উদয়শঙ্করের নাচ, ঢিলে কাঁচুলিতে ষোড়শী, বললেন ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ

শঙ্কর সরণি ৩০
আগের পর্বে

লন্ডনের একটি অনুষ্ঠানে উদয়শঙ্করের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল লেনার্ড এলমহার্স্টের। পরে এই আলাপ আত্মীয়তার স্তরে পৌঁছায়। এলমহার্স্টের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ ঘটেছিল অনেক আগেই। ১৯১৫ সালে ভারতে এসে দেশের কৃষকদের দুরাবস্থা দেখেছিলেন তিনি। পরে কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে যোগ দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের পল্লী পুণর্গঠনের কাজে। এলমহার্স্টের সংস্পর্শে এসেই রবীন্দ্রনাথের প্রতি উদয়ের আগ্রহ আরও বৃদ্ধি পায়। ১৯৩৩ সালে ভারতে ফিরলেন উদয়। সঙ্গে সিমকি। দেশের নানা প্রান্তে অনুষ্ঠান করে আমেরিকা ফিরতে হবে তাঁকে। কিন্তু ফেরার আগে একবার রবীন্দ্রনাথের সামনে নৃত্যপ্রদর্শনী করতে চান। এর আগে ১৯২২ সালে রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিলেন উদয়। পরে আর দেখা হয়েছে কিনা জানা নেই। তবে মানুষ উদয়কে ভালো লেগেছিল কবিগুরুর। ৬ জুলাই কলকাতার ম্যাডানের প্যালেস অফ ভ্যারাইটিজে উদয়ের নাচ দেখলেন তিনি। শিল্পী উদয়শঙ্করকে কেমন লাগল রবীন্দ্রনাথের?

৬ জুলাই ১৯৩৩-এ কলকাতায় ম্যাডানের ‘প্যালেস অব ভ্যারাইটিস’-এ উদয়শঙ্করের নৃত্যানুষ্ঠানে সশ্রদ্ধ আমন্ত্রণ জানাল হল রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথ এলেন। নৃত্য শেষ হলে উদয়শঙ্করকে গলায় মালা পরিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। বললেন, ‘নটরাজ শঙ্কর প্রাচীন ভারতের রসধারার উৎস— আমি আশা করি আমাদের এই শঙ্কর (উদয়শঙ্কর) হইতে সেই বিলুপ্ত প্রায় ভারতীয় প্রাচীন রস বিজ্ঞানের পুনরুজ্জীবন সম্ভবপর হইবে’। সর্বজনসমক্ষে সৌজন্যকে অক্ষুণ্ণ রাখতে সভার বিশিষ্ট অতিথির কর্তব্য পালন করলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু তাঁর অন্তরস্থ শিল্পতত্ত্বের ধারণার সঙ্গে জুতসই ঠেকল না উদয়শঙ্করের নৃত্য। মনে হল, গুণী তিনি, প্রতিভাবানও। তাঁর সংগ্রাম ভারতীয় নৃত্যধারণাকে গতি দেবে। কিন্তু উদয়শঙ্করের নৃত্যকলায় তিনি খুঁজে পেলেন না শিল্পের ঐশ্বর্যমূর্তির পূর্ণতাকে।

অবহেলিত নৃত্য বিষয়টিকে বঙ্গসমাজের মুখ্যভাগে সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত করতে চাওয়ায় রবীন্দ্রনাথের তাগিদ, পরিশ্রম আর সদিচ্ছাটিকে ভুললে চলবে না। সে কথা আগে আমরা জানিয়েছি বিস্তারিত। বিভিন্ন দেশ থেকে এবং স্বদেশীয় নৃত্যরীতি-পদ্ধতির বিমিশ্রণে শান্তিনিকেতনে তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন নৃত্যের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ। নৃত্যের ধারণায় তৎসমকালীন সমাজে মিশেছিল অমর্যাদা, অসন্তোষ। শরীরী ভঙ্গিমাকে উপজীব্য করে উপার্জন, সেইসব ক্লিন্নধারণা থেকে তিনিই মুক্তি দিয়েছিলেন নৃত্যকলাকে। আনন্দ-উপচারে, উৎসবে-অনুষ্ঠানে নাচকে করে তুলেছিলেন জীবনের অঙ্গস্বরূপ। সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে উদয়শঙ্করের সংগ্রামকে সম্মান জানালেন তিনি। কিন্তু সর্বৈবভাবে গ্রহণ করলেন না তাঁর নৃত্যরীতিকে।

