যশোরের বাটাযোড় অমলার গ্রাম। গ্রামের গা দিয়ে বইছে নবগঙ্গা নদী। শীতকালের সকালবেলায় আকাশের নীচে খোলা উঠোনে জলখাবারের পাত পড়ত। লাল আতপ চালের ভাত আর বাড়ির তৈরি ঘি। খাওয়া শেষে বাড়ির ক্ষুদেরা হইহই ছুট লাগাত নদীর জলে হাত ধুতে। বাবা, অক্ষয়কুমার নন্দী, পেশায় ছিলেন স্বর্ণকার। কিন্তু মনের সবটুকু জুড়ে ছিল দেশ। তাই বাণিজ্যবৃত্তিকে আশ্রয় করে বিচিত্র উপলক্ষ্য তৈরি করে নিতেন দেশসেবার। ‘মাতৃমন্দির’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। ভক্ত ছিলেন শ্রীঅরবিন্দের। স্বদেশি করতেন বলে বাড়ির চৌহদ্দি পেরোত না বিলিতি জিনিস। সেইজন্যই একবার গ্রামের মেয়েদের কাঁচের চুড়ি পরতে বাধা দিলেন। মেয়েরা ভারি রাগ করল, বলল, কাঁচের চুড়ি ভাঙছ, সোনার চুড়ি দেবে? অক্ষয় বললেন, দেশ স্বাধীন হোক, তাই দেবো। বাঙালি মেয়েদের জন্য সস্তায় হালকা গয়না গড়বার চিন্তা বোধ করি সেই কারণেই এসেছিল তাঁর মনে।
মাটির ঘর ছিল, খড়ের চাল। ছোট্ট অমলা মাটি লেপত। একভাবে ঘুরত হাত। মাটি লেপা যেন আলপনার চেহারা নিত। সকলে প্রশংসা করতেন খুব। সন্ধেবেলা জ্বলত মাটির প্রদীপ। মাস্টারমশাই এলে সেই টিমটিমে আলোতেই চলত পড়া। গীতার শ্লোক ছিল কণ্ঠস্থ। ঢেঁকি পাড়তে পাড়তেও চলত শ্লোক বলা। কিন্তু বাবার শিক্ষা ছিল একেবারে অন্যরকম। সাফ-সুতরো দাওয়ায় ঢেলে দিতেন এক বস্তা চাল। বলতেন, বানাও দেখি দেশের মানচিত্র। অমলা বলতেন, ‘সে কী হইহই কাণ্ড রে বাবা। কেউ বানাচ্ছে গঙ্গা, তো কেউ পদ্মা। কেউ এ দেশকে তুলে দিচ্ছে ও দেশের ঘাড়ে। তখনও কি বুঝেছি নিজের দেশকে গড়ে তোলার, নিজের দেশকে মূর্ত করে তোলার অমন আশ্চর্য শিক্ষা তিনি আমাদের দিয়েছিলেন নিছক খেলাচ্ছলেই।’
একদিকে গ্রামীণ সহজতায় অনাড়ম্বর চলাচল, প্রকৃতির সঙ্গে নিরবিচ্ছিন্ন জীবনাচরণ অন্যদিকে অক্ষয় নন্দীর স্থৈর্যময় গভীর জীবনবোধের মিশেলে বড়ো হয়ে উঠছিলেন অমলা।
সমস্ত ফাল্গুন মাস জুড়ে তাঁদের গ্রামে চলত এক উৎসব। ছয় থেকে এগারো বছরের মেয়েরা করত। বাড়ির কোনো ফুলগাছের উঠোনে বানানো হত বেদি। আর বাড়ির প্রত্যেক সদস্যদের নামে তৈরি হত একটা ডালা। সে পুজোর নিয়ম ছিল বিচিত্র। ওই ডালাতে সাজিয়ে রাখতে হত সারাদিন-ধরে-ফোটা বারো রকমের ফুল। অমলা জানিয়েছিলেন, ‘ওই জন্যই তো এত ফুল চিনি। কোন ফুল কখন ফোটে, কখন ঝরে, কী রকম গন্ধ। ভাবি, সমস্ত ফাল্গুন মাস জুড়ে সারাদিন তো ফুল আর গন্ধের পিছনেই তো ছুটতাম। ফুলের খোঁজে বেড়ানো, সে এক কাণ্ড। এখনও সব সিজনে যেন সব ফুলের গন্ধ আমার কাছে ভেসে আসে। এর থেকে বড় সোশ্যাল সিস্টেম আর কী হতে পারে? ওই পুজোর একটা মন্ত্রও ছিল। আর যাকে বলে সে মন্ত্র একেবারে অনিঃশেষ। ডালা সাজিয়ে বলতে হত,
তুমি ঠাকুর ভালো, আমার মাকে কোরো ভালো,
তুমি ঠাকুর ভালো, আমার ভাইকে কোরো ভালো
এই রকমই চলতে থাকত। শেষে প্রণামের একটা প্রার্থনাও থাকত। গ্রামের লোক নানা রকম রোগেও তো ভুগত। খোস-পাঁচরার ভয়ও ছিল। তাই বলতে হত,
উজান থেকে এলেন ঠাকুর, খোস-পাঁচড়া নিয়ে,
তুমি ঠাকুর যাও গো আমার শাঁখা সিঁদুর দিয়ে।
