ময়দানে কখনো সন্ধে হওয়া দেখেছেন? কখনো দেখেছেন কি প্র্যাকটিস ফেরত ছেলেদের ডান হাতে জুতো জোড়া নিয়ে খালি পায়ে ফিরে যেতে? কিছু বছর আগেকার কথা লিখতে চলেছি এই পর্বে। ঘুম ভেঙেছিল শুভ্রাংশু রায়ের সকালবেলার ফোনে। বলল, “গোষ্ঠ পালের মূর্তির সামনে বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ দাঁড়াস। এক জায়গায় যাব।” সেইমতোই শুভ্রাংশুদার জন্য অপেক্ষা ময়দানে গোষ্ঠ পালের মূর্তিটার ঠিক সামনে। তাও সময়ের তিরিশ মিনিট আগেই। তখন তো প্র্যাকটিস ফেরত নয়, বরং জার্সি বুট পরে ছেলেরা ময়দানমুখো। কারোর হাতে ফুটবল। কেউ বা পিঠে ব্যাগ আগলে। ভিতরে খেলার সরঞ্জাম। হাতে উইকেট ব্যাট নিয়েও ছেলেছোকরার দল আগুয়ান। এসবই দেখেই তখন চোখের আরাম। ধারণা ছিল, শুভ্রাংশুদা যখন ময়দানে আসবে, আমাদের গন্তব্য হবে স্বাভাবিকভাবেই মোহনবাগান মাঠ কিংবা ইডেন গার্ডেন্স। কিছুক্ষণ পরেই বাস থেকে নামল দাদা। ঘেমে স্লান। হন্তদন্ত হয়ে বলল, ‘চ...’। খানিকটা এগোতেই হঠাৎ দেখলাম বাঁ-দিকে এগিয়ে গেল। ভাবলাম, তাহলে হয়তো আমাদের গন্তব্য পুলিশের মাঠ অথবা কাস্টমস টেন্ট। কিন্তু সেসবও অবলীলায় পেরিয়ে গেলাম। দেখি শুভ্রাংশুদা অম্লান বদনে হেঁটে চলেছে ইস্টবেঙ্গল মাঠের দিকে। আমি তো অবাক! ভাবলাম প্রশ্ন করি। কিন্তু পরক্ষণেই তার অমন ভাবলেশহীন মুখ দেখে প্রশ্ন করার ইচ্ছেটাও মরে ভূত। নিজেকে মনে হল ‘সোনার কেল্লা’র লালমোহনবাবুর মতো― ‘কোনো প্রশ্ন নয়, নো কোয়েশ্চেন’। দাদার দিকে দৃষ্টি আরোপ করার চেষ্টা করলেও বিশেষ পাত্তা আর দিল কই! তার মুখে কোনো বিস্ময় নেই। বরং তার হাঁটার গতি আরো বেড়ে গেল। লাল-হলুদ ক্লাবের গেটের সামনে তখন দাঁড়িয়ে ইস্টবেঙ্গল কর্মকর্তা দেবব্রত সরকার। আমাদের দেখেই বললেন, ‘‘হ্যাঁ ওরা এসে গেছে।’’ বুঝলাম, দেবব্রত সরকারের সঙ্গে শুভ্রাংশুদার ব্যক্তিগত পরিচয় রয়েছে। এভাবেই আমার প্রথমবার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ভিতরে ঢোকা। আমি বেশ ইতস্তত। আসলে ঝটকাটা বেশ ভালোই লেগেছে যে! ঢুকেই দেখলাম, ক্লাবের মাঠে মহিলাদের ফুটবল ম্যাচ চলছে। এক বয়স্ক মোটাসোটা ভদ্রলোক দৌড়ঝাঁপ করছেন। তাঁর নাম দেবু মুখার্জি। উনি পশ্চিমবঙ্গের মহিলা ফুটবলটা দেখেন। ‘‘সেই দেরি করলি!’’ দেবুবাবু শুভ্রাংশুদাকে দেখে কিঞ্চিৎ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন। এরপর এক ভদ্রলোককে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। তিনি ফিফার ডেভালপমেন্ট অফিসার, ড. শাজি প্রভাকরণ। আমি তো অবাক! শাজি প্রভাকরণের মতো ব্যক্তিত্ব শুভ্রাংশুদাকে বাই নেম চেনেন! ফিফার কর্তা-ব্যক্তিদের সঙ্গে তার এই পরিচয়ের কথা কই, কখনো তো আমাকে বলেনি দাদা? একথা সকল লোকের মাঝে থেকে একটু আলাদা হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করতেই বলল, “হ্যাঁ ওই আর কী... সময় হলে ঠিকই জানতিস, এই তো এখন জানলি।” এইসব ঘটনা খুবই দ্রুত ঘটছিল। নাটকের ভাষায় বলতে গেলে, কোনো ড্রামাটিক রিলিফের বালাই নেই। প্রথমে একজন মোহনবাগানি হয়েও ইস্টবেঙ্গল মাঠে ঢুকছি বলে বেশ কুণ্ঠাবোধ হচ্ছিল। কিন্তু কখন যে সেসব উধাও হয়ে গেল, টেরই পাইনি।
