৪ মাস ৩ সপ্তাহ ২ দিন

ছায়াছবি-কথা - ১

১৯৮৭ সাল। রোমানিয়ার কোনো এক শহরের কোনও এক মেসে দুই বান্ধবী রুম শেয়ার করে থাকে। অটিলিয়া আর গাবিতা। গাবিতা গর্ভপাত করাতে চায়। সেই কাজে সাহায্য করে অটিলিয়া। তারা যোগাযোগ করে এক মিস্টার বেবের সঙ্গে যিনি গর্ভপাতের কাজটি করে দেবেন, পয়সার বিনিময়ে, গোপনে।

১৯৬৬ সালে কম্যুনিস্ট নেতা (পরে রাষ্ট্রপ্রধানও) নিকোলাই চাইসেস্কুর নেতৃত্বে ৭৭০ নম্বর ফরমান জারি করা হয়। তাঁরা চাইছিলেন দেশের জনসংখ্যা বাড়াতে। এই ফরমান অনুযায়ী গর্ভপাত নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, যদি না - ১। কারুর বয়স ৪৫ বছরের ওপর হয়, ২। চারটি সন্তানের জন্ম দেওয়া হয়ে গিয়ে থাকে, ৩। কোনো চিকিৎসাজনিত জটিলতা থাকে, ৪। ধর্ষণ/‘অজাচার’ হয়ে থাকে। স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞদের দ্বারা মহিলাদের পরীক্ষা করানো হত প্রতিমাসে। গোপন পুলিশবাহিনী এ বিষয়ে কড়া নজর রাখত। জন্মহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অপুষ্ট শিশু আর ‘অনাথ’ শিশুদের সংখ্যাও বেড়েছিল সে সময়ের রোমানিয়ায়, যেহেতু বেশিরভাগ পরিবারেই এত সন্তান পালনের মতো আর্থিক সামর্থ্য ছিল না। বেড়েছিল গর্ভবতী মেয়েদের মৃত্যুহারও।

রোমানিয়ার নব তরঙ্গের অন্যতম প্রধান পরিচালক ক্রিশ্চিয়ান মুঁগ্যু-র তৃতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি ফোর মান্থস থ্রী উইকস টু ডেজ (২০০৭)। প্রায় প্রত্যেকটা দৃশ্যই একটি করে মাত্র শটে নেওয়া, যাতে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটার বাস্তব সময়ের, স্পেসের সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্যভাবে জুড়ে থাকতে পারেন দর্শক। ১ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট দৈর্ঘের এই ছবিতে ক্লোজ শটকে একেবারেই এড়িয়ে যাওয়া হয়। ক্যামেরা সবসময় কিছুটা কাঁপতে থাকে, হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরার নান্দনিকতায়। আক্ষরিক অর্থেই নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া-ছাড়া করতে করতেই দেখতে থাকা ক্যামেরা বরং চলন্ত বাসে স্টেডি থাকে। কিন্তু বিষয়টা এমন নয় যে, যেসব জায়গায় ছবি তোলা হয়েছিল তার সর্বত্রই ট্রাইপড পাতার স্থানের সংকুলান হয়নি। একমাত্র ডিনারের দৃশ্যে সত্যিই হাতে নেওয়া ছাড়া ক্যামেরার উপায় ছিল না। (অনেক চলচ্চিত্র সমালোচক এই ডিনারের দৃশ্যটিকে ‘দ্য লাস্ট সাপার’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন।) এমনকি চরিত্রদেরও ঠিকমতো বসার জায়গা হচ্ছিল না। এমনও হয় যে, যে চরিত্র কথা বলছেন তার হাত নাড়ানো দেখা যাচ্ছে কিন্তু মুখ দেখা যাচ্ছে না। সেখানেও লম্বা একটি সংলাপ নির্ভর দৃশ্য এমনভাবে একটা ছোট্ট জায়গায় একটা শটে চলতেই থাকে যে, অটিলিয়ার মানসিক চাপের/অস্বস্তির শারীরিক প্রতিভাস তৈরি করে শটের ম্যাগনিফিকেশন। এভাবে ক্লস্ট্রোফোবিক ক’রে তোলা মিজ-অঁ-সিনটি তৈরি এই ছবির একইসঙ্গে স্টাইলাইজেশন বা গঠনশৈলী, আবার নয়ও। এক অর্থে এটা একটা ইতিহাস-নির্ভর ছবি। পরিচালক যেহেতু তাঁর বোঝা এক টুকরো ইতিহাসকে ধরে রাখতে চান এই ছবিতে, তাই একটি উচ্চশিক্ষিত, মধ্যবিত্ত পরিবারের অর্থনৈতিক ইতিহাসের প্রতিবিম্বও এই দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে ধরা পড়ে। ধরা পড়ে সময়ের সাংস্কৃতিক নৈতিকতার ইতিহাস।