কোনো ধর্ম নয়, সংস্কার নয়, জীবনের মধ্যে দাঁড়িয়ে পেয়েছি আনন্দের ধর্মকে।’
নৃত্যকলায় তাঁর খ্যাতি ভুবনবিদিত। কিন্তু ছবি-আঁকিয়ে অমলা, তাঁর এই উপেক্ষিত সত্তার সন্ধান যাঁরা জানতেন, বিস্ময়ের অবধি ছিল না তাঁদের। তর্জনি আর নখ দিয়ে ফুটিয়ে তুলতেন রঙ আর তার আবছায়া। নিজের ছবি আঁকা সম্বন্ধে বলতেন, ‘আমার ছবি আঁকতে পারাটা আমার কাছে ভারি অদ্ভুত ঠেকে। কী করে পারলাম। শিখিনি তো কখনও। কিন্তু এসব দেখতে দেখতে আর সব কিছুর মধ্যে মিশে থাকতে-থাকতেই বোধহয় নেচারের মধ্যেই পেলাম ছবি আঁকাকে। প্রকৃতির এত রং, ঋতুর আসা-যাওয়াতে তার সাজের কী বাহার। আর সেই সাজকে ঘিরে আবার মানুষের সাজ আর উৎসব। বোধহয় ওখান থেকেই ছবি এসে দাঁড়াল আমার কাছে। তবে শুধু ছবি আঁকা নয়, ছবির মধ্যে একটা চিন্তা, সেটাও আঁকলাম। আমার আঁকা একটা ছবি আছে। একটা ইয়ং মেয়ে, গায়ে তেমন ভালো জামা নেই। একটা সুতির শাড়ি, কিন্তু কোলে একটা কী সুন্দর বাচ্চা। মেয়েটা একটা গুহার মধ্যে বুদ্ধমূর্তির সামনে বসে আছে, maybe her illegitimate child… somebody must have ruined her life। কিন্তু তবু জীবন সুন্দর heavenly। mother-child relationship কী সুন্দর। ছবিতে ওই মেয়েটাকে দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। কোলে সুন্দর সন্তান আর ছবির সামনে কত shadow। ওইখানে দাঁড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ, সক্রেটিস…। ওরা অমর। ওই অমরত্বের মধ্যে দিয়ে ওঁরা সবটা দেখছেন। এটাই বলছিলাম, চিন্তাকেও আঁকছি।
আর একটা ছবি আঁকার অভিজ্ঞতা খুব মনে পড়ে। আঁকতে গিয়ে খুব মজা হয়েছিল। সেদিন ছবিতে একটা নির্জনতা আঁকতে চেয়ে ছিলাম। একটা নির্জন জায়গা, সুন্দর… এই রকম আর কী। কিন্তু আঁকতে আঁকতে শেষে দেখলাম, ছবিটা এত নির্জন হল, ওখানে তো আমি থাকতে পারব না। আমি তো লোকজন ভালোবাসি। তাই ছবির ভেতর এঁকে দিলাম, একজন বসে তপস্যা করছে। ছবিটা যখন আঁকছি, তখনই বোধহয় টের পাচ্ছিলাম, খুব নির্জন হয়ে যাচ্ছে। একটু আধটু মুছতে চাইছিলাম আর দেখছি my goodness, ওগুলোই জলের reaction হয়ে যাচ্ছে। ভাবি কোথায় পেলাম এসব?’
কলকাতায় তাঁদের ছিল আরেকখানা বাসা। অক্ষয় নন্দী বছরে তিনবার সন্তানদের নিয়ে আসতেন কলকাতায়। মাঘোৎসব, ক্রিসমাস আর মহরম। মাঘোৎসবে সাতদিন জুড়ে সমস্ত অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। এই স্মৃতির কথা বহুবার বলেছেন অমলা, ‘মাঘোৎসবে মন দিয়ে সমস্ত ব্রহ্মসংগীত শুনতাম। ক্রিসমাসে ভাইবোনেরা মিলে ট্রি করতাম। বাবা একদিন বললেন, আজ অশোক প্রার্থনা করবে। আমার ছোটোভাই। অশোক তখন ছ-বছরের। আমরা গোল হয়ে বসে। অশোক প্রার্থনা শুরু করলে, ভগবান আমাকে একটা সাদা ভাল্লুকের বাচ্চা দাও। ওরে বাবা, সে কী হাসি। উৎসবের কঠিন আচারের দিকটা নয়, সমস্ত উৎসবের নিজস্ব উদযাপন আর মেলামেশাতেই বাবা গুরুত্ব দিতেন বেশি। মহরমের দিন ভোর পাঁচটায় আমাদের নিয়ে যেতেন ভিক্টোরিয়াল মেমোরিয়ালে। ভোরের আলোতে অত অত মানুষের একসঙ্গে আনত হওয়ার ভঙ্গি আর নিবেদনকেই দেখতে বলতেন শুধু।’