সেইসব কাহিনি এখন বয়ান করতে গিয়ে টের পাচ্ছি অভিজ্ঞতাটুকু মনে রাখার মতোই হয়েছিল। সেদিনের বিকেলটায় মনে পড়ছিল মামাদের কথা। তারা পাঁড় ইস্টবেঙ্গল সমর্থক। ঢেরা পিটিয়ে এক সময় মাঠ করত। সদ্য যখন কলেজে উঠেছি, বড়মামা বলেছিল— ইস্টবেঙ্গল মাঠে নিয়ে যাবে। আমারই বেঁকে বসার কারণে সেই ইচ্ছে আর পূরণ হয়নি মামার। তবে শুভ্রাংশুদার কল্যাণে সেবার ইস্টবেঙ্গল মাঠে ঢোকাটা তো আমার কাছে রীতিমতো হতচকিত হয়ে ওঠার মতো একটা ব্যাপার। আসলে সেদিন ইস্টবেঙ্গল মাঠে ভারতের উইমেন্স ফুটবল ফেডারেশন ডেভালপমেন্ট খতিয়ে দেখতে ফিফার প্রতিনিধি হিসাবে আসেন এক জার্মান লেডি, যিনি এককালে ইউরোপের এক দাপুটে ফুটবলারও ছিলেন। 'জার্মান'দের (এককালে ওরা নিজেদের 'জার্মান' বলত। জার্মানি ভাগ হয়ে গিয়েছিল। বাংলায় তাই। বাংলার পূর্ব দিক চলে গিয়েছিল অন্য দেশে। তাই হয়তো এমন সম্বোধন।) মাঠে আসল জার্মানের সঙ্গে মুলাকাত। বহু চেষ্টাতেও তাঁর নাম আমরা মনে করতে পারলাম না বলে দুঃখিত। তবে এটুকু মনে আছে, তিনি ছিলেন উইমেন্স ফুটবলে গ্লোবাল ডেভালপমেন্ট অফিসার। এই উপলক্ষে ইস্টবেঙ্গল মাঠে একটি প্রদর্শনী ম্যাচের আয়োজন করা হয়। যাতে বাংলার স্থানীয় মহিলা ফুটবলাররা নিজেদের মধ্যে দু'টি দল গড়ে অংশ নেন। প্রদর্শনী ম্যাচটি হয় আইএফএ একাদশের সঙ্গে মেয়র একাদশের মধ্যে। শুভ্রাংশুদাকে দেখলাম লাল-হলুদ গ্যালারিতে বসে থাকা কুন্তলাদির পাশে গিয়ে বসতে। আলাদা করে আর বলে দেওয়ার দরকার নেই, এই কুন্তলাদিই কুন্তলা ঘোষ দস্তিদার। যখন 'বাংলা ও বাঙালি' পত্রিকায় চাকরি করি, শুভ্রাংশুদার কাছেই শুনেছিলাম তাঁর কথা। যা পুরুষরা পারেননি, তা করে দেখিয়েছেন এই কুন্তলাদি। ভারতের মেয়েরা কিন্তু ১৯৮২-তে ফুটবল বিশ্বকাপ খেলেছিলেন। সেই দলের ক্যাপ্টেন ছিলেন কুন্তলা ঘোষ দস্তিদার। সেদিন আমাকে দেখে একটু হেসে মন দিলেন ম্যাচে। একফাঁকে দাদা তাঁকে জিজ্ঞেস করল, কোচিং কেমন চলছে সে কথা। কানে পৌঁছল, তিনি এখন ইংলিশ প্রিমিয়র লিগের অধীন প্রিমিয়র স্কিলস ফুটবলেও যুক্ত।
‘‘আরে এভাবে কেউ খেলে!’’ ম্যাচ দেখতে দেখতে হঠাৎই উত্তেজিত কুন্তলাদি। বুঝলাম, ম্যাচের মধ্যে ঢুকে গেছেন। ম্যাচে খেলছিলেন আলপনা শীল, সুজাতা কর, রঞ্জিতা খানের মতো ফুটবলাররা। দাদা একে-একে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ওটা আলপনা শীল, উনি সুজাতা কর। ওই যে গোলকিপার, তাঁর নাম রঞ্জিতা খান। বলতে বলতেই সুজাতা করের গোল! ক্রমে ফুটবলে মজে গিয়েছি যখন, শুভ্রাংশুদা জানালেন, প্রথম ভারতীয় মহিলা ফুটবলার হিসাবে ভারতের বাইরে চুক্তিতে সই করেছিলেন আলপনা শীল, সুজাতা কর। ২০০৮-০৯’এ। চিত্রা গঙ্গাধরণ, জানকি কোটেচা-র মতো মহিলা খেলোয়াড়রা ওই সালে অল-এশিয়ান স্টার দলে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ‘‘এঁরা কিন্তু অনেক মেয়েকে ফুটবলকে পেশা হিসাবে বেছে নিতে অনুপ্রাণিত করেছে বুঝলি।’’
আরও পড়ুন
মারাদোনা ও মোহনবাগান
—তা আর বলতে!
