ছায়াছবি-কথা – ২
আগের পর্বে
ফোর মান্থস, থ্রি উইক্স, ২ ডেস। রোমানিয়ার নবতরঙ্গের অন্যতম পরিচালক ক্রিশ্চিয়ান মুঁগ্য-র তৃতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা। ১৯৮৭ সালের প্রেক্ষাপট তৈরি দুই বান্ধবী অটিলিয়া এবং গাবিতার গল্প নিয়ে। রোমানিয়ার কম্যিউনিস্ট শাসক তখন নিষিদ্ধ করেছেন গর্ভপাত। কিন্তু গাবিতা গর্ভপাত করতে চান। আর তাঁকে সাহায্য করেন অটিলিয়া। একটি মাত্র শটে তোলা এই চলচ্চিত্রের প্রাণকেন্দ্র বন্ধুত্ব হলেও, রোমানিয়ার সামাজিক, নৈতিক ইতিহাস, উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা সবটাই ধরে রেখেছেন মুঁগ্য। কিন্তু ১৯৮৯ সালে রোমানিয়ায় এই আইন নিষিদ্ধ হওয়ার পরে ২০০৭ সালে এই সিনেমা তৈরির উদ্দেশ্য কি শুধুই ইতিহাসকে ধরে রাখা? নাকি ৪, ৩, ২ একটি রিভার্স কাউন্টডাউন? রহস্য, বন্ধুত্বের আখ্যানে মোড়া এই সিনেমাকে ফিরে দেখা...
ভাষিক শব্দ নয়। মনুষ্যপ্রজাতি-সৃষ্ট ধ্বনি -- ঈব আল্ল ঊউ।
কয়েক বছর আগে বাস্তবিকই হনুমানে বাঁদরে ভরে গিয়েছিল রাজধানী দিল্লির কিছু আবাসিক অঞ্চল। স্থানীয় প্রশাসন এদের হাত থেকে রক্ষা পেতে কিছু পোষা লেঙুড়ের সাহায্য নিয়েছিল বাঁদর তাড়ানোর জন্য। কিন্তু বন্যপ্রাণী কল্যাণ দপ্তর আপত্তি জানানোয় তারা মহিন্দর নামক একজন মানুষকে এই কাজে লাগায়, যে এই সমস্ত জীবদের ‘ঈব আল্ল ঊউ’ ধ্বনি শুনিয়ে ভয় পাইয়ে তাড়াতে পারে।
নতুন দিল্লির লুট্যিয়েনস অঞ্চলের রাষ্ট্রপতি ভবন, ইন্ডিয়া গেট থেকে শুরু করে নির্মাণ ভবন, উদ্যোগ ভবন, বিজ্ঞান ভবন, বায়ু ভবন ইত্যাদি প্রশাসনিক অফিস পাড়ায় কমবেশি সকাল আটটা নাগাদ প্রথম ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা দেয় তারা। “রাইসিনা হিল এলাকা হনুমানের শাসনেই থাকে। কোর্টও এই কথা বলেছে” কিংবা “কোনও হনুমান যদি কোনও স্থাপত্যের গম্বুজ ভেঙে ফেলে, সরকার পর্যন্ত পড়ে যেতে পারে” -- শোনা যায় এমন কথাও। সিসিটিভি ক্যামেরা, গুরুত্বপূর্ণ ফাইল মায় জাতীয় পতাকা-- কোনোকিছুকেই রেয়াত করে না তারা। হনুমান হিন্দুদের উপাস্য তথা পূজ্য দেবতাদের (অবতারের?) অন্যতম। পুণ্য সঞ্চয়ের আশায় এই জীবেদের নিয়ে ধর্মীয়-উন্মাদনাও তাই যথেষ্ট। অন্যদিকে বন্যপ্রাণী বিষয়ক আইনের আওতাভুক্তও বটে এরা। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সুষ্ঠুভাবে প্রশাসনিক কাজ যাতে চালিয়ে যাওয়া যায়, সেদিকে নজর রাখা তো সরকারেরই দায়িত্ব।
