কোহিমা, ইম্ফল, মণিপুর, নাগাল্যান্ড— সুভাষচন্দ্র বসু— নেতাজির রণধ্বনি— চল, চল, চল দিল্লি— আজাদি সেনারা জীবনপণ লড়াই লড়ছেন ব্রিটিশ আর্মি— রেগুলার ব্রিটিশ আর্মি— ইংরেজ সেনাদলের বিরুদ্ধে। অনেক অনেক অনেক শাহাদত, তবুও অনেক অনেক অনেক স্বপ্ন। দুচোখ জুড়ে স্বাধীন হিন্দুস্থান— স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বপ্ন— খোয়াব। পর্যাপ্ত অস্ত্র-গোলাবারুদ, রসদ— খাদ্য ইত্যাদি— সবেতেই টান পড়ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় শেষ পর্বে মার খেতে খেতে জাপানও খানিকটা কোণঠাসা, নিপ্পন— জাপানি শক্তির নানা আলো-অন্ধকার আর সেভাবে দায়িত্ব নিতে চাইছে না আজাদ হিন্দ ফৌজ— আইএনএ— আজাদি সৈনিকদের। জাপানি— জাপান সম্রাট হিরোহিতো, জাপানি সৈনিকদের বন্দুক ও তরবারি, তথাকথিত ‘মিত্রশক্তি’-অ্যালায়েড ফোর্স-এর প্রোপাগান্ডা মেশিনে ‘অক্ষশক্তি’— অ্যাকসিস পাওয়ারের যাবতীয় কুৎসা, সবই পর পর ভেসে উঠছে সামনে। তখন তো খবরের কাগজ খুবই সীমাবদ্ধ এক শ্রেণীর মাউনষের কাছে, রেডিও-ও তাই। একটু মফসসলে একটা রেডিও— মার্কনি সেট ঘিরে অনেক অনেক শ্রোতা, যুদ্ধের খবর শোনা, তখন একটা প্রবল প্রাত্যহিকতার মধ্যে পড়ে। নীরদ সি চৌধুরী অল ইন্ডিয়া রেডিওতে সমর সাংবাদিকতা করতেন। যুদ্ধের খবর। যুদ্ধের খবর। যুদ্ধ যত গড়াচ্ছে, এগোচ্ছে, ব্রিটিশরা বুঝতে পারছে ক্রমশ, তারা তাদের এই সব উপনিবেশদের আর বেশিদিন হাতের মুঠোয়, পায়ের নিচে রাখা যাবে না। ওদিকে আইএনএ-র রণধ্বনি চল দিল্লি, দিল্লি চল বলতে বলতে এগিয়ে আসছেন আজাদ হিন্দ ফৌজের আজাদি-সেনারা। যুদ্ধের খবরে তখন রোমাঞ্চ। পরাধীন দেশ ভারতবর্ষের মানুষ স্বপ্ন দেখছেন স্বাধীনতার— পূর্ণ স্বরাজের। ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস নয়, পূর্ণ— পূর্ণ স্বরাজ— পূর্ণ স্বাধীনতা। বরানগরের বড়াল পাড়ার আনন্দগোপাল ভট্টাচার্য তাঁর বাড়িতে কিছু না জানিয়েই চলে গেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রন্টে— যুদ্ধক্ষেত্রে ব্রিটিশ পল্টনের হয়ে লড়াই করতে। ‘স্বরাজ ইজ আওয়ার বার্থ রাইট’— ‘স্বাধীনতা হল আমাদের জন্মগত অধিকার।’ এমন রণধ্বনি— এই স্বাধীনতা বাসনা হয়তো বাড়িতে বরানগরের বড়াল পাড়ায় থাকবার সময়, তেমন ভাবে ছিল না আনন্দগোপাল ভট্টাচার্যর। