লোকালে আর গ্লোবালে বাঙালির ফুটবল

ফোনে চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ায় মোবাইল অ্যাপে খেলা দেখার সুখ শেষ হয়ে গেল। মোহনবাগান প্রথমার্ধ শেষে তখন ৩-১ গোলে এগিয়ে। ‘সুখ’ শব্দটা লিখলাম, কারণ যে টিভি চ্যানেলটিতে খেলা দেখায়, সেখানে খেলা চলাকালীন বিজ্ঞাপন শুরু হয়ে যায়। জানি না, আর কোনও দেশে এমন বিচিত্র টেলিকাস্টের রেকর্ড আছে কিনা! অগত্যা ক্রিকেটে ওভারের শেষে বিজ্ঞাপন দেখছি ধরে নিয়েই টিভির সামনে দ্বিতীয়ার্ধ দেখতে বসেছিলাম। ০-৩ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ার পর সবুজ-মেরুন দুর্গে ক্রমশ হানা চালাচ্ছিলেন ইম্ফলের ট্রাউ এফসির স্ট্রাইকাররা। ফলে, ৩৫ মিনিটে ওদের উইলিয়ামসের করা গোলে স্কোরলাইনও ৩-১ হয়ে যায়। তার ওপর ম্যাচের ৬৯ মিনিটে তুরসুনাভকে জোড়া হলুদ কার্ড দেখান রেফারি। লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন এই তাজিকিস্তান ফুটবলার। ১০ জন হয়ে যায় মোহনবাগান। এর আগে অবশ্য অন্য কিস্সা ছিল। ব্রিটিশ ক্লাব লিভারপুলের সঙ্গে তখন তুলনা চলছে কলকাতার মোহনবাগানের। দুই দলই অপ্রতিরোধ্য। তবে, মোহনবাগানের এই ম্যাচটির আগে ২৮ ম্যাচ পর পরাজয়ের মুখ দেখে লিভারপুল। ব্যস, অমন খবরে সুপারস্ট্রেশনে পর্যন্ত ভুগতে দেখেছি মোহনবাগান সমর্থকদের। শেষহাসি হাসবে তো দল? প্রশ্নের উত্তর দিলেন অবশ্য ফ্রান গঞ্জালেস। পেনাল্টি থেকে গোল করে ১৪ মিনিটে মোহনবাগানকে এগিয়ে দেন। এরপর দূরপাল্লার ভাসানো সুইংয়ে ২২ মিনিটে অনবদ্য গোল করেন বেইতিয়া। এক মিনিট পরেই বাবা দিওয়ারা মোহনবাগানকে ৩-০য় এগিয়ে দেন।

মোহনবাগানের রঙে বর্ধমানের কার্জন গেট। ছবি: সংগৃহীত

 

যদিও এরপর মোহনবাগানের ডিফেন্স বারবার পরীক্ষার মুখে পড়ে। পাহাড়ে খেলার সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে ট্রাউ এফসির ছেলেরা দারুণ ম্যাচ উপহার দেন। এই সময় মোহনবাগান গোলকিপার অপ্রতিরোধ্য হয়ে না উঠলে স্কোরলাইন অন্যরকম লেখা হতে পারত। খেলা শুরুর সময় বা চলাকালীন গ্যালারির ছবিতে অসাধারণ কিছু দৃশ্য মন জয় করে নিয়েছিল। গ্যালারিতে সবুজ-মেরুন পতাকা হাতে বা ওই রঙের জার্সি গায়ে বেশ কিছু মোহনবাগান সমর্থকদের দেখা যায়। যার অধিকাংশই কলকাতায় মোহনবাগান গ্যালারির পরিচিত মুখ। কলকাতা থেকে তাঁরা উত্তর-পূর্ব রাজ্যের এই রাজধানী শহরে পৌঁছে গেছেন নিজেদের প্রিয় দলকে সমর্থন করতে। যাঁরা মনে করতেন, ক্রমে মাঠবিমুখ হয়ে উঠছে মানুষ, তাঁদের ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করার জন্য ম্যাচটা যেন আদর্শ বিজ্ঞাপন। ইম্ফলের স্টেডিয়ামে কলকাতা থেকে মণিপুরের রাজধানীতে পৌঁছনো সবুজ-মেরুন সমর্থকরাও ট্রাউয়ের সমর্থকদের সঙ্গে ভরিয়ে তুলেছিলেন। তাঁরাও ট্রাউয়ের সমর্থকদের সঙ্গে পাশাপাশি বসেই ম্যাচ উপভোগ। যাইহোক, ৩-১ গোলে জয়ের পর মোহনবাগান ১৪ ম্যাচে ৩৫ পয়েন্ট নিয়ে তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের আরও কাছে পৌঁছল। দ্বিতীয় আই-লিগ ট্রফি বোধহয় আসতে চলেছে!

বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দির সেজে উঠেছে সবুজ-মেরুন আলোয়। চিত্রঋণ: শুভঙ্কর বিশ্বাস

 

আরও পড়ুন
ময়দানি কুইজিন

কিছুদিন আগেই কলকাতার জওহরলাল নেহরু রোডের দ্য ফোর্টিটু বিল্ডিংয়ের রং হয়ে গিয়েছিল সবুজ-মেরুন। সন্ধ্যার হাওড়া ব্রিজও সেজে উঠেছিল সবুজ-মেরুন আলোয়। তখন মোহনবাগান ছিল ৩২ পয়েন্টে। এরপরই কিন্তু ট্রাউ এফসির ডেরায় গিয়ে তিন পয়েন্ট নিয়ে আসে কিবু ভিকুনার মোহনবাগান। অন্যদিকে, আই-লিগের চার্চিল, মিনার্ভা হেরে যাওয়ায় আরও সুবিধা পায় মোহনবাগান। অমন পরিস্থিতিতে কল্যাণীর মিউনিসিপ্যালিটি স্টেডিয়ামে খেলতে নামা। প্রতিপক্ষ একদা মোহনবাগানে খেলা কাতসুমি ইউজার চেন্নাই সিটি। ট্রাউ ম্যাচে লাল কার্ড দেখায় দলে ছিলেন না ‘তাজিক তুফান’ কমরন তুরসানভ। ডিফেন্ডার ড্যানিয়েল সাইরাসকেও চোট সমস্যার কারণে দলে পাননি কিবু। ৪-৪-২ ফর্মেশনে দল সাজান। নীচ থেকে শুরু করেন আশুতোষ মেহেতা, ফ্রান মোরান্তে, ফ্রান গঞ্জালেস এবং গুরজিন্দর কুমার। মাঝমাঠে ভি পি সুহের, শেখ সাহিল, শিলটন ডি’সিলভা এবং নগদম্বা নাওরেম। আর ওপরে জোফেবা বেইতিয়া এবং বাবা দিওয়ারা। চেন্নাই কোচ আকবর নওয়াস ৪-১-৪-১ ফর্মেশনে দল সাজান। শুরু থেকেই দুই দলের আক্রমণ প্রতি-আক্রমণে খেলা জমে ওঠে। মোহনবাগান বেশ কিছু সুযোগ পায়। তাতে গোল হয়নি। ৩১ মিনিটে ফ্রিকিক থেকে বেইতিয়ার শট চেন্নাইয়ের পোস্টে লেগে প্রতিহত হয়। মোহনবাগান গোলকিপার শঙ্কর রায় দু’টি ক্ষেত্রে দলের পতন রোধ করেন। প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তেই আসে বহু প্রতীক্ষিত সেই মহরত। ১৬ নম্বর জার্সিধারী নাওরেমের ডিফেন্স চেরা পাস থেকে চেন্নাই ডিফেন্ডারকে পরাস্ত করে অসামান্য ফিনিশে মোহনবাগানের পক্ষে স্কোরলাইন ১-০ করেন পাপা বাবাকার দিওয়ারা।

আরও পড়ুন
সশরীরে বিশ্বকাপে

সবুজ-মেরুন আলোয় সেজে ওঠা হাওড়া ব্রিজ। ছবি: চিন্ময় শেঠ।

 

