শঙ্করসরণি - ১৪
আগের পর্বে
বারাণসী থেকেই শুরু হল অ্যালিস বোনারের ভারতভ্রমণ। সেখানে একটি হোটেলের ছোটো ঘরেই সাজিয়ে বসলেন। অ্যালিস বোনারের ভারতভ্রমণের ব্যাপারে সাহায্য করলেন শ্যামশঙ্করও। একদিন বারাণসীর সেই হোটেলের ঘরে বসেই এক অদ্ভুত শব্দ শুনলেন অ্যালিস ও উদয়। জানলা দিয়ে দেখলেন এক ব্যক্তি অদ্ভুত একটি বাজনা বাজাচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গে সেটি সংগ্রহ করতে ছুটলেন দুজনে। সামান্য একটি বাজনাকে ঘিরে এমন দুজন মানুষের উৎসাহ অবাক করল সেই বাজিয়েকে। অ্যালিস ও উদয়শঙ্করের ভারতভ্রমণের জন্য নানা রাজার কাছে চিঠি পৌঁছলো। বরোদার রাজসভায় প্রথম গেলেন তাঁরা। সেখানকার গ্রন্থাগারে বুঁদ হয়ে থাকতেন উদয়শঙ্কর। ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের উপর লেখা একটি বই তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। ত্রিবাঙ্কুরে দেখলেন গুরু শঙ্করণ নাম্বুদ্রির কথাকলি নৃত্যের পরিবেশন। তাঁর শিষ্য হতে চাইলেন উদয়। নাম্বুদ্রি জানালেন, তাঁর আশ্রয় উদয়শঙ্করের জন্য থাকবে সদা অবারিত।
চলতে থাকল ভারতভ্রমণ। নিসর্গপ্রকৃতি থেকে মানবপ্রকৃতি, রাজার স্থাপত্য থেকে জনজীবনের বিশ্বাসভূমি, মূর্তি-ভাস্কর্য থেকে গ্রামীণ লোকশিল্প, চিত্রকলা থেকে সরাশিল্প, গুহাচিত্র থেকে পটচিত্র, অজন্তা-ইলোরা থেকে জনবিহারের অলি-গলি, ধ্রুপদি সংগীত থেকে দেশওয়ালি সুরে শাশ্বত এই দেশটিকে অকৃপণ দৃষ্টিতে গ্রহণ করলেন অ্যালিস বোনার। ভালোবাসলেন এই দেশটিকে।
জন্মসূত্রে সুইস অ্যালিস (১৮৮৯-১৯৮১) চিত্রকলা ও ভাস্কর্যশিক্ষার প্রথাগত পড়াশোনা করেন ব্রাসেলস, মিউনিখ আর বাসেলে। ১৯১১-তে শেষ করেন পড়াশোনা, আর ১৯১৬-তেই মিউজিয়ম অফ মডার্ন আর্ট-এ তাঁর প্রদর্শনী সশ্রদ্ধ গুরুত্ব পেতে শুরু করে কলাবিদদের কাছে। ১৯২৫-এ তিনি তৈরি করলেন নিজের স্টুডিও। প্রতিকৃতি আর নিসর্গচিত্রে তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল। তবে তাঁকে সবচেয়ে আলোড়িত করত, প্রতিক্ষণে বদলে-যাওয়া মানুষের শরীরের ভঙ্গি এবং গতিময়তা। প্রখ্যাত শিল্পী লিলি, জেনি, লিওনি ব্রাউনের বিভঙ্গকে একসময় তিনি লক্ষ করেছেন ধারাবাহিকভাবে। তটস্থ পর্যবেক্ষণ আর নিরলস পরিশ্রমে গড়ে তুলেছিলেন আশ্চর্য সব ভাস্কর্য। জুরিখ আর জেনিভার বিভিন্ন অঞ্চলে ইতিমধ্যে স্থাপিত হয়েছে তাঁর তৈরি মূর্তি। আমরা জানি ১৯২৭-এ জুরিখে তাঁর আলাপ হয় উদয়শঙ্করের সঙ্গে। ১৯২৯-এর ডিসেম্বরে উদয়শঙ্করের সঙ্গে তিনি এসে পৌঁছোন ভারতে। ভারতভ্রমণ সেরে, উদয়শঙ্করের সঙ্গেই ১৯৩০-এই তিনি ফিরে গেলেন প্যারিস, নিজের দেশে। ফিরলেন বটে, কিন্তু ভারতের পিছুটান আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রইল তাঁকে।
