শঙ্কর সরণি - ১৩
আগের পর্বে
১০ বছর পর দেশে ফিরলেন উদয়শঙ্কর। সঙ্গে অ্যালিস বোনার। প্রথমেই উদয় গেলেন কাশীতে, মায়ের কাছে। সামান্য অর্থসম্বলের মধ্যেও মায়ের গুছিয়ে রাখা সংসার। দশ বছর পর ছেলেকে পেয়ে হেমাঙ্গিনীর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। ভাইয়েরাও বড়ো হয়েছে। তারা পৃথিবীবিখ্যাত মানুষটিকে কোথায় রাখবেন বুঝতে পারলেন না। তবে উদয়শঙ্করের সহজ ব্যবহারে সেই দূরত্ব মুছে গেল সহজেই। অন্যদিকে সবার ছোট রবিশঙ্কর জ্ঞান হয়ে থেকে দাদাকে দেখেনি। সে সম্পূর্ণ অধিকার করে বসল উদয়শঙ্করকে।
অ্যালিস বোনার বারাণসী দিয়েই শুরু করলেন তাঁর ভারতযাত্রা। প্রাচীনত্বের অলংকারে সজ্জিত এক নগরী। ইতিহাসের চেয়েও পুরোনো। যেন পুরাণ থেকে খসে-পড়া এক জনপদ। অতীত এখানে অক্ষয়। অনড়। ভূমিতে প্রসারিত বেগবতী। স্থাপত্যের কারুকাজ ওই জলের সঙ্গে লগ্ন হয়ে, দাঁড়িয়ে আছে অভ্রভেদী গরিমায়। রাজকীয় ঔদ্ধত্য হেনে সারি সারি তোরণ-প্রাসাদ। ঘাটকে এমনভাবে সাজতে কেউ দেখেনি কখনও। বাহারি বর্ণে জলের ওপর নির্ভার দুলে চলেছে ডিঙি। দেবতার আবাসভূমি কাশী, একথা বিশ্বাস করতে চেয়েছে মানুষ। গঙ্গাতীরের শ্মশানে নির্মোহ আত্মবিলীনকে দেখতে চেয়েছে সে। মেনেছে সেই তার স্বর্গদ্বার। যুক্তি-অযুক্তির পাশ এড়িয়ে মানুষের মনের বিশ্বাসভূমিতেই যে সত্য কাশীর বাস একথা ভুললে চলবে কী করে।
সান্ধ্যকালীন কাশী, সেও তার এক অপরূপ চিত্র। সূচীভেদ্য শর্বরী, তাতে লক্ষ নক্ষত্রের সম্ভারে কে করছে প্রজ্বলিত আকাশপ্রদীপ। আর ঠিক তেমনভাবেই কৃষ্ণকায়া স্রোতস্বিনীর গায়ে ফুটে উঠছে, অনন্তের উদ্দেশে ভাসিয়ে- দেওয়া, ইচ্ছাপূরণের মাটির প্রদীপ। অভিন্ন পরিধান, অভিন্ন আলোর স্বর্ণালঙ্কারে সেজেছে আকাশ-গঙ্গা। যেন প্রস্তুত হয়েছে স্বর্গলোক, ইন্দ্রসভা। আরতির আলোর আভা, সম্মিলিত মন্ত্রোচ্চারণের ধুন হাওয়ায় ভাসতে-ভাসতে স্পর্শ করছে মানবের অস্তিত্বের গভীরে লুকিয়ে থাকা নভোস্তল। অ্যালিস অবাক মুগ্ধতায় চেয়ে দেখলেন বেনারসকে।
একখানা ছোট্টো হোটেলে ঘর ভাড়া নিয়ে নিজেকে মেলে বসলেন অ্যালিস। কাগজ-পেন্সিল-রঙ-ক্যামেরা আর মূর্তি গড়ার যাবতীয় জিনিসপত্রে গুছিয়ে নিলেন ঘর। মানুষের প্রয়োজনে আগাগোড়া নিঃসংকোচ দরাজ ছিলেন বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী অ্যালিস। কিন্তু নিজের প্রয়োজনকে রাখতেন মিতব্যয়িতার ঘেরাটোপে। একদিন এই হোটেলের ঘরেই কথা বলছিলেন উদয়শঙ্কর আর অ্যালিস। আকস্মিক কথা থামালেন উদয়। দূর থেকে ভেসে আসছে একটা ক্ষীণ স্বর। তিনি অপেক্ষা করলেন। শব্দ এগিয়ে আসছে তাঁদেরই দিকে। জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখলেন প্রশাসনের তরফ থেকে হেঁকে চলেছে কোনো বিজ্ঞপ্তি। তাদেরই কারোর হাতে বাজছে ওই শব্দ। দ্রুত নীচে নেমে এলেন তিনি। দেখলেন ছোট্টো ঢোলের মতো দেখতে একটা বাজনা। কিন্তু বেশ খানিকটা লেপে দেওয়া আছে মাটিও। এদেরই হাতে-হাতে তৈরি বোধহয়। এসব কাজের কথা মাথায় রেখে বানিয়ে নিয়েছে। অথবা মিলতে পারে দেহাতি বাজারে। কিন্তু তর সইল না তাঁর। উদগ্রীব উদয় ওই যন্ত্র-বাজিয়েকে অনুনয় করে বসলেন, এটা কি তাঁকে দেওয়া যেতে পারে? আকাশ থেকে পড়ল সে মানুষ। এই হেলা-ফেলার জিনিস নিয়ে এত বড়ো মানুষের, এ কী অদ্ভুত ছেলেমানুষি? তাছাড়া, এখনও তার মেলা কাজ বাকি।