আরও পড়ুন
৯ ডিসেম্বরের বাতিল ডার্বি: মাঠ থেকে দূরে অথচ মাঠের এত কাছে

মনে পড়ে, এই ম্যাচের ঠিক আগের দিন প্রেস কনফারেন্সে চেন্নাই কোচ বলেছিলেন, ‘মোহনবাগান এমন জায়গায় আছে যে, দলে কে আছে কে নেই তাতে বিশেষ ফারাক পড়ে না।’ তাঁর কথা যে কতটা বাস্তব, ম্যাচে তার প্রমাণ পাওয়া গেল। টিম গেমকে মূলধন করে পাসিং ফুটবলের মন্ত্রে আরও একবার ফুল ফোটালেন বেইতিয়ারা। ম্যাচের তিনদিন পরেই দোল। আমরা গ্যালারিতে বসে ভাবছি, দোলের সেলিব্রেশনে কী কী করব, তার খুঁটিনাটি। বাবার প্রথম গোলের পর আমাদের মধ্যে রং খেলার প্রস্তুতিও শুরু হয়ে যায়। খেলা দেখতে আসা কোনও এক প্রেমিক তাঁর প্রেমিকাকে চুমুও খেলেন। সেই দৃশ্য আবার দেখলেন অশীতিপর কোনও বৃদ্ধ। তাঁর মুখে কোনও বিরক্তি নেই। কোনও বাবা তার দুই ছেলেকে নিয়ে মাতলেন আনন্দ হরষে। কিন্তু দল যে তখনও জেতেনি। তাতে কী? যত্তসব! এই সব আদিখ্যেতার জন্যই যে বহুবার পিছলে পড়তে হয়েছে প্রিয় দলকে। মনে নেই তাঁদের? সত্যি বলতে কী, ডিফেন্সিভ ল্যাক এবং মাঝমাঠের কিছু ভুলত্রুটিও চোখে পড়ছিল। মিসপাসও হচ্ছিল। আর আলাদা করে নজরে পড়ছিলেন কাতসুমি। জাপানি এই ফুটবলার তাঁর পুরনো চেনা মেজাজেই ছিলেন। সেই ছটফটানি, সেই দৌড় বারবার মনে পড়াচ্ছিল অতীতকে। আমরা অনেকেই আশা করেছিলাম ম্যাচটা জিতে প্রায় আই-লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাব। কিন্তু ম্যাচ ড্র হওয়ায় সেই মুহূর্ত কিছুটা দূরেই রয়ে গেল। চোনা হিসেবে রইল একদা মোহনবাগান-বাতিল কাতসুমির গোল এবং তাঁর ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হওয়া। ৬৭ মিনিটে কাতসুমির গোলে সমতা ফেরায় চেন্নাই। যদিও ড্র হওয়ায় পয়েন্ট টেবিলে হেরফের হয়নি। মোহনবাগানের পরের ম্যাচ কল্যাণীতে ১০ মার্চ আইজল এফসির বিপক্ষে। জিতলেই চ্যাম্পিয়ন। আন্দাজ করতে পারিনি অমন রূপকথায় মোড়ানো থাকবে এই আই-লিগ। কারণ, ওই মরশুমে ডুরান্ড আসেনি, কলকাতা লিগ আসেনি, শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপ থেকেও খালি হাতে ফিরেছিল দল। আই-লিগের শুরুতেই চার্চিলের কাছে ২-৪ গোলে হেরে হোঁচটও খেতে হয়েছিল। কিন্তু স্প্যানিশ কোচ কিবু ভিকুনা গোটা মোহনবাগান দলকে বদলে দিলেন। এরপর ট্রাউ, গোকুলম কেরালা আর ভূস্বর্গ কাশ্মীরে গিয়ে রিয়াল কাশ্মীরকে হারিয়ে স্বপ্নের দৌড় শুরু হয়েছিল আমাদের।

আরও পড়ুন
স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের দিনলিপি

গ‍্যালারিতে পুলওয়ামা। চিত্র ১। সংগৃহীত

 