আঞ্জানি (অজ্ঞাতনামা) বিহারের গ্রাম থেকে কাজের খোঁজে দিল্লি আসে। আঞ্জানির (শার্দুল ভরদ্বাজ) পড়াশোনা এগারো ক্লাস পর্যন্ত। সে রান্না করা, গাড়ি চালানো, কম্প্যুটারের কাজ বা ইলেকট্রিক তেমন কোনো কাজই শেখেনি যা দিয়ে সে দিল্লি শহরে একটা কাজ জোটাতে পারে। দিল্লির এক বস্তিতে তার দিদি (নূতন সিনহা) আর জামাইবাবু (শশি ভূষণ) থাকে এক কামড়ার একটা খুপরিতে। ঘরেই ঠোঙা বানানো, প্লাস্টিক প্যাকেট মোড়ার মতো কাজ করে অন্তঃসত্ত্বা দিদি। আর জামাইবাবু করেন সিক্যুইরিটি গার্ডের চাকরি। জামাইবাবুর চেষ্টাতেই বাঁদর তাড়ানোর, দিদির ভাষায় ‘সরকারি কাজ’, জুটে যায় আঞ্জানির। মাসে ছ’হাজার টাকার কন্ট্র্যাক্ট।
আরও পড়ুন
৪ মাস ৩ সপ্তাহ ২ দিন
এর আগে চার বছরের পরিশ্রমে প্রতীক বানিয়েছেন বিশ্বশ্রী ব্যায়ামবীর মনোহর আইচের জীবনীমূলক তথ্যচিত্র-- আ ভেরি ওল্ড ম্যান উইথ এনরমাস উইংস (২০১৭-তেই জাতীয় বিশেষ জুরি পুরষ্কার পেয়েছে)। তারপর প্রতীক বৎসের প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘের হিন্দি চলচ্চিত্র-- ঈব আল্ল ঊউ (২০১৯, ৯৭ মিনিট)। কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সহযোগী পরিচালনা - শুভম। সম্পাদনা - তনুশ্রী দাস। শব্দ - বিজ্ঞ ভূষণ দহাল। সঙ্গীত - আনশুল টাকর। ৫-৬ জনের ছোট্ট দল নিয়ে ছাড়া এ-ছবি তোলার কাজ সম্ভব হত না। রাজধানীর হাই অ্যালার্ট অঞ্চলের রাস্তাঘাটে অদৃশ্য হয়ে কাজ করা ছাড়া উপায় ছিল না। পরিচালকসহ মূল কলাকুশলীদের বেশিরভাগই ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট, পুনের প্রাক্তনী (একই ব্যাচেরও কেউ কেউ)। তাই তো ছবির মুখ্য চরিত্র, শার্দুল, ট্রাইপড কাঁধে দৌড়োন। কিমবা গাড়ি থেকে রাস্তায় নামা মাত্রই ছবির চরিত্র সেজে, অথচ চারপাশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে মিশে যেতে পারেন। ক্যামেরা তাকে কতক্ষণ দেখছে তাও হয়ত সবসময় না জেনেও চরিত্রে স্থিত থাকতে পারেন। এই প্রক্রিয়াটাই এই ছবির শরীরে লেগে থাকে।