৬ জুলাই অনুষ্ঠানের পর, সম্ভবত ৮ জুলাই ১৯৩৩, উদয়শঙ্কর পৌঁছন শান্তিনিকেতনে। যদিও আনন্দবাজার পত্রিকার রিপোর্ট এবং রবীন্দ্রজীবনী-কার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের তথ্যে রয়েছে সামান্য তফাত। উদয়শঙ্করের আগ্রহেই সম্ভবত সেইসময় আয়োজন করা হয় আশ্রম দর্শন এবং নৃত্যানুষ্ঠানের। শান্তিনিকেতনে তখন চলছে ‘বর্ষামঙ্গল’ উৎসব। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অংশ নিলেন আবৃত্তি আর গানে। তার সঙ্গে আয়োজিত হল আশ্রমিকদের নৃত্য। এসময় শান্তিনিকেতন যাওয়া প্রসঙ্গে রবিশঙ্করেরও রয়েছে মূল্যবান একটি স্মৃতি। বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সব personality, musicians তো বটেই, সবাইকেই প্রায় meet করেছি। কিন্তু ওই আমার একটা experience প্রথম রবীন্দ্রনাথকে যখন দেখলাম। ভাবতে পারিনি যে এরকম একটা personality হতে পারে। প্রথম ওঁকে দেখি stage-এ। কী একটা নাটক হচ্ছিল— আর উনি বসে ছিলেন stage-এর এক কোণে। আমি নাটকফাটক কিচ্ছু দেখিনি, খালি ওঁকেই দেখেছিলাম— ধবধবে সাদা দাড়ি। Piercing কালো চোখ।’ পরের দিন কাছে গেলেন রবীন্দ্রনাথের। প্রণাম করলেন পায়ে হাত দিয়ে। রবিশঙ্করের মাথায় হাত রেখে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘বাবার মতো বড়ো হও, দাদার মতো নাম করো’।

রবীন্দ্রনাথ ও উদয়শঙ্কর

 

আরও পড়ুন
অহঙ্কারের ইনজেকশন চলেচে, বললেন রবীন্দ্রনাথ

১২ জুলাই শান্তিনিকেতনে আয়োজিত হল উদয়শঙ্করের নৃত্যানুষ্ঠানের। সঙ্গে রইলেন সিমকি। মাসিক পত্রিকা ‘প্রবাসী’তে (ভাদ্র ১৩৪০-এ), প্রকাশিত হল সেই প্রতিবেদন। নৃত্যশেষে একটি দীর্ঘ বক্তৃতায়, সেদিন উদয়শঙ্করকে নৃত্য বিষয়ে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করলেন রবীন্দ্রনাথ। বক্তৃতার গোড়ায় জানালেন আশীর্বাদ। তারপর বললেন, দেশে-বিদেশে উদয়শঙ্কর লাভ করেছেন ‘প্রভূত সম্মান’, কিন্তু একথা নিশ্চয়ই তিনি নিজেও অনুভব করেন যে, তাঁর ‘সাধনার পথ এখনো দূরে প্রসারিত’। তাঁর ‘প্রতিভা’ আছে, সেইজন্যই তাঁর আশা উদয়শঙ্করের ‘সৃষ্টি কোনো অতীত যুগের অনুবৃত্তিতে বা প্রাদেশিক অভ্যস্ত সংস্কারে জড়িত হয়ে থাকবে না’। অর্থাৎ, উদয়শঙ্করের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত এমন কোনো আধুনিক নৃত্যশৈলীর অপেক্ষা করছিলেন যা ‘অতীত যুগের অনুবৃত্তি’ বা ধ্রুপদি ভারতীয় নৃত্যের রীতিসম্মত উপস্থাপনামাত্র হবে না। আবার তা সীমাবদ্ধ থাকবে না কোনো বিশেষ প্রদেশের নৃত্যশৈলীর চর্চাতেও।