এই সময় উদয়শঙ্করের ট্রুপটির যাবতীয় দায়িত্ব গ্রহণ করলেন তিনি। ভারতের প্রতি তাঁর অনেকানেক অবদানের সূত্রে একটু আড়ালে পড়ে যায় এই তথ্যটি। উদয়শঙ্করের তথা এই ভারতীয় নৃত্যশৈলীকে সমস্ত পৃথিবীর নজরগোচর করে তুলতে উদ্যোগী হলেন অনাবিল আন্তরিকতায়। দলের প্রচার-প্রসারের সঙ্গেই পোষাক পরিকল্পনা এবং যাবতীয় নান্দনিক বিষয়েও তিনি নিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। উদয়শঙ্করের আগে নৃত্যে মূলত যে ধরনের পোষাক ব্যবহৃত হত তাতে আমূল পরিবর্তন আনলেন তাঁরা। রবিশঙ্কর তাঁর ‘স্মৃতি’ গ্রন্থে বলেছিলেন, উদয় আর বোনার ‘এঁরা দুজনে মিলে নতুন ধরনের costume তৈরি করা শুরু করলেন। তার আগে সব যাত্রাদলের ড্রেসের মতো costume ছিল। এর আগে এসব কেউ ভাবতেও পারেনি।… যতখানি সম্ভব অজন্তা, ইলোরারকে মনে রেখে এইসব costume তৈরি করা হত।’ শুধু তাই নয়, উদয়শঙ্কর যে ট্রুপটি তৈরি করে গেলেন প্যারিসে, তার অর্থভারও বহন করলেন সানন্দচিত্তে। ১৯৩৪-এ আবার তাঁরা দুজনেই ফিরলেন ভারতে। আর ঘটল সেই অত্যাশ্চর্য ঘটনা। সেই সময় থেকে দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছর অ্যালিসের মূলত ঠিকানা হল বারাণসী। অসি ঘাটের কাছে কিনলেন একটি ছোট্ট বাড়ি। কী প্রগাঢ় কারুবাসনায় একটি ভিনদেশকে ভালোবেসে তাকেই করে তুললেন তাঁর ‘স্বদেশ’। অমিতবিত্তশালী অ্যালিস, অগাধ প্রতিপত্তির অধিকারী অ্যালিস, প্রভূত খ্যাতি, অনিঃশেষ জনপরিচিতির আবর্তে অধিষ্ঠিত অ্যালিস। ছেড়ে এলেন কী অতুলনীয় রাজকীয়-সন্ন্যাসে। নিজের প্রাসাদ, ভোগ-বিলাস, আত্ম-পরিচিতি ছেড়ে এলেন সব। এলেন সেইখানে, যা তাঁর হৃদয়ের আবাসভূমি। তাঁর কাঙ্ক্ষিত কলাক্ষেত্রই, তাঁর স্বভূমি। এক আত্মিক জীবন যাপনের দৃষ্টান্ত হয়ে রইলেন অ্যালিস বোনার।
আরও পড়ুন
তাঁর আশ্রয় উদয়ের জন্য থাকবে সদা অবারিত
১৯৩৬ থেকে ভারতে শুরু হল তাঁর কাজ। ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সুপ্রচুর ছবি আর স্কেচের কাজে। একদিকে তাঁর অনবদ্য রেখায় আকার পেতে শুরু করল এদেশীয় প্রাত্যহিক, অন্তরঙ্গ অথচ কারুকার্যময় জনলোক আর সেইসূত্র ধরেই অন্যদিকে এল অনভিপ্রেত এক সংবাদ। অ্যালিস প্রায় ছেড়েই দেবেন ভাস্কর্য নির্মাণ। মূর্তি নির্মাণে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল অ্যালিসের প্রতিভা। তাও। আর সেই সিদ্ধান্তকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অ্যালিস কী অপূর্বভাবেই না বিশ্লেষণ করলেন তাঁর উপলব্ধি। সে কথার পথ ধরে খানিক থই পাওয়া যায়, তাঁর চেয়ে-দেখতে চাওয়ার গড়নটিকে। ভারত কলা ভবন থেকে প্রকাশিত তাঁর আর্টিস্ট অ্যান্ড স্কলার বইতে, অদ্ভুত একটা কথা তিনি বললেন, ‘‘too slow process to catch up with the wealth of aspects India offered to the observing eye.’’ যে দেখতে পায়, তার চোখের সামনে ভারতবর্ষ মেলে রেখেছে বিপুল ঐশ্বর্য। তাকে পুরোপুরি ধরে রাখতে হলে ভাস্কর্য খুব জুতসই মাধ্যম নয়। কারণ ভাস্কর্যনির্মাণ একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অর্থাৎ ভারত শুধু তার অতীতচারিতায় আর স্থানমাহাত্ম্যেই বাঁধা পড়ে নেই, তার রহস্য প্রতি মুহূর্তের চলমানতাতেও। সমস্ত প্রান্তে, আনাচে-কানাচে প্রতিপলে নির্মিত হচ্ছে দৃশ্য আর প্রতি মুহূর্তেই হচ্ছে অন্তর্হিত। ক্ষণাশ্রিত সেই চিত্রটিকে খুইয়ে ফেলতে চাননি অ্যালিস বোনার।
আরও পড়ুন
হেমাঙ্গিনীর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল জল
ভাস্কর্যকে ছাড়তে চাইলেন বোনার, কিন্তু ভাস্কর্য তাঁকে ছাড়ল না। নৃত্যরত অবস্থায় মানুষের শরীর জুড়ে কত কাণ্ড-কারখানা। একেকটি মুদ্রা একেকটি মূর্তির স্বরূপ। তিনি আকৃষ্ট হলেন, দক্ষিণ ভারতীয় কথাকলির স্বাতন্ত্র্যে। পুরী পৌঁছে আসমুদ্রবিস্ময় ঘিরে ধরল তাঁকে। স্থাপত্যের নৈপুণ্যে অনড় মুগ্ধতায় তিনিও স্থির হয়ে রইলেন প্রতিমারই মতো। তাঁর দেখা হল পণ্ডিত সদাশিব রথ শর্মণ-এর সঙ্গে। ওড়িশায় তিনি রইলেন দীর্ঘ কুড়ি বছর। মন্দির স্থাপত্যনির্মাণ বিষয়ে তাঁরা একসঙ্গে সম্পাদনা করলেন তিনটি গ্রন্থ। ওড়িশাতে তাঁর হাতে এল তালপাতার পুঁথি। শিল্পপ্রকাশ, হিন্দু মন্দির নির্মাণ বিষয়ে স্থাপত্যবিদ্যার নির্দেশিকা। অনুবাদের কাজে হাত দিলেন তিনি। ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হল তাঁদের অনূদিত গ্রন্থ ‘শিল্পপ্রকাশ’। সম্ভবত এর পর প্রকাশিত হয় ‘নিউ লাইট অন দ্য সান টেম্পেল অফ কোনার্ক’ (১৯৭২) এবং ‘বাস্তুশাস্ত্র উপনিষদ’ (১৯৮২)। আমাদের বিদ্যাচর্চায় তখনও উপেক্ষিত এই প্রাচ্য স্থাপত্যবিদ্যায়, ভাস্কর অ্যালিস হয়ে রইলেন চিরভাস্বর। ‘প্রিন্সিপলস অফ কম্পোজিশন ইন হিন্দু স্ক্যাল্পচার’ নিয়েও বই লিখবেন তিনি। ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন ভারতত্ত্ববিদ। ১৯৬৯-এ জুরিখ ইউনিভার্সিটি তাঁকে প্রদান করে সাম্মানিক ডক্টরেট। ১৯৭৪-এ ভারত তাঁকে শ্রদ্ধা জানালো ‘পদ্মভূষণ’ পুরস্কারে। সেই বছরই শিল্পকলায় পদ্মভূষণ পেয়েছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় আর চিন্তামণি কর।
