বৈশাখের প্রথম জলে, আশুধান দ্বিগুণ ফলে... কথাটা যেন অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই পয়লা বৈশাখে। বৈশাখের প্রথম দিনে মানুষটার সঙ্গে আলাপ। যে মাঠে ফুটবল শিখতাম, সেখানে। বছর পনেরো আগেকার কথা। পয়লা বৈশাখের দিন বার পুজোয় তিনি গোপেশ্বর দত্ত স্কুলের খেলার মাঠে আমন্ত্রিত। তাঁকে বিশেষ অতিথি করে আনা হয়েছে। সপ্তাহখানেক আগে আমাদের কোচ ভ্যাকালুদা (সুব্রত মিশ্র) বাড়ি বয়ে এসে জানিয়ে গিয়েছিলেন, কিংবদন্তি সেই মানুষটির আগমনী। কনে দেখা আলোয় তখন কুসুমরঙা শাড়িতে সেজে উঠছে ছেলেবেলা। চারিদিক আলোয় ভরে এসে ক্রমশ চাগিয়ে উঠছে স্মৃতি। কবে আসবে পয়লা বৈশাখ ভেবে মন বাগ্র। ‘তাপসনিশ্বাসবায়ে’ এল বৈশাখ। সেজে উঠেছে ছোটবেলার খেলার মাঠ। এরই মাঝে বিকেলে মাঠে এলেন সেই মানুষটি— শৈলেন মান্না। কোচ বলেছিল, বিকেল চারটের সময় তিনি আসবেন। ‘তোরা কিন্তু এক ঘণ্টা আগে মাঠে ঢুকিস’। সেইমতোই মাঠে ঢুকে গিয়েছিলাম। ঘড়ির কাঁটা যখন চারটের ঘর ছুঁইছুঁই, তিনি এলেন। ভ্যাকালুদা মাঠে উপস্থিত সকল খুদে বড় ফুটবলারকে বললেন— “দ্যাখ, একেই বলে সময়জ্ঞান। এই বয়সে এসেও বিন্দুমাত্র বদলাননি মানুষটা।” তাঁকে দেখে প্রণাম করব নাকি হাত মেলাব, দ্বিধায় ভুগছি। তিনি নিজেই হাতটা বাড়িয়ে দিলেন এমন ভাবে যে, আমার হাত মেলানো ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তারপর পরিচয় পর্ব সেরে যতটুকু জেনেছিলাম, তা বয়সের খেয়ায় চড়ে বারবার ফিরে আসে। যা কখনো ভুলবার নয়। সেই নবীন পয়লা বৈশাখ আজো টাটকা।
একচিলতে বিকেলে বার পুজো চলছে... আর আমি ভাবছি তাঁকে প্রশ্নটা করব কিনা। কিন্তু কিন্তু করে পাড়লাম প্রশ্ন― অলিম্পিকের গল্প শুনব... তিনি হেসে বললেন, “স্যুট ছিল না আমার। ধীরেনদা (দে) আর মোহনবাগান ক্লাব থেকে আমার জন্য স্যুটের ব্যবস্থা করেছিল। ওটাই ছিল ক্লাব থেকে পাওয়া প্রথম উপহার।” বুঝলাম, তাঁর কথার সূক্ষ্ম স্রোতগুলো অতটা সূক্ষ্ম নয়। এ যেন ডুবন্ত জলাশয়ে জীবনের চিহ্ন। আসলে কী জানেন, আপনি দুঃখের পাখিদের আপনার মাথার উপর উড়তে বাধা দিতে পারবেন না, তবে আপনি তাদের আপনার চুলে বাসা বাঁধতে বাধা দিতে পারেন। দুঃখমুখী জীবন এগিয়ে যেতে শিখিয়েছে তাঁকে। সেদিনের ভাষণেও একই কথা বলছিলেন শৈলেন মান্না। বলছিলেন― নিজে যেটা পারো, যেটুকু দক্ষতা আছে তোমাদের, তা নিয়ে সন্তুষ্ট থেকে সেই দক্ষতাকে বারবার ঝালিয়ে নিতে শেখো। দেখবে, জীবনে সাইন করবেই। আর চেষ্টা করো। চেষ্টা করলে সবকিছু সম্ভব। চেষ্টা করলে স্বপ্ন দেখাও সম্ভব।” এখানে ফুটবল কেবল নয়, জীবনবোধ শিখিয়ে গিয়েছিলেন এই অশীতিপর অলিম্পিয়ান।
