ছোটো ছিলেন তবু কথাটা বুঝেছিলেন অমলা

শঙ্কর সরণি- ২৭
আগের পর্বে

অমলার নাচের প্রতি আগ্রহ দেখে তাকে নিজের দলে নিলেন উদয়শঙ্কর। নতুন নাম রাখলেন, অপরাজিতা। নতুন নামকরণ হল দলের। ইউরোপের নানা জায়গায় ঘুরেছে উদয়শঙ্করের দল। জার্মানিতেও একাধিক অনুষ্ঠান করেছেন। কিন্তু কোনো সময়েই উপস্থিত থাকেননি হিটলার বা নাৎসি দলের কেউ। একবার তো হল্যান্ডে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর রোশের মুখেই পড়লেন। বিরাট বিরাট বাজনা দেখে তাঁরা ভেবেছেন এঁরা ব্যবসা করতে চলেছে। শেষ পর্যন্ত তিমিরবরণের বাজনা শুনেই মোহিত হলেন সীমান্তরক্ষীরা। সুরের কাছে বারবার হার মেনেছে সমস্ত ক্ষমতার দম্ভ।

তিরিশের দশকের প্রথমদিকে লন্ডনের স্ট্রান্ড থিয়েটারে তখন উদয়শঙ্করের অনুষ্ঠান চলছে নিয়মিত। সেদিন ছিল শেষ রজনী, উনিশতম দিন। কানায়-কানায় পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ। অনুষ্ঠান শুরুর ঠিক আগে, এক বয়স্কা ইংরেজ ভদ্রমহিলা এলেন উদয়শঙ্করের সঙ্গে দেখা করতে। বললেন, আজ এখানে তোমাদের অনুষ্ঠানের শেষদিন, তোমরা চলে যাবে, তাই এসেছি দেখা করতে। উদয়শঙ্কর কৃতজ্ঞ বোধ করলেন। এই বয়সে তিনি এসেছেন তাঁদের জন্য, এতখানি পরিশ্রম করে। তিনি অনুরোধ করলেন আগন্তুককে, কষ্ট করে যখন এসেছেন, আজ আপনি আমার অতিথি। আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি আমাদের অনুষ্ঠানে। ইংরেজ ভদ্রমহিলার মুখে ফুটে উঠল বিমল এক হাসির রেখা। ব্যাগ হাতড়ে কী যেন খুঁজছেন তিনি। তারপর সেদিনের অনুষ্ঠানের টিকিটটা উদয়শঙ্করের সামনে তুলে ধরে তিনি জানালেন এক অদ্ভুত কথা, শুনে বিস্মিত হয়ে গেলেন উদয়শঙ্কর। বললেন, তোমাদের অনুষ্ঠান দেখার এটি আমার উনিশতম দিন। প্রত্যেকদিন এসেছি আমি, দেখেছি প্রত্যেকটা শো। আশ্চর্য, একদিনও মনে হয়নি এটা পুনর্বার দেখছি। রোজই দেখি অথচ মনে হয়, এই প্রথমবার দেখছি।

ইউরোপ ভ্রমণের সময় একটি শো-এর কার্টেন কল হয়েছিল উনত্রিশটা। অনুষ্ঠান শেষ হলে উঠে দাঁড়িয়ে শিল্পীদের কুর্নিশ জানাতেন দর্শক-শ্রোতারা। কী অসামান্য ছিল তাঁদের শ্রদ্ধা জানানোর রীতি। করতালি অশেষ হয়ে বেজে চলত রঙ্গালয় মুখরিত করে। উচ্ছ্বসিত দর্শক ছুড়ে দিতেন ছোট্টো ছোট্টো ফুলের তোড়া। অনুষ্ঠান শেষে বাহারি ফুলে ভরে যেত মঞ্চ। মনে হত যেন পুষ্পবৃষ্টি হয়েছে এইমাত্র। এইরকমই একদিন উদয়শঙ্কর হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন পাদপীঠের আলোকবৃত্তে। মাথা নত করে গ্রহণ করছেন দর্শকের অভিবাদন। ঈষৎ সময় অতিক্রান্ত হলে ধন্যবাদজ্ঞাপনে তিনি শুরু করলেন কথা বলা। আর ঠিক সেই মুহূর্তে সামনের সারিতে বসে রয়েছেন যেসব মহিলারা, তাঁদের চোখ উঠল কপালে। বিস্ময়াভিভূত তাঁরা, অস্ফুটস্বরে বারংবার শুধু বলতে লাগলেন, He talks! He talks! তিমিরবরণ থেকে শুরু করে অমলাশঙ্কর এবং রবিশঙ্করও তাঁদের স্মৃতিচারণে জানিয়েছিলেন, বিদেশের দর্শক উদয়শঙ্করকে শুধুমাত্র একজন গুণী, আর্টিস্ট বা স্রষ্টা হিসেবেই দেখেনি, উদয়শঙ্করকে তাঁরা মনে করতেন দেবতুল্য, দেবোপম।