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে এসে, নেহাৎই ‘শত্রুর কামানের খোরাক’ হতে এসেই, আনন্দগোপাল ভট্টাচার্য, অথবা তাঁর মতো যাঁরা ইংরেজ বাহিনীর সৈনিক, লড়াই করছেন জাপানি সেনা আর আজাদ হিন্দ বাহিনী— আইএনএ-র যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে, যেখানে সবটাই হচ্ছে অতি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। আবাস, নিবাস— সবই মাঠ ময়দানে। হামফ্রে ডেভির আবিষ্কার করা ডে ল্যাম্পের আলো ছিল কি সেইসব সেনা নিবাসে? আর কীভাবে কীভাবে জ্বর আনতে আনতে— জ্বর আনতে আনতে বললে অত্যন্ত ভুল কথা বলা হবে, আসলে তো জোর করে, একরকম জোর-জবরদস্তি করেই জ্বরকে নিয়ে আসা হল, অনেক অনেক রকমভাবে বৃষ্টিতে ভেজা, তারপর বেয়াড়া ধরনের স্নান, বার বার স্নান করা, তারপর অনেক, অনেকখানি টক দই— গাঢ় টক— অতিরিক্ত টক— জোঁদা টক— হ্যাঁ, জোঁদা টকই— বীভৎস জোঁদা টক যাকে বলে, সেই যে একেবারে দাঁত ফেলে দেওয়া খাট্টা, তাকে— তার ঘাড়ের ওপর ভর দিয়েই জ্বর আর সঙ্গে সঙ্গে আর্মি হাসপাতাল। অস্থায়ী মিলিটারি হাসপাতাল, তাঁবু, হামফ্রে ডেভির ডেলাইট কী সেখানে? না কী সেখানে অন্য কোনো আলো? চারপাশে ওঁ ওঁ ওঁ করে বেজে ওঠা পাগলা সাইরেন। খুব— অত্যন্ত নিচু দিতে উড়ে যেতে থাকে অতি হালকা জাপানি বোমারু বিমান, বম্বার। —‘সা রে গা মা পা ধা নি/ বোম ফেলেছে জাপানি/ বোমের ভেতর কেউটে সাপ/ ব্রিটিশ বলে, বাপ রে বাপ/ জার্মান বলে, ধর ধর/ ব্রিটিশ বলে পুড়ে মর…।’ এই লোকাল মেড ছড়া কলকাতার বহু ক্যালকেশিয়ানদের মুখে মুখে…। জাপানি বোমা পড়ে হাতিবাগানে ওঁ ওঁ ওঁ— সাইরেন। আঁ— আঁ— আঁ অলক্লিয়ার ধ্বনি। ব্রিটিশ যুদ্ধবিমান তাড়া করে জাপ রণ এয়ারোপ্লেন বা এরোপ্লেনকে। তাঁর অনেক পরে সুভাষ মুখোপাধ্যায় লেখেন, ‘জাপ পুষ্পকে জ্বলে হ্যাঙ্কাও…।’ পার্ল হারবারে নেমে আসে জাপানি বিমান আক্রমণ। সেই ঘটনা নিয়ে কত কত না যুদ্ধ আর প্রেমের ছবি। গুলি-গোলা, গুলি, গোলাপ আর চুম্বন— যৌন আর্তি। সাইরেন আর অল ক্লিয়ারের ধ্বনির ভেতর জাগে প্রমিত আখ্যানের আড়বহর। বরানগরের আনন্দগোপাল ভট্টাচার্য আর তাঁর তিন বাঙালি বন্ধু এভাবেই নাকি জ্বর ডেকেছিলেন, জুম্মা খাঁ আর বাচ্চি খাঁদের চোখ এড়িয়ে, যুদ্ধ তখন পেকে উঠেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন জমেও উঠেছে বলা যায়। খোদ ইউরোপ তার প্রবল বারুদ গন্ধ। ঘরে ঘরে ছেলেরা মিলিটারিতে, মেয়েরা নার্সিংয়ে ফ্রন্টে— প্রায় সবাই ফ্রন্টে। কত কত যুদ্ধ-শব্দ তৈরি হচ্ছে কথায় কথায়। মুখে মুখে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে ফিফথ কলাম— পঞ্চম বাহিনী। কে কার ফিফথ কলাম, তা নিয়ে চলছে ভয়াবহ চাপান-উতোর। জার্মানির নাজি বাহিনীর ব্ল্যাক শার্ট, ব্রাউন শার্ট, গুজস্টেপ, গেস্টাপো— সবই খবরের কাগজের পাতায় পাতায়। নতুন নতুন শব্দি— হিটলার— অ্যাডলফ হিটলার, বেনিতো মুসোলিনি, উইনস্টন