এই অভিনব কাণ্ডটি ঘটিয়েছিল অগ্নিজিৎ! অগ্নি আমার বন্ধু। কলকাতায় আয়োজিত ‘মেসি ম্যাচে’ ও মাঠে গিয়েছিল। আর আমি অনলাইনের গ্যাঁড়াকলে টিকিটের হাল-হদিশ না পেয়ে লেবেঞ্চুস চুষতে চুষতে বাড়িতে বসে টিভিতে ওই ম্যাচ দেখেছিলাম। তবে, বাবাকে এত চুপচাপ বসে খেলা দেখতে দেখিনি কখনো। কারণ জিজ্ঞেস করতে বলল― “এটা ডার্বি নয়। অত আদিখ্যেতা কেন কে জানে!” আমি বিষয়টাকে প্রজন্মের ফারাক বুঝে এড়িয়ে গেলাম। তবে, আমাদের প্রজন্মের এই ম্যাচ থেকেই ভারতের ফুটবল ইতিহাসে কোনো ম্যাচে অনলাইনে টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছিল। কেবল তাই নয়, মেসি ম্যাচকে ঘিরেই যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের আধুনিকীকরণ শুরু হয়। তৈরি হয়েছিল ১০০ সিটের মিডিয়া বক্স, ৪৪ সিটের ভিভিআইপি বক্স এবং টিভি ব্রডকাস্টিং সেন্টার। স্টেডিয়াম সংলগ্ন রাস্তায় টিনের শেড, উচ্ছিষ্ট বাঁশ কিংবা নির্মাণকাজের ধ্বংসাবশেষও সাফাই হয়। দর্শকদের জন্য ২৮টি টয়লেটের ওপর কাজ করেছিল পিডব্লিউডি। যাই হোক, আমাদের থিয়েটার দল ‘কিনাক’-এর প্রধান এই অগ্নিজিৎ। তা আপাতত দু-দিন পরের রিহার্সালের চিন্তাভাবনা পকেটে রেখে ভোলা চললেন ঝোলা নিয়ে। ম্যাচটি ছিল শুক্রবার। ২ সেপ্টেম্বর, ২০১১। আর প্রতি রবিবার হত আমাদের রিহার্সাল। তার কথায় পরে আসছি… আগে বলি সেই অভিনব কাণ্ডকারখানার কথা।
অফিস কেটে হায়াত রিজেন্সিতে গিয়েছিল অগ্নিজিৎ। তাও আবার ম্যাচের আগের দিন। লাঞ্চে। প্রায় পনেরোশো টাকা পকেট থেকে খসিয়ে। আর্জেন্টিনা দলের আপাত বসত যে হায়াত, তা আশা করি বুঝেই গেছেন। তা কী দেখেছিলি পাঁচতারায় মধ্যাহ্নভোজ করতে গিয়ে? ও যা বলল, তার সারকথা সত্যিই ঈর্ষণীয়। ওই সময় আর্জেন্টিনা দলও লাঞ্চ করতে আসে। এক্কেবারে দুইয়ে দুইয়ে চার হওয়ার মতো ব্যাপার যে! চোখের সামনে তখন দাঁড়িয়ে ক্যামিনো― আরে, জুলিয়ান ক্যামিনো! আশির দশকের শেষে কলকাতার ইস্টবেঙ্গলে খেলে যাওয়া সেই ক্যামিনো আর্জেন্টিনা দলের সাপোর্টিং স্টাফ! তো ক্যামিনো চামচে করে পাউরুটি তুলছেন। অগ্নিজিৎ-ও তাই। অগ্নি নার্ভাস। স্নায়ুসূত্রে উত্তেজনা প্রবাহে ওর চামচটাই তখন মাটিতে গড়াগড়ি। ক্যামিনো একটু সরে গিয়ে বললেন― আর একটা চামচ নিয়ে নিন, কোনো অসুবিধা নেই। একটু কোনায় তখন মাসচেরানো বসে আছেন, হাফ প্যান্ট পরে। ইন্টারভিউ চলছে। কিন্তু মেসি কই? করিডোরের কাছে কোচ সাবেলার সঙ্গে ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত। বোধহয় ভেনিজুয়েলা ম্যাচের গেমপ্ল্যান ছকে নিচ্ছিলেন।
মেসি তখন বার্সেলোনার। গেল সপ্তাহেরই সোমবার মেসির বার্সা ভিলারিয়ালকে লা লিগার ম্যাচে সোজা-সাপটা পাঁচ গোলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। আর সোজা-সাপটা একটা হিসাব আমাদেরও ছিল বটে। আমি, অগ্নি সবাই মেসি যে দলে, সেই দলকেই সপোর্ট করতাম। ভিলারিয়ালকে পাঁচ গোল মারার ম্যাচে মেসির সতীর্থ কিন্তু ছিলেন জাভিয়ের মাসচেরানো। সুতরাং কলকাতায় মেসি-মাসচেরানো জুটিই কিন্তু এসেছিল। তা নিয়ে পাগলামো তুঙ্গে। কলকাতা এয়ারপোর্টে তো হাজারে হাজারে জনতা ভোর থেকেই উপস্থিত কয়েক পশলা বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে। আমিও