সুরের ঝরনাধারার নির্জনে ছিল এঁদের বাস

শঙ্কর সরণি - ১৬
আগের পর্বে

১০ বছর পর দেশে ফিরে উদয়শঙ্কর এক নতুন জীবন খুঁজে পেলেন। যেখানে তাঁর শিকড়ের টান। কিন্তু এর মধ্যেও বিরোধ ঢুকে পড়ল খুব তাড়াতাড়ি। বিদেশে তাঁর শিল্প সাধারণ মানুষ থেকে অভিজাত প্রত্যেকের কাছে সমাদর পেয়েছে। কিন্তু ভারতবর্ষে তিনি সাধারণ একজন ‘নর্তক’। তাছাড়া ভদ্র, অভিজাত পরিবারের পুরুষ নাচ করবেন, এটা কল্পনা করাই ছিল কঠিন। এমনকি শিল্পের জগতের মানুষরাও তাঁকে সহজে গ্রহণ করেননি। কারণ নির্দিষ্ট কোনো ঘরানার মধ্যে আটকে থাকেননি তিনি। শিক্ষিতদের মধ্যে নাচের কদর করতেন না প্রায় কেউই। কেবল শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ নাচকে জীবনের সঙ্গে মেলাতে চেয়েছিলেন। দেশবিদেশের নানা নৃত্যকলাকে যেমন মিশিয়েছেন, তেমনই গভীর প্রভাব পড়েছে স্থানীয় বাউলদের জীবনযাত্রার।

দেশে ফিরে যে প্রশ্নটি ঘুরেফিরে এসে পৌঁছচ্ছিল উদয়শঙ্করের কাছে, তা হল কী ব্যাকরণ তাঁর নৃত্যধারার? কোন ধ্রুপদি ঘরানার তিনি উত্তরসূরি? কী উত্তর দেবেন উদয়শঙ্কর? জীবনের ঘটনাপ্রবাহে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন নৃত্যের সঙ্গে। তারপর থেকে এক মূর্তিকে তিনি দিতে চেয়েছেন রূপ। সে মূর্তি নির্মীয়মাণ। তিনি সৃষ্টি করে তুলছেন বটে, তবে সম্পূর্ণ অবয়বটি যে এখনও অধরা তাঁর নিজের কাছেও। আন্তরিক ধৈর্যে যদি শুনতে চান কেউ, তিনি হয়তো জানাতে পারতেন তাঁর একান্ত চিন্তাসূত্রগুলিকে। যেমন তাঁকে শুনলেন গুরু নাম্বুদ্রি। কিন্তু এমন যুদ্ধসাজ পরা প্রশ্নের এজলাসে তাঁকে বাধ্যত থাকতে হল নিরুত্তর। 

দেশের মাটিতে নিজের নৃত্য পরিবেশনের ইচ্ছেকে তবু দমতে দিলেন না তিনি। পৌঁছলেন এক অতীব বিশেষ মানুষের সাকিন-ঠিকানায়। তিনি হরেন ঘোষ। হরেন ঘোষের প্রাথমিক পরিচয় তিনি ইম্প্রেসারিও, প্রমোদ- পরিবেশক। কিন্তু তাঁর আসল পরিচয় তিনি একজন শিল্প-অন্তপ্রাণ মানুষ। বইপত্র আর তিনি ছিলেন হরিহর আত্মা। সংস্কৃত, বাংলা আর ইংরেজি তিনটি ভাষাতেই ছিলেন অবিশ্বাস্য রকমের দক্ষ। ‘ফোর আর্টস জার্নাল’ নামে এক ইংরেজি বার্ষিক সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয় তাঁর সম্পাদনায়। ছায়াচিত্র সম্বন্ধে তাঁর ছিল বিশেষ ঔৎসুক্য। নির্বাক যুগে তিনি নিজেও তৈরি করেছিলেন ছবি। কিন্তু এছাড়াও তাঁর ছিল এক বৈশিষ্ট্য। ঈর্ষণীয় ছিল তাঁর বন্ধুভাগ্য।  তিনি ছিলেন বন্ধু-স্বজন-শিল্পী-সাহিত্যিকের চোখের মণি। স্নেহ করতেন রবীন্দ্রনাথ। অবনীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী থেকে শুরু করে শিল্পী-সাহিত্যিক-কলাকুশলী সকলেই ভালোবেসেছিলেন তাঁকে।

