শঙ্কর-সরণি - ১১
আগের পর্বে
প্যারিসের ব্যালে স্কুলের কর্ত্রী জঁ রনসের হাত ধরে নতুন এক সময়ে পা রাখলেন উদয়শঙ্কর। আত্মীয়তা গড়ে উঠল দুই ফরাসি কন্যা মিশেল এবং সিমনের সঙ্গে। উদয় সিমনের নাম রাখলেন সিমকি। আর সিমকি তাঁকে ডাকলেন ‘দাদা’ বলে। প্যারিসের নানা অনুষ্ঠানে তাঁদের নৃত্যের প্রদর্শনে মুগ্ধ দর্শকরা। রাজপুত বধূর বেশে ইতিহাস তৈরি করলেন উদয়শঙ্কর। ডাক এল ফ্রান্সের বাইরে থেকেও। উদয় ও সিমকি সুইৎজারল্যান্ডেও জনপ্রিয়তা পেলেন। এইসময় আলাপ হল ভাস্কর অ্যালিস বোনারের সঙ্গে। তিনি উদয়শঙ্করের একটি প্রতিকৃতিও তৈরি করলেন।
অ্যালিস বোনার শুনছিলেন উদয়শঙ্করের জীবনকথা। আর সেই উপলক্ষ্যে, নিজের খণ্ডিত জীবনকে কেন্দ্রে রেখে, সেই আখ্যানবৃত্ত ধীরগমনে প্রদক্ষিণ করছিলেন উদয়শঙ্কর নিজেও। সদ্য অতীতকে পূর্বাপর দেখতে-দেখতে আসন্ন সময়টিকেও নীল-নকশার পূর্বপ্রস্তুতিতে ধরতে চাইছিল তাঁর মন। জীবনের সূচনালগ্নেই তিনি দেখেছেন নিরঙ্কুশ খ্যাতি। অযুত অর্জন। উচ্ছ্বাস আর উন্মাদনায় তখন দাঁড়িয়ে তিনি, পাদপ্রদীপের রোশনাইতে। অপ্রতিরোধ্য তাঁর শক্তি। স্বয়ংপ্রভ প্রতিভা তাঁকে প্রতিনিয়ত করেছে পূর্ণতর। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তিনি অনুভব করলেন অস্মিতাবিবর্জিত এক আকাঙ্ক্ষা। আর সেই আকাঙ্ক্ষা হল, তিনি দীক্ষিত হতে চান ওই তাল-লয়ের ভিত্তিভূমিতে।
উদয়শঙ্করের কথা বলা শেষ হতে, তন্নিষ্ঠ শ্রোতার মতো, অ্যালিস বললেন, তারপর? উদয় উত্তর দিলেন, তিনি ফিরতে চান দেশে। সুগভীর এক প্রশান্তি অনুভব করলেন বোনার। উদয় জানালেন, দেশে ফিরে তিনি খুঁজতে চান আকাড়া দেশের সুর, একান্ত দেশীয়-আঞ্চলিক যত বাদ্যযন্ত্র। খুঁজতে চান যথার্থ যন্ত্রী। সুর-তালের সমঝদারদের নিয়ে গড়তে চান দল। তারপর ফিরবেন, ইউরোপে। আত্মমগ্নতায় দীর্ঘ একটা সময় নিশ্চুপ রইলেন বোনার। তারপর স্বগতোক্তির মতো করে বললেন, আমিও যদি তোমার সঙ্গে যাই শঙ্কর? আমি খুঁজব একটা দেশ, আর তুমি স্বদেশ।
অ্যালিস বোনার জানালেন, মানুষের অস্তিত্বের প্রাত্যহিকতায় তিনি দেখতে চান ভারতবর্ষকে। তাদের নিত্যনৈমিত্তিকতায়। দেশের আনাগোনায় যত বিবিধ ঐতিহ্য, জানতে চান তাকে। ভাস্কর্য আর স্থাপত্যের নিরিখে নতুন ভূ-মানচিত্রে ঢেলে নিতে চান সে দেশের রেখাচিত্র। একটাই দেশ, অথচ ধারণ করেছে দ্বীপ-হ্রদ, অরণ্য-উপত্যকা, নদী-মরুভূমির বিচিত্র ভূমিরূপ। তেমনই হরেক তার জল-হাওয়া, বর্ণ-ধর্ম, বেশ-ভূষা, উৎসব-আচার। তিনি ভারতবর্ষকে দেখতে চান সেই লোকালয়ে। সেই জনস্থানে। সেই জনমানসের ভেতর দিয়ে। প্রথমে সবটা অসম্ভব মনে হল উদয়শঙ্করের। মনে হল অবিশ্বাস্য। ধাতস্থ হতে আনন্দের সীমা রইল না আর।