আরও পড়ুন
আজ কোথায় যেন বেসুর বাজল সব

উদয়শঙ্করের প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিলেন রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গে অনুক্ত রাখলেন না সাধনার প্রসঙ্গটিও।  শেষদিকে এসে প্রকাশ করলেন তাঁর সংযত কিন্তু তীব্র অভিমত। বললেন, ‘নৃত্যহারা দেশ’ অনেক সময় ভুলে যায়, নৃত্য ‘ভোগের উপকরণমাত্র নয়’। নৃত্য সেইখানেই ‘বেগবান’, ‘গতিশীল’ আর ‘বিশুদ্ধ’ যেখানে আছে ‘মানুষের বীর্য’। যেখানে ‘পৌরুষের দুর্গতি’ ঘটে, সেখানে অন্তর্ধান করে নৃত্য। ‘বাঈজীর’ নাচের মতো হারায় তার ‘তেজ’, তার ‘স্বাস্থ্য’। বললেন, ‘এই পণ্যজীবিনী নৃত্যকলাকে তার দুর্বলতা থেকে তার সমলতা থেকে উদ্ধার করো। সে মন ভোলাবার জন্যে নয়, মন জাগাবার জন্যে।’  লক্ষণীয়, বিংশ শতাব্দীর আধুনিক ভারতীয় শিল্পের ঐতিহ্যে নৃত্যশিল্প প্রাথমিকভাবে উপেক্ষিত। অথবা বলা চলে, যেখানে তা প্রচলিত সেখানে ঘটেছে তার শৈল্পিক অবনমন। এই উপেক্ষিত ও অবমানিত শিল্পকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নৃত্যভাবনায় উন্নীত করতে চাইছিলেন বিলাসীর জলসাঘর থেকে সুকুমার শিল্পের আঙিনায়। সেইসূত্রেই স্পষ্টত জানালেন, শিল্প মনোরঞ্জনের বিষয় নয়, শিল্পের কাজ চিত্ত উদবোধনের।  

আরও পড়ুন
ছোটো ছিলেন তবু কথাটা বুঝেছিলেন অমলা

রবীন্দ্রনাথের ভাষার গূঢ় দিকটির সঙ্গে যাঁরা পরিচিত তাঁরা বুঝবেন, চিরদিন সত্যনিষ্ঠ তিনি। মানুষকে আঘাত, তাঁর স্বভাব-বিরুদ্ধ, সহবত-বিরুদ্ধও। তায় উদয়শঙ্কর তাঁর অতিথি। তদুপরি এ কোনো শিল্প-তর্কের ক্ষেত্রও নয়। তাই উদয়শঙ্করের গুণ, তাঁর প্রচেষ্টার প্রসঙ্গ সূত্রেই তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন তাঁর আসন্ন কর্তব্য। ‘প্রবাসী’-র সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন রবীন্দ্র-ঘনিষ্ঠ। ফলে কবির অসন্তোষ তাঁর অজানা থাকার কথা নয়। সেই কথার ছাপ রইল ‘প্রবাসী’র প্রতিবেদনেও। বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলা হল, ‘ইহা আশীর্বাদ বলিয়া ইহাতে রবীন্দ্রনাথ স্বভাবতই সমালোচনা সুস্পষ্ট করেন নাই’। একথাও ছাপার অক্ষরে মুদ্রিত হল, কথাপ্রসঙ্গে উদয়শঙ্করের নৃত্য সম্বন্ধে তাঁরা জেনেছেন কবির মত। বলা হল, উদয়শঙ্করের নৃত্যশিক্ষা হয়েছে রাজপুতানার কোনো কোনো ক্ষেত্রে। ‘মুসলমান আমলের বিলাস ও ভোগলালসার উদ্দীপক পেশাদার নর্তকীদের নৃত্যই সেখানে চলিত আছে।’ সেই প্রকার নাচকে কবি ‘নিন্দনীয়’, ‘অননুকরণীয়’ এবং রুচিশীল দর্শকদের পক্ষে পীড়াদায়ক বলে মনে করেন।

আরও পড়ুন
সুরের কাছে হার মেনেছে হাজার কথার হল্লা

উদয়শঙ্কর ও সিমকি

 

৩ জুলাই সংগীতজ্ঞ ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে লেখা চিঠিতে নিরহঙ্কার, বিনীত উদয়শঙ্করের প্রতি প্রকাশ পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথের মুগ্ধতা। গত পর্বে যা জানিয়েছি আমরা। বাইরের অবিশ্রান্ত প্রশংসার আবর্তেও আর্টিস্টের নিজের ভেতর জিইয়ে রাখতে হয় যে ‘নিরন্তর অসন্তোষ’, উদয়শঙ্করের চারিত্র্যের ভেতর রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন সেই আদর্শকে। সেই চিঠিতে অনর্গল, অবিরল ছিল উদয়শঙ্কর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের স্নেহ আর প্রবল ভালোলাগা। অথচ ৬ জুলাই, কলকাতায় এবং ৯ জুলাই, শান্তিনিকেতনে উদয়শঙ্করের নৃত্যানুষ্ঠানের পর সেই সহজ ভাবাবেগ বদলে গেল দ্রুত। ক্রোধান্বিত হলেন রবীন্দ্রনাথ।

