শঙ্কর সরণি -১৮
আগের পর্বে
তিমিরবরণের সরোদের সুরে মুগ্ধ হয়েছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথ। তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন মাইহার থেকে ফিরে বিশ্বভারতীতে যোগ দিতে। কিন্তু আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের কাছে তাঁর শিক্ষা সম্পূর্ণ হল না। এক অনুষ্ঠানে উদয়শঙ্করের নৃত্যে মুগ্ধ হলেন তিমিরবরণ। তাঁকে আমন্ত্রণ জানালেন শিবু ঠাকুরের গলির বাড়িতে। সেখানে মাইহার ব্যান্ডের অনুকরণে তিমিরবরণ তৈরি করেছেন এক পারিবারিক মজলিস। উদয় এবং অ্যালিস সেই বাড়িতে চেনা-অচেনা নানা বাদ্যযন্ত্র দেখলেন। মুগ্ধ হলেন তিমিরবরণের প্রতিভায়। উদয়ের দলে যুক্ত হলেন আরও এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তবে তিমিরবরণ ভট্টাচার্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারতেন নিজের একক শিল্পের জোরেই। এই যৌথতার ফলে এক শিল্পীর উত্থান যেমন হল, তেমনই ঢাকা পড়ে গেল আরেক প্রতিভা।
উদয়শঙ্করের কাকা হলেন কেদারশঙ্কর। তাঁরই কন্যা কনললতা। ডাক নাম মীনা। কনকলতা দেখতে ভারি সুন্দর। দীঘল দুটো চোখ, টলটলে মুখখানা। যেন রবি বর্মার ছবি। দল গড়বার তোড়জোড়ের সময় তাঁকে ডেকে পাঠালেন উদয়শঙ্কর। মীনার মামারবাড়িও কাশীতে। প্রথম দিন মীনা এলেন যেন সাক্ষাৎ কাঠের পুতুল। সবাই তাঁর অপরিচিত। গল্পগাথা বহু শুনলেও, জ্ঞান হওয়া অবধি তিনি উদয়কে চোখে দেখেননি কখনও। তায় সঙ্গে মেমসাহেব। চোখ-মুখ-হাত নাড়া ভিন্ন যার সঙ্গে কথা বলার আর কোনো উপায় তাঁর জানা নেই। মীনার মনে হল প্রাণপণে যদি পালানো যায় এখান থেকে। সবচেয়ে গোল বাধল খাবার সময়। খাবারের যে এত ঝক্কি, সে কে জানত। কাঁটা-চামচ-রুমাল-প্লেট আর তার বিবিধ ব্যবহার বিধি নিয়ে তোলপাড় সব। মীনা গ্রামের মেয়ে, গ্রামভিন্ন তাঁর দেখা হয়নি কিছু, কখনও যাওয়া হয়নি কোথাও। ফলে পেটের খিদে পেটেই রইল। মেমসাহেব তাঁকে আন্তরিকভাবে কিছু বললেন, কিন্তু তিনি তার মাথামুন্ডু কিছু বোঝেননি। শেষে উদয় যখন বললেন, মীনা, তুমি হাতেই খাও না, ক্ষতি কী? কথাটা সামান্য বটে, কিন্তু চোখে আর বাঁধ মানল না জল।