প্রমোদ-পরিবেশনে হরেন ছিলেন রুচিমান। বর্মা থেকে বার্মিজ নৃত্যশিল্পীদের এনেছিলেন তিনি। ইতিমধ্যে কাজ করেছেন নানান প্রদেশের মানুষদের নিয়েও। ১৯৩০-এ উদয়শঙ্কর অনেক আশা নিয়ে গেলেন তাঁর দপ্তরে। হরেন পড়লেন মহা ধন্দে। তাঁর সুনাম, সুখ্যাতি গড়ে উঠেছে শিল্পের রুচিতে, তিনি তিল আনার আপোষহীন। প্রমোদ-পরিবেশক হয়েও তিনি বরাবর গুরুত্ব দিয়েছেন শিল্পের বিশুদ্ধতা রক্ষায়। উদয়শঙ্করকে তিনি কোন খাপে ফেলবেন? চিন্তায় পড়লেন, ভাবলেন, প্রচারের বয়ান কী হবে? বিজ্ঞপ্তি তৈরি হবে কীসের ভিত্তিতে? নৃত্যাচার্যদের ক্রোধানলকেই বা শান্ত করবেন কীভাবে? কিন্তু সহৃদয় তিনি। এসব দুর্ভাবনার মধ্যেও উদয়কে গ্রহণ করেছে তাঁর মন।

উদয়শঙ্কর ও হরেন ঘোষ।

 

আরও পড়ুন
তাঁর জীবনে দেশ এল, বিদ্বেষের ধারাটি সঙ্গে নিয়ে

তিনি সুবিবেচকও। উদয়কে নিয়ে সমকালীন রক্ষণশীলদের মনোভাবের পাশাপাশি বিচ্ছিন্ন আগ্রহ-কৌতূহলকেও লক্ষ করলেন হরেন। আনা পাভলোভার সঙ্গে তাঁর সফর-সংবাদ সংবাদপত্রে জেনেছেন মানুষ। বিলেতফেরত শব্দের মাহাত্ম্যটিও অনস্বীকার্য। তাঁর সঙ্গে এসেছেন মেমসাহেব অ্যালিস বোনার। ধনকুবের তিনি, নামজাদা ভাস্কর। যৎকিঞ্চিৎ একথাটিও ভেসে বেড়াচ্ছিল হাওয়ায়, তা হল বিদেশে থাকলেও তিনি প্রতিনিধিত্ব করেছেন দেশেরই হয়ে। সমস্যা-সংকুল এই পরিস্থিতির যুক্তিসম্মত সমাধানে হরেন পা ফেললেন অতি ধীরে।

স্বনামধন্য সাহিত্যিক হেমেন্দ্রকুমার রায়ের কাছে উদয়শঙ্করকে নিয়ে গেলেন তিনি। বুদ্ধিদীপ্ত, উজ্জ্বল যুবকটিকে ভালো লাগল হেমেন্দ্রকুমারের। তিনি তাঁদের পাঠালেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। যেকোনো ক্ষেত্রের শিল্পকলাকে উদ্ধার আর প্রতিষ্ঠায় ঠাকুর বাড়ির কাছে বাঙালির ঋণ অপরিশোধ্য। অবন ঠাকুর শুনলেন সবটা। স্থৈর্য, প্রসন্নতা তাঁদের ধাতুচরিত্র। আশ্বস্ত করলেন তিনি। প্রতীক্ষিত সেই মুহূর্তটি এসে দাঁড়াল উদয়শঙ্করের জীবনে। ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্টস-এর তরফে প্রাচ্য চিত্রকলা ভবনে আয়োজিত হল দেশে উদয়শঙ্করের প্রথম নৃত্য প্রদর্শনীর। কলকাতায় তাঁর একক নৃত্য, আমন্ত্রণ জানানো হল শহরের সমস্ত গণ্যমান্যদের।