আরও পড়ুন
ডায়মন্ড দত্ত থেকে চাতুনি পর্ব
শুভ্রাংশুদা রঞ্জিতা খানকে দেখিয়ে বললেন, ‘‘আমি সম্ভবত ওনার আরও একটা ম্যাচ দেখেছিলাম। মণিপুরের বিরুদ্ধে খেলা ছিল। ওই সময় মণিপুরে খেলতেন সোখিতম্বী দেবী। দারুণ সব সেভ করেছিলেন।... উফফ!’’ এরই মধ্যে কুন্তলাদি জানালেন, মহিলা ফুটবল নিয়ে আরো পজিটিভলি ভাবা উচিত মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলকে, এই দুই ক্লাবের যা পরিকাঠামো আছে, তাতে মহিলা ফুটবল দল না গড়ার কোনো কারণ নেই... ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি এসব ছেড়ে শুভ্রাংশুদাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘তুমি রঞ্জিতা খানের খেলা দেখেছ?’’
আরও পড়ুন
সেই অমলময় দিনগুলি
—হ্যাঁ। খুব সম্ভবত সিনিয়র মহিলা জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচ ছিল। বাংলা দলে ছিলেন। ওইসব নিয়েই তো এককালে থাকতাম।
—অদ্ভুত ছুপা রুস্তম তুমি। তোমার মধ্যে কিন্তু গুপ্তধন আছে।
—হাহাহা! এটা কিন্তু ভালো বললি... গুপ্তধন।
—আমি ভালোই বলি।
আমরা তখন গ্যালারি থেকে একটু নিচের দিকটায় নামছি। ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে কুন্তলাদির পাশে একজন মাঝবয়সি মহিলা বসলেন। চিনতাম না। উনি কে, জিজ্ঞেস করতেই শুভ্রাংশুদা বলে বসল, ‘‘কপিল দেবকে চিনিস?’’
—তাঁকে কে না চেনে?
—হ্যাঁ বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিল বলেই চিনিস। নইলে কপিলকেও...
বুঝলাম না, এরসঙ্গে কপিলের কী সম্পর্ক! ‘‘তুমি খামোকা কপিল দেবকে টানছ কেন?’’
—কারণ আছে। ওই যে, উনি শান্তি মল্লিক। ভারতের প্রথম মহিলা ফুটবলার হিসাবে অর্জুন পুরস্কার পেয়েছিলেন। কপিল ’৮৩-তে বিশ্বকাপ আনার বছরেই।
—ভালো বলতে তো।
—আমি ভালোই বলি। হাহাহা!
