২০১৬-১৭’র মরশুমে মোহনবাগানের হোম গ্রাউন্ড রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়াম। ওই বছর আই-লিগে আইজলে গিয়ে কুয়াশা ঘেরা মাঠে ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে অল্পের জন্য আই-লিগ খেতাব হাতছাড়া হয় মোহনবাগানের। ওই মরশুমটা অনেকগুলো কারণে মনে আছে। আইজল ম্যাচটা তো বটেই, স্মৃতিতে রয়ে গিয়েছে শিলিগুড়ি ডার্বি। শিলিগুড়িতে প্রথমবার ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়েছিল সবুজ-মেরুন। সেই ম্যাচের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা। সনি নর্দির ‘স্টেনগান সেলিব্রেশন’, আজহারউদ্দিন মল্লিকের স্বপ্নের গোল সবই একসঙ্গে ঘটেছিল শিলিগুড়ি ম্যাচে। যদিও এই পর্বে লিখব ওই মরশুমেরই ১৮ ফেব্রুয়ারির কথা। ২০১৭-র ওই তারিখে মোহনবাগান মুখোমুখি হয়েছিল ডিএসকে শিবাজিয়ান্স এফসির। যতদূর মনে পড়ে, ৩০ মিনিটের আশপাশের সময়ে মিলন সিংয়ের গোলে এগিয়ে গিয়েছিল শিবাজিয়ান্স। গ্যালারিতে তখন উৎকণ্ঠা। গোল শোধ হবে তো? হাহুতাশ চলতে চলতেই প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার আগেই পর পর দু’টো গোল করে স্নায়ুকে আপাতত ঠান্ডা করে দিয়েছিল মোহনবাগানের বলবন্ত সিং। যাইহোক, ম্যাচের এক্কেবারে শেষ মুহূর্তে জাপানি নক্ষত্র কাতসুমি ইউজার গোলে মোহনবাগান সেদিন জিতেছিল ৩-১ গোলে।
স্টেডিয়াম সংলগ্ন অঞ্চলটিতে প্রচুর গাছগাছালি। সামনেই ঢাকুরিয়া লেক। ১০ নম্বর গেটের কাছেই আবার লায়ন সাফারি পার্ক। বন্যপ্রাণী এবং খেচরের এই অঞ্চলে নিশ্চিন্ত বাস। তাই প্রায় গোটা অঞ্চলটিতেই কড়া আলো জ্বলে না। মোহনবাগান জিতেছে। মন ফুরফুরে। শুভ্রাংশুদা বলল, “একটু হাঁটতে হবে। ১১ নম্বর গেট পর্যন্ত। ওখানে একটা স্পেশাল চা পাওয়া যায়, লেবু চা আদার কুঁচি দেওয়া। চল আপাতত চা দিয়েই আমরা উল্লাস করব।” আমরা কয়েকজন অসম বয়সের বন্ধুরা ম্যাচশেষে আগুয়ান। অনতিদূরে ভিআইপি গেট। গেটের সামনে পৌঁছতেই দেখলাম প্রবাদপ্রতিম গোলকিপারকে। শিবাজি ব্যানার্জি। প্রণাম করলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না, কার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। হ্যাঁ, এই মানুষটিই ১৯৭৭-এ ফুটবল সম্রাট পেলেকে গোল করতে দেননি। বলা হয়, পেলের পা থেকে বল ছিনিয়ে নিয়েছিলেন শিবাজি ব্যানার্জি। কসমসের সঙ্গে এই ম্যাচটি ২-২ গোলে ‘সুখের’ ড্র করে ইডেন গার্ডেন্স ছেড়েছিল মোহনবাগান। সেই শিবাজি ব্যানার্জি কিনা প্রায় ৩০ মিনিট গল্প করেছিলেন আমাদের সঙ্গে। আড্ডার