অক্ষয় নন্দী ছিলেন উদার, সংস্কারমুক্ত। প্রগতিশীল ছিল তাঁর মন। কিন্তু স্ত্রীর পুজো-আচ্চা আচার-অনুষ্ঠান কোনো নিজস্বতাতেই তিনি বাধা দেননি কখনও। বিপরীত এই দুই ধারা অমলার মধ্যেও বয়েছে নিরুপদ্রবে। মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে অক্ষয় নন্দীর আগ্রহ ছিল প্রবল। তিনি চাইতেন মেয়েরা আত্মনির্ভর হোক। ‘মাতৃমন্দির’ সেই কারণেই গড়া। মেয়েরা নিজেকে খুঁজুক, তেমনই চাইতেন তিনি। তাঁদের লেখক সত্তাকে তিনি বিবেচনা করতেন বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে। ট্রামে মহিলাদের স্বতন্ত্র বসবার বন্দোবস্ত হয়েছিল তাঁরই উদ্যোগে। নিজের কন্যাসন্তানদের এ ব্যাপারে তাঁর পরামর্শটি সে যুগের পক্ষে ছিল রীতিমতো অভিনব। বলেছিলেন, মেয়েদের আসনে বসে যদি জায়গা ফাঁকা থাকে, তবে যে-কোনো বয়সের পুরুষই তখন সিটের অপেক্ষায় থাকুন-না-কেন, তাঁকে বসবার অনুরোধ করবে। আর যদি মেয়েদের আসন ভরা থাকে তবে নিজেও অন্য আসনে বসতে দ্বিধা কোরো না। মেয়েদের স্থানের স্বতন্ত্রীকরণের গুরুত্ব বুঝেছিলেন তিনি। আবার প্রয়োজনে সেই ব্যবস্থাকে পেরিয়ে আসার সংকীর্ণতা থেকেও মুক্ত হতে পেরেছিল তাঁর মন। অধিকার অর্জন আর অধিকার প্রয়োগের এই অভাবনীয় আধুনিকতা নিশ্চয়ই ছাপ ফেলেছিল অমলার মধ্যেও।
অমলা গয়না পরেছেন ষোলো টাকা ভরি, বাবার তৈরি গয়না। প্রথম ভারতীয় বাঙালি হিসেবে অক্ষয় নন্দী দোকান দিলেন কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে। ইকনমিক জুয়েলারি ওয়ার্কস। তাঁর কাজের কদর হতে থাকল ধীরে ধীরে। ব্রিটিশ এম্পায়ার এগজিবিশন চলছে তখন বিলেতে। ব্রিটিশ সরকার আমন্ত্রণ জানালেন তাঁকে। ভারতীয় কারিগর কীভাবে পাইপে ফুঁ দিয়ে গয়নায় নকশা ফুটিয়ে তোলে তা শিখিয়ে দিতে হবে তাঁদের। প্রত্যাখ্যান করলেন অক্ষয়। তাঁর মনে ক্ষোভ ছিল, ম্যাঞ্চেস্টারে গিয়ে শেষ হয়ে গিয়েছে আমাদের বেনারসির ঐতিহ্য, গয়নার ক্ষেত্রে তিনি অন্তত তেমনটা হতে দেবেন না।
বিলেত তিনি গেলেন, তবে স্বেচ্ছায়। ১৯৩১-এ ইন্টারন্যাশানাল কলোনিয়াল এগজিবিশন-এ। সঙ্গে নিলেন দেশের হস্তশিল্প। দেশের টুকিটাকি প্রয়োজন মেটাতে, কখনও গ্রামীণ শিল্পের তাগিদে যেসব জিনিসের উদ্ভাবন, অক্ষয় বুঝেছিলেন তার বৃহত্তর তাৎপর্য। বড়ো বড়ো বাক্সে খই ভরে নিয়ে গেলেন হাতের তৈরি শঙ্খের কাজ, হাতির দাঁতের জিনিস, কাঁথা আরো কত কী। সেই এগজিবিশনে লাভ হয়েছিল পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা। সেই টাকায় বিলিতি মেশিন কিনলেন তিনি। আর গ্রামে ফিরে তাঁর বাবার স্মৃতিতে গড়লেন এক অবৈতনিক স্কুল।
বিদেশ থেকে গ্রামে ফিরলেন অক্ষয়। বেধে গেল ধুন্ধুমার। পণ্ডিতরা আপত্তি করলেন, সাগর পেরিয়েছ, প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে। অক্ষয় বললেন, তাই হবে। পাঁচটা গ্রামকে নেমন্তন্ন করা হল। একুশ-বাইশটা করে পরিবার তখন এক-একটা গ্রাম জুড়ে। সবাই এল। ছুতোর-কামার-মুচি-মেথর। বাদ শুধু ব্রাহ্মণ। স্বাভাবিক রইল না পরিস্থিতি। হাল ধরলেন স্ত্রী। তাঁর আর স্বামীর বিশ্বাসের জগতের মধ্যে ব্যবধান ছিল বিস্তর। তবু তাঁর মধ্যস্থতাতেই শান্ত হল সব।
Powered by Froala Editor