অদূরে দাঁড়িয়ে এ কাণ্ড দেখছিলেন এই হোটেলেরই একজন। উদয় আর অ্যালিসকে তাঁরা দেখছেন কদিন। সবটা বোঝেন তেমনটা নয়, তবু এটুকু বোঝেন, এঁরা যেন কেমন অন্য ধারার মানুষ। এঁদের আগলে রাখার স্বযাচিত দায়িত্বটি তাঁরা নিয়েছেন এই অল্প সময়েই। এগিয়ে এসে মধ্যস্থতা করলেন তিনি। কী সব বোঝালেন তাকে। যন্ত্র-বাজিয়ে ঢোলটি দিয়ে দিলেন উদয়শঙ্করকে। অভিভূত উদয় শিশুর সারল্যে ধন্যবাদ দিলেন তাকে। পীড়াপীড়ি করে, দিলেন অর্থমূল্যও। তারপর বিস্মিতদৃষ্টিতে আপন মনে চললেন সেটা বাজাতে-বাজাতে। কাজ ভুলে সে যন্ত্র-বাজিয়ে দাঁড়িয়ে রইল বেবাক। উদয়শঙ্করকে নিয়ে বিষ্ণুদাস শিরালির গল্পটা মনে পড়ে যায়। সুর আর ধ্বনির লহরী উঠত তাঁর অন্তঃকরণে, সে কথা কে বুঝবে।
আরও পড়ুন
হেমাঙ্গিনীর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল জল
অ্যালিসের ভারতভ্রমণের বিষয়টা অনির্দিষ্ট করে দেখতে চাননি উদয়শঙ্কর। ফলত সুপরিকল্পিতভাবে এর দায়িত্বভার নিলেন তিনি। এ ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করলেন পিতা শ্যামশঙ্কর। অ্যালিস বোনারের কর্মপরিচিতির বিস্তারিত বিবরণসহ তাঁর দেশভ্রমণের ইচ্ছা আর কারণটি জানিয়ে একটি চিঠি প্রস্তুত করলেন উদয়। সঙ্গে দিলেন তাঁর নিজের কাজ-কর্মের হালহদিশও। সেই চিঠি পাঠানো হল বিভিন্ন রাজা-মহারাজাদের উদ্দেশে। তাঁদের রাজত্ব পরিভ্রমণের আকাঙ্ক্ষাটি প্রকাশ করে। স্থাপত্য-শিল্পের আস্তানা তখন মূলত রাজমহল অথবা রাজার আয়ত্তাধীন। নিজের কাজের জন্য অ্যালিস হয়তো এক-একটি স্থানে বসবাস করবেন দীর্ঘ সময়। তাছাড়া ভারতীয়ত্বকে বুঝতে চান বোনার। সুর-তাল-শিল্প-স্থাপত্য সমাহারের একটা অংশ যে রাজার শামিয়ানায়, সে কথা যে অনস্বীকার্য। সমস্ত কিছু মাথায় রেখে তৈরি হল চিঠির বয়ান। উত্তর এল পত্রপাঠ। বিভিন্ন প্রদেশের মহারাজারা সসম্মান আমন্ত্রণ জানালেন অ্যালিস বোনার এবং উদয়শঙ্করকে। প্রকাশ করলেন তাঁদের সঙ্গে আলাপের বিষয়ে তাঁদের ঔৎসুক্য।
শুরু হল যাত্রা। উদয় উপলব্ধি করলেন, দেশে জন্মলাভ আর দেশে দিনযাপন করলেও, দেশকে জানি বলার সদর্থ অধিকারটি, কী দুর্লভ এক বস্তু । দেশও একটা অন্তহীন খোঁজ। দেশও একটা নিরন্তর চর্চা।অ্যালিস বোনার যে তাঁর ভ্রমণ সঙ্গী, এ তাঁর উপরি পাওনা। নিজের দেশ বলেই কখনও কোনো দেখাকে গ্রাস করতে পারে বহু পরিচয়ের ঈষৎ শৈথিল্য। কিন্তু বোনার দেখছেন তাঁর অপরিচয়ের বিস্ময়ে। দেখছেন তাঁর শৈল্পিক দৃষ্টির স্থৈর্যে। তাঁর সান্নিধ্যে উপায় কী, এক লহমারও বিচ্যুতি?