ভ্যাকালুদাকে আগেভাগেই বলে রেখেছিলাম, শৈলেন মান্নার কাছে বেশ কিছু জিনিস জানতে চাইব। তা পুরুতমশাইয়ের পুজোর পর কোচ ছোটদের জন্য একটা আর বড়দের জন্য দু'টো টিম করে দিল। ম্যাচ হবে। তার আগে গোল হয়ে বসল প্লেয়াররা। ওদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে শৈলেন মান্না পরামর্শ দিচ্ছিলেন। “তোমাদের তো সুব্রত (ভ্যাকালুদা) প্র্যাকটিসের পর কাঁচা ছোলা-বাদাম দেয়। মাঝেমাঝে টিফিনেরও ব্যবস্থা করে নিশ্চয়ই। কিন্তু আমার ফুটবল জীবন যখন শুরু হয়, তখন জানতামই না টিফিন কী জিনিস। তবে দেওয়া হত ভেজানো ছোলা, বাদাম, আদা কুঁচি। আর ম্যাচের দিন এক বোতল লেমোনেট। এই সব সহ্য করেই কিন্তু আজ তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে। আমি বলছি না যে, তোমাদেরও আমার মতো এই সব সহ্য করতে হবে। সেটা উচিতও নয়। কিন্তু স্ট্রাগেলটা করতেই হবে। সঙ্গে পরিশ্রমটাও। তাহলেই হবে।” বলতে বলতে চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছিল তাঁর। ম্যাচের পর আমার কাছে এল সেই সুযোগ। ভয়ে ভয়েই প্রশ্ন করলাম, “শুনেছি ইংল্যান্ডের রাজা-রানির সঙ্গে বসে চা খেয়েছিলেন। যদি একটু ঘটনাটা বলেন।” ওটা ছিল তাঁর প্রথম অলিম্পিকের ঘটনা। ১৯৪৮-এর লন্ডন অলিম্পিকে ফ্রান্সের কাছে ১-২ গোলে হেরে বিদায় নিয়েছিল ভারত। অথচ খালি পায়ে খেলা ভারতীয় ফুটবলাররা মন জয় করে নিয়েছিল সকলের। “আমি একটা গোল মিস করেছিলাম। এখনো সেই স্মৃতি জ্যান্ত। তবে, আমাদের পায়ে বুট না দেখে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন। যাই হোক, আমাদের শেফ দ্য মিশন মইনুল হক জানালেন ইংল্যান্ডের রাজা চা-পানে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমি তো চমকে গেলাম! আমি একা নই, সঙ্গে গিয়েছিল ছোটে লাল, কিষেণলাল। কিষেণলাল তো সেবার হকি টিমের ক্যাপ্টেনও ছিল। ঘোড়ার গাড়িতে রওনা দিয়েছিলাম। সামনে ব্রিটিশ সেনা। পাইলট কার। বাকিংহাম প্যালেসে ঢুকে সত্যিই চমকে গিয়েছিলাম। একতলার একটা বিরাট ঘরে আমাদের বসানো হল। টেবিলের উল্টো দিকে বসে রানি এলিজাবেথ এবং রাজা ষষ্ঠ জর্জ। এভাবেই আর কী...”