চার্চিল, রুজভেল্টদের তৈরি। সোভিয়েত রেড আর্মি— লাল সেনার বার্লিনের পথে ঢুকে পড়া, তারপর গামবাট, ভোঁতা— ভারী ট্যাঙ্ক নিয়ে একটার পর একটা দেশ— পূর্ব ইউরোপের দেশ— যুগোশ্লাভিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, আলবেনিয়া বা আলবানিয়া, পোল্যান্ড, জার্মানির পূর্ব ভাগ— সব— সব মুক্ত। উইনস্টন চার্চিল, রুজভেল্ট, জোসেফ স্তালিন— সকলেই প্রবল ধূম্রাসক্ত। চুরুট, চুরুট। সিগারেট, পাইপ। হিটলার নন-স্মোকার নাকি। সেসব নিয়ে অনেক রসিকতা পরে। এর অনেক অনেক বছর পর মিখাইল গর্ভাচভ— পশ্চিমি মিডিয়া যাকে আদর করে গোর্বি বলেছে, তার গ্লাসনস্ত আর পেরেস্ত্রোইকা তত্ত্বের হারিকিরিতে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন— আস্ত অখণ্ড সোভিয়েত, সেইসঙ্গে ওয়ারশপ্যাকট— ওয়ারশ চুক্তিভুক্তি পূর্ব ইউরোপের সব দেশ পোল্যান্ডে ভ্যাটিক্যান ও পোপের আশীর্বাদধন্য ‘সলিডারিটি’-র লেক ওয়ালেশা— ঝোলা গোঁফের লেক বা লেশওয়ালেশ পোপের আশিস আর ‘টাইম ম্যাগাজিন’, ‘নিউজ উইক’-এর মলাট-ছবি হয়ে শেষ পর্যন্ত গোমুলকাকে— পোলিশ ‘কমিউনিস্ট’ নেতা গোমুলকাকে হটাতে— হটে যেতে বাধ্য করলেন। পূর্ব জার্মানি থেকে সরে যেতে বাধ্য হলেন ‘কমিউনিস্ট’ হোনেকার। হটে যেতে বাধ্য হইলেন হোনেকার। তারপর রুমানিয়া সেসোস্কু বা চিসে— তার বাথরুম— ওয়াশরুম— চান ঘরে নাকি সোনার কল। এই সব কথা বলতে থাকল পশ্চিমি মিডিয়া। সব। আজ আর কেউ কী স্মরণ করেন— মনে রাখেন মিখাইল গর্বাচভকে? মনে রাখেন ‘সলিডারিটি’—পোল্যান্ডের কমিউনিস্ট বিরোধী শ্রমিক সংগঠন ‘সলিডারিটি’-র লেক বা লেশ ওয়ালেশাকে? ইতিহাস বড়ো নিষ্ঠুর। বড়ো কঠিন।
তথাকথিত মিত্র বাহিনীর নরম্যান্ডি বা নরমান্ডির দিক থেকে জার্মানির মধ্যে ঢুকে পড়ার চেষ্টা, সেই ‘অ্যালায়েড ফোর্সে’ আমেরিকান ও ব্রিটিশ সেনারা। পরে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন ফরাসি ‘রেজিস্ট্যান্স’-এর— প্রতিরোধ বাহিনীর— জার্মান— নাজি খেদানোর লোকজন। খুব কম হাতিয়ার, তার মধ্যে ভারী অস্ত্র— নেইই প্রায়। বেশির ভাগই স্বল্প পাল্লার বন্দুক— দোনলা, একনলা, খুব বেশি রাইফেল নেই। দূরপাল্লার রাইফেলে ভেদশক্তি অনেক বেশি, তাও তেমনভাবে নেই ফরাসি রেজিস্ট্যান্স গড়ে তোলা ছেলে মেয়েদের হাতে। আর আছে কিছু হ্যান্ড গান, শট গান, পিস্তল, রিভলভার— এ সামান্য অস্ত্র ভাণ্ডার নিয়ে— অস্ত্র আর গুলির যোগান নিয়ে লড়াই করা যায় নাকি ভারী অস্ত্রে সেজে থাকা নাজিদের সঙ্গে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস যাঁরা লিখেছেন, তাঁরা তাঁদের ইতিহাসবোধ আর দর্শন নিয়ে লিখেছেন, বিবরণ— জয়ের