নেতাজির সঙ্গে সঙ্গে

বাগবাজার মানেই বোস পাড়া, দর্জিপাড়া, লক্ষ্মী দত্ত লেন, বাগবাজার ব্যায়াম সমিতি। নাহ, এটাই তো সব নয়, এর বাইরেও আছে অনেক কিছু। বহু স্বর। আসলে আইএনএ আজাদ হিন্দ ফৌজ— ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি— সব মিলিয়ে বাঙালি, বাঙালি জাতিসত্তা, তার রণনির্ঘোষ, —চলো দিল্লি, দিল্লি চলো— নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। বরাহনগর— বরানগরের বোড়াল পাড়া অথবা বড়াল পাড়ার আনন্দগোপাল ভট্টাচার্য ও তাঁর তিনজন ফৌজি বাঙালি বন্ধু চেষ্টা করেছিলেন, অনেক অনেক চেষ্টা করেছিলেন, আইএনএ-র সঙ্গে মিট করতে। তাঁদের স্বপ্ন তাঁরা যুদ্ধ করবেন আইএনএ-র হয়ে, ভারতের স্বাধীনতার জন্য, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তার সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে। বাগবাজারের ভাড়া বাসায় অনেক অনেক বড়ো পরিবার, স্ত্রী-সন্তানাদি নিয়ে কোনোরকমে যাপনে থাকা দুর্লভ বা দুল্লভি ভট্টাচার্য। কিন্তু আপন রইসিতে স্থিতধী, অটুট, অনড়। রাস্তার কলে খুব মোটা করে জল পড়ে। সেখানে গামছে পরা দুর্লভ ভট্টাচার্য। বড়ো একখানা গামছার দাম তখন তিন আনা মানে পরবর্তী সময়ের উনিশ নয়া পয়সা। সসেই গামছা বাঁদি পোঁতার কিনা জানা নেই। তাঁতে তৈরি গামছা নাকি মিলের? তাও তো জানা নেই। তবু দেখতে পাই ১৯৪২-৪৩-৪৪-এর কলকাতা, উত্তর কলকাতার বাগবাজার। সেখানে ভাড়া বাসা, ইলেকট্রিক আলো, কল-পায়খানা, এজমালি বড়োসড় সিমেন্ট বাঁধানো চৌবাচ্চা সমেত বাড়িতে দুর্লভের সংসার। কল-পায়খানা— সব কমন। বড়ো চৌব্বাচায় জল জমে। আবার জমা জল ফুরিয়েও যায় অতি দ্রুত। কারণ এবাড়িতে ভাড়াটে অনেক বেশি। লোকজন গিসগিস। দুর্লভ হলেন স্বাধীনতার আগে থেকেই অতি নেতাজি পন্থী। তিনি যে বাড়িতে ভাড়া থাকেন, সে বাড়ির বাড়িওয়ালা বা সেই বাড়ির বাড়িওয়ালাদের মতো অন্য বাড়িওয়ালারাও ভাড়াটেদের ব্যাপারে, ভাড়াটেদের দিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে আঙুল তুলে অথবা না তুলে বলে ওঠেন, ভাড়াটে না অ্যাড়াটে। বেয়াল্লিশের মহাঝড়, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি হজম করে বেঁচে থাকা বাঙালি জাতি সত্তার জনেরা দেখতে পেলেন, কলকাতায় জাপানি বোমা পড়ার পর পর বা একটু আগে থেকেই মানুষ— সাধারণ জনেরা শহর ছাড়ছেন দলে দলে। তখন উত্তর কলকাতা, দক্ষিণ কলকাতার বড়ো বড়ো বাড়িতে ঝোলানো— সাদার ওপর লালে ইংরাজিতে লেখা চৌকো অথবা আয়তকার টু লেট। ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা হরফে লেখা— ভাড়াটে চাই। দলে দলে মানুষ কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন দূর মফঃস্বলে। সে যেন কোনো এক বড়োসড় গৃহত্যাগের দৃশ্য। যেমন কোনো কোনো গ্রুপ থিয়েটারের গৃহত্যাগ দৃশ্য হয়। কলকাতা ছেড়ে জাপানি বোমার ভয়ে ঘর ছাড়ছেন মানুষ। দল দল মানুষ। কলকাতা— মূল কলকাতা— প্রপার ক্যালকাটা ছেড়ে বর্ধমান, মেদিনীপুর। তখন মেদিনীপুর, বর্ধমান— সবই অখণ্ড আর বড়ো জেলা। বর্ধমানের কালনা-কাটোয়াতে বহু মানুষ। ব্রিটিশ রাজশক্তি নিয়ম করে ছাত্র-ছাত্রীদের অনায়াসে ভর্তি হয়ে যেতে পারবেন, গ্রামের স্কুলে, মফঃস্বলী বিদ্যালয়ে। আমার বাবা অমরনাথ রায়, তাঁর জ্যাঠামশাই ভারত বিখ্যাত নব্য ন্যায়ের পণ্ডিত, দর্শন চতুঃষ্পাঠীর পণ্ডিত মশাই, সংস্কৃত কলেজের পণ্ডিত তারানাথ ন্যায় তর্কতীর্থ ও তাঁর স্ত্রী সরযূদেবীর আশ্রয়ে থাকেন মা— বিধবা মা শিবানী রায়কে নিয়ে। পিতা— অমরনাথের পিতা অম্বিকানাথ প্রয়াত হয়েছেন অমরনাথ— ডাকনামের খোকা যখন আট মাস গর্ভবাসে, ভ্রূণ হয়ে ভেসে আছেন গর্ভজলে, তখন। অমরনাথের থেকে মাত্র আড়াই বছরের বড়ো কিরণপ্রভা— ডাকনামে কিন্নি, তিনিও তো চললেন কালনায়, তাদের আপন বড়ো পিসিমার বড়ো ছেলে ভবতোষ চক্রবর্তী, তিনি তখন সাব ডেপুটি। সাব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ভবতোষ চক্রবর্তীর আর এক ভাই শিশু— শিশু চক্রবর্তী। তিনিও বড়ো চাকরি করেন ইংরেজ সরকারের। ব্রিটিশ গভমেন্ট তখন সরকার বাহাদুর। এই ‘সরকার বাহাদুরই’ আবার তখন তার অতি বিশ্বস্ত— পা-চাটাদের জন্য ‘রায় সাহেব’, ‘রায় বাহাদুর’, ‘খানবাহাদুর’ ইত্যাদি খেতাব চালু করেছে। মূলত ব্রিটিশের চরম দালালদের দেওয়া হত এই সব খেতাব। বিশেষ করে যারা ধরিয়ে দিত বা ধরত স্বদেশি— স্বাধীনতা যোদ্ধাদের। তো সে যাই হোক, কালনায় ভবতোষ চক্রবর্তীর বি-ই-শা-ল বাংলো। সেখানে সশস্ত্র পাহারাদার, পাহারা, দারোয়ান, খানসামা, ভৃত্য, দাসী। চারক-ঝি একাধিক। ভবতোষ চক্রবর্তীর এক বোন ছিলেন— দিদি, তাঁর নাম মানা। এঁদের সকলেই চোখ বেশ বড়ো, বাহারি। ভবতোষ চক্রবর্তী এবং তাঁর অগ্রজা মানার তো বটেই। ভবতোষ বাবুকে— বাবার ভবাদাকে আমি দেখি সত্তর দশকে তারানাথ ন্যায় তর্কতীর্থ প্রয়াত হওয়ার পর। ভবতোষ চক্রবর্তী— অমরনাথ রায়ের ভবাদার মাথা জোড়া টাক, তখন। রং উজ্জ্বল শ্যামলা। ত্রিসন্ধ্যা গায়ত্রী করেন তিনি। পরনে মিলের ধুতি আর পুরো হাতা শার্ট, সেই শার্ট সাদা রঙের। সামান্য ঝুঁকে গেছেন তিনি, সামনে, খুব