শঙ্কর সরণি - ১৫
আগের পর্বে
ভারতে এসে অ্যালিস বোনার ভাস্কর্যকে ছাড়তে চাইলেন। কিন্তু ভাস্কর্য তাঁকে ছাড়ল না। ভারতীয় স্থাপত্যের রূপ তাঁকে মুগ্ধ করল। শরীরের সেইসব ভঙ্গিমাই আবার উঠে এল উদয়শঙ্করের নাচে। প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্যের সঙ্গে নৃত্যের যোগ সরাসরি। উদয়শঙ্করের নাচের মধ্যে সেই অনুসঙ্গটি নিয়ে এলেন বোনার। বদল হল নৃত্যের সাজসজ্জাও। অন্যদিকে প্যারিসে বোনার যা পাননি, তাই পেলেন উদয়শঙ্করের মধ্যে। শিল্প সেখানে জীবনের কাছে উপস্থিত। স্টুডিওর চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি নয়। বোনার লিখেছিলেন, “যা আমি খুঁজছিলাম, সেই সমস্ত কিছু ধারণ করেছিল উদয়ই।”
উদয়শঙ্করের জীবনে রাজকীয় মহিমা, শিল্পিত বাতাবরণের উল্টোদিকে ঘনিয়ে উঠছিল একটা সংকটও। একটি অন্তঃসলিলা স্রোত ক্রমে হয়ে উঠছিল প্রকট। প্রথম-প্রথম পরিজনদের মধ্যে, তারপর ধীরে-ধীরে পরিচিতদের মধ্যেও আরেক রকমভাবে দেখা দিচ্ছিল সেই ভ্রূকুটি। বিদেশে তিনি বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী। সাধারণ মানুষ থেকে সম্মাননীয় সকলের কাছে তাঁর শিল্পকলা পেয়েছে অকল্পনীয় আদর, অশেষ শ্রদ্ধা। নানান ক্ষেত্রের গুণীরা করেছে তাঁর কদর। নানান দেশের কষ্টিপাথরে যাচাই হয়ে, তিনি ফিরেছেন দেশে। অথচ, দেশে ফিরে, তাঁর পরিচয় দাঁড়াল তিনি নিছক এক নর্তক, একজন ‘নাচিয়ে’ মাত্র। ভদ্রবাড়ির পুরুষমানুষ নেচে বেড়াবে, এ কেমন কথা, আত্মীয়েরা রব তুললে। এমন বেমানান, সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড কেউ কখনও দেখেছে, না শুনেছে? সমকালকে তার আদ্যিকালের ধারণার চক্রব্যূহ থেকে বের করে আনে, সে সাধ্য কার? অগ্রণী হয়ে যে ভেঙেছে প্রাচীর, যন্ত্রণার সাতসাগর যে পেরোতে হবেই সেই পথিকৃৎকে।অন্যদিকে শিল্পমহলেও তাঁকে ঘিরে তৈরি হল, এক দ্বিধা, এক অসন্তোষ। কে উদয়শঙ্কর? কী তাঁর ঘরানা? কোন মূল নৃত্যধারায় তাঁর শিক্ষা? উদয়শঙ্করকে দাঁড়াতে হল, আরেক অগ্নিপরীক্ষার সামনে। তাঁর জীবনে দেশ এল বিদ্বেষের ধারাটি সঙ্গে নিয়ে।
এই সময়ে নাচ বিষয়ে সমকালীন মনোভাবটি সম্পর্কে খুব সুন্দরভাবে আমাদের জানিয়েছিলেন শান্তিদেব ঘোষ, তাঁর ‘জীবনের ধ্রুবতারা’ গ্রন্থে। শুধু সমকালীন মনোভাবই নয়, মূলত, রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে কীভাবে নাচের ধারাটি বাঙালি জীবনের সঙ্গে যুক্ত হল তিনি জানিয়েছেন সেই কথাও। সেইসূত্রেই সমস্ত পৃথিবীর নৃত্যধারাকেও কীভাবে মিলিয়ে নিচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেই দরকারি তথ্যটিও এসে পৌঁছয় আমাদের কাছে।