ভারতবর্ষকে দেখছেন আর ফুরসতবিহীন তৎপরতায় নিচ্ছেন ফোটোগ্রাফও। উদয়শঙ্কর আর অ্যালিস এলেন কলকাতায়। আপাতত একটা স্থায়ী বন্দোবস্তের খোঁজে পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলে ফ্ল্যাট নিলেন অ্যালিস। একদিন কলকাতার পথে পথে হেঁটে বেরিয়ে দেখছেন এই শহর। সদাব্যস্ত, আপনভুবন মত্ত, আমোদপ্রিয়, মাতোয়ারা এই শহর। হাঁটতে-হাঁটতে এক জায়গায় থমকে দাঁড়ালেন তিনি। উদয় এগিয়ে গিয়ে ফিরে এলেন। পথের মাঝে হঠাৎ দাঁড়িয়ে, কী দেখছেন অ্যালিস। গভীর মন দিয়ে দেখছেন। কাছে গিয়ে দেখলেন, এক শ্রান্ত মুটে। বোধ করি বিরামহীন কেটেছে তার দিন। দুদণ্ড জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ ঘটেনি হয়তো বা। অবসন্ন হঠাৎ পথের প্রায় মাঝখানটিতেই শুয়ে পড়েছে সে। শুয়ে আছে নিজের ঝাঁকাটির ভেতর। স্থানাভাব তাকে বিচলিত করেনি। হয়তো বা ঘুমের ঘোরেও তার অস্থাবর সম্পত্তিটিকে আগলে রাখতে চেয়েছে সে। গভীর নিশ্চিন্তিতে ঘুমিয়ে আছে। অ্যালিস বললেন, দেখো উদয়, কত সামান্য ওর চাওয়া অথচ কত পরিতৃপ্ত ওর জীবন।
আরও পড়ুন
বিদেশও তাঁকে অশেষ করেছে
দ্বিতীয়বার ১৯৩৪-এ যখন অ্যালিস আবার এলেন এই দেশে, সেই সময় থেকে প্রায় ধারাবাহিকভাবে তিনি লিখেছেন ডায়েরি। নিয়মিত বা দৈনিক নয় সেই দিনলিপি। কিন্তু তাঁর মনে আঁক ফেলেছে যেসব ঘটনা, দেখা, অনুভূতি-উপলব্ধি গুরুত্ব পেয়েছে সেইসব দিন-ক্ষণ। তিনি লিখেছেন মূলত তাঁর নিজের ভাষায় জার্মানে, এবং কখনও-কখনও ইংরেজিতে। পরে ইংরেজিতে অনূদিত হয় সেই ডায়রি। প্রকাশিত হয় গ্রন্থাকারে ১৯৯৩-এ। ‘অ্যালিস বোনার ডায়ারিস: ইন্ডিয়া 1934-1967’। প্রথিতযশা অপরূপ সেই মানুষের চোখে কেমনভাবে ধরা দিয়েছে আমাদের দেশ আর দেশের ধারা পড়লে, অভিভূত হয়ে যেতে হয়। অ্যালিস দেখা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও। ধরা রয়েছে সেইসব অমূল্য মুহূর্ত-কথাও।
আরও পড়ুন
সৌভাগ্য স্বয়ং এসে দাঁড়ালেন
নভেম্বর ১৩, ১৯৩৪ এ ডায়ারিতে লিখেছিলেন অ্যালিস, আমার সময়ের ধারণাগুলো যেন কেমন তালগোল পাকিয়ে গেছে। গতকাল কী হল? বা গত পরশু? কিংবা আজ? বা আজ সকাল?... এই দেশে ঐতিহাসিক সময়ের ক্রমপরম্পরাটি কেন কাজ করে না বুঝতে পারছি। সময় যেন ঝুলে আছে, দিন আর রাত স্পর্শ করে না তাকে। এখানে ক্যালেন্ডারের মতো ননসেন্সিকাল বিষয় আর কিছু হয় না। বর্তমান আর প্রাত্যহিকতার বাইরেও রূপকারের চোখ সমান্তরালভাবে খুঁজে নিচ্ছিল ভারতের শাশ্বত প্রহর। আর সেইসূত্রেই ক্রমে নিষ্প্রয়োজন হয়ে উঠছিল প্রায়োজনিক রোজনামচা। অসামান্য একটি খোঁজ দিয়েছিলেন এই ‘ভারতীয়’ বিদেশিনী। অগাস্ট ১৪, ১৯৩৭-এর ডায়রিতে লিখেছিলেন, ভারতবর্ষ সম্পর্কে আমার প্রথম অনুভূতি তৈরি হয়েছিল ফর্মের মধ্যে দিয়ে, আর্টের মধ্যে দিয়ে, হ্যাভেলের বইয়ের মধ্যে দিয়ে এবং লিভিং সোর্স অফ ইন্ডিয়ান স্ক্যাল্পচার উদয়শঙ্করের নাচের মধ্যে দিয়ে। উদয়শঙ্করের নাচই ছিল আমার কাছে ভারতীয় স্থাপত্যের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।