আরও পড়ুন
আইনের ফাঁক গলে গোল
![](https://www.prohor.in//uploads/editor_image/bde8812e6cf649f2f841f37e9a1b0986ea2a8822.png)
আরও পড়ুন
জাতীয় লিগে প্রথমবার সেরা হওয়ার জমাটি মুহূর্তগুলি
বাবার কাছে শোনা গল্প। ’৭৫-এর আইএফএ শিল্ড ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলের কাছে ৫-০ গোলে হেরে গেছে মোহনবাগান। উত্তপ্ত ক্লাব চত্বর। রীতিমতো তাণ্ডব পরিস্থিতি। বিক্ষুব্ধ জনতার সামনে আসতে ভীষণই ভয় পেয়েছিলেন বাগান ফুটবলাররা। অগত্যা কাছের গঙ্গায় নৌকাই ভরসা। হ্যাঁ, মাথা ঢাকতে ছুটলেন গঙ্গামধ্যে এক নৌকায়। এমন বিস্ফোরক পরিস্থিতিতে ভক্তদের শান্ত করার ক্ষমতা ছিল মাত্র একজনেরই। তিনি শৈলেন মান্না। সমস্ত নিন্দা ও সমালোচনার ঊর্ধ্বে তিনি। সকলের প্রিয় 'মান্নাদা' তখন মোহনবাগান ফুটবলারদের উদ্ধার করে তাঁদের নিরাপদে নিয়ে গিয়েছিলেন। যে মানুষটির কাছে সবুজ-মেরুন জার্সিটি ‘জীবন্ত বিগ্রহ', তাঁকে ঘিরে আমরা কিন্তু উদাসীনই থেকেছি। আসলে একটি জাতি এমন উদাসীনতার মধ্যেই কিন্তু তার পরিচয় হারায়। রোমানিয়ান-আমেরিকান লেখক এলি উইজেল একবার বলেছিলেন― “ভালোবাসার বিপরীত ঘৃণা নয়, উদাসীনতা। শিল্পের বিপরীত কদর্যতা নয়, উদাসীনতা। বিশ্বাসের বিপরীত ধর্মদ্রোহিতা নয়, উদাসীনতা। এবং জীবনের বিপরীত মৃত্যু নয়, উদাসীনতা।” উক্তিটিতে একটু সংযোজন করব― অস্তিত্বের বিপরীত বিলীন নয়, উদাসীনতা। বাঙালির ক্ষেত্রেও কিন্তু এমন উদাহরণ খাটে।
![](https://www.prohor.in//uploads/editor_image/c611ab08b3d56db71f6b54740440480765ddada7.png)
এই উদাসীনতা বা অবহেলার গল্পটা একটু অন্যরকম। কোনো এক দার্শনিক বলেছিলেন, যদি সংযম একটি দোষ হয়, তাহলে উদাসীনতা একটি অপরাধ। এই গল্পটা অনেকটা তেমনই। শৈলেন মান্নাকে নিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু ইচ্ছা যদি জীবনের অর্ধেক হয়, উদাসীনতা মৃত্যুর অর্ধেক। সামান্য কিছু অর্থ না আসায় শেষ পর্যন্ত সেই চেষ্টা ব্যর্থ হল। যে শৈলেন মান্না পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামে, পথে-প্রান্তরে সামান্য ফুল আর মালার বিনিময়ে হাজির হয়েছেন, ফুটবলারদের উৎসাহ দিয়েছেন, পাশে দাঁড়িয়েছেন— সেই শৈলেন মান্নার ওপর একটা তথ্যচিত্রের জন্য সামান্য কিছু টাকা দেওয়ার মতো কন্ট্রিবিউটর খুঁজে পাওয়া গেল না। ফুটবল গবেষক শুভ্রাংশু রায়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁরা শৈলেন মান্নাকে নিয়ে তথ্যচিত্র বানাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন কিংবদন্তির জীবিত অবস্থাতেই, আজ থেকে প্রায় বছর কুড়ি আগে। শৈলেন মান্নার সঙ্গে কথা বলে বলে তথ্যচিত্রটি তৈরির সাধ ছিল তাঁদের। শুরু হয়েছিল গবেষণাও। কিন্তু একটা তথ্যচিত্র নির্মাণ করতে মিনিমাম এক থেকে দেড় লক্ষ টাকা খরচ হয়। অনেক কাটছাঁট করে শেষ পর্যন্ত সেই বাজেট ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত কমানো গিয়েছিল। কিন্তু সেই টাকা জোগাড় করা যায়নি। ফলে দু-দিন শ্যুটিং করে তথ্যচিত্রের কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। শৈলেন মান্না জন্মদিনে শুরু হয়েছিল শ্যুটিং। ফুটবলারের বাড়িতে শুরু হয়েছিল