বিশ্ববিদ্যালয় জীবন যখন শেষ করছি, রূপকথারা বেঁচেছিল বহাল তবিয়তে। বেশিদিন নয়, বছর পনেরো আগের কথা। তবে এ রূপকথার গল্প ফুটবল ময়দান এবং তার দুই প্রান্তের মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ক্লাব তাঁবুকে বুকে আগলে রেখেই। এই যে, যত্ন করে আগলে রাখা, এ-কথা বলতে গিয়ে আগল আটকে যায় কখনো-সখনো। ভাবি, আজকের এই অতি গতির যুগে সেই আগল খুলবে? ময়দান ঘিরে রূপকথা প্রচুর। কিন্তু আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ের ময়দান ঘিরে? রূপকথা থাকলেও তা লিখে রাখেনি প্রায় কেউই। বাজারে এই জাতীয় রূপকথার কোনো মূল্য নেই। তাই তারা মাঠে জন্মায় আর মাঠেই হারিয়ে যায়। নিউজ প্রিন্টে কদর পাবে না বলে তারা অকালে ঝরে। আমরা বড্ড বেশি কদর-নির্ভর আজকাল। লাইনের বাইরে কিছু লেখাটাই যেন পণ্ডশ্রম। তাই গুগল বিশ্ববিদ্যালয়ের দৌলতে জ্ঞানচর্চা নয়, বরং অনেক বেশি করে প্রাধান্য পায় পরিসংখ্যান। এবং কেবলই পরিসংখ্যান। এই 'কেবল পরিসংখ্যানে'র দৌলতে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক বা ট্যুইটারের দেওয়ালে তুফান তুলে তর্কে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায় বটে, কিন্তু মাঠ-ময়দানের বিশাল সামাজিক সাংস্কৃতিক জগৎ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়ে যায়। ধরুন, আজ থেকে বছর কুড়ি আগে বড় ম্যাচে কী ঘটেছিল, সার্চ করতে বসলে পাওয়া যাবে কেবল ম্যাচের ফলাফল এবং সঙ্গে টুকরো ম্যাচ রিপোর্ট। কে কত মিনিটে কেমন সুযোগ পেয়েছিলেন অথবা কে গোল মিস করেছেন বা দিয়েছেন, সেসব। কিন্তু গ্যালারিতে কী হল, টিকিটের লাইনেতে কী ঘটল, বড় ম্যাচ ঘিরে উত্তেজনার সাগরস্নানের পর কে কতটা শুদ্ধ হল, সেসবের হদিশ মেলা দূরঅস্ত। এটা কিন্তু ক্রমে 'আইসোলেটেড’ হয়ে পড়ার মতোই। সামাজিক, সাংস্কৃতিক দিক থেকে তো বটেই, নিজেকেও ক্রমে হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা থাকে এতে। ঠিক করেছি এই পর্বে লিখব সেসব রূপকথা-কলি, যা কোনও ম্যাচকে ঘিরে জন্মাতে দেখেছি। তেমনই এক কিস্সা টিকিট বদল। ময়দানি ভাষায় যা চেঞ্জ বা এক্সচেঞ্জ। অনেকেই দলবদলের বিভিন্ন সরগরম কাহিনি শুনেছেন। কিন্তু এ অন্য উত্তেজনার গল্প...
