পিছনে ফিরে উদয়শঙ্কর সজোরে মারলেন এক ঘুঁষি

শঙ্কর সরণি - ২৫
আগের পর্বে

কাশী থেকে বোম্বে হয়ে রবিশঙ্কর পৌঁছলেন প্যারিসে। স্কুলে ভর্তি হলেন। সেখানে তিনি ছাড়া সবাই ফরাসি। অথচ কিছুদিনের মধ্যে রবিশঙ্করই হয়ে উঠলেন সবার সর্দার। উদয়শঙ্করের দলের সঙ্গে ঘুরেছেন আরও নানা দেশ। প্যারিসে থাকতেই জাঁকিয়ে বসেছিল সিনেমার নেশা। আমেরিকা ভ্রমণের সময় তা আরও প্রকট হল। বিখ্যাত অভিনেত্রী মেরি ড্রেসলার নাকি তাঁকে দত্তক নিতে চেয়েছিলেন। উদয়শঙ্কর বাধা দেওয়ায় কেঁদে ভাসিয়েছিলেন রবিশঙ্কর। আর প্যারিস তো তখন সারা বিশ্বের গুণীজনদের তীর্থক্ষেত্র। কত না নক্ষত্রের সঙ্গে ওঠাবসা ছোটো থেকেই। তবে এইসব অসাধারণ স্মৃতির মধ্যেও থেকে গিয়েছিল একটু আক্ষেপ। সবসময় বড়োদের সঙ্গে থেকে তিনি বড়োদের জীবনই প্রত্যক্ষ করেছেন। শৈশবের অভিজ্ঞতা হয়নি কখনও সেভাবে। কখনও কেউ হাতে ধরে শিখিয়েও দেননি কিছু। নিজেকে গড়ে তুলেছেন নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই।

১৯৩১-এর ২৯ ডিসেম্বর শুরু হল যাত্রা। উদয়শঙ্কর তাঁর দল নিয়ে প্যারিস থেকে গেলেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। জার্মানি, বেলজিয়ম, হল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, সুইটজারল্যান্ড, ইতালি ও দক্ষিণ ফ্রান্সের বড়ো বড়ো শহরে আট মাস জুড়ে প্রদর্শিত হবে উদয়শঙ্করের নৃত্য। সঙ্গে রইলেন ইম্প্রেসারিও হফম্যান আর ম্যানেজার বোগনার। নেওয়া হল একটা অটো বাস। গাড়ির সামনে ছিল আরামদায়ক বসবার বন্দোবস্ত। বাকি অর্ধেক জুড়ে রইল আশি রকমের বাদ্যযন্ত্র।

নৃত্য তো চললই, তার সঙ্গে চলল হরেক কাণ্ডকারখানা। আজ গল্প সেইসব নিয়ে। একবার অনুষ্ঠান ছিল বেলজিয়মের লিজ শহরে। তাঁদের থাকার বন্দোবস্ত  হয়েছিল মস্ত এক হোটেলে। হোটেলখানা দেখামাত্র ভালো লেগে গেল সকলের।  চারিদিক সুসজ্জিত। পরিপাটি। বিশাল বিশাল ঘর। প্রকৃতির মাঝে একেবারে খোলামেলা চারধার। কিন্তু ঘর পাবার সময় ঘটল এক উলট কাণ্ড। হোটেলে পর্যাপ্ত, সুন্দর সব ঘর থাকা সত্ত্বেও উদয়শঙ্করদের বিশেষভাবে দেওয়া হল অত্যন্ত সাধারণ মানের ঘর। আশ্চর্য বোধ করলেন উদয়শঙ্কর। ম্যানেজারের কাছে জানতে চাইলে, ধেয়ে এল এক অদ্ভুত উত্তর। তিনি জানালেন, এ হোটেলের মালিক এবং তাঁরা সকলে ব্রিটিশ। আর ভারতবর্ষ এখন ইংরেজ-শাসনাধীন। ফলত, প্রজা হয়ে ইংরেজের হোটেলে উপযুক্ত আপ্যায়নে তাঁরা অনধিকারী। উদয়শঙ্করের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। তিনি ফোন করলেন ব্রিটিশ কনসালকে। উপরমহল থেকে তৎক্ষণাৎ ছুটে এল লোক। ম্যানেজারকে শাসালেন তিনি। আজ যে-শিল্পীকে দেখতে নানান প্রান্ত থেকে ছুটে আসছে মানুষ, তাঁর প্রতি এমন অনুচিত আচরণ করার সাহস তিনি পেলেন কোথায়? এসব বোধবুদ্ধি তিনি জোটালেন কোথা থেকে? ক্ষমা চাইলেন অনুতপ্ত ম্যানেজার। খুলে দেওয়া হল হোটেলের সুন্দর সুন্দর সব ঘর-দোর। যথোচিত সম্মান আর অভ্যর্থনায় গ্রহণ করা হল উদয়শঙ্করের দলকে।