গ্রামেগঞ্জে নিম্নবর্ণের মানুষদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিচরণ করত নাচ। পালা-পার্বণ-উৎসব-অনুষ্ঠানে দলবদ্ধভাবে, কখনও যৌথ বা একার নাচ ছিল তাদের জীবনের অংশ। কিন্তু শহরের মানুষদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি তেমন ছিল না। ধ্রুপদিধারায় কুক্ষিগত হয়ে নাচ থাকলেও জীবনধারায় তার প্রকাশ ছিল অকল্পনীয়। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই নৃত্যকলা মূলত সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল পেশাদার বাঈজি, থিয়েটারের পেশাদার নর্তক-নর্তকী, যাত্রা, খেমটাওয়ালি প্রভৃতিদের মধ্যে।
আরও পড়ুন
যা আমি খুঁজছিলাম, সেই সমস্ত কিছু ধারণ করেছিল উদয়
রবীন্দ্রনাথই শান্তিনিকেতনে জীবনাচরণের সঙ্গে যুক্ত করলেন নাচকে, বিংশ শতকের গোড়াতেই। নাচের মধ্যে দেহভঙ্গিমার প্রকাশ বলেই, শরীরই সেখানে দ্রষ্টব্য বলে, এতদিন সাধারণের কাছে তা ছিল ব্রাত্য, অসম্মাননীয়। মানবমনের আদিম অসংযমের প্রশ্রয়কে অনাবশ্যকভাবে জুড়ে নিয়েছিল এই শিল্পের প্রতি দৃষ্টিকোণ নির্মাণে। তদুপরি নাচের সঙ্গে তখন জুড়ে রয়েছে জীবিকার সম্বন্ধ। শরীরী ছলা-কলায়-প্রগলভতায় মানুষ করছে রুজির সংস্থান। এই ক্লিন্ন ভাবাবর্ত থেকে এই অবহেলিত শিল্পকে মুক্তি দিলেন রবীন্দ্রনাথ। নৃত্যকে ভাববার, চিন্তা করবার জন্য তৈরি করে দিলেন একটা বেদি। গড়ে দিলেন নাচকে চেয়ে দেখবার শিল্পিত, দীক্ষিত ব্যাখ্যাটিকে। নৃত্যকে রবীন্দ্রনাথ বললেন, দেহের উপর একটা ‘চলমান শিল্পরূপ’। বললেন, দেহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ভারকে বহন করে। কিন্তু তাকে চালনা করে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গতিবেগ। সৃষ্টির অভিপ্রায়েই, দেহের ভারটুকুকে নানা ভঙ্গিতে বিচিত্র করে তোলে, দেহের গতি। জানিয়েছিলেন, তা যে করে সে সৃষ্টির খাতিরেই, জীবিকার তাগিদে নয়। কী অসাধারণভাবে মানবসত্তার অসংযমের বিপ্রতীপে যা সহজ, যা স্বতঃস্ফূর্ত সেই প্রাণময়তাকে চিনিয়ে দিলেন তিনি।
আরও পড়ুন
তাঁর আশ্রয় উদয়ের জন্য থাকবে সদা অবারিত
শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথ নৃত্যকলার মর্যাদাপূর্ণ আবহ রচনা করলেন। পরে যাকে করবেন বিদ্যাচর্চারও অঙ্গ। ১৯০৮-এর পুজোর ছুটির সময় বিদ্যালয়ের ছেলেদের নিয়ে করলেন শারদোৎসব। সেখানে গানের সঙ্গে সুচারুভাবে যুক্ত করা হয় নাচকে। সূচনায় বিদ্যালয়ের ছাত্রদের দিয়ে অভিনয়কালে, শিক্ষক-কর্মী-ছাত্রদের উৎসাহিত করতে, গানের সঙ্গে নিজের মতো