বড় ম্যাচ দেখতে মাঠে যাইনি, গত দশ বছরে এমন দিন খুব কমই এসেছে। বড় ম্যাচের দিন ঘোষণা হলে অফিসে সেদিনই বলে রাখতাম। ম্যাচের দিন ভিতর ভিতর এতটাই চাপা উত্তেজনা থাকে যে, কাজে মন দেওয়া সম্ভব নয়। শুনতে আকাশকুসুম মনে হতে পারে। কিন্তু আপাদমাথা মোহনবাগান অথবা ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের এই ‘রোগ' অতি সাধারণ। ম্যাচের আগে থেকেই পরিকল্পনা থাকে অনেক। আমাদের একটা গ্রুপ আছে। ময়দানি ব্রিগেড। অভিষেকদা, অশোকদা, স্বর্ণাভদা, অপরূপদা, পারমিতাদি এবং সর্বোপরি শুভ্রাংশুদা। এদের প্রত্যেকের সঙ্গেই আলাপ শুভ্রাংশুদা মারফত, মোহনবাগানকে কেন্দ্র করে। মোহনবাগানের অন্যান্য খেলায় সবসময় একাট্টা হওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু বড় ম্যাচ বা ডার্বি ম্যাচে আমরা একাট্টা হবই, যেনতেন উপায়েই হোক না কেন। তবে, প্রত্যেক মানুষই থেকে আলাদা আলাদা জায়গায়। তারা প্রত্যেকেই স্ব-স্ব ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠিত। কর্মক্ষেত্রও পৃথক। তবুও কেউই চাই না এক যাত্রায় পৃথক ফল। গ্যাং একাট্টা করতে বরাবরই উদ্যোগী শুভ্রাংশুদা। ম্যাচের সাতদিন আগে থেকেই তার কাছে টিকিটের বায়নায় ফোন এমনই ঢুকত যে, একদিন বলে বসল তার নাকি নিজেকে 'টেলিকলার' মনে হয়। গ্রুপের সকলেই যে সমস্ত বড় ম্যাচে পাশাপাশি সিট পাবে, এমনটা দিবাস্বপ্ন দেখার মতো। তাই স্টেডিয়ামের বাইরেটায় যেন আমাদের দেখা হয়, সেটার চেষ্টা করাও হত। কিন্তু আমার একটা আদর্শ আছে। শুভ্রাংশুদার পাশে বসেই খেলা দেখব। সংস্কারও বলতে পারেন একে। বিশ্বাস করুন, দক্ষিণ কোরিয়ার ডু ডং যে ম্যাচে শুরুতেই বিশ্বমানের দু’টো ফ্রিকিক গোলে ইস্টবেঙ্গলকে এগিয়ে দিয়েছিলেন, ওই ম্যাচটা ছাড়া শুভ্রাংশুদার পাশে বসে কখনো বড় ম্যাচে হেরে ফিরতে হয়নি। যদিও প্রায় ৩০ গজ দূর থেকে ডংয়ের গোল পাশাপাশি বসে নয়, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম। কারণ জ্যামজট ছাড়িয়ে অনেক কষ্টে মাঠে ঢুকেছিলাম সেদিন। বসার সিটও পাইনি। সেন্টারের ঠিক পরেই ডংয়ের গোল আজও চোখে ভাসে। শিলটন পাল বাঁ-দিকে ঝাঁপিয়েও নাগাল পাননি। গ্যালারিতে তখন কাউকে উত্তেজিত হয়ে বলতে শুনেছি, শিলটন নাকি ঝাঁপাতে কিঞ্চিৎ দেরি করে ফেলেছেন। ২০১৫-১৬’র কলকাতা লিগের ম্যাচটায় প্রথমেই শিকড় উপড়ে গিয়েছিল সবুজ-মেরুনের। ০-৪ গোলে হেরে যায় বাগান। ডং মোহনবাগানের বারোটার ঘণ্টা বাজিয়ে আরও একটা স্পট কিক থেকে গোল করেছিলেন। বাকি দু’টো গোল ছিল মহম্মদ রফিক ও রাহুল ভেকের। ওই ম্যাচটিতেই প্রথমবার স্বজন হারানোর মতো কাঁদতে দেখেছিলাম কিছু বাগান সমর্থকদের। কেউ বলছিলেন, পরের মাসেই দুর্গাপুজো... পুরো মাটি হয়ে গেল!