 বাঁদিক থেকে তিমিরবরণ, বিষ্ণুদাস শিরালী, সিমকি। ডানদিকে কনকলতা।

 

একবার তাঁরা ছিলেন জার্মানির ন্যুরেনবার্গ-এ। এখান থেকে পরবর্তী অনুষ্ঠান প্রাগ-এ। বেরোতে হবে পরদিন ভোরে। কিন্তু আটকে রইল সব। ন্যুরেনবার্গে যে রঙ্গালয়ে ছিল তাঁদের অনুষ্ঠান, সেখান থেকে তাঁদের হোটেল অদূরবর্তী। আর ঠিক তার পাশেই ছিল এক ক্যাবারে। অনুষ্ঠান শেষে সবাই চলেছে হাঁটতে-হাঁটতে। কথা বলতে-বলতে। সকলে ছড়িয়ে রয়েছে এদিক-সেদিকে। পেছনে উদয়শঙ্কর তিমিরবরণ। আগে আগে চলেছেন কনকলতা। উদয়শঙ্কর আর তিমিরবরণ দুজনেই আচম্বিতে খেয়াল করলেন একটা মুহূর্ত। ওই ক্যাবারে থেকে বেরিয়ে এল এক জার্মান, কনকলতার পাশ দিয়ে যাবার সময় যেন সে স্পর্শ করল কনকলতাকে। অন্যমনস্কতায় নয়। ইচ্ছাকৃত অভব্যতায়। সেই ব্যক্তির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন  উদয়শঙ্কর, তিমিরবরণ। অক্ষম্য সেই আচরণের সম্পূর্ণ শাস্তিটুকু চুকিয়ে তবে থামলেন তাঁরা। পরদিন যখন প্রাগ-এর জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন সকলে, খবর এল, অপেক্ষা করছে পুলিশ।

আরও পড়ুন
রবিশঙ্কর: প্যারিস তাঁকে গড়েছে, করেছে বিভ্রান্তও

উদয়শঙ্কর, তিমিরবরণ এলেন। দেখলেন পুলিশের সঙ্গে রয়েছে আহত এক ব্যক্তি। ক্ষত-বিক্ষত তার চেহারা। উদয়শঙ্করদের দেখা মাত্র সে বলে উঠল, গতরাত্রে এঁদের আচরণেই তার এই হাল। যার-পর-নাই বিস্মিত হলেন তিমিরবরণ আর উদয়। পুলিশ জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন। উদয়শঙ্কর পুরো ঘটনার কথা জানিয়ে স্বীকার করলেন, গতকাল রাত্রে তাঁরা প্রহার করেছেন এক ব্যক্তিকে। কিন্তু এ ব্যক্তি সে নয়। দ্বিতীয়ত, এতদূর আঘাতও তাঁরা করেননি সেই দুর্বৃত্তকে। সেই পুলিশ চৌখস। পুরো ব্যাপারখানা মনে মনে জরিপ করে নিতে বিলম্ব করলেন না তিনি। বুঝলেন সে কাণ্ড ঘটিয়েছে ওই ক্যাবারের ম্যানেজার। তারপর মিথ্যা লোক আর ঘটনা সাজিয়ে হাজির করেছে পুলিশের কাছে। উদয়শঙ্করদের তখন ধুম তাড়া। তার মধ্যে এই ঝঞ্ঝাট। পুলিশ বুঝল পুরো ব্যাপারকে আদ্যোপান্ত মেটাতে বিড়ম্বনা বাড়বে বই কমবে না। কিছু তুচ্ছ আইনি জরিমানার ছল করে পুলিশ তাঁদের মুক্তির বন্দোবস্ত করল দ্রুত।

আরও পড়ুন
রবিশঙ্কর: বাবাকে প্রথম দেখলেন যখন তাঁর বয়স আট

কনকলতা

 