সমস্ত ব্যবস্থা হতে-হতে আর হাতের কাজ গুটিয়ে নিতে-নিতে সময় গেল কিছু। ১৯২৯ স্থির হল যাত্রা। ঠিক এই সময়েই প্যারিসে, কাকতালীয়ভাবে উদয়শঙ্করের সঙ্গে আলাপ হল উজ্জ্বল এক ভারতীয় তরুণের। নাম, বিষ্ণুদাস শিরালী। সংগীতশাস্ত্রে উচ্চতর গবেষণার কাজে তিনি রয়েছেন এখানে। উদয়শঙ্করও দিলেন নিজের পরিচয়। স্মিত হাসলেন বিষ্ণুদাস। জানালেন, তিনি উদয়কে চেনেন। তবে বিলেতে তাঁর খ্যাতিই তাঁকে চেনার একমাত্র কারণ নয়, তার অন্য কারণ রয়েছে। অবাক হলেন উদয়। বিষ্ণুদাস ডুব দিলেন তাঁর স্মৃতির ঝাঁপিতে। ধীরে ধীরে বললেন, তাঁর গুরু বিদগ্ধ বিষ্ণুদিগম্বর। বোম্বাইতে রয়েছে অতি উৎকৃষ্ট বাদ্যযন্ত্রের এক সাবেকি বিপণি। এই কার্যালয়ের নানা বিষয়ে যুক্ত রয়েছেন তাঁর গুরুও। তিনি নিজেও মাঝে-মাঝে নানা কাজে থাকতেন সেখানে। সেইখানেই একদিন এসেছিলেন এক তরুণ, সুদর্শন। গভীর ঔৎসুক্যে, তিনি গিয়ে দাঁড়াচ্ছিলেন প্রত্যেকটি বাদ্যযন্ত্রের কাছে। অনেকখানি সময় নিয়ে শুনছিলেন যন্ত্রনিঃসৃত ধ্বনি। তারপর মিলিয়ে আসা ধ্বনির অনুরণনকেও গ্রহণ করছিলেন একাগ্র অপেক্ষায়। যেন বিশ্বচরাচরের সমস্ত সুর এক অদৃশ্য পত্রপূটে ধারণ করে বিমোহিত করে তুলছিল তাঁর অন্তরাত্মাকে। ওই ঝংকার আর পদসঞ্চারের ভাববিহ্বলতা আজও রয়ে গিয়েছে তাঁর মনে। এতটুকু বলে থামলেন বিষ্ণুদাস। পুনরায় হাসলেন। উদয়কে তিনি দেখেছিলেন সেদিন, বোম্বাইতে, সেই ছাত্রাবস্থায়।
আরও পড়ুন
সৌভাগ্য স্বয়ং এসে দাঁড়ালেন
লজ্জা পেলেন উদয়শঙ্কর। তাঁর মনে পড়ল, পিতা শ্যামশঙ্করের প্রয়োজনীয় কিছু বাদ্যযন্ত্র কিনতে, তিনি গিয়েছিলেন সেই বিপণিতে। বিষ্ণুদাস শিরালীর গল্পের উদয়শঙ্কর, তখন জে জে স্কুল অব আর্টসের ছাত্র। চিত্রকলা বিষয়ক শিক্ষালাভ শেষে তিনি হতে চান কলাবিদ, চিত্রশিল্পী। তাঁর আসন্ন জীবনটি তখনও বিধাতা ভিন্ন আর সকলের অজ্ঞাত। অথচ কী আশ্চর্য, সেই অধ্যায়েও তাঁর গভীরতর সত্তা নিজস্ব পদচিহ্নটি, ঠিক রেখে গেছে জীবনপটে। তবে এই অতুলনীয় অভিজ্ঞতাটি যিনি গেঁথে নিয়েছিলেন নিজের স্মৃতির সঙ্গে, তিনিও যে সামান্য নন, অনুল্লিখিত থাকে না সেই কথাখানাও। সুর আর মানুষের সম্পর্কের এষণায় ধরা পড়ে বিষ্ণুদাসের দুর্লভ অন্তর্দৃষ্টিটিও। সকলেই জানেন, ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে দিকনির্ণায়ক, উদয়শঙ্কর-সৃষ্ট ‘কল্পনা’ চলচ্চিত্রটির সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব নেবেন এই বিষ্ণুদাস শিরালী।
উদয়শঙ্কর অ্যালিস বোনারের কথা জানালেন বিষ্ণুদাসকে। জানালেন তাঁর আগামী পরিকল্পনার কথা। তিনি দল-গঠনের ভাবনায় চলেছেন দেশে। তারপর সন্তর্পণে পাড়লেন তাঁর মনোবাঞ্ছাটি। দল নিয়ে এদেশে ফিরলে, তাঁর ইচ্ছা সেই দলে সামিল হোন তিনি। ফের হাসলেন বিষ্ণুদাস। সম্মতি দিলেন সাগ্রহে, সানন্দে। আশ্বস্ত করলেন তিনি অপেক্ষা করবেন।