করে রবীন্দ্রনাথ তৈরি করতেন নাচ। সবচেয়ে প্রাণজুড়ানিয়া তথ্যটি হল, এসব অনুষ্ঠানে তিনি নাচতেন স্বয়ং। ১৯১৪-তে ‘ফাল্গুনী’ নাটকে অন্ধ বাউলের চরিত্রে নাচলেন তিনি। শুধু তাই নয় নাচলেন বালকদলের উল্লাসের গানের সঙ্গেও। একবার তো ‘অচলায়তন’ নাটকে স্থির হল ‘শোণপাংশুরা’ সব নাচবেন যে যার মতো। তাতে নিজের দেশের নাচের রীতিতে নেচেছিলেন খোদ পিয়র্সনও।
১৯২০-তে একজন মণিপুরি নৃত্যগুরুকে রবীন্দ্রনাথ আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তাঁকে ভার দিয়েছিলেন অল্পবয়সী ছেলেদের নাচ শিখিয়ে তোলার ব্যাপারে। এ বিষয়ে তাঁর সবচেয়ে বড়ো ভরসা ছিলেন, তাঁর পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। ১৯২৪-এ রবীন্দ্রনাথের সমর্থনে ছাত্রীদের নিয়ে নৃত্যচর্চা শুরু হয় তাঁরই উদ্যোগে। মূলত তাঁরই উৎসাহে তখন বিশ্বভারতীর এক পার্শি, ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপকের স্ত্রী মেয়েদের শেখান গরবা। ১৯২৫-এর বর্ষামঙ্গল-এ জুড়ে নেওয়া হল গরবা। ত্রিপুরার মহারাজকে অনুরোধ করে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে আনলেন আরো এক মণিপুরি নৃত্যশিক্ষককে। মৃদঙ্গের সঙ্গে এবার মেয়েরা শিখল মণিপুরি নৃত্য। ১৯২৬-এর ২৫ বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের ‘পূজারিণী’ কবিতাকে নৃত্যসহ মূকাভিনয়ের পরিকল্পনা করেন প্রতিমাদেবী। এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ‘নটীর পূজা’। শুধু তাই নয়, অভিনয় শিখিয়ে তোলবার দায়িত্বও তিনি তুলে নিলেন নিজের কাঁধে। ১৯২৮-এ তা অভিনীত হল কলকাতায়। ১৯২৮-এ দোলের দিন ‘ফাল্গুনী’-র অভিনয় হল আবার। এবারও নৃত্যে অংশ নিলেন তিনি। মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন সাতষট্টি।
আরও পড়ুন
হেমাঙ্গিনীর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল জল
১৯৩১-এর ‘গীতোৎসব’ আর ‘শিশুতীর্থ’-এর অনুষ্ঠানে হাঙ্গেরির কন্যা ব্রুনার তাঁর নিজের দেশের নাচকে মিশিয়ে দিলেন এই স্রোতে। নেচেছিলেন ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, কবির স্বকণ্ঠে ‘ঝুলন’ কবিতা আবৃত্তি ‘ও এসো নীপবনে’ গানটির সঙ্গে ব্রুনার নেচেছিলেন ইউরোপীয় মডার্ন ড্যান্স। দক্ষিণ ভারতীয় এক ছাত্র তাঁর প্রদেশের রীতিতে নেচেছিলেন, ‘যেতে যেতে একলা পথে’-এর সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে মণিপুরি নৃত্যরীতিকে কেমনভাবে সংযুক্ত করা যায়, তার তালিম দিতেন প্রতিমা দেবী। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, প্রতিমা দেবী নিজে নৃত্যশিক্ষা গ্রহণ করেননি অথচ তাঁরই হাতে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র ছত্রছায়ায় নৃত্য পেল অভাবনীয় বিচিত্রতা আর পরিপূর্ণতা।