আরও পড়ুন
সৌভাগ্য স্বয়ং এসে দাঁড়ালেন
উদয়শঙ্কর আর অ্যালিস বোনার গেলেন বরোদার রাজ অতিথি হয়ে। রাজকীয় অভ্যর্থনায় তাঁদের নিয়ে যাওয়া হল রাজ-অন্তঃপুরে। বরোদার স্মৃতি উদয়শঙ্করের জীবনে স্থায়ী হয়ে রইল। তিনি পেরোলেন একটা সিংহদ্বার। প্রবেশ করে দেখলেন যত দূর দৃষ্টি যায় এই কক্ষ বিস্তৃত ততদূর । রাজার পাঠাগারে তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন নিশ্চল। কদিন এখানেই ডেরা বাঁধলেন তিনি। শাস্ত্র। পুঁথি। এইসব গ্রন্থ তাঁকে হাজির করল কতশত অশ্রুতলোকের দরবারে। রাজ-গ্রন্থাগারিক নিঃশব্দ-দূরত্বে কদিন দেখলেন তাঁকে। রাজার গ্রন্থাগারিক তিনি, অতিকায় সমৃদ্ধ এক পাঠাগারের গ্রন্থাগারিকও বটে। উদয়শঙ্করের অনুসন্ধিৎসাকে অনুমান করতে পারলেন তিনি। একদিন কাছে এসে তাঁর হাতে তুলে দিলেন একটি গ্রন্থ। জানালেন, এই বই ভালো লাগতে পারে তাঁর। উদয়শঙ্কর দেখলেন ভারতীয় বাদ্যবিষয়ক একটি বই। বইটির প্রতি আকৃষ্ট হতে কয়েকটি পলেরও বিলম্ব ঘটল না তাঁর। তার পরের কয়েকটা দিন, তিনি পাঠরত আবেশে রইলেন গ্রস্ত হয়ে।
আরও পড়ুন
এখানে তোমাকে মানায় না শঙ্কর
সে বইতে রয়েছে আদিকাল থেকে চলে আসা যাবতীয় দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের হদিশ। একই যন্ত্রের কত প্রকারভেদ। নির্মাণের সামান্য তরি-তফাতে খুলে গেছে কত ভিন্নসুরের উৎসমুখ। বিবরণ রয়েছে ফুঁ দিয়ে বাজানো বা বাঁশি গোত্রীয় যন্ত্রের আশি থেকে নব্বুই রকমের উল্লেখ। তারযন্ত্রের কথা রয়েছে ষাট রকমের। রয়েছে দুশো আশি রকমের ঢোলবাদ্যের সন্ধান। উদয়শঙ্কর দেখলেন বইতে উল্লিখিত রয়েছে, সময়ের অতলে হারিয়ে যাওয়া কত কত বাজনা। একটি বাজনার বিস্মৃতি যে একটি অদ্বিতীয় ধ্বনিস্বরেরও প্রস্থান, সে কথা তাঁর চেয়ে ভালো কে জানে?
