ভাষা, ভাষান্তর

কথা হচ্ছে ভাষা নিয়ে। ভাষা অর্থে তথাকথিত কোনো পণ্ডিতি বাখানি নয়, বরং এখানে ভাষা এক চলমানই— চলমান— বহতা সংযোগ ধারা। যা দিয়ে যোগাযোগ— আলাপ-পরিচয় করা হতে থাকে, যা শুধুই মানব সমাজের সমস্ত মানুষ কেন, সমস্ত প্রাণীজগৎ, বৃক্ষকূল, নদী, পর্বত, সমুদ্র, প্রস্তরাদি, অরণ্য— সব কিছুরই এক ভরকেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। কালেদিনে তা হয়ে উঠতে থাকে ভাষাভিত্তিক বাঁচার মন্ত্রযান। কথা হচ্ছিল মন্দিরের ভাষা, বেশ্যাবাড়ির ভাষা, জেলখানার ভাষা, মদখানার ভাষা নিয়েও। পাণ্ডা-বুলি— দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাটের পাণ্ডাদের নিয়ে যে পাণ্ডাবুলি কথা লিখে এসেছি। তার মধ্যে তো অনেক অনেক সংযোজন, বিয়োজন, যোগ বিয়োগ হয়েছে। খুব শক্ত, ঘাড় না নোয়ানো তীর্যযাত্রীকে ‘গেঁড়িভাঙা মার্কিন’ বলার রেওয়াজ দেখেছি কালীঘাটের কালী মন্দিরের পালাদার, পালাদারি কেনা লোকজনের মুখে। ‘ছ কে লাস’ শব্দটাও খুবই প্রচলিত ছিল মন্দির-চাতালে। মন্দির-চাতালের ভাষা, কেওড়া-বাগদিদের ভাষা, এইসব কথা প্রচলিত ছিল, যাঁরা তথাকথিত ভদ্রলোক, তাঁদের উচ্চারণে। কালীঘাটের কালী মন্দির লাগোয়া পাথর পট্টি, কেউ কেউ পাথরপটিও বলে থাকে কদাচিৎ, তো সেখানেও এক ধরনের মুখের ভাষা তৈরি হয়েছে কয়েকশো বছরের চলমান মনুষ্য স্রোতের এদিক-ওদিকের কথায়, যাপনে। কালীঘাটে ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিট, মুখার্জি পাড়া লেন, নেপাল ভট্টাচার্য লেন, নকুলেশ্বর ভট্টাচার্য লেন, মহামায়া লেন, বিচিত্র তার জীবন, গঠন, জনবিন্যাস। কালীঘাটের মুখার্জির পাড়া লেনে ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিট থেকে ঢোকার মুখেই ডান হাতে ছিল একটি বস্তি। একেবারে ১৫ বি ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটের মাতৃকাশ্রম-প্রণব সংঘর গা ঘেঁষে সেই বাড়ি। ‘মাতৃকাশ্রম প্রণব সংঘ’ ব্রহ্মতন্ত্র ঘরানার যোগী সাধক বশিষ্ঠানন্দ, বিশুদ্ধানন্দ, সচ্চিদানন্দ পরমহংস, প্রণবানন্দ পিতাজি মহারাজ, সন্ন্যাসী-সাহিত্যিক তারাপ্রণব ব্রহ্মচারী— এই এক বিস্তীর্ণ— বিস্তৃত ধারা। ব্রহ্মতন্ত্র ঘরানা একটি প্রায় অবলুপ্ত তান্ত্রিক আচার কেন্দ্রিক ধারা। এখানে অগ্নিই সব। অগ্নিপ্রজ্জ্বলন আর তাতে যজ্ঞে, হোমে যেমন হয়ে থাকে, তেমনই ঘৃতাহুতি দেওয়া, কর্পূর আহুতি দেওয়া, অমাবস্যা, পূর্ণিমায়, বিশেষ বিশেষ তিথিতে। যেমন কালীপুজো, লক্ষ্মীপুজো, দুর্গাষ্টমী, দুর্গাষ্টমী ও নবমীর সন্ধিলগ্নে— সন্ধিপুজোর সময়। হিন্দু পুরাণ বিশ্বাস, শ্রী শ্রী চণ্ডীর বিবরণ ও বিন্যাস অনুযায়ী এই সময় কালেই— মহাষ্টমী ও মহানবমীর সন্ধিক্ষণে দুর্গা বধ করেন মহিষাসুরকে। ইদানিং বেশ কয়েক বছর হল মহিষাসুর, শুম্ভ-নিশুম্ভ, রক্তবীজ প্রভৃতি অসুরদের বধ করার বিরোধিতা করে ‘তথাকথিত ব্রাহ্মণ্যবাদ’ বিরোধী কিছু আপ্তবাক্য ছাড়া হচ্ছে বাজারে। আমি সেই বিষয়ে আর বিস্তারিতভাবে যেতে চাইছি না। ব্রহ্মতন্ত্র ঘরানা, দেবী মাতাজি-শক্তি মাতাজি, সচ্চিদানন্দ পরমহংস, প্রণবানন্দ পিতাজি মহারাজ (তিনি ভারত সেবাশ্রম সংঘর প্রতিষ্ঠাতা প্রণবানন্দজি নন) বরং একদিক থেকে দেখলে সম্ভবত নিগমানন্দ সরস্বতী— ওঁরা গুরুভাই, আমি কালীঘাটের মাতৃকাশ্রম-প্রণব সংঘর প্রতিষ্ঠাতা প্রণবানন্দ পিতাজি মহারাজের কথা বলছি। এই সবটাই আমার ধারণা। সন্ন্যাসী-সাহিত্যিক তারাপ্রণব ব্রহ্মচারীজি স্পষ্ট করে বলে যাননি একথা। তবে তিনি যা সংকেত দিয়ে গেছেন, বাক্য সংকেত, তা থেকে অনুমান করতে পারি নিগমানন্দ সরস্বতী এবং প্রণবানন্দ পিতাজি মহারাজ একই গুরুর শিষ্য। তিনি হলেন সচ্চিদানন্দ পরমহংসজি। কালীঘাটের ১৫বি ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটের মাতৃকাশ্রম-প্রণব সংঘর প্রতিষ্ঠাতা প্রণবানন্দ পিতাজি মহারাজ ও নিগমানন্দ সরস্বতী, যাঁর সারস্বত মঠ পশ্চিমবাংলার হালিশহর আর আসামের কোকিলামুখী— এই দুই ভাগে এখন বিভক্ত। সারস্বত মঠের এই ভাগাভাগি অবশ্য অনেক অনেক দশকের— অনেক অনেক বছর আগের, আজকের নয়। কালীঘাটের ১৫ বি ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটের একদম ওপরেই রাস্তার ঘা ঘেঁষে তিনতলা বাড়ি। ১৯৪৫-৪৬ সালেই সম্ভবত কন্ট্রাকটারকে দিয়ে তৈরি করানো হয় এই বাড়ি। প্রথমে দোতলাই ছিল। পরে ১৯৭৮-৭৯-৮০ সাল নাগাদ তিনতলা হয়। খুব ধীরে ধীরে। কারণ এই আশ্রমের পেছনে কোনোদিনই খুব বড়ো ফান্ডিং ছিল না, এই তথ্যটুকু আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি। তো সে যাই হোক, কালীঘাটের মাতৃকাশ্রম— প্রণবসংঘর ঠিক পেছনেই বস্তি। টিনের চালওয়ালা নিচু নিচু কাঁচা ধর। দেওয়াল পরে পাকা হল। যতিলাল, মতিলাল আর সতীলাল তিন ভাই, তাদের বোন— দুই বোন, মা-বাবা সবাই এখানেই। যতিলাল ও মতিলাল পাকা মাতাল। প্রায় রোজই দিশি খেয়ে কাওতালি। যতিলাল আবার কালীঘাটের খুচরো মস্তানদের মধ্যে পড়ে। কালীঘাটে তখন টুপি-কাশি জাতীয় কংগ্রেসের বড়ো নেতা। মাথা জোড়া টাক বলে প্রায় সব সময়ই সবুজ রঙের, নয়তো ছাই ছাই রঙের ক্যাপ পরে থাকত টুপি-কাশি। কাপড়ের ক্যাপ দিয়ে টাক আড়াল করার চেষ্টা, যেমন হয়ে থাকে। ক্যাপের ডিজাইন অবশ্য প্রায় নেহরু-ক্যাপ যেমন, তেমনই, একটু ছড়ানো এই যা। তখন জাতীয় কংগ্রেস করা টুপি-কাশি খুবই ঘনিষ্ঠ প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির সঙ্গে। এছাড়াও কালীঘাটের খুচরো মস্তান বা মাস্তানদের মধ্যে নাটাই হালদার, খোকা হালদার, বেশ পরিচিত নাম ছিল। পরে— আশির দশকের গোড়ায় বেঁটের উত্থান হয়। বেঁটেও জাতীয় কংগ্রেস আশ্রিত। জরুরি