আরও পড়ুন
উদয় নিজেও দাঁড়ালেন দর্পণের সামনে
‘অপেক্ষা’ শব্দে উদয়শঙ্করের মনে পড়ল আরো একটি নাম, সিমকি। খুব অল্পদিনেই নিজের জীবনের সঙ্গে যাঁকে জেনেছেন অপরিহার্য করে। তাঁর ললিত সৌন্দর্য, তাঁর শিল্পমনস্কতা উদয়ের জীবনে রচনা করেছে এক আনন্দলোক। এই আবির্ভাব তাঁকে উদ্দীপিত করেছে জীবনের প্রতি। সিমকির স্নিগ্ধ স্বভাব জীবনের মায়াময় সম্বন্ধে তাঁকে করেছে জাগরুক। তাঁর প্রতি সিমকির নিঃশর্ত সমর্পণটিও তিলমাত্র নজর এড়িয়ে যায়নি কখনও। চিরদিন তা গ্রহণ করেছেন পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে। নিজের দেশে ফেরার সংবাদটি নিয়ে তিনি পৌঁছলেন সিমকির কাছে। পরিচয়ের সূচনাপর্ব থেকেই উদয়ের ইচ্ছের সঙ্গে নিজের অস্তিত্বকে মিলিয়ে দেখেছেন তিনি। উদয়ের সঙ্গে দীর্ঘ সময়ের বিচ্ছেদের খবরটি নিঃসন্দেহে পীড়া দিয়েছিল তাঁকে। কিন্তু উদয় চলেছে শিল্পের সন্ধানে। তাঁর শেকড়ের সন্ধানে পরিপূর্ণতার খোঁজে। সেই নিবিড় প্রাপ্তির কাছে বেদনার চেয়ে আনন্দকেই তিনি দিলেন অগ্রাধিকার। তিনি প্রতীক্ষায় থাকবেন, জানলেন উদয়।
এল ১৯২৯। দেশের কূলে ভিড়বে যে তরী, সেই জাহাজের নাম, ‘দ্য গ্যাঞ্জেস’। প্রায় দশ বছর পর উদয়শঙ্কর ফিরছেন তাঁর দেশে। সমুদ্রের ওপর বইছে ‘গ্যাঞ্জেস’। বইছে স্মৃতির ঢেউ। উদয় এদেশে এসেছিলেন চিত্রকলা শিখতে। ছবিই ছিল তাঁর জগৎ। এই বিদেশের মাটিতেই তিনি দেখলেন কবিকে। বিস্ময়কর প্রতিভাশালী রবীন্দ্রনাথকে, যুগশ্রেষ্ঠ তাঁর নিজের দেশের মানুষটিকে। অজ্ঞাত, অব্যক্ত অনুভূতিলোকের রূপকার তিনি। চিনিয়ে ছিলেন জীবনদেবতাকে। জীবন যাপনের সমস্ত প্রান্তে, অতিতুচ্ছ-খুঁটিনাটির সবখানেও প্রোথিত করতে পেরেছিলেন শৈল্পিক প্রেক্ষিত। শুধু বিদ্বৎসমাজে নয়, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সমস্ত ক্ষেত্রের মানুষের সম্মোহনকে তিনি দেখলেন এখানেই। অনুপম সেই মুহূর্ত আঁকা হয়ে রইল উদয়শঙ্করের জীবনে।
আরও পড়ুন
দেখা করতে চাইলেন খোদ আনা পাভলোভা
তারপর রটেনস্টাইন। ইউরোপের চিত্রকলাই পড়তে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু রটেনস্টাইন তাঁকে বললেন, আগে দেশকে জানতে। অভাবিত এক শিক্ষার সঙ্গে পরিচয় ঘটল তাঁর। নিজের দেশকে ফল্গুধারার মতো বহন করছে প্রত্যেকের চেতনা। দেশকে অগ্রাহ্য করে নয়, তার ঐতিহ্যকে স্বীকার করেই বিস্তৃত করতে হয় অধিকার। উদার এ দর্শনের আশ্রয়ে সে যাত্রায় তাঁর শিক্ষালাভ হয়েছিল, আশ্চর্য শিক্ষকলাভও।