দিল্লির রাজপথ কনভয় ফুটপাথ দোকানপাট গলিঘুঁজি মেট্রোরেলের-দৈনন্দিন-ক্লান্ত-কামরা রেললাইন-লাগোয়া-ঘাসজমি দিল্লির রাত ভোর দুপুরের-রোদ উৎসব উদযাপন দেখে ফেলি আমরা, ছবির চরিত্রদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে। তথ্যচিত্রের ঢঙে সিনেম্যাটোগ্রাফার সৌম্যানন্দ সাহির ক্যামেরা নির্দিষ্ট স্পেসে নিঃশব্দে কিছু চরিত্রকে অনুসরণ করে শুধু, অথচ কাহিনিচিত্রের আঙ্গিক থেকে বেরিয়ে যায় না। বিশেষত ক্যামেরা যখন রাস্তায় থাকে তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মনেই হয়না যে ক্যামেরার জন্য কিছু অনুষ্ঠিত (স্টেজড) হচ্ছে। এমনকি বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে সন্তর্পণে (বণ্যপ্রাণ চিত্রগ্রাহকদের ঢঙে?) অপেক্ষা না করলে গাছের ডালে, পাঁচিলে, গার্ডরেলে, ফুটপাথে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে বাঁদরদের লাফঝাঁপ, চোখ পাকানো, পাও খাওয়া, ভ্যাঙচানির বিশেষ সিনেম্যাটিক মুহূর্তগুলো তোলা সম্ভব হত না। এমনভাবে লেন্সও ব্যবহার করতে হয়েছে যাতে আলাদা করে তোলা বাঁদরের শটের সঙ্গে মানানসই হয় মনুষ্য-চরিত্রযুক্ত শটের টাইম-স্পেস অর্থাৎ আলো-ছায়া-টেক্সচার এবং সর্বোপরি আবেগ।
শ্রমের গল্প, ‘পরিযায়ী’ পরিষেবাকর্মীর গল্প, বেকারত্বের অনিশ্চয়তার গল্প বলে ঈব আল্ল ঊউ। হনুমান আর মানুষ, মানুষ আর বাঁদরের মধ্যে দুলতে দুলতে ডারউইন চার পায়ে হাঁটতে থাকেন আখ্যানের ছায়া হয়ে। হনুমানের স্বর, অঙ্গভঙ্গি নকল করতে করতে বিবর্তনবাদের তত্ত্ব মুখ ভ্যাঙচায় প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বাধীন নাগরিকদের দিকে তাকিয়ে। একবিংশ শতক যে অস্তিত্ত্বের জন্য সংগ্রাম-এর এমন অর্থ করবে, কে তা জানত! প্রতীক এবং শুভম শিল্পমজুর কি লুম্পেন প্রলেতারিয়ত কিংবা অন্ধকার-জগৎ নয়, নিম্নবর্গের বেঁচে থাকার আকাক্ষাকে একটা চূড়ান্ত অযৌক্তিকতা (অ্যাবসার্ডিটি) আর অস্তিত্ববাদী জায়গায় নিয়ে যান অত্যন্ত সহজ চালে। হাস্যরসকে বিদায় না দিয়েও, রাজনৈতিক স্যাটায়ার বা শ্লেষাত্মক বচন তো বটেই, কিন্তু যে অযৌক্তিকতা ছবিটার মূল সুরকে বাঁধে, তাকে কি আমরা শহুরে ডিস্টোপিয়া দিয়েও পড়ব না! শহুরে উদ্বর্তনবাদের (আর্বান সার্ভাইভালিজম) ধারণার আরেকটা প্রান্তও কি প্রকট হয়ে ওঠে না বাস্তবতার এই অবাস্তব নির্মাণে! সিক্যুইরিটি গার্ডের বন্দুক এখানে লজ্জার, ভয়ের, বিবমিষার। শিশুদের নাগরদোলা এ ছবিতে ধরা দেয় হিংস্রতার জমি (সাইট অফ ভায়োলেন্স) হিসেবে।
