভাঁটা পড়ল সমস্ত কিছুতে।  ছিঁড়তে শুরু করল সম্পর্কের তার। সহজ আদান-প্রদানের বদলে ক্রমে জায়গা করে নিল অহং। অমর্যাদাকর হয়ে উঠল পরিবেশ।

আমেরিকার ক্লিভল্যান্ডে তখন চলছে উদয়শঙ্করের নৃত্যানুষ্ঠান। পরবর্তী অনুষ্ঠান শিকাগোয়। প্রবল ব্যস্ততার একটা সময়সূচিকে মেনে কাজ করতে হচ্ছে সকলকে। বাধ্যত শরীর ও মন যুগপৎ ক্লান্ত। ইতিমধ্যে আর্থিক বিষয় নিয়েও দলের ভেতর ঘনিয়ে উঠেছে অসন্তোষ। অনুষ্ঠানে প্রত্যেকের গুরুত্বের তর-তম নিয়েও শুরু হয়েছে তর্ক। সেদিন অনুষ্ঠান চলছে। গ্রিন রুমে মেক আপ করছেন দেবেন্দ্রশঙ্কর, ‘গজাসুর’-এর। উদয়শঙ্কর জানালেন, অনুষ্ঠান শেষেই তাঁদের ছুটতে হবে একটি নিমন্ত্রণ রক্ষার ব্যাপারে। এক অত্যন্ত প্রতিপত্তিশালী ভদ্রমহোদয়ার আমন্ত্রণ, এড়াবার উপায় নেই কোনো। যেন আগুন লেগে গেল সর্বত্র। দেবেন্দ্রশঙ্কর স্পষ্টত জানালেন, তাঁর পক্ষে অসম্ভব, এরপর কোনোরকম কর্তব্যপালন। কথার পিঠে কথা, ক্ষোভের মুখে রোষ। কী হল উদয়ের, সজোরে মেরে বসলেন দেবেন্দ্রশঙ্করকে। আকস্মিকতার ঘোরে কিছুক্ষণ থম হয়ে রইলেন দেবেন্দ্র। ঘোর কাটতে প্রত্যাঘাতে সময় নিলেন না এতটুকু। প্রবল শক্তি দিয়ে উদয়কে আঘাত করলেন তিনিও। ক্রোধে বিহ্বল উদয়শঙ্কর, দল থেকে বেরিয়ে যেতে নির্দেশ দিলেন দেবেন্দ্রশঙ্করকে।

সেদিন গজাসুরের অভিনয় করলেন, অপ্রস্তুত উদয়শঙ্কর। ফিরে দেখলেন দ্বার রুখে দাঁড়িয়ে আছেন রাজেন্দ্রশঙ্কর। পাশে রয়েছেন দেবেন্দ্র। কী কারণে দেবেন্দ্রর প্রতি এই অন্যায্য আচরণ, উদয়ের কাছে এখুনি তার কৈফিয়ত চান রাজেন্দ্র। সংঘাত এগোল জটিল পথে। রাশ রইল না ক্রোধের। একদিকে উদয় অন্যদিকে রাজেন্দ্র আর দেবেন্দ্র। বেধে গেল তুমুল হাতাহাতি-ধ্বস্তাধস্তি। উদয়শঙ্কর চোট পেলেন পায়ের আঙুলে। যেন আকস্মিক বজ্রপাত হল দলের অভ্যন্তরে। এ আঘাত ততখানি শরীরে নয়, যতখানি গভীর হয়ে বাজল তাঁদের হৃদয়ে। ম্যানেজারকে নির্দেশ দিলেন উদয়, শিকাগো যাবেন না রাজেন্দ্র আর দেবেন্দ্র, কেউই। ভাইদের ব্যক্তিগত পরিসর থেকে, এ ব্যাপারে, নৈঃশব্দ্যের দূরত্বে নিজেদের রাখলেন সকলে। রাজেন্দ্র আর দেবেন্দ্রর পাশে দাঁড়ালেন তিমিরবরণ। জানালেন শিকাগো যাবেন না তিনিও। রাত্রে তাঁরা তিনজন এলেন স্টেশনে। উদয়শঙ্করের সফর থেকে সরে যেতে চান তাঁরা। অনেক রাত্রি তখন, ট্রেন আসতে বাকি কয়েক মিনিট, উদয়শঙ্কর এসে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন সকলকে।