আইজল ম্যাচ ঘিরে উন্মাদনা তুঙ্গে। মেরিনার্স দি এক্সট্রিমের পক্ষ থেকে গান বাঁধলেন দীপঙ্কর— ‘চলো মিছিলের রং হোক সবুজ-মেরুন আর/ মাতৃভাষায় বাঁধি গান/ দেখো সোনার হরফে লেখা প্রতি হৃৎস্পন্দনে/ গর্বের মোহনবাগান।’ এ গান যেন মন্ত্রভাষার মতো বেজে উঠল প্রতিটি সবুজ-মেরুন হৃদয়ে। খেলা সেই কল্যাণীতে। আর তারজন্য শিয়ালদহ স্টেশনে যে ছবি দেখা গেল, ভুলবার নয়। পিলপিল করছে লোকজন। কোনও কিছুকেই তোয়াক্কা করার জো নেই মোহন-জনতার। ট্রেন স্টেশনে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে অজস্র মোহনবাগানীর স্লোগান শুরু। কল্যাণী পৌঁছনোর পর সবাই শোভাযাত্রা করতে করতে স্টেডিয়াম-মুখো। আগের দিনই গেছে দোল। যেদিন আইজল ম্যাচ, দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে হোলি। উৎসবের সমস্ত বারুদ মজুত ছিলই। কাগজের ভেঁপু। বাঁশি। কাসর। ঘণ্টা। ব্যান্ড। সঙ্গে আবির, আবির এবং আবির। যার রং সবুজ-মেরুন। বাতাস মাতিয়ে, আকাশ রাঙিয়ে মোহন-জনতা মিছিল করে চললেন মিউনিসিপ্যাল স্টেডিয়ামে। এক প্রেমিক তাঁর হৃদয়-নন্দিনীর কপালে আর সিঁথিতে আবির ছুঁইয়ে দিলেন। জানি না, সে অবিরে সিঁদুর মেশানো ছিল কিনা। এক খুদেকেও দেখা গেল বাবার কাঁধে চেপে ‘রাঙা হাসি রাশি রাশি’র দলে মিশে যেতে। এসেছেন এক বৃদ্ধ দম্পতিও। তাঁদের বিয়ে হয়েছে পঞ্চাশ বছর হতে চলল। “আর তো ক’টা বছর বাঁচব, যাওয়ার আগে এই মোহনবাগান মনে হয় আরও কয়েকটা বছর আমাদের বাঁচিয়ে দিয়ে গেল।” বৃদ্ধ মানুষটির স্ত্রী তাঁর বরের কাছ থেকে অমন কথা শুনে ওনার হাতটা চেপে ধরলেন। হ্যাঁ, এই বয়সেও। কামগন্ধহীন এই অটুট বাঁধনই জাতীয় ক্লাব মোহনবাগানের সম্পদ। যাকে লিখে প্রকাশ করা খুব সামান্যই যায়।

গ‍্যালারিতে পুলওয়ামা। চিত্র ২। সংগৃহীত

 

মোহনবাগান কোচ কিবু ভিকুনা ৪-৪-১-১ ফর্মেশনে দল সাজান। ৯ মিনিটেই মোহনবাগানের কমরন তুরসুনভকে পিছন থেকে স্লাইডিং ট্যাকল করেন আইজলের লালরোসাঙ্গা। রেফারি রক্তিম সাহা তাঁকে হলুদ কার্ড দেখাতে ভুল করেননি। ১২ মিনিটে দিনের প্রথম সেভটি করেন মোহনবাগানের গোলকিপার শঙ্কর রায়। খেলার প্রথম কোয়ার্টারে মোহনবাগানের বল পজিশন ৬৯ শতাংশ। ম্যাচের ২৯ মিনিটে ভি পি সুহেরের একটি দূরপাল্লার শট বাঁচিয়ে দেন আইজল গোলরক্ষক জোথানমাবিয়া। ৪৩ মিনিটে বক্সের ঠিক বাইরে নিজেদের অনুকূলে একটি ফ্রিকিক পায় মোহনবাগান। বেইতিয়ার সেই ফ্রিকিক নিষ্ক্রিয় থাকে। ৪৫ মিনিটে তুরসুনভ সুযোগ মিস করেন। প্রথমার্ধে স্কোরলাইন থাকে চশমা (০-০)। দ্বিতীয়ার্ধে আইজল শুরু থেকেই বেশ পজিটিভ ফুটবল খেলতে শুরু করে। অন্যদিকে, কাঙ্ক্ষিত গোলের দেখা পাচ্ছিল না মোহনবাগান। গ্যালারিতে ফিসফাস বাড়ছিল। এরই মধ্যে বেশকিছু আক্রমণ শানিয়ে সুযোগ তৈরি করে আইজল। ৫০ মিনিটে ফ্রিকিক পায় তারা। তাতে তারা অবশ্য মোহনবাগান দুর্গ ভাঙতে পারেনি। ৫৬ মিনিটে প্রায় গোল করেই ফেলছিল মিজোরামের এই দল। এই সময় তারা পর পর দু’টি সুযোগ মিস করে। আইজলের মাতিয়া ভেরন দুর্দান্ত এক স্কোয়ার পাস দেন জুয়ালাকে। তবে বল জালে ঠেলতে ব্যর্থ হন জুয়ালা। এর ঠিক আগে ডানদিক থেকে লালরোঙ্গার একটি লো ক্রস পেনাল্টি স্পটের কাছে এসে আটকে যান। ৭০ মিনিটে ফ্রিকিক পায় মোহনবাগান। কিন্তু গোল হল না!