রীতিসম্মত চর্চায় সৃষ্ট হয়নি উদয়শঙ্করের নৃত্যলোক। তাঁর নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত নৃত্যশৈলীর তাত্ত্বিক প্রেক্ষিত গঠনে সহায়ক হয়েছিল সম্ভবত দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রথমত, তাঁর পাঠক সত্তা। তাঁর জিজ্ঞাসু ও গ্রহিষ্ণু সত্তা। গ্রন্থপাঠকে শুধুমাত্র পড়া এবং জ্ঞান আহরণের লক্ষ্মণরেখায় সীমাবদ্ধ করে দেখেননি তিনি। গ্রন্থ তাঁর আচার্যও। সেইসূত্রেই শিক্ষাগ্রহণ আর শিক্ষাঙ্গন বিষয়টিকেও তাঁর বৈদগ্ধ্য গ্রহণ করেনি স্থানসংলগ্ন করে। বিশ্বলোকের যেকোনো জ্ঞানবস্তু আর তাঁর নিজস্ব বোধ, শিক্ষা আর শিক্ষাগ্রহণের ধারণাকে রূপান্তরিত করে নিয়েছিল তাঁর স্বকীয় পদ্ধতিতে। তাঁর গ্রহিষ্ণুতা আর তাঁর মনোলোকই তাঁর শিক্ষাক্ষেত্র।
আরও পড়ুন
বাংলার গণ্ডি পেরিয়ে সুন্দরবনের মধু এবার পাড়ি দিচ্ছে বিদেশেও
দ্বিতীয় বিষয়টি, তাঁর সুবিস্তৃত সৌভাগ্যময় জীবন অভিজ্ঞতা।ক্ষণজন্মা, প্রতিভাবান, পণ্ডিত, শিল্পী, গুণী, জ্ঞানী, তাত্ত্বিক আশ্চর্য সব মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন তাঁর জীবনধারায়। অসামান্যকে দেখেছিলেন। দেখেছিলেন সামান্যের মধ্যে অসামান্যতাকেও। দেখতে পারার সেই দুর্নিবার ক্ষমতাটি তাঁর ছিল। নৃত্যপর নিম্নবর্গীয় বালক মাতাদিন হোক, ক্যাবারে হোক অথবা কুমারস্বামীর অনূদিত বইয়ে নন্দিকেশ্বর-বর্ণিত নন্দনতত্ত্ব থেকে মুদ্রাজ্ঞান লাভ, তাঁর জীবন ছিল নৃত্যশিক্ষার উদার পাঠশালা-প্রাঙ্গণ। নিজের ক্যাবারের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে একবার বলেছিলেন তিনি, একটা ঘুপচি আলো-আঁধারিতে নাচতে হত আমাকে। সবাই মদ্যপানে ব্যস্ত, ফূর্তি করছে, রাতের পর রাত, কী যে সেখানে করে যেতাম আমি। কিন্তু এখন ভাবি, সেই সমস্ত দিন আমার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ সেখানেই আমি হাতে-কলমে বুঝতে শিখলাম সত্যিকারের চোখ-ধাঁধানো আর মন-ভোলানো নাচকেও কী ভাবে করে তুলতে হয়। সমস্ত মানুষ আর তাঁদের কর্মধারার সারটুকু নিঙরে নিতে পেরেছিলেন তিনি। সংস্কারশূন্য ঔদার্যে তা গ্রহণ করেছিল তাঁর মননশীল হৃদয়বিশ্ব। হয়তো বা সেই ব্যাপ্ত প্রাপ্তিলোককেই উজাড় করে তৈরি হয়েছে তাঁর সৃজনলোকের নেপথ্যভূমি।
ভারতভ্রমণের উদ্দেশ্যে উদয়শঙ্কর আর অ্যালিস বোনার পৌঁছোলেন ত্রিবাঙ্কুর রাজপ্রাসাদে। আভিজাত্য আর সংস্কৃতিমনস্কতার জহরত দিয়ে সাজানো রাজার প্রাসাদসৌধ। রাজ অতিথিকে বরণ করায় রাজপরিবারের তরফে বন্দোবস্ত ছিল প্রাচুর্যময়। খাতির ছিল। অভ্যর্থনায় ছিল সনাতন উষ্ণতার রেশ। মহামান্য অতিথিদের সংবর্ধনায়, মহারাজের নির্দেশে আয়োজিত হয়েছে সান্ধ্যকালীন নৃত্যানুষ্ঠান। মহলের রীতি মেনে উদয়শঙ্কর ও অ্যালিস উপস্থিত হলেন যথাসময়ে।