ছিলাম সেই ভিড়ে। দেখা হয়েছিল, পাশের পাড়ার ক্লাবের বান্টিদার সঙ্গে। পরনে আর্জেন্টিনার আকাশি-সাদা জার্সি। সে এমনই ক্ষ্যাপা যে, ভোর চারটের সময় এয়ারপোর্ট পৌঁছে গিয়েছিল। রীতিমতো কার্নিভালের পরিবেশ বিমানবন্দরের আশপাশে। অনেকেই আর্জেন্টিনা দলের নীল-সাদা জার্সি পরে ‘মেসি-মেসি-মেসি’ চিৎকারে মাতিয়ে রেখেছেন। কেউ বা এসেছেন বার্সেলোনা দলের জার্সি গায়ে। বান্টিদার দুই গালের এক গালে ছিল আর্জেন্টিনার পতাকা আঁকা আর অন্য গালে বার্সার… একজনকে দেখলাম খালি গায়ে, বুকের মধ্যে বিরাট করে ‘মেসি আই লাভ ইউ’ লিখে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। অবাক ব্যাপার হল, লোকটি হঠাৎই হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন। বোধহয়, আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছিলেন। কয়েকজনের হাতে ব্যানার। তাতে লেখা: ‘ভারতে স্বাগতম মেসি’। অনেকের হাতেই দেখা গেল তেরঙ্গা― ভারতের জাতীয় পতাকা।
আরও পড়ুন
মান্না পাঁচালি
আরও পড়ুন
আইনের ফাঁক গলে গোল
ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছিপটান মাছধরার মতো অপেক্ষা চলছিল। কখন চোখের দেখা দেখা যাবে আর্জেন্টিনার রাজপুত্তুরকে। যদিও হতাশই হতে হল। কারণ আয়োজকরা মেসি-পাগল জনতার সেন্টিমেন্ট-টেন্টিমেন্টের ধার ধরেননি। মেসিকে তাঁরা একটা গাড়িতে ভরে বিমানবন্দর থেকে সাইডগেট দিয়ে বের করে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু গোবেচারা ভক্তবৃন্দ তখনো ফ্যালফ্যাল করে দাঁড়িয়ে। তাঁরা মেসির অমন প্রস্থানের থোড়ি কি কোনো খবর রেখেছেন নাকি? কিন্তু অপেক্ষা দীর্ঘস্থায়ী হতে যখন ফিসফাস বাড়ছে, কলকাতার সল্টলেক স্টেডিয়ামে ম্যাচের প্রচারকারী সেলিব্রিটি ম্যানেজমেন্ট গ্রুপের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ভাস্বর গোস্বামী সটান জানিয়ে দিলেন, “আমি শুধু এটুকু বলতে পারি যে শহরেই রয়েছেন মেসি।” তা মেসি কি মেঘদূত নাকি? এতক্ষণ ধরে অতগুলো লোকের চোখকে ফাঁকি দিয়ে মেসি এয়ারপোর্ট ছাড়লেন কোন জাদুবলে, তা ভেবে কূলকিনারা না পেয়ে এয়ারপোর্ট ছাড়তে হয়েছিল এক বুক হতাশা নিয়ে। এক মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন ‘পাগল’কে দেখলাম, মিডিয়ার সামনে বকবক করছেন― “মেসিকে একঝলক দেখতে লিও যে হোটেলে উঠবেন, সেখানে আমরা ডিনার করার জন্যও তৈরি। আমরা সমস্ত খরচ বহন করতেও প্রস্তুত।” জানি না যে, সেই পরিবার তাদের ইচ্ছাপূরণ করেছিল কিনা! ততক্ষণ অবশ্য চাউর হয়েই গেছে, মেসিরা কোথায় উঠেছেন। তা সেই ভদ্দরলোকের পরিবারের ইচ্ছাপূরণের কিস্সা জানা আমার ধর্তব্যে নেই।
আরও পড়ুন
জাতীয় লিগে প্রথমবার সেরা হওয়ার জমাটি মুহূর্তগুলি