দীর্ঘকায় ছিলেন না। তবে মুখের মধ্যে একটি ব্যক্তিত্বের মোড়ক। ভবা জ্যেঠু, শিশু জ্যেঠুদের সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা তাঁদের গর্ভধারিনী, অমরনাথের আপন বড়ো পিসিমা গলায় গুমোর এনে খুব জাঁক করে বলতেন, আমি সাব ডেপুটির মা— না? তাঁর এই উচ্চারণ ফুটে থাকত গর্ব। প্রচ্ছন্ন গর্ব নয়, প্রকাশ্যে গরব-গরম। অমরনাথ কিরণপ্রভাদের দুই পিসিমা— বড়ো আর ছোটো। সেই যে কথায় আছে না, ছিকুলি উচ্চারণে— ‘বাবার বোন পিসি/ ভাতকাপড় দিয়ে পুষি’, ‘মায়ের বোন মাসি/ কাদার তলায় ঠাসি’। এই দুইটি টুকরো ছিকুলি উচ্চারণের ভেতরেই বাবার বোন ও মায়ের বোনের সামাজিক অবস্থান কীরকম ছিল, তা তো স্পষ্ট বোঝা যায়। খড়দার রহড়া মধ্যপাড়ায়, তারানাথ ন্যায় তর্কতীর্থ নির্মিত দুর্গাভবন-এর উঠোনে তারানাথ ন্যায় তর্কতীর্থর শ্রদ্ধানুষ্ঠান— মুখে মুখে প্রচলিত যা শ্রাদ্ধ বলে, সেই শোক সমাবেশে একদা সাব ডেপুটি ভবতোষ চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার শেষ দেখা। অমরনাথ কিরণপ্রভাদের ছোটো পিসিমা ছিলেন মাটির মানুষ—বাবার কাছেই শুনেছি। অমরনাথের ছোটো পিসিমার এক ছেলে অমূল্য। তিনি এক সময় প্রাণের বন্ধু ছিলেন অমরনাথের। মধ্যম আকার, গৌরবর্ণ। মাথায় পাতলা হতে চাওয়া কৃষ্ণবর্ণ কুচিত কেশ। ধুতি, ফুলশার্ট। কেমব্রিকের সাদা ফুলশার্ট, তার সঙ্গে সেনগুপ্তর ধবধবে ‘কাচি’ ধুতি। কাচা নয় কাচি ধুতি। অমূল্যর— অমূল্যকাকার মাতৃদেবী ছিলেন নিরহঙ্কার। একেবারে বিপরীত তাঁর বড়ো বোন— দিদি। অমরনাথ কালনার বিদ্যালয়ে গিয়ে ভর্তি হলেন স্কুলে। আগেই বলেছি, তখন তো সিস্টেমই এমন। যখন তখন, যেখানে সেখানে— আপতকালীন ভিত্তিতে ভর্তি হওয়া যায়, কোনোরকম শিক্ষা বর্ষের তোয়াক্কা না করেই। তখন তো পাঠ্যসূচিতে ব্রিটিশ রাজ পরিবারের কাহিনি। তা পাঠ করা বাধ্যতামূলক। চতুর্দিকে ‘গড সেভ দ্য কিং…’, ‘গড সেভ দ্য কুইন’। সেই সঙ্গে সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী ইউনিয়ন জ্যাকের অতি আস্ফালন। আমাদের স্বপ্নের তিরঙ্গা— ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা। পঞ্চম জর্জ, নয়তো ষষ্ঠ জর্জ— কারও একটা সিংহাসন আরোহণ অথবা অন্য কোনো উৎসব উপলক্ষে ঘরে ঘর বাতি জ্বালানোর উদ্দেশ্যে প্রত্যেক পরিবারের জন্য টাকা— নগদ পয়সার ব্যবস্থা করেছিল তখনকার ইংরেজ প্রশাসন। আলো জ্বালার জন্য মাটির প্রতীপ আর সর্ষের তেলের খরচ চার আনা, ছ’আনায় সেই ‘প্রজা’ নুরঞ্জন— ‘সম্রাট’-এর সিংহাসন আরোহণ উপলক্ষে মুঘল সম্রাটদের ‘দিল্লিশ্বরো