রবিশঙ্কর, দেবেন্দ্রশঙ্কর ও রাজেন্দ্রশঙ্কর

 

আরও পড়ুন
উদয়শঙ্করের নাচ, ঢিলে কাঁচুলিতে ষোড়শী, বললেন ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ

উদয় একবার এলেন লন্ডনে। কয়েকটা অনুষ্ঠান আছে, আছে আরো কিছু প্রয়োজনীয় কাজ। লন্ডনে এসে প্রথমেই খোঁজ করলেন সেই ল্যান্ডলেডির। কপর্দক-শূন্য অবস্থায় যাঁর কাছে আশ্রয় পেয়েছিলেন তিনি। পেয়েছিলেন যত্ন, ভালোবাসা। তখন হন্যে হয়ে খুঁজছেন কাজ। ব্যর্থতার ভার মাঝে-মাঝে দুর্বহ লাগছে তাঁর। না কাজ, না অর্থের সংস্থান। পরিচিত জনেরা ফিরিয়ে নিয়েছেন মুখ। চিত্রকর হতে এসেছিলেন লন্ডনে, নৃত্যের আকর্ষণে তখন ছেড়েছেন সমস্তকিছু। কিন্তু আদৌ কি পৌঁছতে পারবেন লক্ষ্যে? এক-একদিন আত্মহত্যার চিন্তাও কড়া নেড়েছে নির্জন অন্দরে। সকালবেলা বেরিয়ে যেতেন বাড়ি থেকে, ফিরতেন দিনশেষে, শূন্য হাতে। দূর থেকে লক্ষ করতেন ওই ল্যান্ডলেডি। সকালের খাবার আগলে অপেক্ষা করতেন তিনি, জানতেন এরপর উদয়কে অভুক্ত থাকতে হবে দিনভর। কোনো-কোনো দিন এমনও ঘটেছে, পথ হেঁটে-হেঁটে ক্লান্ত উদয়শঙ্কর, সঙ্গতি নেই বাসে চড়বার। আনমনে, অভ্যাসবশে নিজের কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে অবাক হয়ে গেছেন। হাতে এসে ঠেকছে বেশ কয়েক পেনি। নিঃশব্দ কাজটি কার, বুঝতে অসুবিধা হয় না তাঁর। যেদিন প্যারিসের ভাগ্যান্বেষণে ছেড়ে এলেন সেই আশ্রয়, সেদিন নতমস্তক দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর সামনে। তাঁর প্রাপ্য ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য নেই তাঁর। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে জানিয়েছিলেন সেই নারী, তিনি শুধু চান উদয়ের কল্যাণ। এত বছর পর, আজ উদয় খুঁজবেন তাঁকে। গেলেন বটে সেই বৃদ্ধার খোঁজে, কিন্তু ইতিমধ্যে কেটে গেছে দশ-বারো বছর, পাওয়া গেল না তাঁকে, সেই গন্তব্যে। হাল ছাড়লেন না উদয়। জানা গেল লন্ডনের পাট তুলে, তিনি এখন থাকেন শহরতলিতে।

আরও পড়ুন
আজ কোথায় যেন বেসুর বাজল সব

উদয়শঙ্করের পোর্ট্রেট আঁকছেন রটেনস্টাইন

 