ম্যাচের দিনও পিছু ছাড়েনি বৃষ্টি। যদিও বৃষ্টিকে পরাস্ত করতে ‘মেসি’ নামটাই যথেষ্ট। ম্যাচের সময় যত ঘনিয়ে এল, বাইপাস জুড়ে গাড়ির লম্বা লাইনও বাড়ল। বিরাট জ্যামে লো প্রেসারের রোগীর হাই প্রেসার উঠে যাওয়ার মতো অবস্থা! ফার্স্ট হাফ বোধহয় দেখা যাবে না। গাড়ির তো নো নড়ন-চড়ন। এমন জ্যাম সাধারণত দেখা যায় ডার্বি হলেই। এভাবেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সেদিন মাঠে পৌঁছান দর্শকরা। অনেকেই তো প্রাক্ ম্যাচ প্র্যাকটিস, প্লেয়ারদের মাঠে নামা কিংবা দুই দলের জাতীয় সংগীত শোনা থেকে বঞ্চিত। তাতে কি! গোটা মাঠ তখন ‘মেসি-মেসি’ শব্দব্রহ্ম কাঁপছে। অগ্নির মতো অনেকেই ভেবেছিলেন যে, ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে প্রীতি ম্যাচে মেসি হয়তো সেকেন্ড হাফে নামবেন। বড়জোর ফার্স্ট হাফ খেলে উঠে যাবেন। কিন্তু সকলকে চমকে দিয়ে দু’টো হাফেই দাপিয়ে খেললেন লিওনের মেসি। এক্কেবারে ৯০ মিনিট। কলকাতাতেই তাঁর অধিনায়কত্বের অভিষেক যে। প্রায় পঁচাত্তর হাজার দর্শক যেন ক্রমে আড়মোড়া ভাঙলেন। গোল পেলেন না, তবে ঝকঝকে মেসি। সঙ্গে তাঁর অনবদ্য স্কিল আর ফুটওয়ার্ক যেন মাঠে উপস্থিত দর্শকদের কাছে সত্যিকারের ট্রিট। অসাধারণ সব কর্নার করছিলেন। প্রথম পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সুযোগ এসে গিয়েছিল। প্রায় গোল করেই ফেলেছিলেন মিডিও অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া। এর পিছনে মেসির অবদানও ছিল। সজাগ ছিলেন ভেনেজুয়েলার ডিফেন্ডার। ক্রান্তীয় অরণ্যভূমি ঘেরা দেশটির বিপদ এড়ান তিনি।
তবে কুড়ি মিনিটের আগে ভেনেজুয়েলান হোসে স্যালোমন রন্ডনের সুবর্ণ সুযোগ মিস! পঁয়ত্রিশ মিনিট নাগাদ ফ্রাঙ্ক ফেল্টসচার আরো একটু সুযোগ তৈরি করেছিলেন। কাজের কাজ কিছু হয়নি। যদিও এর সামান্য আগে মেসির একটা মাটি ঘেঁষা শট সরাসরি চলে যায় ভেনেজুয়েলান গোলরক্ষকের কাছে। সন্তুষ্ট হতে পারেননি রাজপুত্তুর। এই মিসের পর মাটিতে বসে আপশোস করতে দেখা যায় তাঁকে। কিন্তু ততক্ষণে মেসির কোমরের ঝটকায় বিপক্ষ দলের ডিফেন্ডারদের ছিটকে পড়ে যেতে দেখে নিয়েছেন কলকাতার ফুটবলপাগল জনতা। যতবারই লিও কর্নার করতে যাচ্ছিলেন, ততবার দর্শকরা গ্যালারি থেকে নেমে ফেন্সিং-এর সামনে হুড়হুড় করে চলে আসছিলেন। যদিও এতে কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না মেসির। যেন নিজের ধ্যানে মশগুল। সেই সময় ম্যাচ চলাকালীন ড্রিঙ্ক ব্রেক নেওয়ার কোনো নিয়ম সম্ভবত চালু ছিল না। কিন্তু কলকাতার প্রীতি ম্যাচটি ছিল এই দিক থেকেও ব্যতিক্রমী। মেসিকে দেখা গেল জল খাবেন বলে রেফারির কাছে অনুরোধ করতে। কর্ণপাত করেছিলেন ভারতীয় রেফারি রোমান আরুমুগান। ম্যাচের সম্ভবত তিরিশ মিনিটের মাথায় দু’টো দলই কিছুক্ষণ খেলা থামিয়ে জলপান করেছিল তারপর। এখন তো ফিফার নিয়মেই রয়েছে এটা। আর হ্যাঁ, গোল হচ্ছে না দেখে মেসিকে উদ্দেশ্য করে বিরতির আগে গ্যালারি থেকে চিৎকার করে উঠেছিল অগ্নিজিৎ— ‘‘ওরে, হিগুয়েন ফাঁকায় আছে, বল বাড়া…’’ হাহাহা… গ্যালারিতে তখন যেন এমন অসংখ্য ভারতীয় ‘কোচ’ গোটা আর্জেন্টিনা দলকে পরিচালনা করছেন। ওইসব সাবেলা-টাবেলাকে কেইবা থোড়াই পাত্তা দেন! দর্শকদের প্রতীক্ষার অবসান ঘটে ৬৭ মিনিটে। মেসির কর্নার থেকে গোল করেন নিকোলাস ওটামেন্ডি। আর্জেন্টিনাও জেতে। ম্যাচ শেষে দেখা গেল তারকা ইস্টবেঙ্গল ফুটবলার অ্যালভিটো ডি’কুনহা আমজনতার দুই নম্বর গ্যালারিতে বসে তাঁর গোয়ান বন্ধুদের সঙ্গে ছবি তুলতে ব্যস্ত। আর ম্যাচে একদিন পর, রবিবারে, আমাদের রিহার্সালের দিন থিয়েটারের কথা কম, মেসি ম্যাচ নিয়েই আড্ডা হয়েছিল বেশি।
Powered by Froala Editor