মুডে ছিলেন। সেদিন মোহনবাগানের খেলায় একদম খুশি ছিলেন না। ম্যাচের ভুলভ্রান্তি নিয়েই বলছিলেন। এরমধ্যেই শুভ্রাংশুদা শিবাজি ব্যানার্জিকে ওনার আত্মজীবনী নতুন করে লেখার কথা বললেন। সে-ব্যাপারে ‘শিবাজিদা’ শুভ্রাংশুদাকে তাঁর বাড়িতে যেতে বললেন। দাদা বলেছিলেন, “আমরা সকলে মিলে বিষয়টা দাঁড় করিয়ে দেব।” তারপর ছবি তোলা। কমদামি মোবাইলে। প্রথম ছবি তোলার পরে ছবিটা তেমন ভালো হয়নি শুনে শিবাজিদা নিজে থেকে আর-একবার ছবি তুলতে বলায় সেকেন্ড টাইম তোলা হয়েছিল সেই পোস্ট করা ছবি। আজ বুঝি কিছু জিনিস সম্পত্তি নয়, সম্পদ হয়।
ফিরতে অনেকটা রাত হয়েছিল সেদিন। সেলিব্রেশনের মুডে ছিলাম। এক মধ্যবিত্ত রেস্তরাঁয় ডিনার করতে করতে দাদা বলেছিল, সকালবেলার ম্যাচের গল্প। মানে বুঝলেন না? এর অর্থ হল, ঘুম থেকে উঠেই সকালবেলা ফেডারেশন কাপের সেমিফাইনাল দেখার জন্য একদা ব্যস্ততা শুরু হয়ে গিয়েছিল। এমন রূপকথার তারিখটি ৭ মে, ১৯৮০। দাদা তাঁর ‘পেনান্টি স্পেশালিস্ট শিবাজি ব্যানার্জি রূপকথা জন্মের চার দশক পেরিয়ে’ নিবন্ধে পরবর্তীতে লিখেছে এই ম্যাচের কথা। “শুধু সকাল বললেই শেষ হয় না। কাহিনিতে আরও টুইস্ট আছে। এই সেমিফাইনাল ম্যাচটি ছিল দ্বিতীয় রিপ্লে ম্যাচ। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। পর পর তিনদিনে তৃতীয় ম্যাচ। সকালবেলায় এ খেলার জন্য কোনও টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা ছিল না। মুখে বলা হয়েছিল আগের দিনের টিকিট দেখিয়ে ঢুকতে হবে ইডেন গার্ডেন্সে। অবশ্য প্রবেশ প্রায় অবাধ ছিল। তৃতীয় দিনের সকালের ম্যাচে টাইব্রেকারে ম্যাচ জিতিয়ে এক নতুন মিথের জন্ম দিয়েছিলেন মোহনবাগান গোলকিপার শিবাজি ব্যানার্জি। আর উল্টোদিকে হতাশ হতে হয়েছিল ময়দানে আর-এক প্রায় মিথ হয়ে যাওয়া গোলরক্ষক ভাস্কর গাঙ্গুলিকে। পরাজিত মহমেডান স্পোর্টিং দলের গোল দুর্গ রক্ষার দায়িত্ব ছিল যাঁর কাঁধে।” এখন লেখা কোট করে যতটা সহজে প্রকাশ করে ফেললাম, প্রথমদিন শুনে ঘটনাবলি অ-আ-ক-খ’র মতো করে ডিনারের সঙ্গেই একপ্রকার গিলে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। ফের আই-লিগ জয়ের স্বপ্নও তাতে মিশে একাকার। যাই হোক, দাদাকে ভোরবেলায় কর্মসূত্রে বেরোতে হত তখন। আমিও ভোরে উঠেছিলাম পাখি দেখতে যাব বলে। দেখলাম, দাদা ঘুম থেকে উঠেই শিবাজি ব্যানার্জির সঙ্গে সেই ছবিটা ফেসবুকে নিজের টাইমলাইনে পোস্ট করেছে। ঘড়িতে টাইম দেখাচ্ছে ভোর ৫টা বেজে ০৩ মিনিটে। ক্যাপশন লিখেছে, “উইথ লেজেন্ডারি গোলকিপার শিবাজি ব্যানার্জি”। সেদিন ১৯ ফেব্রুয়ারি।