আরও পড়ুন
রবিশঙ্কর: সেই থেকে তৈরি হয়েছিল একটা অ্যান্টি- ফাদার ফিলিং

অনেকদিন আগের একটা ঘটনা এ-কথার খেই ধরে। পিতাল্যুগা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তখন চুক্তি স্থির হয়েছে ত্রয়ী বা ট্রায়ো-র। অর্থাৎ শকি, অ্যাডলেড এবং উদয়শঙ্করের। সেই তাঁর সংগ্রামের দিনগুলো। তীব্র অর্থাভাবে তখন কাটছে দিন। বিদেশে নিজস্ব ব্যয়ভার বহন করতে বাধ্যত তাঁকে নৃত্য পরিবেশন করতে হয়েছে বিভিন্ন ক্যাবারে-তে। রুচির ধার ধারে না এমন সব জমায়েত। পরিশীলনের বোধ থেকে অনন্ত দূরত্বে গজিয়ে ওঠা সেইসব জমায়েত। ধীরে ধীরে যোগাযোগ হল নৃত-সংগীত কেন্দ্রগুলিতে। অনুষ্ঠান শুরু হল শহরের পরিচিত, প্রতিষ্ঠিত ক্ষেত্রগুলিতে। মিলান শহরে সেদিন অনুষ্ঠান তাঁদের। পরবর্তী অনুষ্ঠান এই ট্রায়োর। দুই কন্যেকে নিয়ে উইংসের ধারে অপেক্ষা করছেন উদয়। হঠাৎ খেয়াল করলেন তিনি, আয়োজকদের মধ্যে কেউ একজন অ্যাডলেডের সঙ্গে কথা বলতে-বলতে যেন ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে অযাচিতভাবে। অশোভন দাবিতে স্পর্শ করতে চাইছে তাঁকে। অনুষ্ঠানের বাকি তখন কয়েক মুহূর্ত। ঠিক-ভুল সময়-অসময় এসব বিচার-বিবেচনা কাজ করল না উদয়শঙ্করের। অ্যাডলেডের নিঃশব্দ অসহায়তা দ্বিগুণ করে তুলল তাঁর ক্রোধকে। উইংসের আড়ালেই দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে একেবারে ধরাশায়ী করলেন তাকে। আহত বাঘের হুঙ্কার দিয়ে সাময়িক বিদায় নিল সে।

আরও পড়ুন
আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাইনে তোমারে

অনুষ্ঠানশেষে নিজেদের পারিশ্রমিক নিতে গিয়ে চমকে উঠলেন উদয়শঙ্কর। সেই ব্যক্তিই স্বয়ং অনুষ্ঠানের এক কর্মকর্তা। পারিশ্রমিক নিতে হবে তার কাছ থেকেই। তিনজনেই দাঁড়িয়ে রইলেন স্থির। দূরে। ওই হাত থেকে পারিশ্রমিক নেওয়ার অভিরুচি নেই কারোর। কিন্তু তাঁদের তিনজনকেই অবাক করে নিজেই এগিয়ে এল সেই ব্যক্তি। নিজের শরীরে আঘাতের চিহ্নগুলির ওপর হাত রেখে উদয়শঙ্করের দিকে চেয়ে খানিক হাসল সে। বলল, একথা আমাকে মানতেই হবে, খুবই শক্তিশালী তুমি। তারিফযোগ্য তোমার পৌরুষ। আমি অনুতপ্ত। তারপর শকি আর অ্যাডলেডের দিকে ফিরে বলল, তোমাদের বন্ধুটি বিলক্ষণ যোগ্য অভিভাবকও। নৃত্যের সঙ্গে নমনীয়তাকে চিরদিন মিলিয়ে ভেবেছে মানুষ। শুধু দেহে নয় চারিত্র্যেও থাকে ক্ষাত্রধর্মের তেজ, শক্তি।

উদয়শঙ্করের সঙ্গে শকি আর অ্যাডলেড

 