অবস্থার সময় থেকেই কালীঘাট বিজুদির উত্থান। তিনিও জাতীয় কংগ্রেসেরই। আর অবশ্যই ইন্দিরা কংগ্রেসের। বিজুদি আবার জাতীয় কংগেস— ইন্দিরা কংগ্রেসের শ্রমিক নেতা লক্ষ্মীকান্ত বসুর ঘনিষ্ঠা। আমি অবশ্য এই ঘনিষ্ঠতা রাজনৈতিক অবস্থানের দিক থেকেই বলছি। লক্ষ্মী বোস, লক্ষ্মী বসু, লক্ষ্মীকান্ত বসু ইন্দিরা কংগ্রেসের আইএনটিইউসি-র অসম্ভব বিরোধী ছিলেন। জাতীয় কংগ্রেস— ইন্দিরা কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন ছাত্র পরিষদ— সিপির পাল্টা সংগঠন শিক্ষা বাঁচাও কমিটির একেবারে শীর্ষ নেতৃত্বে। স্বাধীন ভট্টাচার্য আর তাঁর কোনো কোনো সঙ্গী মিলে রচনাবলি বার করার কাজে এগিয়েছিলেন। কুপন কেটে পাঁচ টাকা, দশ টাকার গ্রাহকও করা হয়েছিল, কলেজ স্ট্রিট পাড়ার কোনো এক বড়ো প্রকাশককে কেন্দ্রে রেখে। স্বাধীন ভট্টাচার্য ধুতি, বাংলা ফুল প্যান্ট। সেই শার্টের হাতা গোটানো সব সময়। পায়ে স্যানডেল। মাথাভর্তি কাঁচা-পাকা চুল, একেবারে গাজানো চুল— মাথাভর্তি কেশ যাকে বলে। গালভর্তি সাজানো দাড়ি। তেমন লম্বা নন একেবারেই। বরং স্বাধীন ভট্টাচার্যকে খর্বকায়ই তো বলা বিধেয়। কেমন যেন সবাইকেই সন্দেহ করছেনও অথবা দুনিয়াজোড়া— দুনিয়া জুড়ে যত মানুষজন, সবার ওপরেই তো তিনি বিরক্ত। যথেষ্টই বিরক্ত। এটা স্বাধীন ভট্টাচার্যর দিকে যখন তখন তাকালেই বোজা যেত। বিজুদি লক্ষ্মীকান্ত বসু বা লক্ষ্মী বোসের অনুগামী। আর কালীঘাটের মন্দির থেকে একটু দূরে মন্দিরের আশেপাশে, যে যে হকাররা বসেন, তাঁরা বিজুদিকে অসম্ভব চমকায়। বিজুদি কৃষ্ণবর্ণা। গলার স্বর অতি জোরালো আর খ্যারখ্যারে। সেই অতি কর্কষ, তীক্ষ্ণ কণ্ঠেই তিনি আদেশ করেন। তাঁর নিজস্ব বাহিনী আছে, তারা বেশ ঠ্যাঙাড়ে টাইপ আর মারমুখো। এদের মধ্যে অন্যতম হল বেঁটে। বেঁটে সত্যি সত্যিই বেঁটে। গায়ে মেদ একেবারেই নেই। পাকানো, পেশিবহুল চেহারা। খাপটা, হনু বার করা গাল। লোকাল ডায়লেক্টেই তা ‘চোবড়া গাল’। মুখকে ‘খোমা’, ‘থোবড়’, ‘থোবড়া’ বলার রেওয়াজ— চল বহুদিনের। খুব খারাপ দেখতে মুখকে ‘বিষ খোমা’-ও বলা হয়ে থাকে, নয়তো শুধুই ‘বিষ’। বিষকে আবার ‘বিশ’, ‘একুশ’, ‘চারশো, ‘পাঁচশো’, ‘সাতশো’, ‘আটশো’— এইসব নম্বর দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। বিজুদি বেশ অ্যাকশন টাইপ। নিজে বোমা ছুঁড়তে পারতেন। ১৯৮০-১৯৮১-১৯৮২-১৯৮৩, এই সময়টায় তাঁরা ডাঃ হৈমি বসুরও কিছু কিছু আনুকূল্য পেতেন গোপনে। ডাঃ হৈমি বসু ছিলেন প্রথম বামফ্রন্ট সমর্থিত নির্দল কাউন্সিলার। কলকাতা কর্পোরেশন-এর কাউন্সিলার তিনি। এরপর তিনি ইন্দিরা কংগ্রেসের প্রার্থী হিসাবে বিধানসভায় নির্বাচিত হন বিধায়ক হিসাবে। ডাঃ হৈমি বসু ছিলেন অসম্ভব পরোপকারী জন। কার রেশন কার্ড হচ্ছে না, কার বাড়ি থেকে প্রায় জবরদখল করে