প্রসঙ্গে ফিরি। আমার বায়নাক্কাকে প্রশ্রয়ও দিত দাদা। পাশাপাশি বসে খেলা দেখব বলে কত কি যে সয়ে যেতে হয়! তেমনই কোনো একটা বড় ম্যাচের আগের দিন দাদা ফোন করে জানাল, আমার টিকিট জোগাড় হয়ে গেছে। তিন নম্বর গেটের সামনে সময়মতো দাঁড়াতে হবে। বোর্ডওয়ে রোডের ওপর তিন নং গেট। ম্যাচ শুরু হতে মাত্র দশ মিনিট বাকি। দাদার পাত্তা নেই। ফোনেও পাচ্ছি না। টেনশন বাড়ছে। ফোন এল। বলল, “পৌঁছতে দেরি হবে। তোকে একটা ফোন নম্বর দিচ্ছি। ফোন কর। তোকে মাঠে ঢুকিয়ে দেবে। অশোকদার কাছে এক্সট্রা টিকিট আছে। প্রশ্ন করিস না। বাকিটা গিয়ে বলছি।”
অশোক দে মোহনবাগানের সদস্য। তাঁর কাছে মেম্বার্স কার্ডের টিকিট রয়েছে। তা সত্ত্বেও উনি একটা টিকিট কেনেন। সেই টিকিটেই আমি ঢুকব। অশোকদা এসে আমাকে গ্যালারি দেখিয়ে মেম্বারদের জন্য বরাদ্দ চার নম্বর গ্যালারিতে চলে গেলেন। ম্যাচ শুরু হয়ে গেছে পনেরো মিনিট আগেই। শুভ্রাংশুদা তখনো পৌঁছয়নি। হাফটাইম হতে চলল। দেখতে পেলাম, পুলিশের সঙ্গে কথা বলছে দাদা। পাশে এক অল্প বয়সি ছেলে। এগিয়ে গেলাম। কথা কানে পৌঁছল। “এই গ্যালারিতে আমার ভাই আছে...” পুলিশ বলছে, “তা তো বুঝলাম কিন্তু বসবেন কোথায়? দেখছেনই তো কত ভিড়!” ততক্ষণে ওখানে পৌঁছে বেশ জোরেশোরে বললাম, “চলো তাড়াতাড়ি। অনেক কষ্টে জায়গা রেখে দিয়েছি। চেপেচুপে হয়ে যাবে। এখনো গোল হয়নি।” পুলিশ আর আটকায়নি। দশ মিনিট পরেই হাফটাইম হল। কিন্তু দাদার বিলম্বের কারণ তখনো জানি না। ঠিক করেছি, ম্যাচ শেষে ও-কথা তুলব। সেদিনের ম্যাচে কোনো পক্ষই জেতেনি। গোলশূন্য শেষ হয় ম্যাচ।
আরও পড়ুন
অনামিকা সেন: হুইসেলিংয়ের নেপথ্যে থাকা নিঃশব্দ কাহিনি
একটি চিনা প্রবাদ আছে। অতি অস্পষ্ট কালির লেখা উৎকৃষ্ট স্মরণশক্তি থেকে বেশি উজ্জ্বল। অর্থাৎ স্মৃতিশক্তি দুর্বল হলে সেই স্মৃতিকথা লিখে রাখলে তা কিন্তু চিরস্থায়ী হয়। সেই কারণেই এই প্রয়াস। শুভ্রাংশুদার কাছে দু'টো ইস্টবেঙ্গল গ্যালারির টিকিট ছিল। কীভাবে? দাদার পিকনিক সেদিন। আর বড় ম্যাচ শীতের সন্ধ্যায়। ম্যাচের দু-দিন আগেই ক্লাব তাঁবু থেকে নিজের মেম্বারশিপের টিকিট ছাড়া আরও গোটা তিরিশ-বত্রিশটা টিকিট তোলে শুভ্রাংশুদা। এর মধ্যে একটা আমারও। বাকিগুলো দাদার কলেজ কলিগ , কিছু ছাত্র এবং কিছু পরিচিতর জন্য। ম্যাচের দিন কলেজ পিকনিকেও নাকি বেশ কয়েকজনকে টিকিট দেবে। পিকনিক স্পটে তাঁরা