প্যারিসে সপুত্র হেমাঙ্গিনী। সঙ্গে সিমকি আর কনকলতা।

 

এত সাফল্য এত আনন্দ এত অর্জন তবু আঁধার ঘনিয়ে এল দুজন মানুষের মনে। হেমাঙ্গিনী আর তিমিরবরণ। দুটি ভিন্ন কারণে, কিন্তু অনিবার্য হয়তো এই ছন্দপতন। আজকের কথা হেমাঙ্গিনীকে নিয়ে। তখন ইউরোপ ভ্রমণের সময়, তাঁরা সকলে রয়েছেন মন্টে কার্লোতে। অমলাকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছেন হেমাঙ্গিনী। বেড়াতে-বেড়াতে এসে পড়েছেন একটা মস্ত উঁচু টিলার ওপর। চেয়ে দেখলেন নীচে বিপুল তরঙ্গ নিয়ে বয়ে চলেছে প্রকাণ্ড সমুদ্র। সমুদ্রে-আকাশে একাকার হয়ে আছে দিগন্ত। আকাশের গায়ে আজ কে উপুড় করেছে রঙের পাত্র। গাঢ় নীল, বেগুনি কখনও লালচে তো কখনও ঘন সবুজ অতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে নিয়ত সঞ্চরমান গগনতল। সময় নিলেন হেমাঙ্গিনী। গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলেন এই প্রকৃতি। তারপর হাঁটতে-হাঁটতে এসে বসলেন গির্জা সংলগ্ন ভূমিতে, একটি গাছের নীচে। পাশে বসলেন অমলা। চার্চের ভেতর থেকে ভেসে আসছে উপাসনার মন্দ্র স্বর। খুব নিবিড়, ধ্যানমগ্ন এক মুহূর্ত। নীরবতা ভেঙে কথা বললেন হেমাঙ্গিনী। অমলাকে বললেন, আর ভালো লাগছে না, আমি দেশে ফিরে যাব।

আরও পড়ুন
সুরের কাছে হার মেনেছে হাজার কথার হল্লা

তিনি ফিরে যেতে চান দেশে, অথচ অমলার সমস্ত দায়িত্ব অমলার বাবা অক্ষয় নন্দী দিয়েছেন তাঁকে। অমলা যুক্ত হয়েছেন দলে, এসময় আকস্মিক তাঁকেও নিয়ে ফিরতে চাইলে বিড়ম্বনায় পড়বেন উদয়। নৃত্যশিল্পীর অভাবপূরণে সদ্য নেওয়া হয়েছে এমনকি রবিশঙ্করকেও। দ্বিধায় পড়লেন হেমাঙ্গিনী। আত্মমগ্ন তিনি। যেন স্বগতোক্তির মতো করে বললেন, তোকে নিয়ে কী করি বলতো? তোর ওপর তো আমার দাবি নেই কোনো? অন্তর থেকে অমলাকে ভালোবেসেছিলেন হেমাঙ্গিনী। অন্তরের দাবি তো সামাজিক নয়, তিনি জানেন। শান্তস্বরে হেমাঙ্গিনী বলে চলেন, উদয় তো বিয়ে করবে না, না হলে তোর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে কাছে রেখে দিতাম তোকে। বিবাহের কথাকে গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করবার, তখন বয়স নয় অমলার। তবু হেমাঙ্গিনীর কথার মধ্যে অনুভূতি আর বাস্তবচিন্তা দুটোই বুঝলেন তিনি। হেমাঙ্গিনীকে তিনিও ভালোবেসেছিলেন খুব।