শ্যুটিংয়ের কাজ। শৈলেন মান্নার ওপর স্মৃতিচারণ করেছিলেন গোল করে ভারতকে এশিয়ান গেমসে সোনার পদক জেতানো কিংবদন্তি ফুটবলার শিও মেওয়ালাল, মোহনবাগান রত্ন মহম্মদ আবদুস সাত্তার, বদ্রু ব্যানার্জি, শ্যামল সেন-সহ অনেকেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, তা আর সংরক্ষণ করা যায়নি। কাজটি আর এগোনোও যায়নি। শুনতে শুনতে বড্ড হতাশা লাগছিল। মনে হচ্ছিল, উদাসীনতা আত্মার একটি পক্ষাঘাত, একটি অকালমৃত্যুও।
![](https://www.prohor.in//uploads/editor_image/d9e0386445ac39091d9e17e43f925bf87dd57dd6.png)
![](https://www.prohor.in//uploads/editor_image/7ed44ebf5e0d336cbd12392b7d48f64c1461c707.png)
আগের পর্বের আলোচনা প্রসঙ্গে ফোন করেছিলাম মোহনবাগানের এক সিনিয়র মেম্বার পুলক মুখার্জিকে। গভীর নস্টালজিয়ায় ডুব দিয়েছিলেন পুলকবাবু। শুরু করলেন অনেক পুরনো থেকে। একটি ঘটনা শুনে তো আমি চমকে উঠলাম। শৈলেন মান্নাকে নিয়েই বললেন। আশির দশকের শেষের দিকে এয়ারলাইন্স কাপে মুখোমুখি মোহনবাগান এবং মহামেডান। ম্যাচটি দুই-দুই গোলে ড্র হয়। খেলা চলাকালীন রটে যায় ম্যাচটি গটআপ হচ্ছে। যা তুমুল উত্তেজনা তৈরি করেছিল খেলার শেষে। শৈলেন মান্নাকে পর্যন্ত প্রশ্ন করা হল ম্যাচটা গটআপ হয়েছে কিনা। তবে, সেই ঘটনায় অন্য মাত্রা যোগ করে এক স্বনামধন্য সম্পাদক এবং সাংবাদিক শৈলেন মান্নাকে চিঠি ধরিয়ে দিলেন। সেখানে বলা হল এই গটআপের বিরুদ্ধে তিনি যেন পদত্যাগ করেন। পদত্যাগ করলেই বিনিময়ে মিলবে তাঁকে হাইলাইট করে বিশাল করে কভারেজ। এ অনেকটা হালফিলের ঋদ্ধিমান-কাণ্ডের মতো। ভারতীয় দল থেকে বাদ পড়ার পর ‘বিশিষ্ট’ সাংবাদিকের কল রিসিভ না করায় তিনি হুমকিও পর্যন্ত দিয়েছিলেন ঋদ্ধিমান সাহাকে। অনেকটা এমনই ঘটনা ঘটেছিল শৈলেন মান্নাকে ঘিরেও। কারণ, শৈলেন মান্না পদত্যাগ করলেই জন্ম নেবে বিরাট খবর। যা পড়ে সমর্থকদের রক্ত গরম হতে বাধ্য। তাই হয়তো চামচাগিরির চামচ নিয়ে ঢিলটা ছুড়েই দিয়েছিলেন ওই ‘সম্মাননীয়’ সাংবাদিক। খবরটা কিন্তু চেপে থাকেনি। জানাজানি হতেই শৈলেন মান্নাকে বোঝানোর উদ্যোগ নেন বাগান কর্মকর্তা ধীরেন দে। সন্ধ্যা ৬টা ২০ নাগাদ তিনি ফোন করেন পুলকবাবুকে। পুলকবাবু শৈলেন মান্নার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। পুলকবাবু বললেন, “আমি সেই সময় সবে বাড়ি ঢুকছি। ধীরেনবাবু বললেন, 'তুই এক্ষুনি মান্নাদার বাড়ি যা।’ তখন পদ্মপুকুরের কাছে তিনি থাকতেন। জানতে পারলাম ঘটনাটা। মান্নাদার বাড়ি রাত আটটা নাগাদ ঢুকলাম। তাঁকে বোঝালাম। খেলাটা গটআপ হয়েছে কিনা, তা আপনি কীভাবে বুঝবেন? আমরা মান্নাদাকে বললাম, ‘একজন আপনাকে চিঠি লিখবেন আর আপনি রিজাইন করবেন? এটা তো মেনে নেওয়া যায় না।’ ততক্ষণে চিঠিটা পড়ি। জানতে পারি যে, চিঠিটা কে লিখেছেন। তখন ময়দানে ইতিমধ্যেই শুরু তোলপাড়। রটে গিয়েছে শৈলেন মান্না বোধহয় পদত্যাগ করেছেন।” কিন্তু তিনি শৈলেন মান্না। টোপ গেলেননি। পদত্যাগ না করে পিছনের দরজা দিয়ে এসে প্রথম হতে চাওয়া সেই সাংবাদিকের স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছিলেন। স্মৃতির সঙ্গে মিশিয়ে এই কথাগুলো তাই বলতেই হল।
Powered by Froala Editor