আরও পড়ুন
যা আমি খুঁজছিলাম, সেই সমস্ত কিছু ধারণ করেছিল উদয়

উদয়শঙ্করের জীবনে যথামুহূর্তে যথাযথ মানুষের আবির্ভাবগুলি লক্ষ করলে মাঝে মাঝে চমৎকৃত হতে হয়। যেন কোন সুনিপুণ ঔপন্যাসিক একাগ্র মনোযোগে রচনা করে চলেছেন তাঁর ললাট-লিখন। যেন, এক-একটি ব্যক্তিত্ব, যুক্ত হন এক-একটি অধ্যায়ে, আর বুনে তোলেন নায়কেরই অভিপ্রায়। তাঁর জীবনে এলেন তিমিরবরণ, তিমিরবরণ ভট্টাচার্য।

হেমেন্দ্রকুমার রায়

 

আরও পড়ুন
তাঁর আশ্রয় উদয়ের জন্য থাকবে সদা অবারিত

অনুষ্ঠানের ঠিক আগের দিন হরেন ঘোষের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল তিমিরবরণের। এক আশ্চর্য প্রতিভা, তাঁর শৈশব যেন গয়নার বাক্স। মণি-মুক্তো-হিরে-জহরতে ঠাসা এক অস্থির, উদাসী জীবন। বড়বাজারের অপ্রশস্ত একত্রিশ নম্বর শিব ঠাকুরের গলিতে ছিল তিমিরবরণদের বাস। পিতা ছিলেন জ্ঞানেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য। পাথুরিয়াঘাটার রাজপরিবার ছিলেন এঁদের মন্ত্রশিষ্য। এমনিতে তাঁদের তিনপুরুষ তান্ত্রিক সাধক। বাংলা জুড়ে তাঁদের শিষ্য। কিন্তু সেসবে ধ্যানজ্ঞান ছিল না এঁদের। এঁরা মজেছিলেন সংগীতে। পাথুরিয়াঘাটার রাজবাড়িতে ছিল উচ্চাঙ্গ সংগীতের প্রতি বিশেষ প্রীতি। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসতেন ওস্তাদরা, বসত মজলিস। ভট্টাচার্য-নিবাসে ঘটেছিল ত্রিধারা সংগম। পাড়ায়-পাড়ায় তখন ছিল হিন্দুস্থানি সংগীতের রেওয়াজ। রাজপরিবারে যাঁরা আসতেন, গুরুগৃহেও তাঁরা রাখতেন তসরিফ। তারই সঙ্গে এসে মিশেছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সাংস্কৃতিক চর্চার রেশও। তিমিরবরণের দিদিমার ভাই ছিলেন প্রখ্যাত যদু ভট্ট।

জ্ঞানেন্দ্রমোহনের তিনপুত্র মিহিরকরণ, তিমিরবরণ, শিশিরশোভন। মিহিরকরণের কাছে তাঁর ভাইদের নাম শুনে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এত সুন্দর নাম, বাবা কি কবি ছিলেন? ১৯০৪-এর ১০ জানুয়ারি জন্ম তিমিরবরণের। তিমিরবরণ যখন ছোটো তখন একজনের গান আর আরেকজনের বাজনা গভীর ছাপ ফেলেছিল তাঁর মনে। রাজবাড়ির জামাই আশুবাবু আসতেন জ্ঞানেন্দ্রমোহনের বাড়িতে। অলৌকিক ছিল তাঁর ধ্রুপদের গায়কি। কবি নরেন্দ্র দেবের পিতা নগেন দেব বাজাতেন পাখোয়াজ। স্বর্গীয় ছিল সেই সুর। বিষ্ণুপুর ঘরানার ধ্রুপদ ও খেয়ালের নামজাদা গায়ক রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামীর কাছে নাড়া বাঁধলেন তিমিরবরণ। নেহাতই ছোট তখন, তবু গলায় ছিল অদ্ভুত মায়া। শিষ্যরা তাঁর গান শুনতেন, হৃদয়ে লাগত উথাল-পাথাল, চোখ থেকে নেমে আসত ধারা। সংগীতের সঙ্গেই মিহিরকরণের আবার ঝোঁক ছিল বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহের। সুরের এই ঝরনাধারার নির্জনে ছিল এঁদের বাস।