আরও পড়ুন
পিছনে ফিরে উদয়শঙ্কর সজোরে মারলেন এক ঘুঁষি

ট্রুপে নৃত্যশিল্পীরূপে যোগ দিলেন রবিশঙ্কর

 

আরও পড়ুন
রবিশঙ্কর: প্যারিস তাঁকে গড়েছে, করেছে বিভ্রান্তও

ইউরোপ ভ্রমণ সেরে ফিরেছেন তাঁরা। শুধু ফিরেছেন নয়, বলা উচিত, শিল্পের সাম্রাজ্যবিস্তার করেছেন তাঁরা।  বিজয়কেতন উড়িয়ে তাঁরা ফিরেছেন প্যারিসে। ১৯৩২ সালের শেষদিকে প্যারিসে এলেন সলোমান হ্যুরক। প্রখ্যাত ইম্প্রেসারিও। নতুন-নতুন শিল্পীর সন্ধানে আমেরিকা থেকে প্রায়ই ছুটে আসতেন এঁরা। অতুলনীয় ছিল এঁদের ব্যবস্থাপনা। এঁদেরই পরিকল্পনামতো তাঁদের দেশে পরিবেশিত হত অনুষ্ঠান। যেমন প্রভূতপরিমাণ ছিল সম্মানপ্রাপ্তি, তেমনি অগাধ ছিল অর্থসম্ভাবনা। দু-তরফেই। উদয়শঙ্করের অনুষ্ঠান প্যারিসে দুবার দেখলেন হ্যুরক। তারপর হল চুক্তি। তিনবারের চুক্তি স্বাক্ষরিত হল একসঙ্গে। উদয়শঙ্করের দল তিনবার যাবে আমেরিকা। প্রথমবার তিনমাস, দ্বিতীয়বার ছ-মাস এবং শেষবার ন- মাসের জন্য।

আরও পড়ুন
রবিশঙ্কর: বাবাকে প্রথম দেখলেন যখন তাঁর বয়স আট

হেমাঙ্গিনী জানিয়ে দিলেন উদয়কে, তিনি আর কোথাও যেতে চান না। তিনি ফিরবেন দেশে এবং অমলাকে সঙ্গে নিয়ে। উদয় পড়লেন মহা বিপদে। ক্ষুব্ধ হলেন অমলার ফিরতে চাওয়ার বিষয়টিতে। দলের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন অমলা। রাতারাতি এখন অন্য শিল্পী তিনি পাবেন কোথায়? সামনে তাঁর নতুন চুক্তি, নতুন প্রতিশ্রুতি, নতুন দায়িত্ব। অমলাকে দেশে ফেরার অনুমতি দেওয়া অসম্ভব তাঁর পক্ষে। পরিস্থিতি বুঝে দায়িত্ব নিলেন অমলা। চিঠিতে সমস্ত কথা অমলা খুলে জানালেন বাবাকে। সঙ্গে পরামর্শ দিলেন উদয়শঙ্করের উদ্দেশে লিখতে একটি চিঠি। তৈরি করে পাঠালেন তার বয়ানও।  বাবাকে বললেন, লিখবেন, অমলার মা অসুস্থ, যত শীঘ্র সম্ভব তাকে পাঠাবার বন্দোবস্ত করবেন। অক্ষয় নন্দী আদ্যন্ত বিচক্ষণ মানুষ। চিঠিতে যা লেখা আছে তা বুঝলেন তিনি, যেটুকু লেখা নেই, বুঝলেন তাও। চিঠি লিখলেন তিনি। দেশে ফেরার জাহাজে উঠলেন অমলা আর হেমাঙ্গিনী।

কনকলতা, উদয়শঙ্কর, সিমকি ও সলোমান হ্যুরক

 