আরও পড়ুন
ছোটো ছিলেন তবু কথাটা বুঝেছিলেন অমলা

উদয় পৌঁছলেন ঠিক। দেখা পেলেন অমায়িক সেই মানুষটির। ন্যুব্জ, আরো বৃদ্ধ হয়েছেন তিনি, তবু উদয়কে চিনলেন দেখামাত্র। তাঁর আশ্রয়ে কাটানো কঠিন দিনগুলোর কথা স্মরণ করে উদয় তাঁকে জানালেন তাঁর কৃতজ্ঞতা। তাঁর সম্মানার্থে তিনি এনেছেন উপহার। উদয় ভেতর-ভেতর ইতস্তত করছেন। এই মানুষটির কাছে তাঁর ঋণ অশেষ, কীভাবে পাড়বেন সেকথা। উদয়ের ইচ্ছার কথা টের পেয়ে, তিনি জানালেন, সেদিন তোমাকে ভালোবেসে মনে মনে তৃপ্ত হয়েছিলাম। চেয়েছিলাম, তোমার আকাঙ্ক্ষা যেন পূর্ণ হয়। সেকথা সত্য হয়েছে জেনে, পেয়েছি পরম আনন্দ। এর বেশি তো কিছু সেদিনও চাইনি, আজও চাই না।

আরও পড়ুন
বন্ধুর অহংকার ভাঙাতেই প্রথম কবিতা লেখেন শিবনাথ শাস্ত্রী

শহরে ফিরে উদয় দেখা করলেন উইলিয়ম রটেনস্টাইনের সঙ্গে। তাঁর মাস্টারমশাই। শিক্ষা সম্বন্ধে, দেশ-ঐতিহ্য সম্বন্ধে যিনি খুলে দিয়েছিলেন তাঁর চোখ। শিক্ষকের সবচেয়ে বড়ো কর্তব্য ছাত্রকে তাঁর চেতনার মধ্যে নবজন্ম দেওয়া, উদয়ের জীবনে সেই দুরূহ কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন রটেনস্টাইন। তেরো-চোদ্দো বছর পর তাঁর এই উজ্জ্বল ছাত্রটির সাফল্যে অভিভূত হয়ে রইলেন তিনি। ছাত্রের পোর্ট্রেট আঁকতে চাইলেন নিজহাতে। ইতিহাস হয়ে রইল সেই ক্ষণটি।

অ্যালিস বোনার

 

উদয়শঙ্করের দলে কাজ করতে-করতে ক্লান্ত বোধ করছিলেন তিমিরবরণ। তাঁর সৃজনশীল সত্তা অতৃপ্ত ছিল ঠিকই, কিন্তু সেইসঙ্গে দলের হাওয়া-বদল তাঁকে ভারাক্রান্ত করে তুলছিল ভেতর-ভেতর। গতবার ভারতে আসার আগেই উদয়শঙ্করকে জানিয়েছিলেন তিনি, আমেরিকা সফর শেষ হলেই তিনি ফিরে যাবেন দেশে। সেইমতো তিনি চাইলেন অনুমতি। মরিয়া উদয়, রাজি হলেন না কিছুতেই। এখনও তাঁর হাতে রয়েছে বেশ কিছু কাজ। তিমিরবরণ ছাড়া অসম্ভব অনুষ্ঠান পরিচালন। নিরুপায় উদয় সমস্ত কথা জানিয়ে চিঠি লিখলেন অ্যালিস বোনারকে। দল গড়ার সেই শুরুর দিনগুলি থেকে সঙ্গী ছিলেন তিনি। সুখ-দুঃখে আনন্দ-আহ্লাদে সেই সহজ নিরাভরণ দিনগুলি উদয়ের মতোই মহামূল্যবান অ্যালিস আর তিমিরবরণের কাছেও। অ্যালিস ফোন করলেন তিমিরবরণকে। অনুরোধ করলেন আরো কটা দিন উদয়ের সঙ্গে থাকতে। উদার, স্বজনবৎসল, ভারত-মুগ্ধ, আদ্যন্ত এই শিল্পী মানুষটির কথা ফেলতে পারলেন না তিমিরবরণ।