টিকতে হলে, মহিন্দর শেখায় আঞ্জানিকে, “হনুমানদের লিডার হয়ে যা। ওদের মতোই খা, ওদের মতোই ভাব, ওদের মতোই থাক।” নিজের বাস্তব চরিত্রে অভিনয় করেন মহিন্দর, মহিন্দর নাথ। হ্যাঁ, তিনিই সেই মানুষ যাকে বাস্তবে বাঁদর তাড়ানোর কাজে নিয়োগ করা হয়েছিল দিল্লির আবাসিক অঞ্চলে। এখানে এসে ইতালিয় নব্য বাস্তববাদ-এর ছোঁয়া পায় ছবিটা। কিন্তু ফিল্ম স্কুল-প্রশিক্ষিত পেশাদার অভিনেতারা, পরিচালকেরা স্থিত থাকেন অযৌক্তিক বাস্তববাদ (অ্যাবসার্ড রিয়ালিজম)-এর জমিতে। ভুলবশত একটা হনুমানকে মেরে ফেলে মহিন্দর। গণপিটুনিতে মৃত্যু হয় তার, ‘ফলতঃ’। আমাদের ভাষায়-- মব লিঞ্চিং; যার ছোঁয়ায় বহু প্রাণ নিঃশব্দে স’রে যাচ্ছে ভারতভূমি থেকে, রোজ। এই ছবিতেও আমরা ঠিক তেমনই শুকনো তথ্য পাই শুধু মহিন্দারের প্রস্থানের। মহিন্দর শুধু আসে আঞ্জানির অবচেতনে। সেইই তো ছিল এই বিরাট দিল্লি শহরে তার গুরু-বন্ধু-রক্ষাকর্তা। খুন হয়ে যাওয়ার ঠিক আগে মহিন্দার আর আঞ্জানির বন্ধুত্বের দু’টো গোটা দৃশ্য জাস্ট দু’টো লম্বা শটে। এ থেকেই পড়ে নেওয়া যায় এ ছবির আখ্যানের গঠনশৈলীটা।
ছবির সাড়ে পঞ্চান্ন মিনিটের মাথায় স্তোত্রের মতো ঈব-আল্ল-ঊউ উচ্চারণ শুরু হয়ে মিনিট দুয়েকের একটা গানে ডাবস্টেপ, ডিজারিডু, মনুষ্যকন্ঠের গোঙানি আর র্যাপ মিলেমিশে এক জটিল মানসপট নির্মাণ করে। বাঁদর তাড়ানোর পথে তার আর একটা স্বতন্ত্র ইম্প্রোভাইজেশনের অঙ্গ হিসেবে হনুমানের বহুরূপী-সাজে সাজে আঞ্জানি। রাজপথের বিশৃঙ্খল পরিসর রূপান্তরিত হয় একটা পথ-অভিনয়ের (স্ট্রিট পার্ফরমেন্স) মঞ্চে। বহুরূপী-হনুমানের সঙ্গে সেল্ফি তোলে আম-আদমি।
২৬ জানুয়ারির রাষ্ট্রীয় পার্ফরমেন্সের সময়ে ভেসে আসা “জাতীয়তাবাদ দ্বারা আমাদের হৃদয় পূর্ণ থাকা উচিত” জাতীয় ভেসে আসা ভাষণের শব্দের সঙ্গে বাঁদরের শটের ইন্টরকাট অতিরেক মনে হয়। ভারত মাতা আর বজরংবলির ট্যাবলো আসে পরপর। সহকর্মীদের দ্বারা আঞ্জানিকে বাঁদরের খাঁচায় বন্ধের দৃশ্য ছবিটিকে প্রতীকীবাদের খাঁচায় আটকে ফেলতে চায়। এমন মুহূর্তে মনে হয় প্রতীকসর্বস্ব রাজনীতিকে সরাসরি প্রত্যাঘাত করার জন্য উদ্যত হয়ে ওঠে ছবিটা। ঈষৎ সিদ্ধান্তহীনতা হয়ত। এ ছবিতেও ‘প্রেম’ আসে, সারল্যে, জটিলতায়। কিন্তু পরিণতিহীন। ন’ সংখ্যার মোবাইল নম্বর-লেখা কাজ চাওয়ার চিরকুট ছবির সামান্যও ক্ষতিবৃদ্ধি করে না। আর তাই, প্রথম বিশ্বের হ্যালোইন মুখোশ আর তৃতীয় বিশ্বের অনাম্নী বাঁদর অনায়াসে নাচতে থাকে পাশাপাশি, মুখোশের গণতন্ত্রে।
এ-ছবি শুরু হয়েছিল মহিন্দর আঞ্জানীর মতো ভাগ্যাহতদের মুখের ক্লোজ আপ শট দিয়ে। তারা অনুশীলন করছিলেন ঈব আল্ল ঊউ… ঈব আল্ল… ঈব।
Powered by Froala Editor