জগদীশ্বরোবা’ বলা হত। আর ব্রিটেন— গ্রেট ব্রিটেনের ‘সম্রাট’ অথবা মহারানির রাজত্বে সূর্য আস্তমিত হয় না। ইংরেজের সাম্রাজ্য এতটাই বিস্তৃত— বি-ই-শা-ল। যাক সেই সব কথা। অমরনাথ রায় বাগবাজার কাশিমবাজার হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন। পরে কাশিমবাজারের মহারাজা— মহারাজা মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দীর নামাঙ্কিত কলেজ। অমরনাথ অনায়াসে গিয়ে ভর্তি হলেন কালনার স্কুলে। ভবতোষ চক্রবর্তী— সাব ডেপুটি ভবতোষ চক্রবর্তীর আলিশান বাংলোয় জায়গা হল তাঁদের। তারপর কয়েক মাস। তখন যুদ্ধ মানেই বেশ কিছু নতুন শব্দ উঠে এল বাঙালি জীবনে। ব্ল্যাকমার্কেট— কালোবাজার, কনট্রোন— রেশন ইত্যাদি, তার সঙ্গে সঙ্গে ফিফথ কলাম— পঞ্চম বাহিনী। ওয়াকাই, প্যারাসুট, প্যারাট্রুপার, কার্পেট বম্বিং শার্ট, এইসব কথা ঢুকে পড়ল পৃথিবীর ইতিহাসের পাতায় পাতায়, সেই সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি জীবনেও। হোর্ডিং— মজুতদারি এই শব্দটির সঙ্গে সঙ্গে আমরা পেলাম কুইসলিং, স্পাই— ইত্যাদি শব্দমালাও। শিয়ালকাঁটা মেশানো সর্ষের তেল— বাঙালি শিখল নতুন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তছনছ করে দিল বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবন। যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ একেবারেই করতে পারেনি। বাগবাজারের দুর্লভ বা দুল্লভি রাস্তায়— রাস্তার কলে মলয়চন্দন সাবান ঘষে স্নান করতে করতে সময় পার করে ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন ‘নেতাজি দাদু’। তাঁর জীবনে সাইরেন, অলক্লিয়ার, সৈন্যবাহিনীর র্যাঙ্কের হিসেব, ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে হঠাৎ হঠাৎ লালবাতি জ্বালানো— সব উঠে এল একটু একটু করে। উঠে এল রেসের মাঠ, শনিবার শনিবার ঘোড়দৌড়, বাঙ্গালোর, কলকাতা, বম্বের ডার্বি— ঘোড়দৌড়। তার সঙ্গে অবশ্য কোনো সম্পর্ক নেই যুদ্ধের— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। সম্ভবত কলকাতা ময়দানের রেস তখন বন্ধ— টাকা বেলানো, টাকা কেড়ে নেওয়া ঘোড়ারা আর দৌড়ল না কিছুকাল। জকিরা বেকার হলেন। ‘টোটে’, ‘উইনে’— এইসব শব্দাবলি লুকনো রইল কলকাতার বাতাসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নব নব শব্দাবলির কথা লিখেছি আগেও। আবার উঠে এল সেইসব শব্দ মঞ্জির। বরাহনগর বা বরানগরের আনন্দগোপাল ভট্টাচার্য তাঁদের বড়ালপাড়া, জনমুখে কখনও কখনও বোড়াল পাড়া হয়ে ওঠা বাড়ি