এই সময় তাঁর একান্ত সঞ্চয়টি ছিল শ্যামশঙ্করের সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ। পিতাকে চিরদিন দেখেছেন দূর থেকে। যখন কাছে থেকেছেন দূরত্ব তখনও থেকেছে স্বমহিমায়। পিতৃত্বের একটা আভাস পেয়েছেন। পিতাকে নয়। সেই আটপৌরে সম্পর্ক, সমস্ত পরিচিত কোলাহল থেকে সরে এসে, দাঁড়াল ভিনদেশে। পিতা-পুত্রের এক নিজস্ব শামিয়ানায়। পাণ্ডিত্য চিরকাল প্রাচীর নির্মাণ করে রেখেছিল শ্যামশঙ্করের চতুর্দিকে। পরিখা পেরিয়ে তাঁকে যখন দেখলেন তাঁর স্বক্ষেত্রে, উদয় তাঁকে আবিষ্কার করলেন নতুনতর করে। না, সব বাধা ধুয়ে-মুছে গিয়েছিল এমনটা হয়তো নয়। তবু বহু লগি ঠেলে সম্পর্ক যে নোঙর ফেলল ঈষৎ, তাও বা কম কি? উদয়শঙ্করের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণত না হলেও শ্যামশঙ্করের পরিবর্তনটি ছিল অচিন্তনীয়। সদ্য কৈশোর পেরোনো সপ্রতিভ, গুণী নিজের প্রথম সন্তানটিকে তার তারুণ্যে প্রথম অব্যবহিত করে লক্ষ করলেন তিনি। আর সেই সংস্পর্শ বিস্তার করল অমোঘ মায়াজাল। যে শৃঙ্খল থেকে অচিরদিন সুস্পষ্ট তফাতে রেখেছিলেন নিজেকে, আজ তাকেই মনে হল পরমরমণীয়। নিজের নৃত্যপ্রসঙ্গে উদয়শঙ্কর হয়তো কখনও পিতার উল্লেখ করেননি সেভাবে। কিন্তু পিতার ইচ্ছাতেই তাঁর বিলেতে আগমন। পিতার কর্মসহযোগী হয়েই যে এই চারুকলা প্রাঙ্গণে তাঁর অভ্যুদয়, সে কথা যে অনস্বীকার্য।
আনার সঙ্গে পরিভ্রমণ, সে তাঁর আত্ম-অভিযানও বলা যায়। জীবনের সূচনাতেই, অলীক নৈকট্যে এক জাত শিল্পীকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে দেখতে পারার সৌভাগ্যকে, ব্যর্থ হতে দেননি উদয়। পুঙ্খানুপুঙ্খ গ্রহণ করেছিলেন তাঁকে। যে শিল্প বহু জন আর বহু স্বর নিয়ে প্রবহমান তাঁর মন জরিপ করেছিল তার ধরন-ধারনও। আনার ক্রোধ আর তাঁর শিল্প-বিষয়ক চিন্তাধারা দুটিকেই উদয়শঙ্কর অনুধাবন করতে চেয়েছিলেন নির্মোহ হয়ে। আনা পাভলোভাই তাঁকে দিয়েছিলেন দেশে ফেরার পরামর্শ। দল গঠনের মতো জরুরি বিষয়টিও ছিল তাঁরই নির্দেশ। দেশের মৃত্তিকা ভিন্ন আত্ম-আবিষ্কার যে অসম্পূর্ণ, রটেনস্টাইনের মতো, তিনিও হয়েছিলেন সেই কথার দিশারি।
একে একে শকি, অ্যাডলেডের সঙ্গে সংগ্রাম আর সখ্যের দিনগুলি মনে পড়ছে তাঁর। লন্ডনের সেই দয়ার্দ্রচিত্ত গৃহকর্ত্রী? অনটনের দিনে উদয়ের কুশলটুকু নিয়ে তাঁর উদ্বেগ, অসম্ভব তার বিস্মরণ। উদয়শঙ্করের মনে পড়ছে প্যারিসে, ক্যাবারের সেই নর্তকীকে। আসক্তি আর আশ্লেষে লীলাচঞ্চল তাঁর জীবন। অথচ ওই কামোন্মত্ততার আঁধার আবেষ্টনেও, কী সংবেদী গাম্ভীর্যে, তিনি ব্যক্ত করেছিলেন, উদয়শঙ্করের শিল্পসম্ভ্রম নিয়ে তাঁর উৎকণ্ঠা। তারপর অ্যালিস বোনার, সিমকি। সাতসাগরের হাওয়ায় হাওয়ায় একে একে ভেসে উঠছে সব । বিদেশও তাঁকে অশেষ করেছে।
Powered by Froala Editor