রাখা ভাড়াটিয়া উঠছে না, আবার কোন বাড়িওয়ালা জোর করে উৎখাত করতে চাইছে ভাড়াটেকে, কোন দুঃস্থজনকে সরকারি হাসপাতালে বেডঃ পাওয়াতে হবে— সব ব্যাপারেই ডাঃ হৈমি বসু ত্রাতার ভূমিকায়। তিনি তিন দিনে আমার রেশন কার্ড করানোর ব্যবস্থা করেছিলেন দৈনিক বসুমতী সম্পাদক প্রশান্ত সরকারের অনুরোধে। প্রশান্তদা কেবল একটা চিঠি লিখে দিয়েছিলেন, তাঁর দৈনিক বসুমতীর প্যাডে। তাতেই কাজ হয়ে গেল। আসলে পাসপোর্ট— ইন্টারন্যাশনাল পাসপোর্ট তৈরি করানোর জন্য আইডেন্টিটি প্রুফ করার সামগ্রী বলতে সাধারণভাবে রেশন কার্ডই। তখনও ভোটার কার্ড— ভোটার আইডেন্টিটি কার্ড— এপিক কার্ড যাই বলি না কেন, তাকে যে নামেই ডাকি না কেন, তা আসেনি। টিএন শেষন বিষয়টি নিয়ে বাজার গরম করা শুরু করেননি তখনও। কিন্তু স্বরাজ পল বা স্বরাজ পাল নামে একজন লন্ডন কেন্দ্রিক ভারতীয় শিল্পপতির নাম খুব বেশি বেশি করে শোনা যাচ্ছে তখন। আমি ১৯৮১-৮২-৮৩ সালের কথা বলছি। সিপিআই (এম)-এর লোক। ঈষৎ ট্যারা। তিনি আমার ‘দৈনিক বসুমতী’-তে চাকরি হওয়ার ব্যাপারে ঘোর বিরোধী ছিলেন। ঈষৎ ট্যারা— সামান্য ট্যারা বা ‘লক্ষ্মী ট্যারা’ ছিলেন প্রশান্ত সরকারও। তিনি বলতেন, আমি তো একটু ট্যারা আছি। ফলে কোনদিকে তাকিয়ে কখন কাকে কী বলছি, তা বোঝা মুশকিল। এইরকমই ‘লক্ষ্মী ট্যারা’ ছিলেন ত্রিপুরার কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক নৃপেন চক্রবর্তী। নৃপেন চক্রবর্তী ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন। যথেষ্ট নামী সাংবাদিক। সোমনাথ লাহিড়ী, করি গোলাম কুদ্দুস, সরোজ মুখার্জি, সরোজ দত্ত— এঁরা সবাই ‘স্বাধীনতা’-র সাংবাদিক। ‘স্বাধীনতা’ ছিল না ভাঙা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি— সিপিআই-এর দৈনিক মুখপত্র। পরে ‘স্বাধীনতা’ নিষিদ্ধ হয়, সরকারি আইনে। যেমন নিষিদ্ধ হয়েছিল না টুকরো হওয়া ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি— সিপিআই-এর মুখপত্র ‘জনযুদ্ধ’ এবং ‘পিপলস ওয়ার’। থাক সেসব প্রসঙ্গ। খালি চল্লিশ দশকে, পঞ্চাশ দশকেও ‘জনযুদ্ধ’ আর ‘পিপলস ওয়ার’-এর ছবি, লেখা ইত্যাদি দেখে মনে হতে পারে এই পার্টি অরগ্যান— পার্টি মুখপত্র আসলে সিপিআই (মাওবাদী)-র অথবা আরও পুরনো মার্জ হওয়া— একীভূত হয়ে এক পার্টি— একটিই কমিউনিস্ট পার্টি— সিপিআই (মাওবাদী)-র ভেতর মিশে যাওয়া— ডুবে ডুবে এক হয়ে যাওয়া মাওবাদী কমিউনিস্ট কেন্দ্র— এমসিসি অথবা পিডব্লুজি— পিপলস ওয়ার গ্রুপের কোনো ইউজি— আন্ডারগ্রাউন্ড মুখপত্রের পাতা ওল্টাচ্ছি। ভেতের লেখা, পয়লা পাতার হেডিং ইত্যাদি সব মিলিয়ে যেন পিপলস মার্চ-এর রণধ্বনি। ‘পিপলস মার্চ’ পিডব্লুজির মুখপত্র ছিল। সিপিআই (এম-এল) পিইউ— পার্টি ইউনিটির মুখপত্রের কথাও মনে আসতে পার তখনকার ‘জনযুদ্ধ’ বা ‘পিপলস ওয়ার’ পড়তে পড়তে। বসুমতী কর্পোরেশন-এর বোর্ড অফ ডিরেকটরস-এ ছিলেন সিপিআই (এম)-এর সলিল গাঙ্গুলি, ফরোয়ার্ড ব্লকের দেবব্রত বিশ্বাস, ছিলেন আরএসপি-র একজন। সলিল গাঙ্গুলি টেরিকটের ফুলপ্যান্ট, কলার-অলা টিশার্ট। দেবব্রত বিশ্বাস ধুতি টেনে পরা, তার ওপর ছিটের সাদা ফুল শার্ট। কাঁধে ঝোলা। এই কাঁধঝোলাকে ওড়িশার পিপলিতে— যেখানে অসামান্য কাজ হয় অ্যাপ্লিকের— কাটা কাপড়ের টুকরো দিয়ে, সেখানে এই ধরনের সাইড ব্যাগকে বলা হয়, ‘গান্ধী ঝোলা’। এই ‘গান্ধী ঝোলা’ নয়ের দশক থেকেই নিরুদ্দেশ প্রায়। আমি অ্যাপ্লিকের কাজ করা সাইড ব্যাগ— কাঁধঝোলা বহু চেষ্টা করেও কিনতে পারিনি। আরএসপি— বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দলের যে প্রতিনিধি বসুমতী কর্পোরেশন-এর বোর্ড অফ ডিরেকটরস-এ ছিলেন সম্ভবত তাঁর নাম অমরেন্দ্র কিছু। পদবি এখনই মনে পড়ছে না। ফরোয়ার্ড ব্লকের চরম রমরমানির দিনে, আততায়ীর হাতে খুন হয়ে যাওয়া জননেতা হেমন্ত বসুর ঠিক পরের প্রজন্ম— অশোক ঘোষ, কমল গুহ, চিত্ত বসু, অমর রায় প্রধান, নির্মল বসু, এঁরাই তো দলের নেতৃত্বে। আরএসপি-র ত্রিদিব চৌধুরী— ঢাকুবাবু, মাখন পাল, নিখিল পাল, ননী ভট্টাচার্য— এঁরা ছিলেন আরএসপি-র বড়ো বড়ো নেতা। তাত্ত্বিক দিকে অরবিন্দ পোদ্দার, অধ্যাপক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন এই দলে। আবারও কালীঘাটের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ফিরি। অমিয় হালদারের কথা তো লিখেছি আগেই। অমিয় হালদার জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে কলকাতা পুরসভার নির্বাচনে জিতে পুরপ্রতিনিধি— কাউন্সিলার হয়েছেন একাধিকবার। এছাড়া ছিলেন কানাই হালদার। তিনিও নির্বাচনে sজিতেছেন জাতীয় কংগ্রেসের হয়ে। তখন বিরোধী প্রার্থী হিসাবে পুরনির্বাচনে কালীঘাট অঞ্চল থেকেই দাঁড়াতেন থাকোলাল গাঙ্গুলি। তখন মিছিলে ভোট ফর, ভোট ফর, ভোট ফর শব্দটা খুব প্রচলিত ছিল। ‘ভোট ফর কংগ্রেস’, ‘ভোট ফর কংগ্রেস’— এই নির্বাচনী মিছিলধ্বনি আমরা শুনেছি অনেকেই আমাদের বাল্য অথবা কৈশোরে। অমর রায় প্রধান বহুবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি সম্ভবত ছ-বার বা সাতবারের সাংসদ। পরে ফরোয়ার্ড ব্লক থেকে বেরিয়ে এসে তিনি নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি করেন। কিন্তু সেই দল কোনোভাবেই বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি জনমানসে। ফলে দিনহাটা, মেখলিগঞ্জ, হলদিবাড়ি— এইসব নাম আমাদের সামনে বারবারই আসতে থাকে ঘুরেফিরে। একবার নয়, একাধিক বার। দা-কাটা তামাক, মোতিহারি তামাক, পাটের দর— সব মিলিয়ে রেডিও ঘোষণায় এইসব অঞ্চলেরা ঘুরে ফিরে আসতে থাকে আমাদের জীবনে।

Powered by Froala Editor