নাকি টিকিট নিতে আসবেন। পরে এই পিকনিক স্পটে এক অদ্ভুত গল্প শুনেছিলাম শুভ্রাংশুদার মুখে। যখন সে টিকিট তুলে দিচ্ছে, কোনো এক মোহনবাগানী তার কাছে এসে হাজির। ভদ্রলোকের কাছে দু-দু’টো ইস্টবেঙ্গল গ্যালারির টিকিট। তিনি মোহনবাগানের টিকিট না পেয়ে অগত্যা ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিরই টিকিট কিনে ফেলেছেন। তবে, ম্যাচের দিনেও টিকিটের অনিশ্চয়তার জন্য তাঁর বন্ধু খেলা দেখার প্রোগ্রাম বাতিল করেছেন। সব শুনে শুভ্রাংশুদা তাঁর দিকে একটা মোহনবাগান গ্যালারির টিকিট বাড়িয়ে দিতেই বিনিময় প্রথার ঢঙে ওই ভদ্রলোক শুভ্রাংশুদাকে 'নিষ্প্রয়োজন' দু'টি লাল-হলুদ টিকিট দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন। সন্ধ্যায় ম্যাচ। বারুইপুরে পিকনিক সেরে সাত-তাড়াতাড়ি মাঠমুখী হতে হবে। বারুইপুর থেকে যাদবপুর এসে S9 বাস ধরে সোজা যুবভারতী। এটাই ছিল রুট ম্যাপ। কিন্তু তখনও মানুষটা ভেবে পায়নি ইস্টবেঙ্গল টিকিট নিয়ে কী করবে! বাস যখন সায়েন্স সিটির সিগনালে দাঁড়িয়ে, শুভ্রাংশুদার চোখে পড়ল, ম্যাটাডোর থেকে একজন হাঁকছেন— “চেঞ্জ চেঞ্জ?” যে ছেলেটা ম্যাটাডোর থেকে হাঁকছেন, ইস্টবেঙ্গল সমর্থক। গায়ে ইস্টবেঙ্গলের জার্সি। তাঁর কাছে দু'টো মোহনবাগান গ্যালারির টিকিট। বাস থেকে ম্যাটাডোর। ডার্বি ম্যাচের টিকিট বিনিময় করে ফেলল শুভ্রাংশুদা। সেদিনের ম্যাচ শেষে এমন নাটকীয় টিকিট চেঞ্জের গপ্প শুনে জিজ্ঞেস করেই ফেলেছিলাম এটা কী করে করলে? শুভ্রাংশুদার সটান টেনিদা সূচক উত্তর― “খুব সোজা, আমি বাসের জানলা দিয়ে দু’টো লাল-হলুদ এগিয়ে দিলাম। আর দু’টো সবুজ-মেরুন সংগ্রহ করলাম খোলা ময়দানি ম্যাটাডোর থেকে।” বলাই বাহুল্য, 'ময়দানি ম্যাটাডোর' শব্দটি শুভ্রাংশুদার কাছ থেকেই প্রথম শুনেছিলাম সেদিন। আসলে ম্যাটাডোরটি ছিল মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল মিক্সড। বড় ম্যাচ হলে এমনটা সচরাচর দেখা যায়। একই ম্যাটাডোরে মোহন-ইস্ট সমর্থকেরা দলবেঁধে একসঙ্গে আসেন। আমার টিকিট যেহেতু তিন নম্বর গ্যালারিতে, তাই দাদা ম্যাটাডোরে তাকিয়ে জানতে চাইল তিন নম্বর গ্যালারি কোনও টিকিট আছে কিনা। তিন নম্বর গ্যালারির টিকিট পাওয়া না গেলেও 3A গ্যালারির টিকিট রয়েছে বলল একজন। দাদা ওই 3A গ্যালারির টিকিটের সঙ্গে তার মেম্বার টিকিট চেঞ্জ করে ফেলল। সবমিলিয়ে দু'টো