গ্যালারিতেও যখন এনআরসি-বিরোধিতা। চিত্র ১। সংগৃহীত

 

যখন মনে হচ্ছিল দম আটকে যাবে, ঠিক তখনই পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ পাপা বাবাকার দিওয়ারা। ৮০ মিনিটে বেইতিয়ার একটা অনবদ্য টোকা থেকে বাবা দূরপাল্লার মাটিঘেঁষা শটে দুরূহ কোণ থেকে যে গোল করে গেলেন, তা বাঁধিয়ে রাখার মতো। খেলা শেষ হতেই মাঠে দৌড়ে ঢুকে পড়লেন রিজার্ভ বেঞ্চের খেলোয়াড়রা। আর দর্শকদের অবস্থা প্রায় পাগলপারা। গোল হতেই গ্যালারিতে শুরু হয়ে গিয়েছিল আবির খেলা। রেফারির লম্বা বাঁশি বাজতেই সে উল্লাস বাঁধনছাড়া রূপ নিল। চার ম্যাচ আগেই চ্যাম্পিয়ন মোহনবাগান। ‘ভারত সেরা মোহনবাগান’ স্লোগানে কেঁপে ওঠে কল্যাণী। সেই রেশ গিয়ে পৌঁছল কলকাতায়, সারাবাংলায়, গোটা ভারতে, গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা আপামর মোহনবাগানপ্রেমীদের মধ্যে। ‘জয় মোহনবাগান’ লোকাল নয়, গ্লোবাল ফুটবলের স্লোগান যেন। কারণ ভারত ও বিশ্বের বিভিন্ন কোন থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় সেদিন মোহনবাগানের আই-লিগ জয় নিয়ে পোস্ট হওয়া দেখেছি সারারাত জেগে। আনন্দে ঘুম আসেনি। পরে খবর পেয়েছি, বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দিরের ঐতিহাসিক প্রাঙ্গণ বাঁশবেড়িয়া মেরিনার্সের উদ্যোনগে প্রথমবারের জন্য সবুজ-মেরুন আলোয় আলোকিত ছিল। সবুজ-মেরুন আলোয় সেজে উঠেছিল বর্ধমানের কার্জন গেট। এই বৈচিত্র্যময় ভারতে ফুটবল দর্শকের জন্মই যে হয়েছে মোহনবাগানের হাত ধরে, সে-কথা ফের একবার প্রমাণিত হল। এ-কথার সূত্র ধরে বলব আই-লিগ আরো অনেক কারণে চিরকাল মনে থাকবে। কল্যাণী স্টেডিয়ামে নেরোকার বিরুদ্ধে খেলা শুরুর আগে পুলওয়ামার শহিদদের প্রতি অভিনবভাবে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন মাঠে উপস্থিত মোহনবাগান সমর্থকরা। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন ডে কিন্তু দেশের ৪০টি পরিবারের আপনজনের বিস্ফোরণের রক্তে লাল হয়ে ওঠা দিনও। ম্যাচটি ছিল ওই দিনই। ঠিক একবছর কাশ্মীরের মাটিতে ঘৃণা আর ষড়যন্ত্রে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন দেশের সেনা-জওয়ানরা। পুলওয়ামায় কনভয়ের ওপর সেই আত্মঘাতী হামলায় প্রাণ যায় ৪০ জন ভারতীয় সেনার। মনে পড়ে, টিফোর মাধ্যমে অমর শহিদ জওয়ানদের স্মরণ করে দেশজুড়ে খবরের শিরোনামে উঠে আসেন জাতীয় ক্লাব মোহনবাগানের সমর্থকরা। মাঠে বসে দেখেছি, ৩০×৩০ ফুটের সুদৃশ্য টিফো খোলামাত্র দর্শকদের মধ্যে তীব্র আলোড়ন তৈরি হতে। সবুজ-মেরুন স্বপ্ন (সোনারপুর), বর্ন ফর মোহন বাগান, বেলেঘাটা মেরিনার্স, চাকদাহ মেরিনার্স, উল্টোডাঙা মেরিনার্স এবং মেরিনার্স দি এক্সট্রিম-এর তরফে এই টিফোটি নির্মাণ করা হয়। নরেন্দ্রপুরে জনৈক মোহনবাগান সমর্থক বুবাই নস্করের বাড়ির ছাদে এক সপ্তাহ ধরে টিফোটি তৈরির কাজ চলে। মনে পড়ে, চার্চিল ব্রাদার্সের সঙ্গে ২৩ পাসের সেই অভিনব গোল। মনে থাকবে, আইজল ম্যাচের পাঁচদিন পর ছিল বড় ম্যাচ। যা বাতিল হয়ে যায়। আমরা অফলাইন টিকিট কাটি তার আগে। যার টাকা আজো মেলেনি। করোনাভাইরাস তখন অনাহুত রাক্ষস। প্রথম শুনছি কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন এইসব শব্দ। ২৪ মার্চ লকডাউন ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। 