আরও পড়ুন
হেমাঙ্গিনীর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল জল

তিমিরবরণ যখন পাঁচ, তখন হারান তাঁর মা-কে। মা-হারা এই গুণশালী সন্তানদের সমস্ত বালাইকে স্নেহ জুগিয়েছিলেন জ্ঞানেন্দ্রমোহন। তিমিরবরণ যখন দশ, চলে গেলেন তিনিও। আঠারোর মিহিরকরণের সামনে তখন অনন্ত অনটন। তবু ‘পুত্রস্নেহে’ লালন করলেন দুই ভাইকে। সেসময় ক্লারিওনেট বাজিয়ে হিসেবে সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন দুজন, রাজেন্দ্রলাল ভট্টাচার্য এবং নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার। চোদ্দ বছর বয়সে তিমিরবরণ শিখলেন ক্ল্যারিওনেট। এ শিক্ষায়, দেখতে গেলে, দুজনেই তাঁর শিক্ষক। রাজেন্দ্রলালের কাছে তিনি শিখলেন প্রত্যক্ষত। তিনি তালিম দিলেন হিন্দুস্থানি ক্লাসিকাল সুরের। অন্যদিকে নৃপেন্দ্রনাথের রেকর্ড শুনে শুনে তিনি আয়ত্ত করলেন তাঁর গতিমুখও।

তিমিরবরণ

 

তখন স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়। গান্ধীজি বার্তা দিলেন, স্কুলের গণ্ডি ভেঙে ছাত্রদের নামতে হবে পথে। স্কুল ছাড়লেন তিমিরবরণ। ধরলেন ব্যাঞ্জো। নতুন যন্ত্র আর সুর আকুল করে তুলত তাঁকে। রাজেন্দ্রলালের কাছেই চলল ব্যাঞ্জোর শিক্ষা। একদিন সে যন্ত্র মেরামতের কাজে তিমিরবরণ এলেন চিৎপুরে। দোকান মালিক গোবর্ধন সমঝদার, বিচক্ষণ। গুণীদের সঙ্গে তার নিত্য ওঠাবসা। তিমিরবরণকে চিনলেন। বললেন, এসব খেলনা যন্ত্র নয়, আপনি সরোদ বাজান। কী সরোদ? কে বাজান সেসব? কিছুই জানেন না তিমিরবরণ। গোবর্ধন দেখালেন ওস্তাদ আমির খাঁ সাহেবের জন্য তিনি নিজহাতে তৈরি করেন সেই যন্ত্র। তিমিরবরণের ধৈর্যে বান ডাকল। মিহিরকরণ ইতিমধ্যে বিবাহ করেছেন, পরিবার বড় হয়েছে। লোকে বললে, তিমিরকে দাও একখানা কাজে লাগিয়ে। এসব কথায় চমকে উঠতেন মিহিরকরণ। শান্তস্বরে বলতেন, বাবা থাকলে কি তাই চাইতেন? ও বাজাক।

নতুন যন্ত্রের ফরমায়েস পৌঁছল দাদার কাছে। তারপর বাজনার বায়না গেল গোবর্ধনের কাছে। ছ মাস লাগল যন্ত্র তৈরি হতে। ছ মাস সকাল-বিকেল অধৈর্য তিমির অস্থায়ী আস্তানা গড়ে তুললেন সেই বিপণিতে। তিমিররণ তখন ষোলো। ওই যন্ত্র রাজা-মহারাজা আর খোদ মানুষজন ভিন্ন তখনও চাক্ষুষ করেনি কেউ। মাত্র ছজন ওস্তাদ বাজাতেন সরোদ। ফিদা হোসেন খাঁ, আলাউদ্দিন খাঁ, আবদুল্লা খাঁ, হাফিজ আলি খাঁ, আমির খাঁ এবং করমতুল্লা খাঁ। গোলাম আলি খাঁ আবিষ্কার করেন ওই সুরাধার, সরোদ। তাঁর পুত্র ছিলেন মোরাদ আলি খাঁ ও নান্নে খাঁ।  মোরাদের পুত্র আবদুল্লা আর আবদুল্লার পুত্র আমির খাঁ। অন্যদিকে নান্নে খাঁর পুত্র হাফিজ আলি খাঁ। সেই ওস্তাদ, সরোদ ঘরানার ভগীরথ আমির খাঁ সাহেব এলেন শিবঠাকুরের গলি ভট্টাচায্যি নিবাসে। শুরু হল তালিম। বৃদ্ধ বয়সে তিমিরবরণের সঙ্গে আলাপচারিতায় ‘দেশ’ পত্রিকায় তাঁর জীবনকথা লিখেছিলেন, শ্রীঅরুণ চট্টোপাধ্যায়। তিমিরবরণের জীবনে খাঁ সাহেবের অবদান প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, নিজের ঘরানার সোনার সিন্দুকের চাবি তিনি তুলে দিয়েছিলেন তাঁর শিষ্যকে।    