টানা প্রায় দু সপ্তাহ তাঁরা রইলেন জাহাজে। স্বজন-পরিজন থেকে বহুদূর। বহু পরিচিত ঘরকন্না পড়ে রইল পিছে। হেমাঙ্গিনী তখন কিশোরী যখন উদয় এল তাঁর গর্ভে। নিতান্তই বছর বারোর। তারপর বত্রিশটা বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। সন্তান সংলগ্নতায় কেটেছে তাঁর জীবন। তাঁদের প্রতিপালনকেই নিজের জীবন মেনেছেন হেমাঙ্গিনী। এই প্রথম সন্তানদের থেকে বহুদূর তিনি চলেছেন স্বদেশ। নিজ ভূমে। এই প্রথম ছকে ঢালা জীবনের আয়ত্ত থেকে তিনি শতসহস্র দূরে। ভাসমান। ভাসমান অনন্ত সময়। এই ধূ-ধূ উধাও স্রোতের হাওয়া স্পর্শ করল হেমাঙ্গিনীর অন্তর্লোক। ভাসিয়ে নিয়ে গেল সব। চিরদিনের অন্তর্মুখী হেমাঙ্গিনী। নিজের ভেতরটাকে আগল দিয়ে রাখাই যাঁর চিরদিনের স্বভাব, শক্ত চাবি-আঁটা সেইসব কুঠুরি, কোন বাতাসে, আজ খুলে গেল আলগা হয়ে। আঁধারে এক নিবিড় রাতে নিজেকে তিনি প্রকাশ করলেন নিঃসংকোচ। সহজ, আন্তরিক নিঃসম্পর্কিত এই কিশোরীর কাছে।

হেমাঙ্গিনীর একলা মুহূর্তে কখনও-কখনও তাঁর গাওয়া, একটা গান কানে ভেসে আসত অমলার। ‘জীবনে যত পূজা হল না সারা/ জানি হে জানি তাও হয়নি হারা।/ যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে/ যে নদী মরুপথে হারাল ধারা/ জানি হে জানি তাও হয়নি হারা।’ আজ তিনি বললেন, ভূপেন্দ্রর মৃত্যুর কথা। মরমী, সুদর্শন এক যুবক। একদিন হারিয়ে গেল দুম করে। হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। মায়ের হৃদয় থেকে উপড়ে নেবে সে সাধ্য কার? আঁধার ঘনিয়ে আছে বলেই বোধহয়,  জগৎ-সংসার শত কলরব মিছে করে আজ তিনি বললেন, তাঁর স্বামীর কথা। একবার দুই সন্তানকে নিয়ে ফিরছেন স্বামীর কাছে। পথে খবর পেলেন, নতুন স্ত্রী-কে নিয়ে তাঁরই ঘরে স্বামী পেতেছেন নতুন সংসার। সয়নি মুহূর্তের বিলম্ব। পথ থেকেই ফিরে গেলেন বাপের কাছে। কিন্তু সেকেলে যুগ। মেয়েদের মনের খবর বোঝার বিড়ম্বনা থেকে যোজন দূরত্বে নিজেদের রাখত সমাজ, স্বজন। মা হারা তিনি। বিধবা দিদিমা কর্ত্রী সংসারে। পাঠিয়ে দিলেন স্বামীর কাছে। স্বামী বলে কথা। কত রকমের পরাজয়কে বুকে বিঁধে, তার কর্তব্যের ঘেরাটোপে ছদ্ম প্রসন্নতায় বেঁচে থাকতে হয় একটি মেয়েকে। ফিরলেন, তবে স্বামীর ঘরের থেকে দূরে, পাতলেন স্বতন্ত্র সংসার। সেই থেকেই হয়তো নির্বিশেষভাবে পুরুষ বিষয়ে তাঁর ভাবনায় তৈরি হয়েছিল, একটা অনাস্থা। একটা সংশয়। অকপটে, ধীর স্বরে জানালেন অমলাকে, কেন যে তোকে ফিরিয়ে আনলাম, সে তুই এখন বুঝবি না।           ছোটো ছিলেন তবু কথাটা বুঝেছিলেন অমলা। বিদেশের হাওয়া অবিচলতার ভূমি কাঁপিয়ে উজান পথে বয়, অজ্ঞাতেও যদি ভুল হয়ে যেত কিছু। বিবাহের পর নিজের সেই উপলব্ধির কথা, অমলা জানিয়েছিলেন তাঁর স্বামীকে। বলেছিলেন, আপনার কাছে আসতে হবে বলেই, সেদিন অমন করে সরে যেতে হয়েছিল আমাকে।  

Powered by Froala Editor