 

আরও পড়ুন
ত্রুফো-র দুই চরিত্র অভিনয় করেছিল টারান্টিনো-র ছবিতে

এদিক সেদিক থেকে ধারদেনা ক’রে কোনওভাবে হোটেলের ভাড়া, মিস্টার বেবের ফিজ জোগাড় করে দুই বান্ধবী। কিন্তু ঐ সামান্য ফিজ নিয়ে গর্ভপাতের মতো ‘নিষিদ্ধ কাজ’ করা সম্ভব নয়। খানিক আগেই আমরা বেবের বাড়ির অস্বচ্ছলতার কথাও জানতে পেরেছি, দেখতে পেয়েছি রেশন দোকানের সামনে দীর্ঘ লাইন। কিন্তু বহু কষ্টে জোগাড় হয়েছে টাকা। তার খানিক হোটেলের ভাড়া দিতেও বেরিয়ে গেছে। আজও গর্ভপাত না করানো গেলে সমস্যা বাড়তেই থাকবে। তাহলে উপায়? নিরুচ্চারে, ‘পেশাদারি দক্ষতায়’, অবলীলায় দু-দুটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে যায়। কিন্তু স্কোপোফিলিয়ার কোনো অবকাশ থাকে না যেহেতু, ক্যামেরা সেসব দেখেও না। রাষ্ট্রীয় আইনের ন্যায্যতা প্রমাণে এটুকু মূল্য তো দিতেই হতো মেয়ে-নাগরিকদের! ‘নারীবাদে’ মেয়েদের এজেন্সি = চয়েস (পছন্দ) + অধিকার (রাইট)। এই ছবিতে এজেন্সি এবং এজেন্সিহীনতা পাশাপাশি ক্রিয়াশীল থাকে। দু’টো প্রজন্মের নৈতিকতার মধ্যে শুধু নয়, দ্বন্দ্ব লাগে লিঙ্গনির্ধারিত বিচারবোধেও। লরা মালভে কথিত মেল গেজের তত্ত্ব দিয়ে এ ছবিকে পাঠ করা যায়না সম্ভবত। ‘মেয়েলি অন্দর’কে এখানে বেশ সাবলীলতায় ধরা পড়তে দেখি। এখানে ধর্ষক আসে (ভ্রূণ)মুক্তির মসিহা হয়ে। যে মুক্তি দিতে আসে, সেই ধর্ষক। থ্রিলার ছবির একটা জনপ্রিয় কৌশলের মতো ক’রে এখানে দর্শক জানে অটিলিয়া ধর্ষিতা, অথচ তার প্রেমিক জানে না। এই ‘সাসপেন্স’ কোনো চাপা উত্তেজনা তৈরি করে না। অথচ নিজের হৃদকম্পনের শব্দ শোনা যায়। এই ‘জানা’টাই বিব্রত ক’রে রাখে আমাদের, দর্শকদের। অথচ পরিচালক না দেন ধর্ষণ দেখার ‘প্লেজার’, না দেন করুণার কোনো সুযোগ। তিনি আসলে নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের একটা আখ্যান রচনা করছেন যে!