গ্যালারিতেও যখন এনআরসি-বিরোধিতা। চিত্র ২। সংগৃহীত

 

গ্যালারিতেও যখন এনআরসি-বিরোধিতা। চিত্র ৩। সংগৃহীত

 

করোনা-পূর্বের ওই আই-লিগের প্রথম লেগের মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল বড় ম্যাচ শুরুর তিরিশ মিনিট আগে ইস্টবেঙ্গল গ্যালারি থেকে এনআরসি-বিরোধী বিশাল ব্যানার ভেসে উঠেছিল। তাতে লেখা— ‘রক্ত দিয়ে কেনা মাটি, কাগজ দিয়ে নয়’। সঙ্গে আরও দু’টি টিফো। এনআরসি-বিরোধী ব্যানারের পাশাপাশি একই বিষয়ে দু’টি টিফো ওই সময়টাকেও তুলে ধরে। সেদিন লাল-হলুদ জার্সি পরা বাঁটুলকে তার দুই বন্ধু বাচ্চু ও বিচ্চু প্রথম টিফোতে বলছে, ‘কিরে বাঙাল, এনআরসি আসছে, যা পালা’। উত্তরে দ্বিতীয় টিফোতে মিলেছে বাঁটুলের জোরালো ঘুসি। বাঁটুলকে নিজেদের জার্সি পরিয়ে ‘বাঙাল দ্য গ্রেট’-ও বলা হয়। এ নিয়ে সেদিন মোহনবাগান গ্যালারিতে কোনও আপত্তি ওঠেনি। বরং সমব্যথী হয়ে তাদের কুর্নিশ জানাতে দেখেছি। ‘কলকাতা ডার্বি আর বাঁটুলের বাঙালি সুপারম্যানের স্বীকৃতি প্রাপ্তি’ নামক লেখায় শুভ্রাংশুদা (রায়) লিখেছে, ‘‘প্রায় দুই বছর আগের (এখন তিন বছর হয়ে হয়ে গিয়েছে) রবিবাসরীয় ডার্বিতে এমনই ‘টিফো’ নিয়ে লাল-হলুদ শিবিরের সমর্থকদের খেলা দেখতে আসা এবং বাঁটুলকে নিজেদের জার্সি পরিয়ে ‘বাঙাল দ্য গ্রেট’-ও বলা নিয়ে তেমন কোনও বিতর্ক হয়নি। বরং কোথায় যেন ইঙ্গিত ছিল ‘বাঁটুল আমাদের। আমরা তারই মতো শক্তিধারী’। এ যেন বাঁটুলের বাঙালির সুপারম্যানের স্বীকৃতি প্রাপ্তি। খোদ লড়াইয়ের ময়দানেই। বাংলা তো বটেই, সারাদেশ এমনকী বিদেশের মিডিয়ায় বাঁটুল দ্য গ্রেটের নাম উঠে এসেছিল এই অভিনব প্রতিবাদের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে। ঘটনাচক্রে সেই স্বীকৃতি প্রাপ্তির দুই বছর পূর্ণ হতে মাত্র একদিন বাকি থাকতেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন বাঁটুল দ্য গ্রেটের স্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথ। তবে বাঙালি জীবনের একটি অভিনব ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে রয়ে গেল বাঁটুল দ্য গ্রেট ও তাঁর স্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথের নাম।” এরপর কথা নেই।

Powered by Froala Editor