ইস্টবেঙ্গল গ্যালারির টিকিট এক্সচেঞ্জ করে তিনটে সবুজ-মেরুন গ্যালারির টিকিট পেয়ে বেজায় খুশি। এরমধ্যে মেম্বার্স টিকিটটা বাসে পরিচয় হওয়া এক মধ্যবয়স্ক মোহনবাগান সমর্থককে দিয়ে দিয়েছিল দাদা। তিনি স্টেডিয়ামের টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কাটার আশায় মাঠে যাচ্ছিলেন। জানতেন না ম্যাচের দিন এখন আর কাউন্টার থেকে টিকিট বিক্রি করা হয় না। সেই ঝক্কি পোহাতে না হওয়ায় অবশ্য ভদ্রলোক খুবই খুশি হয়েছিলেন। আর বাকি থাকা দু'টো টিকিটে মাঠে ঢুকল দাদা এবং সায়ন ঘোষ। সায়ন কলেজ পড়ুয়া। শুভ্রাংশুদার ছাত্র। প্রথমবার আলাপ ওর সঙ্গে। আমার সেই কথিত 'সংস্কারে'র জন্যই এত আয়োজন! দাদারা তিন নম্বরে না গিয়ে 3A গ্যালারিতে আসার কারণেই পুলিশ নিমরাজি ছিল। যাইহোক, গোলশূন্য সেই নির্বিষ ম্যাচ আমরা তিনজন পাশাপাশি বসে দেখেছিলাম। এই ধরনের ঘটনা রূপকথার চেয়ে কোনো অংশে কম কি?
আরও পড়ুন
'টু ডলার' রেফারিদের নানান গল্পস্বল্প
তবে রূপকথা এখানেই শেষ নয়। ২০১৮-র আর-এক শীতের রূপকথা। মোহনবাগান সে-বছর দলে নিয়েছিল ক্যামেরনের ডিপান্ডা ডিকাকে। আমি টিকিট কাটতে গিয়েছিলাম গোষ্ঠ পাল সরণির সবুজ-মেরুন ক্লাব তাঁবুতে। ক্লাবের পিছন দিকটায় টিকিট দেওয়া হচ্ছে। সকাল থেকেই লাইনে নিজের জায়গা রাখা শুরু করেছেন অনেকেই। লেপের উষ্ণতা ছেড়ে আমি পৌঁছেছি সকাল প্রায় সাড়ে ন'টায়। বাবার মুখে বড় ম্যাচের টিকিটের জন্য লম্বা লাইনের কথা শুনেছি। কিন্তু এই ২০১৮-তেও, বিশেষ করে যে সময়টায় লোকজন 'বাংলার ফুটবল শেষ হয়ে গেছে' বলে নাক সিটকোন, সেই সময় এত লোকের ভিড় দেখে ভিরমি খাচ্ছি। লম্বা লাইন সামলানোর দায়িত্বে ঘোড়পুলিশের টহল। শুনেছি, সরকার থেকে ২ লক্ষ টাকা দাম দেওয়া হয় ঘোড়াপিছু। যদিও সে অন্য প্রসঙ্গ। লাইনে সামান্য সমস্যা তৈরি হলেই টগবগিয়ে ছুটে আসছে তারা। বিপরীতে ইডেন গার্ডেন্সের দেওয়ালে কপিল, দ্রাবিড়, লক্ষ্মণের প্রসন্ন ছবিগুলো দেখে সেই সময় মনে হচ্ছিল, আমাদের অবস্থা দেখেই তাঁরা উপহাস করছেন। এদিকে বেলা গড়িয়ে অফিস টাইমও এগিয়ে আসছে। এক ঘোড়পুলিশকে দেখে অনুরোধ করলাম, “সংবাদপত্রে চাকরি করি, একটু দেখুন না স্যার, সম্পাদক নইলে রেগে যাবেন।” পাত্তাই দিলেন না। শিরে সংক্রান্তি বুঝে অফিসে ফোন করে ম্যানেজ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মুশকিল বাড়ল। যখন