আরও পড়ুন
বিদেশও তাঁকে অশেষ করেছে
ক্রমে এই ধারায় মিশে গেল শান্তিনিকেতনের প্রতিবেশে ছড়িয়ে-থাকা খানিক-খানিক বাউল নাচের ধরন-ধারনও। ৭ই পৌষের মেলাতেও দেখা মিলত তাঁদের। ব্রতচারী আন্দোলনের প্রবর্তক গুরুসদয় দত্তের তরফ থেকে রায়বেঁশে নৃত্য দেখবার আমন্ত্রণ এসে পৌঁছল ১৯৩১-এ। রবীন্দ্রনাথ পাঠালেন ছেলেদের। সেখানেই তাঁরা দেখলেন, ময়মনসিংহের মুসলমান যুবকদের জারি নাচও। পরে রায়বেশে শেখার বন্দোবস্ত করা হল শান্তিনিকেতনে। ১৯৩১-এই শান্তিদেবকে কেরলে পাঠালেন কথাকলির সঙ্গে কলাসন আর সারি শিখতে। জাপানের নো ও কাবুকি নাচের শিল্পী মাকির সূত্রে ‘চিত্রাঙ্গদা’ প্রভৃতি নাটকে রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেন জাপানি নাচের বৈশিষ্ট্য। মালয়েশীয় এক ছাত্রী জানত ব্যালে, আর ভিয়েতনামে শিক্ষাপ্রাপ্ত এক আমেরিকান ছাত্রী, তাদের নৃত্যগুণকেও অব্যবহার্য রাখেননি তিনি। ১৯৩৪-এ রবীন্দ্রনাথ শ্রীলঙ্কা গেলেন ‘শাপমোচন’ নৃত্যনাট্য নিয়ে। তাঁর ভাবনা প্রশংসনীয় হয়ে উঠছিল বিশ্বের বৃহৎ পরিসরে। এই সমস্ত উদ্যোগকেই শান্তিদেব চিহ্নিত করতে চেয়েছেন নৃত্য আন্দোলনের আখ্যায়।
এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঘটালেন আরেক ঐতিহাসিক কাণ্ড। ১৯৩২-এ ‘নটীর পূজা’ নৃত্যনাট্যটিকে রূপদান করলেন চলচ্চিত্রে। ছবির সংগীত পরিচালনা করলেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। নৃত্য, নৃত্যনাট্য তদুপরি চলচ্চিত্র শিল্পের কাছে বিষয়টি হয়ে উঠল দিগদর্শী পদক্ষেপ।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শ্রীলঙ্কা ভ্রমণকালে তাঁর সহযাত্রী সকলেই মুগ্ধ হলেন পুরুষদের বলিষ্ঠ জোরালো ক্যান্ডি নাচ দেখে। ফিরে এসে রবীন্দ্রনাথ শান্তিদেবকে পাঠালেন সেই পদ্ধতি অনুশীলনে। মায়ানমারের রামপোয়ে নৃত্যও শিখলেন শান্তিদেব ১৯৩৭-এ। ১৯৩৯-এ ইন্দোনেশিয়ার রাজবাড়ির নৃত্য এবং বালিদ্বীপের জনসমাজে প্রচলিত নৃত্যও। এইসূত্রেই শান্তিদেব পেলেন রবীন্দ্রগানের ভাব অনুযায়ী নৃত্যরচনা এবং ছাত্রীদের শিখিয়ে তোলার দায়িত্ব। ১৯৩৮-এ এলাহাবাদের কত্থক নৃত্যে অধিকারী এক ছাত্রীর নাচ দেখে খুশি হয়ে তাঁর তৎকালীন নৃত্যনাট্যে যুক্ত করে নেন তার নৃত্যকলাকে। বিদেশীয় মালয়েশিয়ার ছাত্রী, আমেরিকান ছাত্রী অথবা দেশীয় এলাহাবাদের ছাত্রী এরা প্রত্যেকে শান্তিনিকেতনে এসেছিল নাচ শিখতে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বলেই শিক্ষার ধারাটিকে দেখেছিলেন সচল আর সজীব করে। শিক্ষার আদান-প্রদানকে তিনি দেখেছিলেন গভীর উদার দৃষ্টিতে।