থেকে গোপনে বেরিয়ে এসে যেভাবে ব্রিটিশ আর্মিতে ঢুকে পড়লেন— ভর্তি হয়ে গেলেন, তা তো আগেই বলেছি অনেকবার। তিনি এবং তাঁর তিনজন বাঙালি বন্ধু— সহযোদ্ধা ব্রিটিশ রাজের সৈন্যবাহিনী থেকে আজাদি সৈনিকদের সঙ্গে মিলতে চাইছেন, যুদ্ধ করতে চাইছেন দেশের হয়ে, সে তো ইতিহাসের এক ছেঁড়া পাতা। সেই ছিন্নপত্রকেই যত্ন করে কুড়িয়ে নিয়ে আমাদের যাত্রা, ইতিহাসের দুর্গম পথ ধরে ধরে, নিজস্ব আনন্দরেখায়। অমরনাথ রায় বাগবাজারের কাশিমবাজার হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন ১৯৩২ সালে, ক্লাস টুতে। তখন তিনি আট। যুদ্ধের সময় ব্লাক মার্কেটের পাশাপাশি ব্ল্যাক মার্কেটিয়ার— কালোবাজারি— এই শব্দটাও ঢুকে যেতে দেখলেন অমরনাথ তাঁর জীবন অভ্যাসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ধুতি, শাড়ি, কয়লা, চাল— সবই কনট্রোলে— লাইন দিয়ে। দীর্ঘ সেই লাইন। হঠাৎই খবর ভেসে এল বায়াসে অমুক দোকানে, তমুক জিনিস দিচ্ছে— ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে অতি লম্বা লাইন। সোজা, আবার কখনও কখনও আঁকাবাঁকা, সর্পিল। সর্প গতি হেন সেই লাইনে অমরনাথ। সপ্তাহের প্রতিদিনই এমন ছবি প্রায়— সারা সপ্তাহ— গোটা সপ্তাহজুড়েই। ‘করোনেশন’, থ্রোন, ক্রাউন, ক্রাউন প্রিন্স— সেইসব শব্দও উঠে আসে, এমন পরম্পরার মধ্যে। ষষ্ঠ এডোয়ার্ড, সপ্তম এডোয়ার্ড, ডিউক অফ এডিনবরা, রানির স্বামী— হাজব্যান্ড মানেই ‘রাজা’ নয়। এলিজাবেথ, ভিক্টোরিয়ার ‘স্বামীরা’ রানির স্বামী, ব্যস। ১৯৬০-৬১ সালে ভারতসফরে এলিজাবেথ এলে তাঁর সঙ্গে রানির ‘স্বামী’। রাজা নয়। ১৯৬০-এই সম্ভবত বড়ো করে রেল স্ট্রাইক হয়। তারপর আবার ১৯৭৪ সালে, ঐতিহাসিক রেল ধর্মঘট। বরাহনগরের বড়াল পাড়ার আনন্দগোপাল ভট্টাচার্য আর তাঁর থ্রি কমরেডস তিনজন সহযোদ্ধা বাঙালি সৈনিক জুম্মা খাঁ, বাচ্চি খাঁদের কড়া নজর ও পাহারাদারি এড়িয়ে, ব্রিটিশ খুফিয়া বাহিনী— ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের চোখ এড়িয়ে পৌঁছে গেলেন হাসপাতালের বাইরে। তাঁদের সঙ্গে ‘শাট’ বা যোগসাজস ছিল হাসপাতাল কর্মীদের। যেমন কিনা অনেক অনেক বছর পর হাসপাতাল, জেল-হাসপাতাল থেকে পালিয়েছেন অনেকে। তাঁদের মধ্যে নকশালবাড়ির রাজনীতিতে বিশ্বাসী কোণ্ডাপল্লী সীতারামাইয়ার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে এখনই। মূলত অন্ধ্রপ্রদেশ ভিত্তিক নকশালবাড়ির ধারার রাজনীতি— সশস্ত্র সংগ্রাম ও কৃষিবিপ্লবের ধারায় বিশ্বাসী কোণ্ডাপল্লি সীতারামাইয়া সি পি আই (এম-এল)— পিপলস