বিকেলে অ্যালিস বোনার আর কনকলতাকে নিয়ে উদয় গেলেন মিনার্ভা থিয়েটারে ‘মেবার পতন’ দেখতে। রাত্রে কেদারশঙ্কর ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন মীনাকে। আগামীকাল ফের তাঁকে আসতে বললেন উদয়। পরের দিন তাঁকে নিয়ে গেলেন আউট্রাম ঘাটে। আজও সঙ্গে রয়েছেন বোনার। ধীরে ধীরে আড়ষ্টতা কাটতে শুরু করল কনকলতার। দেখা দিতে লাগল একটা সহজতা। একটা আপন-আপন ভাব। একদিন উদয় বললেন, মীনা, আমার ইচ্ছে তুমি আমাদের সঙ্গে প্যারিস চলো। তুমিও আমাদের সকলের সঙ্গে নাচবে। আমি নিজে তোমাকে নাচ শেখাব। যাবে আমাদের সঙ্গে? এই কদিনে উদয়শঙ্করের মতো মস্ত এক মানুষটির পরিচয়ের গাম্ভীর্য থেকে সরে গিয়েছে তাঁর ভীতি, জড়তা। তার বদলে গড়ে উঠেছে একটা আত্মীয়তা। এখন উদয়শঙ্করকে তিনি বেশ ভাবতে পারেন, তাঁর দাদা বলে। কনকলতা জানালেন, বাবার অমত না-থাকলে তিনি যাবেন। নিশ্চিন্ত হলেন উদয়। ভাবলে অবাক হতে হয়, দল গড়ার কাজে উদয়শঙ্করের স্থিরপ্রজ্ঞ পরিকল্পনাটি লক্ষ করে। তাঁর দূরদর্শিতা একদিকে গ্রহণ করতে চেয়েছে তিমিরবরণকে, অন্যদিকে কনকলতাকেও। দলের অণুবিশ্ব আর মহাবিশ্ব দুটোকেই তিনি দেখতে চেয়েছেন নিপুণ ভারসাম্যে।
এই সময় তাত্ত্বিক-সংগীতজ্ঞ দিলীপকুমার রায়কে লেখা উদয়শঙ্করের দুটো চিঠি রয়েছে। সেই চিঠিতে একদিকে পাওয়া যায়, তাঁকে নিয়ে সমকালীন বঙ্গীয় মনোভাবটি, অন্যদিকে, তিমিরবরণের প্রতিভা সম্পর্কে তাঁর শ্রদ্ধা আর স্বীকৃতির চিত্রটিও। দুটো চিঠিরই খোঁজ রয়েছে অরুণ চট্টোপাধ্যায়ের সুলিখিত ‘সুরপ্রেমিক তিমিরবরণ’ প্রবন্ধে। তার মধ্যে একটি মুদ্রিত মূল ইংরেজিতে অন্যটি স্বয়ং প্রাবন্ধিকের অনুবাদে। উদয় লিখলেন, ‘I regard myself as lucky in having Timirbaran with me… I have been travelling through India for the last seven months, but was never so much impressed as by his music. He is really wonderful with his Sarode. When I came to India I never dreamt of a decent Indian Orchestra, Timirbaran’s Orchestra that lately accompanied by my dances in Calcutta made me change my mind’।
আরও পড়ুন
মাইহারে অসম্পূর্ণ রইল তিমিরবরণের শিক্ষা
অন্য একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘৩রা মার্চ আমার প্রথম অনুষ্ঠান সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হল। মাতৃভূমি ত্যাগ করে য়ুরোপ যাত্রার প্রাক্কালে তথাকথিত সংগীতজ্ঞদের অনেকেই আমার সম্বন্ধে বিরূপ মন্তব্য প্রকাশ করেছিলেন। হিন্দু-সঙ্গীতের সাফল্যের বিষয়েও তাঁরা অত্যন্ত সন্দিহান ছিলেন। একঘেয়ে সঙ্গীতের পরিবর্তে পাশ্চাত্যজগতে ভারতীয় সঙ্গীতের সুচারু ও প্রকৃত রূপ তুলে ধরার জন্য আমার দীন প্রচেষ্টার