দশজনের পিছনে, ২০০ টাকার টিকিট শেষ! কাউন্টার থেকে ঘোষণা করা হল, ৪০০ টাকার টিকিট রয়েছে এবং একজন দু'টোর বেশি টিকিট কিনতে পারবেন না। ভাবুন একবার, ঘোড়ার 'গুঁতো' খেয়ে শেষে কিনা এই! তবে, মোহনবাগানের জন্য ৮০০ টাকা খরচ করাই যায়। আর-একটা টিকিট নিতে সায়ন আসবে সেদিনের বিকেলে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সামনে। আমার অফিস রয়েড স্ট্রিটে তখন। বিকেল পাঁচটা নাগাদ ও এসে টিকিট সংগ্রহ করে চলে গেল। কিন্তু পরের দিন ম্যাচের আগে আমার টিকিটটা সেই 'চেঞ্জ' করতেই হল। চেঞ্জ করতে হল বলার চেয়ে বরং বলা ভালো, টিকিট বদল করতে হল ২০০ টাকার টিকিটের সঙ্গে। মানে আমি চারশো টাকার টিকিটের পরিবর্তে দু'শো টাকার টিকিট নিলাম। কারণ ওই একটাই। শুভ্রাংশুদার পাশে বসব। ওই ম্যাচটা মোহনবাগান জিতেছিল ২-০ গোলে। খেলা শুরুর এক মিনিটের মধ্যেই গোল করে গ্যালারি মাতিয়ে দিয়েছিলেন ডিকা। আরেকটা গোলও করেছিলেন ক্যামেরুনের ক্যারিশ্মাটিক এই স্টাইকার। কিন্তু, কী এমন ঘটল গত দশ-পনেরো বছরে যে, টিকিট বদলটা একপ্রকার নিয়ম হয়ে দাঁড়াল? এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে বলে মনে হয়। প্রথমত, টিকিটের বিজ্ঞাপন ঠিকমতো প্রচার না করা। অর্থাৎ টিকিট কোথায় কোন সময় পাওয়া যাচ্ছে, সেটা আরো ভালোভাবে প্রচার করা উচিত। দ্বিতীয়ত, অনলাইন টিকিটের গেরো। এই অনলাইন টিকিটে একটা কিংবা দু'টোর বেশি টিকিট কাটা যায় না মাঝেমাঝেই। এটা অন্যতম প্রধান সমস্যা। যাঁরা গ্রুপ করে খেলা দেখতে আসেন, তাঁরা এক-এক প্রান্ত থেকে টিকিট কাটতে বাধ্য হওয়ায় গ্যালারিতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। তিন নম্বর হল, দরকার আরো বেশি করে টিকিট ছাপানোর। কর্তৃপক্ষ হয়তো বলবেন, স্টেডিয়ামে তো ক্যাপাসিটি ৬৬ হাজারের মতো, এর বেশি কীভাবে ছাপানো সম্ভব? একটাই কথা, এই স্টেডিয়ামেই তো ১৯৯৭-এর ফেডারেশন কাপ সেমিফাইনালে এক লক্ষ একত্রিশ হাজার লোক হয়েছিল। ফিফার রেকর্ড বুকেও রয়েছে সে ভিড়ের কথা। কিন্তু স্টেডিয়ামের আধুনিকীকরণ করতে গিয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ ক্যাপাসিটি কমিয়ে দেওয়ার যৌক্তিকতা এখনও খুঁজে পাইনি। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে ৬৬ হাজার দর্শক কিছুই নয় যে...
আরও পড়ুন
শিবাজি স্মৃতি এবং আই-লিগ
Powered by Froala Editor