নাহ, সেদিন কথা হয়নি শান্তিদির সঙ্গে। কারণ ততক্ষণে ম্যাচ শেষ হয়েছে। আইএফএ একাদশ সম্ভবত জিতেছিল। ইস্টবেঙ্গল কর্মকর্তাদের দেখা গেল ড. শাজি প্রভাকরণ এবং ফিফা প্রতিনিধি ওই জার্মান লেডিকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত। তাঁদের মুখে হাসি। মহিলা ফুটবলের উন্নয়ন দেখে তাঁরা খুশি। ওই জার্মান লেডিকে প্লেয়ারদের বেশকিছু বলতেও দেখা গেল। আর শাজি প্রভাকরণ তাঁর ‘বন্ধু’ শুভ্রাংশু রায়কে বললেন, “সব কুছ তো ঠিক হ্যায়। স্রেফ মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল ম্যায় প্রফেশনালিজম চাহাতা হু।” এরপর দাদার সঙ্গে হ্যান্ডশেক আর আমাকে পিঠ চাপড়ে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ভিতরে ঢুকে গেলেন তিনি। দেবব্রত সরকার আমাদের বললেন, চা সিঙারা খেয়ে যেতে। সবকিছু শেষে লাল-হলুদ ক্লাবের বাইরে তখন গঙ্গার ফুরফুরে হাওয়া। ময়দানে সন্ধে হচ্ছে। একটু এগিয়ে যেতেই প্র্যাকটিস ফেরত ছেলেরা বাড়ির পথে। আমরা পায়ে পায়ে বটতলার দিকে। বসে এক লেবুজলওয়ালা। “দো ঠো স্পেশাল বানাও পাশোয়ান ভাই।” মেজাজি হুকুম শুভ্রাংশুদার। জানলাম, মুজাফফরপুরে পাশোয়ান ভাইয়ের ‘দেশ'। তাঁর বাবাও বটতলায় একই পেশাজীবী ছিলেন। কয়েক বছর হল গত হয়েছেন। তবে, বটতলার পাশোয়ানি লেবুজলের বেশ নামডাক। প্লেয়াররাও গলা ভেজায়। আমাদের দিকে দু’টো গ্লাস বাড়াতেই রসিকতা করল দাদা― “ক্যায় পানি মে স্যাকারিন মিলা দিয়া গ্যায়ে হ্যায়?” শুনে তিরিক্ষি মেজাজে পাশোয়ান ভাই বললেন, “পাশোয়ান কা কসম দাদা।” আমরা হো-হো করে হাসতেই পাশোয়ান ভাই আশ্বস্ত। এর খানিক পরেই হালকা সবুজ টি-শার্ট পরে মাঝবয়সি এক লোকের আবির্ভাব। “দাদা কেমন আছেন? আপনি আজকাল তো খুব বেশি ইডেনে আসেন না। কিন্তু মোহনবাগান মাঠে তো আপনাকে নিয়মিতই ঢুকতে দেখি।” বুঝলাম, ইনিও শুভ্রাংশুদার পূর্ব পরিচিত। ক’দিন পরেই টিম ইন্ডিয়ার ওয়ানডে ম্যাচ ছিল সম্ভবত। সেই সব নিয়ে উনি ভুজংভাজুং করলেন। খেয়াল করলাম দাদা খুব একটা পাত্তা দিল না। কয়েক মিনিট বকবক করে লোকটি প্রায় ঝড়ের গতিতে গায়েব হয়ে গেল। দাদাকে জিজ্ঞেস করলাম, কে?
―একজন ব্ল্যাকার। ক্রিকেট মাঠে অবশ্য অনেক রকমভাবে টিকিট ব্ল্যাক হয়। এই যে এনাকে দেখলি, এরা টিকিট ব্ল্যাক করে গাড়ির মধ্যে বসে।
এরপর দাদার মুখে অনেক কিছুই শুনে ছিলাম। ময়দানের অন্য সব কাহিনি। শুনতে শুনতে হাড় হিম হয়ে গিয়েছিল। সদ্য সন্ধ্যায় বটতলায় সেদিন তাকিয়ে দেখেছিলাম শুভ্রাংশুদার মুখে রাস্তার গাড়ির আলোতে ছায়া আর আলো পড়ছে। শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল সেই আলো আঁধারি যেন ময়দানের প্রতীক। সত্যিই আমরা কতটুকু জানি ময়দানের! কেমন যেন ঘোর লেগে গিয়েছিল। ―“কিরে চাপ খেলি নাকি?” দাদার হাতের ছোঁয়ায় সম্বিত ফিরে পেলাম যেন। “আসলে জানিস তো ময়দানের এই ঘাসগুলি যেমন অনেক স্বপ্নকে গড়তে দেখেছে তেমনি বহু মানুষের স্বপ্ন একবারে ভেঙেচুরে খানখান হয়ে যাওয়ার সাক্ষী এরা। ময়দান বড় ভয়ানক জায়গা রে।” সেদিন অনেকক্ষণ ময়দানে ছিলাম। অনেকক্ষণ, অনেকটা পথ হেঁটেছিলাম দু’জনে।
Powered by Froala Editor