প্রতি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস ছিল না। ভারতের মহান ওস্তাদদের কোনো সুপরিচিত ঘরানার উত্তরাধিকার ছিল না আমার তরুণ যন্ত্রীদলের দখলে। এইসব অক্ষমতা সত্ত্বেও আমি গর্বিত এই দেখে যে, আমার নৃত্যাভিনয় অপেক্ষা সঙ্গীতাংশ অধিক প্রশংসা লাভ করেছে। মালকোষ রাগে সরোদ সহযোগে তবলা-তরঙ্গ শ্রোতাদের কাছে সর্বাপেক্ষা পছন্দের মনে হয়েছে। অর্কেস্ট্রা ও নৃত্যাভিনয়ের সম্পূর্ণ সুর সৃষ্টি করেছেন তিমিরবরণ। সব সম্মান তাঁরই প্রাপ্য’। লক্ষণীয়, তাঁর চালচিত্রেও তিমিরবরণের প্রতিভা আকর্ষণ করে নিয়েছে স্টেজের সমস্ত আলোকচ্ছটা। দর্শক-শ্রোতার কাছে অধিক আদৃত হয়েছে তা। খ্যাতির অমন উচ্চস্তরে থেকেও একথা গ্রহণ করার মতো অহংশূন্য চারিত্র্য আর দার্ঢ্য আমাদের বিস্মিত করে। এত এত বিশিষ্ট মানুষজন জীবনের নানা পর্বে নিঃশর্তে ভালোবেসেছেন তাঁকে, পাশে থেকেছেন ভালো-মন্দ, লাভ-ক্ষতির বাইরে দাঁড়িয়ে। অনুমান করতে পারি, সে নিশ্চয় শুধুই তাঁর কর্মনৈপুণ্যে নয়। তাঁর স্বচ্ছ, ঋজু, অনুরক্ত স্বভাবের অমোঘ জাদুটিও নিশ্চয়ই পালন করে থাকবে সক্রিয় ভূমিকা।
আরও পড়ুন
সুরের ঝরনাধারার নির্জনে ছিল এঁদের বাস
আরও পড়ুন
তাঁর জীবনে দেশ এল, বিদ্বেষের ধারাটি সঙ্গে নিয়ে
দল তৈরি হল। উদয় প্যারিসে ফিরবেন তাঁর নিজের তৈরি দল নিয়ে। ফিরবেন, দেশে সংগৃহীত তাঁর বিপুল বাদ্যযন্ত্রের সম্ভার নিয়ে। রবিশঙ্কর জানিয়েছিলেন, উদয়শঙ্কর ‘৩৫০ রকমের ভারতীয় instrument জোগাড় করেছিলেন including Folk, Classical Drums instrument— সব নিয়ে যাওয়া হল।’ দলে পরিবারের সবাইকে নিলেন উদয়। মা হেমাঙ্গিনী, ভাই রাজেন্দ্রশঙ্কর- দেবেন্দ্রশঙ্কর- রবীন্দ্রশঙ্কর, কাকা কেদারশঙ্কর, তাঁর কন্যা কনকলতা। এক মামা যাবেন, ব্রজবিহারী। আর যাবেন অন্নদাচরণ ভট্টাচার্য। তিনি দেবেন্দ্রশঙ্করের বন্ধু, ডাক নাম বেচু। গান অথবা বাজনা অল্পবিস্তর জানতেন তিনি। আর তিমিরবরণ তো আছেনই, দলের মধ্যমণি। এই দলটি যখন প্যারিস পৌঁছবে, তখন প্রকাশ্য রাস্তা-ঘাটে সম্বোধনের ক্ষেত্রে দেখা দিত এক মজার সমস্যা। সেদেশে ‘মামা’ মানে ‘মা’। ফলত পূর্ণবয়স্ক যুবকেরা ততোধিক প্রৌঢ় একটি মানুষকে মা সম্বোধন করতেন দেখে চমকে উঠতেন সে দেশের মানুষ। অন্যদিকে ফ্রেঞ্চে ‘কাকা’ শব্দের অর্থ ‘বিষ্ঠা’। সেটা উচ্চারণেও কাজ করত অস্বস্তি। সেইজন্য সেই সময় থেকে উদয়রা সকলে মামা ব্রজবিহারীকে ডাকতেন ‘মাতুল’ আর কাকা কেদারশঙ্করকে ‘চাচা’।
আরও পড়ুন