ওয়ার গ্রুপ— পিডব্লুজি-র নেতৃত্বে ছিলেন। সর্বোচ্চ নেতৃত্বে। পরে তাঁকে সরিয়ে দিয়ে— বহিষ্কার করে গণপতি উঠে আসেন পিডব্লুজি— পিপলস ওয়ার গ্রুপের সর্বোচ্চ নেতৃত্বে। পরে পিডব্লুজি-র মাওবাদী কমিউনিস্ট কেন্দ্র— এমসিসি, আর সিপিআই (এম-এল) পার্টি ইউনিটও একসঙ্গে মিশে গিয়ে সিপিআই (মাওবাদী) তৈরি হয়। গণপতি আর তাঁর অনুগামীরা কোণ্ডাপল্লি সীটারামাইয়া আর্থিক ব্যাপারে অস্বচ্ছ— এই দাবি করে। অভিযোগপত্রে বলা হয় কেপিসি— কোন্ডাপল্লি সীতারামাইয়া অনেক দামি দামি গেঞ্জি পরেন, যা নাকি মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ, মাওবাদী তত্ত্ব ও প্রয়োগের ব্যাপারে ভীষণ অপরাধ ও অন্যায়। ফলে গণপতিরা বহিষ্কার করে কোন্ডাপল্লি সীতারামাইয়াকে, এই যুক্তিতে যে কেপিসি-এর আচার-আচরণ, জীবন যাপনে গিসগিস করছে ‘বুর্জোয়া ভাইরাস’, কোথায় ‘বুর্জোয়া’, কোথায় ‘ভাইরাস’, হায় তথাকথিত মার্ক্সবাদী, লেনিনবাদী-মাওবাদী অন্ধতা। পিডব্লুজি, এমসিসি, পিইউ যুক্তভাবে যে সিপিআই (মাওবাদী)— ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী) গড়ে তুলল তার মুখপত্র ‘পিপলস মার্চ’, সব মিলিয়ে অন্যতর এক ‘প্রয়োগের’ লান। সেই ‘প্রয়োগ’— প্র্যাকটিস, সশস্ত্র লাইন— আর্মড স্ট্রাগল। চারজন ‘আজাদি সৈনিক’ ব্রিটিশের সেনা হাসপাতাল— অস্থায়ী সেনা হাসপাতাল থেকে পালালেন বুদ্ধি খাটিয়ে। বাইরে নিকষ অন্ধকার। মাথার ওপর দিয়ে অনেক কম শব্দ করে উড়ে যাচ্ছে জাপানি বোমারু বিমানেরা। ঝাঁক বেঁধে। তাদের আলো দেখা যায় কি যায় না। কাছে, দূরে কখনও কখনও তারা বোমা পেড়ে যায়। শব্দ, আগুন, ধোঁয়া। লাল হয়ে ওঠে আকাশ। মনে পড়ে ১৯৬৫ সালের শরতে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান ও বোমারু বিমানেরা মেদিনীপুরের কলাকুণ্ডা এয়ারবেসে বোমা ফেলে গেল। তার আগুন দেখা গিয়েছিল আমাদের বালির বাড়ি থেকে, উত্তর দিকের আকাশ লাল— সম্পূর্ণ লাল হয়ে উঠল বোমার ঘায়ে। ১৯৬৫-র ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। পাকিস্তানের সর্বময় কর্তা ফৌজি শাসক জেনারেল আয়ুব খান। আইয়ুব বা আয়ুব খান ভেবেছিলেন লাহোর থেকে রওনা দিয়ে বারো ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানি সাঁজোয়া বাহিনী ভারতের রাজধানী দিল্লির পথে আর আমেরিকার থেকে ‘ভোল’-এ পাওয়া প্যাটন ট্যাঙ্ক ইত্যাদি নিয়ে তার সঙ্গে পৌঁছে যাবে। আকাশপথে উড়ে বেড়াবে ‘বি-৫২’ বোমারু বিমান আর আমেরিকার দেওয়া ‘স্যাবার জেট’।

Powered by Froala Editor