কথার ফেরে চলে আসে আরো একখানা কথা। উদয়শঙ্কর তখন সবেমাত্র ফিরেছেন আনা পাভলোভার সঙ্গে ন-মাসের পরিভ্রমণ সেরে। কোথাও যেতে একদিন উঠলেন বাসে। হুড খোলা এক ডবল ডেকারে। গিয়ে বসলেন খোলা ছাদের দোতলায়। হু হু হাওয়া দিচ্ছে সুন্দর। সামনের সিটে বসে এক ইংরেজ। নাগরিক কর্তব্যজ্ঞান তার বিন্দুমাত্র নেই বলতে হবে। বাসে বসেই জোরে জোরে সে থুতু ফেলছে বাইরে। হাওয়ার মুখে তা ছড়িয়ে গিয়ে এসে ছিটছে খানিক উদয়ের গায়ে। উদয় অত্যন্ত শান্তভাবে বিষয়টি বুঝিয়ে, এমন আচরণ করতে নিষেধ করলেন তাকে। কিন্তু সে একেবারে বাধিয়ে দিলে হাঙ্গাম। অশ্রাব্য কটু কথার বাণ ডাকল তার ভাষায়। ব্লাডি নিগার, বিদেশি, আমাদের দেশে এসে আমাদেরই শিক্ষা দেবে তুমি? উদয় বুঝলেন নিদেন চাপান-উতরেরও যোগ্য নয় এ ব্যক্তি। পথ এগোলেন তিনি। কিন্তু নাছোড় সে। উদয়ের পিছু নিয়ে অশোভন ব্যবহারে সে শোনাতে-শোনাতে চলল কদর্য সব কথা। কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়ালেন উদয়শঙ্কর। তারপর পেছন ফিরে সজোরে তাকে মারলেন এক ঘুঁষি। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে রণে ভঙ্গ দিল সে। স্থৈর্য যে দুর্বলতা নয়, শক্তিরও ধর্ম, সেকথা সেদিন হাড়ে-মজ্জায় টের পেয়েছিল সে।

জর্জ হ্যারিসন-এর সঙ্গে  রবিশঙ্কর

 

রবিশঙ্করের একটা উপলব্ধি এ কথার সূত্র ধরে মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন, সময়-সময় উদয়শঙ্কর ঘুঁষির সদ্ব্যবহার করতেন ঠিকই, তবে এতদিন বিদেশে থাকতে-থাকতে ওঁর মধ্যেও পেয়ে বসেছিল একটা জেদ। হয়তো কোনো উচ্চ অভিজাত অথবা অমিত ধনশালীদের হোটেল, রীতি-কানুনের বিষয়ে জো নেই পান থেকে চুন খসবার। পোষাক-আশাক আদব-কায়দার ব্যাপারে তারা কঠোরভাবে মান্য করে চূড়ান্ত নিয়মগুলিকে। কিন্তু উদয়শঙ্করকে বাঁধবে কার আছে তেমনি বাঁধন? বিশেষত, ঠিক সেইসব জায়গাগুলোতেই আরো বেশিরকম তিনি পড়বেন ভারতীয় পোষাক, একেবারে ধুতি পাঞ্জাবি। কোট-প্যান্ট পরা নিয়মমতো সাহেবসুবোদের মাঝে তিনি উপস্থিত হবেন মূর্তিমান খাপছাড়া হয়ে। দেশীয় পোশাকে সগর্বে তারিয়ে-তারিয়ে উপভোগ করতেন নিজের দলছুট স্বভাব। স্রোতের প্রতিকূলে হাঁটতে গেলে তার সমস্ত শক্তি আর আনন্দকে যে সৃষ্টি করে নিতে হয় নিজেকেই। এসব ব্যপারে কখনও-সখনও লেগে যেত মৃদু হাতাহাতিও। কখনও-সখনও সেসব হাতাহাতিকে আন্তরিক আহ্বান জানাতে বিন্দুমাত্র পিছপা হতেন না উদয়শঙ্কর নিজেও।

কী সুন্দর করে রবিশঙ্কর বলেছিলেন, ‘...উনি বিলেতে অতদিন ছিলেন বলেই এত বেশি ভারতীয় হয়ে গেলেন’। দেশে দাঁড়িয়ে স্বদেশির কাছে দেশের অমর্যাদা এমনিই সয়ে যায়। অনুভূতির ধার মরে, হয়ে যায় পানসে। কিন্তু দেশকে যিনি প্রতিমুহূর্তে  প্রাণময় করে প্রতিষ্ঠা করেছেন ভিনভূমিতে, দেশ বয়েছে তাঁর তামাম চেতনায়। শুধু শিল্পে নয়, আচারে-ব্যবহারে-ধরন-ধারনে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন দেশকে। তার মর্যাদাকে, তার নিজস্বতাকে। তবে একথায় মনে পড়বে, যে-বালক দশ বছর বয়সে পৌঁছলেন প্যারিস, তারপর আজীবন বিদেশের মাটিতে দেশীয় সংস্কৃতির সপ্তসিন্ধু বইয়ে দিলেন দশদিগন্তে, সেই রবিশঙ্করকেই বা পাজামা-পাঞ্জাবি ছাড়া দেখা গেছে ক-বার?  

Powered by Froala Editor