জ্যাকসন সিংয়ের গোলের এক মিনিটের মধ্যেই কলম্বিয়ার গোলটা এক্কেবারে মনটাকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল। ২০১৭-র ঘটনা। অক্টোবরের ৯ তারিখ। নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে ভারতের অনূর্ধ্ব-১৭ দলের ছেলেরা বিশ্বকাপে মুখোমুখি কলম্বিয়ার। প্রথম ম্যাচে স্বপ্নের কাছে হেরে গিয়েছে তারা। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সিদে ৩ গোলে হার। তাই কলম্বিয়া ম্যাচে কিছু করতেই হত তাদের। কোচ লুইস নর্টন ডি মাতোস গুরুমন্ত্র দিয়েই রেখেছিলেন। যদিও হাফটাইমের ঠিক পর পরই গোল খেয়ে বসে ভারত। বল পজিশন, শক্তির বিচারে কলম্বিয়া বহু ওপরে। নিখুঁত পাস খেলে তারা। গোলের পরে এবং আগে যেসব শট নিয়েছে তারা, সেসবও অনবদ্য। তবুও হাফটাইম পর্যন্ত ম্যাচ গোলশূন্য দেখে আশায় বুক বেঁধেছি। আরেকটা হাফ এভাবে কাটিয়ে দিলে অন্তত ১ পয়েন্ট হলেও আসবে। কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির একটা গোলেই গোলমাল অনেককিছুর। তবে, মাতোসের ছেলেরা শীতল মানসিকতার পরিচয় দিল। ৮০ মিনিটের পরেই গোল করল জ্যাকসন সিং। সঞ্জীব স্ট্যালিনের ক্রস থেকে হেডে গোল করেছিলেন মণিপুরের থৌবালের এই ছেলে। যদ্দূর মনে পরে, ২০১৭-১৮ মরশুমের আই-লিগে লোনে ইন্ডিয়ান অ্যারোজে যোগ দিয়েছিলেন। কেরালা ব্লাস্টার্স এফসি-র জার্সি গায়ে ২০১৯-২০ মরশুমে হিরো আইএসএলে অভিষেক ঘটায় সে। তেরোটি ম্যাচও খেলে। কলম্বিয়ার সঙ্গে ওই গোলটাই তাকে শিরোনামে আনে। এই সেই জ্যাকসন সিং, যে বিশ্বকাপের ম্যাচে ভারতের হয়ে একমাত্র গোলদাতা। যদিও ওই গোলের আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। পরের মিনিটেই কলম্বিয়া গোল করে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল ভারতবাসীর হৃদয়। কিন্তু ফিফা আয়োজিত কোনো টুর্নামেন্টে এই গোলটা চিরকাল ইতিহাসে লেখা থাকবে।
মনটা খারাপ ছিল। কলম্বিয়া ম্যাচের পরে ঘানার বিরুদ্ধে ০-৪ গোলে হেরেছে ভারত। বিশ্বকাপ অভিযানও শেষ হয়ে গিয়েছে আমাদের। আবার সেই চিরাচরিত অন্য দলকে সাপোর্ট করেই কাটাতে হবে। বিশ্বকাপ নিয়ে কিছু টার্গেট তো ছিলই। যুবভারতীতে হওয়া সেমিফাইনাল ও ফাইনাল দেখব, এই বাসনা অনেকদিনের। তবে মনখারাপ আরো বেড়ে গেল। যুবভারতীতে হওয়া সেমিফাইনালে ব্রাজিল-ইংল্যান্ড খেলার টিকিট কিছুতেই জোগাড় করতে পারলাম না। অনলাইন গেরো তো ছিলই, সঙ্গে ‘ব্রাজিল’ নামটাই কাফি এই টিকিট হাহাকারের জন্য। গোটা কলকাতাই যেন চাইছে ব্রাজিল অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলুক। শুভ্রাংশুদাও পর্যন্ত আমার টিকিট জোগাড়ে বিফল। ওই ম্যাচটা টিভিতেই দেখেছিলাম। কলকাতাকে দুঃখ দিয়ে হেরে গিয়েছিল ব্রাজিল। ১-৩ গোলে। যদিও এই ম্যাচের আগে থেকেই ফাইনাল দেখতে যাওয়ার টিকিট