যা আমি খুঁজছিলাম, সেই সমস্ত কিছু ধারণ করেছিল উদয়
জাহাজ ছাড়ল বিদেশের উদ্দেশে। নিজেকে যেন পূর্ণ করে পেলেন উদয়। সঙ্গে তাঁর পরিবার। সঙ্গে তাঁর দুই পরিজন, যেন তাঁরই অন্যতর সত্তা। তাঁর শিল্পীমানসের পরিপূরক অ্যালিস বোনার আর তিমিরবরণ। সেইসঙ্গে রইল দুর্লভ প্রাপ্তি গুরু শঙ্করণ নাম্বুদ্রীর আশ্বাস, তাঁর আশিস। রইল সেই দুর্মূল্য সঞ্চয়, বহু বাধা পেরিয়েও তাঁকে ভালোবেসেছে তাঁর দেশ। তাঁকে স্বীকার করেছে তাঁর জন্মভূমি।
জাহাজের ডেকে সারাদিন ঘুরে বেড়ান সকলে। ঘন্টার পর ঘন্টা। বই পড়া, গল্প-গাছা। রবিশঙ্কররের চেয়ে সামান্যই বড় কনকলতা। সারাদিন তারা মেতে থাকে বিচিত্রতর খেলার উদ্ভাবনে। হেমাঙ্গিনী দুচোখ ভরে ধূ-ধূ সমুদ্রের দিগশূন্যপুরে চেয়ে থাকেন। কঠিন কর্তব্যকেই তিনি পৃথিবী বলে জেনেছেন চিরদিন। আজ যা দেখছেন তাঁর কাছে কল্পনারহিত তা। এই সুবৃহৎ, উন্মুক্ত, কোনোপ্রকার আগলহীন পৃথিবীটাতে এই প্রথমবার নিজেকে নির্ভার লাগছে তাঁর। সহজ একটা ভালোলাগার অন্তহীন স্রোতে যেন এমনিই ভেসে রয়েছেন তিনি।
উদয়শঙ্কর রয়েছেন নিজের কেবিনে। ১৯২০-তে গিয়েছিলেন বিদেশ, ফের চলেছেন ১৯৩০-এ। আকাশপাতাল তফাত দুই যাত্রার। এইবারের বিদেশ যাত্রা তাঁর কাছে পরম তৃপ্তির, আনন্দের। কিন্তু এবার তাঁর দায়িত্ব অনিঃশেষ। অনেক কাজ- বহুরকম ব্যবস্থাপনা। এই নিরবিচ্ছিন্ন সময়টাতে নিজেকে খানিকটা সময় নিয়ে গুছিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। সেইরকমই একদিন হঠাৎ তাঁর কেবিনে ডাক পড়ল কনকলতার। কনকলতা ঘরে আসতে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ব্রেকফাস্ট করেছো? কনকলতা ঘাড় নাড়লেন। উদয় বললেন, বেশ, তবে আজ থেকে এই সমুদ্রের ওপরই শুরু হবে তোমার তালিম।
বাজনা ছাড়া খুব বেশিক্ষণ টিঁকতে পারেন না তিমিরবরণ। প্রথমদিকে ভেতরেই যন্ত্রকে নাড়াচাড়া করছিলেন তিনি। বিচিত্র ধ্বনিলহরী অণুক্ষণ তাঁর সত্তায় ধরা দেয় আশ্চর্য সমন্বয়ে। এই উধাও পৃথিবীতে আজ নিযুত শব্দরাশির ছলাৎছল। তাঁকে বেঁধে রাখে সাধ্য কার? সেদিন তিমিরবরণ জাহাজের ডেকে, নিয়ে এলেন তাঁর সরোদখানি। আকাশে শতসহস্র গুলালের আটচালা আর অন্যপ্রান্তে বহমান অনন্ত প্রবাহ। ওই বর্ণ, লয় ওই রাজকীয় রণন। যেন ধরিত্রী রয়েছে তার উষালগ্নে। মহাসমুদ্রের বিপুল তরঙ্গ-তাল, গভীর গর্জন নাদ-সংগীত। তন্ময় তিমিরবরণ সুর ধরলেন। ধরার সঙ্গে মেতে উঠলেন যুগলবন্দিতে। কী অলৌকিক সে মুহূর্ত।
Powered by Froala Editor