১৩ জুলাই ধূর্জটিপ্রসাদকে ফের চিঠি লিখলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে পাওয়া গেল বিচলিত, ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথকে। যদিও উদয়শঙ্করের গুণ, প্রতিভা, তাঁর সাধনা, কৃচ্ছ্রসাধনা কোনোটির কথা বিস্মৃত হলেন না তিনি।  দুটি নৃত্যানুষ্ঠানেই বাহ্যত তিনি যে, বরণ করে নিয়েছিলেন উদয়শঙ্করকে, জানিয়েছিলেন স্নেহাশিস, সে বিষয়েও হয়তো প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল জনমানসে। চিঠিতে লিখলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘উদয়শঙ্করের গলায় মালা দিয়েছিলুম, মনে করিনি ব্যাপারটাকে এত অত্যন্ত সার্থক বলে কেউ মনে করবে। ওটা একটা সৌজন্যের অলঙ্কার, এ রকম অলঙ্কারে কিছু অত্যুক্তি থাকতে বাধ্য, ব্যবহারটাকে যথাযথ অর্থসই করার চেয়ে তাকে মানানসই করার দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়।’ বোঝা যায়, সেদিনের জনসমাবেশে স্বভাবতই বর্ষীয়ান, অগ্রজের দায়িত্বপালনকেই সমীচীন মনে করেছেন তিনি। যদি বা মনোভঙ্গি অথবা শিল্পরুচির ধারণায় থাকেও কোনো মতপার্থক্য, প্রকাশ্যে সে কথা বলা অশোভন মনে করেছেন তিনি। তবে তাঁর বৈদগ্ধ্য, প্রাজ্ঞতা যা সত্য তার বাইরে গ্রহণ করেনি কিছু। তাই মন দিয়ে পড়লে বুঝতে পারব, তাঁর আশীর্বচনেও দৃঢ় স্পষ্টতায় ব্যক্ত করেছেন তাঁর অকপট অভিমত।        

চিঠির পরবর্তী অংশে লিখলেন তিনি, ‘উদয়শঙ্করের শক্তি আছে দীপ্তি নেই। খুব পাকা রকমে চালচিত্র বানিয়েছে নানা ভূষণে, কেবল প্রতিমা আনতে পারেনি।’ অর্থাৎ, শিল্প তার আয়োজনের পূর্ণতাকে লাভ করলেও এখনও সম্পূর্ণ হয়নি তার প্রাণ প্রতিষ্ঠা। বললেন, ‘উদয়শঙ্করের সাধনা সুপ্রত্যক্ষ। এই সাধনার দুর্লভ অর্ঘ্য পেলে নটরাজ তার পরে বর দেবেন।’ জানালেন, ‘স্টেজে উদয়শঙ্করকে দেখেছি--- মনে হোলো যেন ঢিলে কাঁচুলিতে ষোড়শীকে দেখলুম। কাল শান্তিনিকেতনের ছোট মঞ্চে তার নাচ দেখলুম— নাচের সুঠাম সৌষ্ঠব স্পষ্ট দেখা গেল--- বুঝলাম লোকটা যথার্থই গুণী বটে। কিন্তু এই গুণপনাকেও ছাড়িয়ে উঠতে হবে।’ অর্থাৎ শিল্পের সাধনা লাভ করেছে পূর্ণতা কিন্তু তার প্রকাশে এখনও অনুপস্থিত কসরত-ভুলানো গরিমা।    

শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ, উদয়শঙ্কর ও সিমকি (ডানদিকে)

 

প্রায় সাত বছর আগে, শ্রাবণ ১৩২৬, জাপানযাত্রী-তে একটা উপলব্ধির কথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নাচ সম্পর্কে তাঁর ভাবনার একটি অভিমুখ স্পষ্টত বোঝা যায় সেখানে। লিখেছিলেন, ‘খাঁটি য়ুরোপীয় নাচ অর্ধনারীশ্বরের মতো— আধখানা ব্যায়াম, আধখানা নাচ; তার মধ্যে লম্ফঝম্ফ, ঘুরপাক, আকাশকে লক্ষ্য করে লাথি-ছোঁড়াছুড়ি আছে। জাপানি নাচ একেবারে পরিপূর্ণ নাচ। তার সজ্জার মধ্যেও লেশমাত্র উলঙ্গতা নেই। অন্য দেশের নাচে দেহের সৌন্দর্যলীলার সঙ্গে দেহের লালসা মিশ্রিত। এখানে নাচের কোনো ভঙ্গির মধ্যে লালসার ইশারামাত্র দেখা গেল না। আমার কাছে তার প্রধান কারণ এই বোধ হয় যে, সৌন্দর্যপ্রিয়তা জাপানির মতে এমন সত্য যে তার মধ্যে কোনো রকমের মিশল তাদের দরকার হয় না এবং সহ্য হয় না।’ দীর্ঘ পরিশ্রমে প্রাথমিকভাবে উদয়শঙ্কর বিদেশের শিল্পীদের সান্নিধ্যে, বৈদেশিক প্রতিবেশেই লাভ করেছিলেন তাঁর নৃত্যকলাকে। হয়তো ভিনদেশের ভিন্নরুচির স্পর্শ লেগে বিপন্ন করেছিল তাঁর নৃত্যকে, তাঁর অজ্ঞাতেই। রবীন্দ্রনাথ বেদনাবোধ করেছিলেন সেই জায়গাটিতেই।