শান্তিনিকেতনের কলাভবনে তখন রয়েছেন শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু। শান্তিনিকেতনের এইসব উৎসব-অনুষ্ঠানে মেতে উঠতেন সকলেই। ১৯৩৬-এ একবার নৃত্যাভিনয়ের জন্য সাজ-পোষাকের পরিকল্পনার সঙ্গেই নন্দলাল বানিয়ে দিলেন অসামান্য সব মুখোশ। কলাভবনের মিউজিয়মে থাকত চিন, জাপান আবার পুরুলিয়ার মুখোশও। মুখোশ নির্মাণে প্রয়োজন মাফিক সবধারাকেই গ্রহণ করলেন নন্দলাল। সেই অনুষ্ঠানেই চরিত্রের চালচলন, রকম-সকমের বৈচিত্র্য আনতে ব্যবহৃত হল বিভিন্ন যন্ত্র। চিন, জাপান, ব্রহ্ম, যবদ্বীপ প্রভৃতি দেশ থেকে সংগৃহীত নানান বাদ্যকেও জুড়ে নেওয়া হল এই কাণ্ডে।
এই সমস্ত পদ্ধতির সূক্ষ্ম নির্বাচন আর যথাযথ সংমিশ্রণের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ জন্ম দিতে চাইছিলেন এক নূতনতর নৃত্যরীতির। সে রীতি অসামান্য মাধুর্যে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠল তার স্বকীয়তায়। যেন সত্য হয়ে উঠল নাচ নিয়ে তাঁর সেই কথাখানা। জীবিকার প্রয়োজনে নয়, সৃষ্টির অভিপ্রায়েই দেহের গতি দেহকে গড়ে তুলছে আনন্দময় নানা ভঙ্গির বৈচিত্র্যে। কিন্তু এই কর্মকাণ্ডে ঘটল আরো একটি বিপ্লব। বাংলার বারো মাসে রবীন্দ্রসৃষ্ট ধর্ম-নিরপেক্ষ উনকোটি পার্বণে নাচ হয়ে উঠল সহজ, স্বাভাবিক একটি অবিচ্ছেদ্য জীবনের অঙ্গ। আনন্দ উদযাপনে কখনও-কখনও জাতির অর্থহীন উন্মাদনাকে রবীন্দ্রনাথ বেঁধে দিলেন নতুন মাত্রায়। রবীন্দ্রগানের সঙ্গে নাচ হয়ে উঠল বাঙালির নিজস্ব সাংস্কৃতিক সম্পদ।
বাংলার নৃত্য-ইতিহাসে ভাবনার পট পরিবর্তন করে দিল এই রাবীন্দ্রিক উদ্যোগ। অথচ তখনও যে মসৃণ ছিল না পথ তার চিহ্ন ছড়িয়ে রইল ইতিউতি। ১৯৩০-এ রবীন্দ্রনাথকে বলতে হল, ‘সকল দেশেই নৃত্য কলাবিদ্যার অন্তর্গত, ভাবপ্রকাশের উপায়স্বরূপ শ্রদ্ধা পেয়ে থাকে। আমাদের দেশে ভদ্রসমাজে তা লোপ পেয়ে গেছে বলে আমরা ধরে রেখেছি, সেটা আমাদের নেই। অথচ জনসাধারণের নৃত্যকলা নানা আকারে এখনও আছে, কিন্তু ওরা ছোটলোক। অতএব ওদের যা আছে, সেটা আমাদের নয়। এমন কি সুন্দর সুনিপুণ হলেও সেটা আমাদের পক্ষে লজ্জার বিষয়।’
শান্তিনিকেতনকে কেন্দ্রে রেখে রবীন্দ্রনাথের নৃত্য আন্দোলন সুপরিণতি পেল ঠিকই, তবুও সামগ্রিকভাবে মানুষের মন তখনও নিঃসংকোচ স্বীকার করেনি তাকে। সেই পরিস্থিতিতে উদয়শঙ্করকে কিছুদিনের জন্য বাঙালির জনগণমন করে রাখল ঈষৎ দূরবর্তী।
Powered by Froala Editor