যাতে হাতে পাই, তারজন্য চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছিল। একটা মজার কথা বলি। ব্রাজিল ইংল্যান্ড ম্যাচের টিকিট যেদিন ফাইনালি পেলাম না, শুভ্রাংশুদাকে বললাম— অতশত বুঝি না, মাত্র ৪৮ টাকায় ফাইনাল দেখা যাবে; আমার টিকিট চাই-ই চাই। পুরো তাজ্জব বনে শুভ্রাংশুদা বলল, তোকে কে দিল এমন উদ্ভট তথ্য? আসলে তখনও বিশ্বকাপ শুরু হয়নি। সংবাদপত্রের এক প্রতিবেদনে পড়েছিলাম টিকিটের মূল্যের ওপর নাকি বড়সড় ডিসকাউন্ট দেওয়া হচ্ছে। হ্যাঁ, তখনই তো পড়েছিলাম মাত্র ৪৮ টাকায় বিশ্বকাপের ম্যাচ দেখা যাবে। আসলে ব্যাপারটা তেমন ছিল না। আমার গবেট মাথায় ‘প্রাণশক্তি’র সঞ্চার করাতে সচেষ্ট শুভ্রাংশুদা বলল, ওরে গাধা কলকাতায় ফাইনাল ক’টা ম্যাচ হচ্ছে জানিস? আমি তো চুপ। কলকাতায় ফাইনাল-সহ দশটি ম্যাচ হবে। টিকিটের জন্য তিনটি ক্যাটিগরি রাখা হয়। দশটি ম্যাচের টিকিট ক্যাটিগরি ওয়ান অনুসারে একসঙ্গে কিনলে খরচ পড়বে ৪৮০ টাকা। একে ১০ দিয়ে ভাগ করলে হয় ৪৮। অনেকটা টেস্ট ম্যাচের ‘সিজন টিকিটে’র মতো ব্যাপার। যা-হোক, ক্যাটিগরি ওয়ানের টিকিট ছিল না আমার কাছে। এর পরের ক্যাটিগরির টিকিটের দাম কত জিজ্ঞেস করলাম। সেই দাম শুনেও আশাহত। কারণ আমার কাছে তা নাগালের বাইরেই। ক্যাটিগরি দুই এবং তিনের টিকিটের দাম ছিল ৯৬০ এবং ১৯২০ টাকা। মুখ ভার হয়ে উঠছে বুঝে শুভ্রাংশুদা আশ্বস্ত করে, ‘দেখছি’। সঙ্গে অনলাইনে ফাইনালের টিকিট কাটার চেষ্টা করার কথা বলেছিল দাদা।
আরও পড়ুন
৯ ডিসেম্বরের বাতিল ডার্বি: মাঠ থেকে দূরে অথচ মাঠের এত কাছে
যদিও এসবে আমি ততটা সচ্ছন্দ নই। গুচ্ছের ধাপ পেরিয়ে অনলাইনে টিকিট বুক করা যাবে। ওই ওয়েবসাইটে যাও রে, সেখানে বুক টিকিটে ক্লিক করো রে, যে ম্যাচে মাঠে যেতে চাই তা খুঁজে ‘বাই টিকিটস’-এ গিয়ে বোতাম দাবাও রে, হাজারটা কন্টিনিউ এবং তা ভেরিফাই করে প্লেস অর্ডার করে টাকা পেমেন্ট করার চেয়ে মনে হচ্ছিল পাটিগণিত কষা (অঙ্কে মোটেও ভালো ছিলাম না) অনেক সহজ। তবে তখন গুলিয়ে ফেললেও এখন বুঝি আয়োজনটা মন্দ করেনি কর্তৃপক্ষ। অনলাইন টিকিট কুরিয়ার ডেলিভারি-সহ বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যাই হোক, শুভ্রাংশুদার কল্যাণে টিকিট পাই অবশেষে। শুভ্রাংশুদা, পারমিতাদি, ওর ছোড়দা আর আমি― এই হল টিম। মাঠমুখী হলাম। চিরাচরিত ট্রাফিক জ্যাম এড়ানো গেল না। বৃষ্টি হলে যেমন কলকাতার অলিগলিতে জল জমে, কোনো হাইভোল্টেজ ম্যাচ হলেও জ্যাম ঠিক হবেই। চিরশাশ্বত ব্যাপার। বাস থেকে নেমে খানিকটা হাঁটার পর স্টেডিয়ামে ঢোকার গেট। ওটুকু পথ হাঁটতে গিয়ে শান্ত সব ছবি চোখে পড়ছিল। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ হলে ততক্ষণে স্লোগান পাল্টা স্লোগানে একে অপরের মধ্যে দুই দলের সমর্থকরা কি কাণ্ডটাই না করতেন! কিন্তু সেদিনকার ছবি একদম অন্যরকম। অনেকেই এসেছেন সপরিবারে। কোনো ম্যাটাডোর চোখে পড়েনি। বেশকিছু বিদেশি ইংল্যান্ডের জাতীয় পতাকা নিয়ে মাঠে ঢুকছেন। স্টেডিয়ামের বাইরেটায় রংতুলি নিয়ে দু-তিনজন ছেলেছোকরার দল ইতিউতি ঘুরছে। ‘সস্তায় পতাকা আঁকুন... পতাকা আঁকুন’ হাঁকছে তারা। চোখে পড়ল, এক উঠতি বয়সি তরুণ পতাকা আঁকিয়ের সঙ্গে বচসা করছে। ওই তরুণের বক্তব্য, ম্যাচ যতই ইংল্যান্ড বনাম স্পেন হোক, গালে ভারতেরই পতাকাই আঁকবে। তাতে আর নতুন কী? নতুনত্ব হল, ওই পতাকা আঁকিয়ে নাকি তরুণটিকে প্রশ্ন করেছিল, কার পতাকা আঁকব ভাই? ইংল্যান্ড নাকি স্পেনের? লোকটার অপরাধ ছিল সে ‘ভারত’ কথাটা উচ্চারণই করেনি।
আরও পড়ুন
স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের দিনলিপি
আরও পড়ুন
দলবদল নয় সরগরম 'টিকিট বদল'
মাঠে ঢোকার আগে ব্যাপক চেকিং হল। নাকা-চেকিং বলতে পারেন। রসিকতা করলাম। তবে, গোপন অঙ্গ বাদ দিয়ে সমস্তটাই খুঁটিয়ে দেখে তবেই ঢুকতে দেওয়া হল মাঠে। নীচের গ্যালারিতে আমাদের সিট। বসলাম এক্কেবারে শেষের সারির চেয়ারে। কারণ সামনে এগোলে ফেন্সিং ছাড়া কিছুই দেখা যাবে না। নড়েচড়ে বসতে না বসতেই স্পেন গোল করে বসল। ১০ মিনিটের মধ্যেই স্প্যানিশ উইঙ্গার সার্জিও গোমেজ দলকে এগিয়ে দেন। তিরিশ মিনিট যেতে না যেতেই ফের গোল করে গোমেজ। আমরা ভাবছি যে, একপেশে ম্যাচ হতে চলেছে। কিন্তু হাফটাইমের ঠিক আগে ব্রিটিশ ফুটবলার রায়ান ব্রুস্টার গোল করে ম্যাচে ফেরায় ইংল্যান্ডকে। দ্বিতীয়ার্ধে যে জমে উঠতে চলেছে ম্যাচ, সেটা বুঝলাম। যদিও দ্বিতীয়ার্ধে খেলা শুরুর পর থেকে মাঠের দখল নিয়ে ফেলে ইংল্যান্ড। স্কিল, গতি, বুদ্ধিমত্তা সবেতেই ইংল্যান্ডের ছেলেরা টেক্কা দিচ্ছে স্পেনকে। আর ৭০ মিনিটের পর থেকে খেলা শেষ হওয়া পর্যন্ত গোটা স্প্যানিশ দল একদম দাঁড়িয়ে গেল। ৫৮ মিনিটে মরগান গিবস হোয়াইটের গোলে সমতায় ফেরে ইংল্যান্ড। এর পর গোটা যুবভারতীতে স্পেনের ওপর ব্রিটিশ আধিপত্য। ব্যস, এক-সে-বড়-কর-এক গোল শুরু। ৬৯ মিনিটে ফিল ফোডেন, ৮৪ মিনিটে মার্ক গুইহি, ৮৮ মিনিটে ফের ফোডেনের গোলে পরাজয়ের মালা পরে স্পেন। ৫-২ গোলে স্পেনকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জেতে ইংল্যান্ড। মনে পড়ে, স্টেডিয়ামে যখন ঘোষণা হল, ৬৬ হাজারের বেশি ফুটবলপ্রেমী এসেছেন ফাইনাল দেখতে, গ্যালারি ভরে উঠল করতালিতে। তবে, মনে ধরেছিল স্পেনের আবেল রুইজের সূক্ষ্ম পাস করার দক্ষতা, জুয়ান মিরান্ডার বাঁ-দিক থেকে নিখুঁত কিছু ক্রস বাড়ানোর ক্ষমতা। সবকিছু নিয়েই স্মৃতিগুলো নিয়ে অসাধারণ একটা রাত কেটেছিল। আমরা যখন মাঠ ছাড়ছি, ইংলিশ ফুটবলাররা সাইড লাইনের সামনে দর্শকদের অভিবাদন কুড়োচ্ছে।
আরও পড়ুন
অনামিকা সেন: হুইসেলিংয়ের নেপথ্যে থাকা নিঃশব্দ কাহিনি
Powered by Froala Editor