রোমানিয়ার নব তরঙ্গের পরিচালকেরা ছেদ টানতে চান রোমানিয়ার সিনেম্যাটিক অতীতের থেকে। মুঁগ্যু, খুব নিটোল না হলেও, আমাদের একটা গল্প বলেন, বিবৃতির ঢঙে। সেই বলার ধরণকে ঐতিহাসিক বাস্তববাদ বলা যায়। সেই গল্প আমাদের ভাবায়, রাগায়। ফোর মান্থস থ্রী উইকস টু ডেজ মূলত একটা ফাউন্ড স্টোরি। ফলত জানা গল্প নতুন ক’রে আর কতদূর ভাবাতে সক্ষম! হ্যাঁ, চেনা পৃথিবীর সত্য মিথ্যা সবই রুপোলি পর্দায় লার্জার দ্যান লাইফ হিসেবে ধরা দেয় ঠিকই। খানিক উত্তেজিতও করে হয়তো। কিন্তু ছবি দেখার পর মনটা যে বিবমিষায় ভরে ওঠে, তা মুঁগ্যুকে তৈরি করতে হয় সিনেম্যাটিক টেকনিক দিয়েই। ছবির রং দিয়ে। বিবর্ণ শীতল ডিস্যাচুরেটেড পোশাক-দেওয়াল-চারপাশের রং, বিশেষত ছবির শুরুতে ধূসর, বিবর্ণ সবুজ আর নীল রঙের ব্যবহার সে দিকে নিয়ে যায়। তাই ধর্ষকের গাড়ির লাল রং মূর্ত করে তোলে চরিত্রদের অসহায়তাকে।

আরও পড়ুন
বিশ শতকের সবচেয়ে ‘বুদ্ধিমান’ ব্যক্তিত্ব বলা হয়েছিল তাঁকে

 

প্রায় ২৫ সেকেন্ড ধরে আমাদের তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করা হয় রক্তমাখা-ভ্রূণের দিকে। হোটেলের করিডোরে একটা টিউব সারাক্ষণ জ্বলতে-নিভতে থাকে, হৃদস্পন্দনের মতো। মিনিমালিস্ট মিজ-অঁ-সিন, ফাঁকা চারপাশ গিলতে আসে, অসহায় আত্মসমর্পণের দাবি নিয়ে। শেষ দৃশ্যে ব্যাকগ্রাউন্ডে যখন রাত্রিকালীন পার্টির নাচাগানা চলে, তখন মিডগ্রাউন্ড থেকে লেন্সে তাকান অটিলিয়া। আমাদের দিকে তাকান। রুঢ় বাস্তব ফোরগ্রাউন্ডেড হয়ে ওঠে। ইতিহাস বর্তমানের সঙ্গে সংলাপে রত হয়। গর্ভপাত বিরোধি আইন তো ১৯৮৯-এর রোমানিয়ার কম্যুনিস্ট সরকারের পতনের সঙ্গেই চুকেবুকে গেছে। গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত এখন ব্যক্তি-মেয়েই নিতে পারে। তাহলে এই ছবি ২০০৭-এ এসেও তৈরি করতে হচ্ছে কেন! শুধুই ইতিহাস ধরে রাখার জন্য!

আরও পড়ুন
আউশভিৎচ নিয়ে স্পিলবার্গের ছবিকে খারিজ করেছিলেন মাইকেল হানেকে

৪ মাস ৩ সপ্তাহ ২ দিন। ৪ ৩ ২-- যেন একটা কাউন্টডাউন। ক্রমশ শূন্যের দিকে ধাবমান। শুধু জানা নেই, সময়ের সিনেম্যাটিক সঙ্কোচন না সম্প্রসারণ-- কী খেলা চলতে থাকে!

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
বাতাস আমাদের বয়ে নিয়ে যাবে (চতুর্থ পর্ব)