ওড়িশি, গৌড়ীয় প্রভৃতি নৃত্যশৈলীর সঙ্গে স্থাপত্যের সরাসরি সম্পর্কের কথা সকলেই জানেন, কিন্তু উদয়শঙ্করের নৃত্য প্রসঙ্গে সম্ভবত অ্যালিসই সর্বপ্রথম নজরগোচর করে তুললেন বিষয়টিকে। বহু পরে উদয়শঙ্করের নৃত্যে অনুপ্রেরণা বিষয়ে বলতে গিয়ে বিষয়টি আলোচনা করেছিলেন রবিশঙ্কর। তাঁর পূর্বোল্লিখিত বইতে ‘দাদা’ অধ্যায়ে জানিয়েছিলেন, উদয়শঙ্করের নৃত্যে প্রভাব মুখ্যত দুটি। প্রথমত, গুরু শঙ্করণ নাম্বুদ্রির সূত্রে লব্ধ প্রাচীন শাস্ত্রীয় কথাকলি নৃত্য। আর ‘দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল অজন্তা, ইলোরা, বাগ, এলিফ্যান্টা, কান্নাড়ি প্রভৃতি গুহার ভাস্কর্য। মহাবলীপুরম, কোনারক প্রভৃতি মন্দির গাত্রের ভাস্কর্যও দাদাকে নতুন ভাবনার পথ দেখায়। ইলোরা অজন্তার প্রস্তুরীভূত ভাস্কর্যের দেহবল্লরীর অপরূপ সুষমার মধ্যে জীবনের তরঙ্গ অনুভব করতে শুরু করলেন। এই সমস্ত ভাস্কর্য তাঁকে তাঁর নতুন নাচের ভাব যুগিয়েছিল। প্রাচীন ভারতের ওইসব স্থাপত্যের অপরূপ দেহভঙ্গিমা, প্রাচীন পোষাক-আশাক এবং গহনার ছাঁদ গ্রহণ করেছিলেন তাঁর রচিত নৃত্যের জন্য।’
এপ্রিল ৭, ১৯৩৭-এ, দেখতে গেলে, ডায়ারি শুরু করবার কতদিন পর, স্বগত উচ্চারণে তিনি ব্যক্ত করলেন তাঁর গভীর এক অনুভবের কথা। অপরূপ, অনিন্দ্য, ছাঁচভাঙা এক শৈল্পিক সম্পর্কের দ্যুতি ছড়িয়ে রইল ডায়ারির ওই পাতায়। ডায়ারিতে কথা বলা, সে তো নিজের কথা নিজেকেই জানান দিতে দিতে যাওয়া। সে প্রকাশ করাও বটে আর একই সঙ্গে আড়াল করে রাখাও বটে। যেন নিজের হৃদয়সত্যকে বর্ণ-ধ্বনিতে দেখতে পাওয়ার গভীর তৃপ্তিটুকু লাভ করা। অ্যালিস বললেন, ‘যা খুঁজছিলাম তা কখনও পাইনি প্যারিসে। সেখানকার নির্লজ্জ, শরীরী কামনাময় পরিবেশে শিল্পের সত্যানুসন্ধান, আর তাকেই শিল্প বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা ভালো লাগছিল না আমার। শিল্পকে আমি দেখতে চাইছিলাম স্টুডিও-র বাইরে, জীবনের কাছাকাছি প্রকৃতির মধ্যে।’ তারপর জানালেন, ‘সেখানেই আমি আরো ভালোভাবে চিনলাম উদয়কে। যা আমি খুঁজছিলাম, সেই সমস্ত কিছু ধারণ করেছিল উদয়ই। উদয় আমাকে দিয়েছিল আনন্দ আর শক্তি। আর আমি তাকে উৎসাহিত করেছিলাম নতুন-নতুন ভাবনায়।’ কী একান্ত। কী নির্জন। কী নিজস্ব এই স্বীকৃতি।
Powered by Froala Editor