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৩৩, অর্থাৎ শান্তিনিকেতনে উদয়শঙ্কর আসার প্রায় দু মাস পর রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখলেন, আত্মীয় ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরীকে। সেই চিঠিতে প্রকাশ পেল উদয়শঙ্করের নৃত্য প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ক্রোধ। লিখলেন, ‘উদয়শঙ্করের নাচের প্রধান গুণ হচ্চে এ নাচে তার আত্মশক্তি ও তার শিক্ষা দুইই মিলেছে। আঙ্গিক দিকে উৎকর্ষপ্রাপ্ত এ জিনিষটা— ভাবিক দিকে ক্ষুণ্ণ। ওর য়ুরোপীয় নৃত্যসঙ্গিনী সিমকি বাইজিদের যে ভাওবাৎলানোর নকল করেছে— সেই ভাওবাৎলানোতে ভাবের গভীরতা নেই— তাতে নারী অঙ্গে কামনার লহরীলীলা প্রকাশ পায়। কামনা উদ্রেকের দ্বারা মন ভোলানো আর্টের ইতর পন্থা। জাভাতে জাপানে এর লেশমাত্র আভাস পাইনি— এ ইন্দ্রিয়পরায়ণ ভোগলোলুপ চিত্তবিকার থেকে সম্ভূত। যে কল্পনাবৃত্তির উৎকর্ষ থেকে সৌন্দর্য্যসৃষ্টি হয় উদয়শঙ্করের নাচে এখনো তার অপেক্ষা আছে। প্রোগ্রামের আরম্ভেই সেদিন নৃত্যকলাকে বিশ্লেষণ করে ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গ চালনার বাহাদুরী দেখিয়েছিল, কোনো যথার্থ আর্টিস্ট্ এ কাজ করতে লজ্জা পেত— উপাদানকে উপকরণকে রূপসৃষ্টি যদি না ভোলে তবে তা সৃষ্টিই হয় না। উদয়শঙ্কর এখনো তা ভোলেনি, তার কারণ নদীপথের নুড়িগুলোর উপরে কল্পনানির্ঝরিণীর ধারা পূরো আনন্দে বইতে পারেনি।’

এই চিঠি নিশ্চয়ই দেখেননি উদয়শঙ্কর, কিন্তু ‘প্রবাসী’-র সংবাদ বা তাঁর সম্মুখে রবীন্দ্রনাথের বিশ্লেষণগুলিকে সুনিশ্চিত জেনেছিলেন তিনি। লক্ষ করব, তাঁর অনন্য চরিত্রের দিকটিকে। এই সমালোচনা রবীন্দ্রনাথের প্রতি বিরূপ করে তুলল না তাঁকে। প্রবাসীর প্রতিবেদনেও অনুল্লিখিত থাকেনি তাঁর এই চারিত্রিক গুণবৈশিষ্ট্যের কথা। সেখানে মুদ্রিত হল, নম্র প্রকৃতির লোক উদয়শঙ্কর। তাঁর কৃতিত্ব সমঝদারের কাছে পেয়েছে স্বীকৃতি। তবু তিনি মনে করেন, নৃত্যকলায় এখনও তাঁর অনেক শিক্ষণীয় এবং উদ্ভাবনীয় রয়েছে। আমেরিকা থেকে ফিরেই তিনি উদ্যোগী হবেন শিক্ষাগ্রহণের বিষয়ে। রবীন্দ্রনাথের প্রতি আজীবন শ্রদ্ধাশীল রইলেন উদয়শঙ্কর। কাজ করলেন রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকে নিয়েও। শিল্পীর অগোচরে কখনও কখনও তাঁর শিল্পকে স্পর্শ করে মালিন্য। কিন্তু সত্যিকারের শিল্পী তো তিনিই, যিনি নিজেকে দেখতে চান ‘নিরন্তর অসন্তোষ’ আর নিরন্তর পরিমার্জনেও।

Powered by Froala Editor