ওই সময় ‘টাইব্রেকার সম্রাট’ শিবাজি ব্যানার্জি ছিলেন মোহনবাগান ক্লাবের টেকনিক্যাল কমিটির অন্যতম সদস্য। সেই ১৯ ফেব্রুয়ারিই রাতে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো খবর এল। শুনলাম, শিবাজি ব্যানার্জি আকস্মিক হার্ট অ্যাটাকে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন। ভাবতে পারিনি যে, আমাদের সঙ্গে তোলা আগের দিনের ছবিটা আমাদের এভাবে আঘাত দেবে। এখনো ভাবতে কষ্ট হয়, কিংবদন্তি গোলকিপার শিবাজি ব্যানার্জি জীবনের শেষ ম্যাচটি তাঁর প্রিয় দলকে শিবাজিয়ান্সের সঙ্গেই খেলতে দেখবেন। পেলের ফ্রিকিক বাঁচিয়েছিলেন এই গোলকিপার। কেবল তাই নয়, তিনি জর্জিও চিনাগ্লিয়ারের ফ্রিকিকও বাঁচিয়েছিলেন। চিনাগ্লিয়ার সে-সময় ইতালিয়ান লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা। কবিতার ভাষায় বললে বলা হয়, পেলের পায়ে দিয়ে ডুব ছিনিয়েছিলে বল / নৌকা বাইয়ে তুমি হয়েছিলে সফল... মনে আছে যে, শিবাজি ব্যানার্জির মরদেহ গণশক্তির অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মোহনবাগান ক্লাব মাঠে, ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল, সিএবি-তে। শুভ্রাংশুদা উপস্থিত ছিল। বলল, “শিবাজিদা ক্লাবস্তরের ক্রিকেটেও কিন্তু যথেষ্ট সফল। ভালোই রান করেছিলেন।” মনখারাপের মেঘ যখন ক্রমে ঘন, দাদা ঘটনাস্থল থেকে ফোনে আরো বললেন, “অনেকেই কাঁদছে বুঝলি। স্বজন হারানোর কান্না। সামনেই দাঁড়িয়ে ভাস্কর গাঙ্গুলি, গৌতম সরকার, চুনী গোস্বামী, সুব্রত ভট্টাচার্যরা... সনি, জেজে, প্রণয়রাও এসেছে... কিছুই ভালো লাগছে না...” গলা ধরে এল শুভ্রাংশুদার। এরপর তিনদিন কথা হয়নি দাদার সঙ্গে। এত ‘অন্ধকার’ কখনো দেখিনি। এরপর নিজেই ফোন করে বলল, “সল্টলেকের ইস্টার্ন জোনাল কালচারাল সেন্টার (ইজেডসিসি)-এ শিবাজিদার পারিবারিক স্মরণসভা (তারিখটা মনে নেই) রয়েছে। একসঙ্গে যাব।” গিয়েছিলাম। শিবাজি ব্যানার্জির ছেলে শান্তনু ব্যানার্জিকে সেই ছবিটাও দেখানো হয়। এরপর বিষাদেও আলো খুঁজেছি আমরা। পাইনি। তার ওপর সামান্যের জন্য ফের আই-লিগ জিততে পারল না মোহনবাগান! কিন্তু আজও সেই ছবিটা ফেবুক দেখালে মনটা ভারী হয়ে ওঠে। এই দুঃখের আয়ু কতদিন? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর পাইনি আজও...
আরও পড়ুন
মোহনবাগান এবং আমাদের সকলের আই-লিগ জয়
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
কৃষ্ণপদ গাঙ্গুলি এবং তাঁর মধ্যমগ্রাম হাইস্কুলের জয়গাথা