আমেরিকার পর অনুষ্ঠান হল ইংল্যান্ডে। তারপর ফ্রান্স। বেশ কিছুদিন টানা অনুষ্ঠানের পর্ব যেই মিটে আসবে সেই সময় খবর এল অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ আসছে স্পেন থেকে। না, এবার রাজি হলেন না তিমিরবরণ। উদয় তাঁকে জানালেন, একজন যথার্থ দক্ষ সরোদিয়া ছাড়া অসম্পূর্ণ থাকবে তাঁর অর্কেস্ট্রা। তিমিরবরণ আশ্বস্ত করলেন উদয়কে। দেশে ফিরে তিনি তাঁর গুরু কিংবদন্তি আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবকে অনুরোধ করবেন, তাঁর দলে যোগ দেওয়ার জন্য। উদয় অভাবিত আনন্দবোধ করলেন। সমস্তটা অবিশ্বাস্য ঠেকল তাঁর। তিমিরবরণকে তিনি জানালেন তাঁর কৃতজ্ঞতা। এইসময়ই অন্তরালে রাখতে চাওয়া বাকিদের নানা সমস্যাও প্রকট হয়ে উঠল ধীরে-ধীরে। ক্ষোভ-অসন্তোষ-অনাগ্রহ দলের অন্দরে বাধিয়ে দিল তুমুল বাগ-বিতণ্ডা। হাতের বাইরে চলে গেল সমস্তটা। দল ভেঙে দিলেন উদয়শঙ্কর। সকলকে দেশে পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন। সিমকি আর বিষ্ণুদাস শিরালী ফিরলেন স্ব-স্ব ক্ষেত্রে। তিনি রয়ে গেলেন ইউরোপে। একা।     

বিয়াত্রিচে

 

এলমহার্স্টকে কথা দিয়েছিলেন উদয়শঙ্কর, নিজের দেশ থেকে ঘুরে এসে তিনি দেখা করবেন তাঁর সঙ্গে। এলেন তাঁদের অপরূপ আস্তানায়। ডার্টিংটন হলে তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেছেন সাংস্কৃতিক কলাকেন্দ্র। ফুলে-ফুলে স্বর্গের নন্দনকানন হয়ে আছে চারপাশ। এলমর্হাস্ট আন্তর্জাতিক মনোভাবে সাজিয়ে তুলেছেন এই কলাকেন্দ্র। রয়েছে একটি নাটমঞ্চও। তাঁদের উৎসাহে জড়ো হয়েছেন পৃথিবীর তাবড় সব অধ্যাপক। রয়েছেন অভিনেতা মাইকেল শেকভ, বিখ্যাত রুশ ঔপন্যাসিক আন্তন শেকভের আত্মীয়। এলমহার্স্টদের সঙ্গে উদয় বেরোলেন ইতালি ভ্রমণে। পরিচয় নিবিড় হল বিয়াত্রিচের সঙ্গে। অ্যালিস বোনার তখন রয়েছেন সাময়িক এক অর্থসংকটে। ফলত উদয়কে নতুন করে সহায়তা সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে। ঠিক সেই সময়ই এলমহার্স্ট, ডরোথি এবং বিয়াত্রিচে চাইলেন, উদয় বড়ো কিছুর সঙ্গে যুক্ত হোন। তাঁকে সমস্তরকম সাহায্য করবেন তাঁরা।

দল তৈরির সময় অনাবিল এক আনন্দ, যেন অনন্তের ধ্রুবপদ বেঁধে দিয়েছিল তাঁর জীবনে। অথচ আজ এই দল ভাঙার যন্ত্রণা ধূমায়মান অন্ধকারে ঢেকে দিল সবখান। তবু ঘুরে যে দাঁড়াতেই হবে তাঁকে।

Powered by Froala Editor