ত্রিবাঙ্কুর রাজের নৃত্যাঙ্গনে পরিবেশিত হবে কথাকলি নৃত্য। প্রায় তিনশো বছরের পুরোনো এক কলারীতি। এই নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গত করে মূলত বিচিত্র আকৃতির ঢোল। অতিকায় পোষাক। অতিরঞ্জিত প্রসাধনেই তার মুখ্য আকর্ষণ। হিন্দু পুরাণ আশ্রিত আখ্যানের কোনো খণ্ডাংশের অভিনয়কেই প্রকাশ করা হয় নৃত্যধারায়। অক্ষি আর তার পারম্পর্যে অঙ্গুলিসঞ্চালন এই আঙ্গিকের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। নাটকীয়তা এর আধার। সেদিন প্রদর্শিত হবে মহাভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাহিনি, দুঃশাসন বধ।
জ্বলছে লক্ষ প্রদীপ। অপূর্ব কারুকাজে গড়া অষ্টধাতুর পিলসুজ। ধাপে ধাপে ধাতুর আলপনা বেয়ে, উঠে এসেছে সুসজ্জিত প্রদীপ। স্বর্ণাভ দ্যুতি বিকিরণ করছে রাজকীয় পরিমিতি আর গাম্ভীর্যে। মহারাজের অক্ষিপল্লবে আভাসিত হল শুভারম্ভের অনুমতি। সায়ংকালীন স্তব্ধতাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে গমকে গমকে বেজে উঠল ঢোল। আবির্ভাব ঘটল নৃত্যগুরুর। গুরু শঙ্করণ নাম্বুদ্রির। কুরুরাজগৃহে দ্রৌপদীর প্রতি দুঃশাসনের অক্ষমণীয় অসম্মানের প্রতিশোধ নেবেন ভীম। কুরুক্ষেত্রের সপ্তদশ দিনে। দুঃশাসনের বক্ষলোক বিদীর্ণ করে ভীম পান করবেন সেই শোণিত। রাজমহিষীর প্রতি অকল্পনীয় অন্যায়ের স্মৃতি জন্ম দেবে সেই নারকীয় ক্রোধ। নাম্বুদ্রির অভিব্যক্তি আর আবহ, নৃত্যাভিনয় আর ধ্বনি কোন মায়াবলে যেন প্রতিভাত করল উড্ডীয়মান রক্তনিশানের সেই বিভীষিকাময় ধূ-ধূ রণভূমি।
পরের দিন সময়নির্দিষ্ট রাজভোজের প্রাক্কালে আলাপবিনিময় পর্বের সূচনা করলেন মহারাজ। গুরু নাম্বুদ্রি সেখানে উপস্থিত। প্রসাধনের আড়ালমুক্ত আজ তাঁকে দেখা যাচ্ছে পূর্ণ করে। জ্ঞানগম্ভীর, ধীর, স্নিগ্ধ। গতরাত্রে সেই অনুষ্ঠানের পর থেকে এক মুহূর্ত স্থিরতা লাভ করেননি উদয়। যেন অনন্ত বিভাবরী পেরিয়ে এলেন তিনি। অতিদ্রুত স্পন্দিত হৃদস্পন্দন ভিন্ন যেন বধির হয়ে আছে তাঁর শ্রুতি। অপেক্ষমাণ এই ক্ষণটির আকাঙ্ক্ষায় তিনি দাঁড়িয়ে আছেন কম্পিত বক্ষে। গুরু শঙ্করণ নাম্বুদ্রির সঙ্গে পরিচয়ের সময় দু হাতে তাঁর পাদস্পর্শ করে, তাঁকে প্রণাম করলেন উদয়। পদধূলি গ্রহণ করে, বিনীত সেই ভঙ্গিতেই করজোড়ে অনুনয় করলেন, আমাকে কি আপনার শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভব হবে?
গুরু নাম্বুদ্রি দীর্ঘ সময় নিয়ে শুনলেন উদয়ের কথা। নৃত্যবিষয়ে তাঁর পড়াশোনা ও ভাবনা-চিন্তার কথা। সেসব কথা ভালো লাগল তাঁর। তবে, হৃদয় জয় করে নিল যুবকের আচরণ, তাঁর শিখতে চাওয়ার অভিলাষ। মহারাজার রাজ-ঘরানার শিল্পী তিনি। মহারাজ তাঁর পৃষ্ঠপোষক। তবু গুরু শঙ্করণ নাম্বুদ্রি উদয়কে ভালোবেসে তাঁকে দিলেন প্রতিশ্রুতি। তাঁর আশ্রয়, উদয়ের জন্য, থাকবে সদা অবারিত।
Powered by Froala Editor