বাবা আলাউদ্দিন খাঁ

 

খাঁ সাহেব থাকতেন মেছোবাজারে কিন্তু মাঝে মাঝে তাঁকে যেতে হত গৌরীপুরে। গুরুর অনুপস্থিতিতে ছাত্রের অনুশীলনের ব্যাঘাত ঘটতে পারে আশঙ্কায় তিনি সছাত্র বিচরণ শুরু করলেন সর্বত্র। বিস্ময়কর প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন তিমিরবরণ। তবু সুরকে পাওয়ার নিরলস আকুতিতে অদম্য নিষ্ঠা ছিল চেয়ে দেখবার মতো। ১৯২৫-এ ঘটল আরেক কাণ্ড। কলকাতার ধনী, অভিজাত সুরসিক গৃহে তখন প্রায়ই বসত সুরের মজলিস। ততদিনে শিশিরশোভনও বড় হয়েছেন, তবলায় তিনি নাড়া বাঁধলেন ওস্তাদ খলিফা আবেদ হোসেনের কাছে। ফলে তিন ভাই সেইসব খোঁজ-খবরে উৎকর্ণ হয়ে থাকতেন সর্বক্ষণ। খবর এল, সুকিয়া স্ট্রিটে গৌরীপুর রাজবাড়িতে উঠেছেন সুরের ঈশ্বর। আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব।

তিমিরবরণ বলেছিলেন, বিশুদ্ধ জাত ঘরানার শিক্ষা, তাঁকে দিয়েছিলেন তাঁর গুরু আমির খাঁ সাহেব। বলেছিলেন, ‘সরোদের ওপর একটা রাগের ঘরানা আলাপের পদ্ধতি ছিল বড় অদ্ভুত। বিলম্বিত দিয়ে শুরু করে ধাপে ধাপে স্থায়ী থেকে শুরু করে অন্তরা সঞ্চারী আভোগ, তারপর জোড় তান ইত্যাদির সঙ্গে রবাব, বীণ ও সরোদের যে বিশেষ কয়েকটি ক্রিয়া আছে যেমন লরি, লড়ন্ত্, লড়গুথাও, ঝালা, ঠোকঝালা ইত্যাদি’ এবং ঘরানার যেসব গৎ শিক্ষা করেছিলেন তা শেষ দিন পর্যন্ত লগ্ন হয়ে থাকবে তাঁর স্মৃতিতে। তা সত্ত্বেও যেদিন প্রথম শুনলেন আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবকে, মনে হল, দেবলোকে অমিত সুরসূত্র বুননে, স্মিতহাস্যে দেবতা গড়ে চলেছেন সুরের ইন্দ্রপ্রস্থ।

সাহস করে নিজের মনোগত ইচ্ছাটি তিমিরবরণ জানালেন আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবকে। প্রস্তাবমাত্র নাকচ করে দিলেন বাবা। ভারতীয় সুরের ঐতিহ্য তাঁকে ওই সম্বোধনেই ডেকেছে, চিনিয়েছেও সেই সম্বোধনেই। তিনি থাকেন মাইহারে। পাণ্ডববর্জিত এক মরুভূমির দেশে। সেখানে বাইরের মানুষের পক্ষে বসবাস অসম্ভব। তিনি না করলেন, কিন্তু হাল ছাড়লেন না তিমিরবরণ। চলতেই থাকল অনু্রোধ-উপরোধ। শেষে একপ্রকার শান্ত হলেন।  শুনতে রাজি হলেন তিমিরবরণের বাজনা। দিন স্থির হল। সেদিন তবলায় সঙ্গত করলেন শিশিরশোভন। নিজের অর্পণটি সুরের দেবতার কাছে পেশ করলেন তিমিরবরণ। বাজনা শেষ হল। ভাববিহ্বল, তন্ময় বাবা আর্দ্রস্বরে  শুধু এইটুকু বললেন, তোমাকে আমি কী শেখাব? তোমার গুরু যে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন তোমায়।

Powered by Froala Editor