বিবরণ, নরমান্ডি— নরমান্ডি অ্যালায়েড ফোর্সের— মিত্রশক্তির নরম্যান্ডি বা নরমান্ডি হয়ে ঢুকে পড়া, অন্যদিকে জার্মানগামী সোভিয়েত লাল ফৌজ— রেড আর্মি, কারা ইতিহাসের চালকশক্তি হল নাৎসি আর্মি, পরবর্তীতে ফ্যাসিস্টদের হারিয়ে, তা নিয়ে বিবিধ বহাস আজও। তর্কের শেষ নেই এখনও। নতুন নতুন গ্রন্থ নির্মাণ হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে সিনেমা, তত্ত্বের— তথ্যের লাইন। তাতে বলা হচ্ছে সোভিয়েত লাল ফৌজ— রেড আর্মি তো রেপিস্ট— ধর্ষক ছিলই, যেমন অন্যান্য সেনারা হয় সাধারণভাবে স্বভাবধর্ষক— বহুদিনের যৌন উপোস, চেতনায় আর শরীরে। কাঁহাতক কাঁচা পর্নোগ্রাফি পড়ার পর আত্মমৈথুনে দিনগুলি রাতগুলি কাটানো যায়? জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র— বটুকদা তাঁর অসামান্য কবিতা ‘মধু বংশীর গলি’-তে যে শিস দেওয়া ‘টমি’-র কথা বলেছেন, সেই শিসদার টমিদের তো দেহেছে কলকাতা। কলকাতার গা লাগোয়া মফঃস্বল। বেশ্যা বাড়িতে ক্রমশ ভিড় জমতে থাকে। যৌন ক্ষুধায় কাতর ‘টমি’-রা— মার্কিনি টমি একটি বেশ্যাকে নিয়ে টানাটানি করে তিনজন। ‘খুবলে খুবলে খাওয়া’ যাকে বলে। এই মার্কিনি ‘টমি’-দের ভেতর সাদা চামড়া, কালো চামড়া— দুই-ই আছে। অনেকটাই তথাকথিত ‘নিগ্রো’— ব্ল্যাক আমেরিকান। তাদের গান, মাতালিয়া হুল্লোড় আর চিৎকারে সে বড়ো ‘রৌরব রজনী’, ‘রৌরব দিবস’। বরাহনগর বা বরানগরের বড়াল পাড়া, মুখে মুখে কেউ আবার বড়াল পাড়াকে বোড়াল পাড়াও বলে থাকেন, সেই বড়াল পাড়ার আনন্দগোপাল ভট্টাচার্য আর তাঁর তিন বন্ধু অস্থায়ী সামরিক হাসপাতালে ভর্তি হলেন জ্বর-টাড়সের কৌশলে। দিনের বেলা উড়ে আসছে জাপানি বম্বার— বোমা পাড়বার জন্য। খুব নিচ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে সেই সব প্লেন বৃষ্টি ভেজা কোহিমা। খুব জোঁক, মশা, বিষাক্ত পোকা, বিষধর সাপ, বিছে, কাঁকড়াবিছে-এর অনেকটাই তো স্থানীয় নাগাদের খাদ্য। জ্যান্ত পোকাও সেই সময় খেয়ে থাকেন তাঁরা অনেক বোমারু বিমান, এতটাই নিচু দিয়ে, যে অনেক সময় মেশিন গানে— মেশিন গান দিয়ে তো বটেই রাইফেলেও চাঁদমারি করে দেওয়া যায়, তাদের কাউকে কাউকে। দিনেরবেলা আগুনের রং একরকম। রাত হলেই, আপাতভাবে সূর্য নেভা আকাশ আর পৃথিবী। তখন তো মহা অন্ধকার। এছাড়া নিষ্প্রদীপ দশা— ব্ল্যাক আউট, কাটা— কেটে নেওয়া সবুজ গাছপাতার ক্যামোফ্লেজ তো সমস্ত অস্থায়ী মিলিটারি আবাস জুড়ে। এরই মধ্যে তো ভেসে আসছে স্বপ্নকথা— আসছেন, আসছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র— সামরিক বেশে— বাঙালির স্বপ্নতোষ সুভাষচন্দ্র— নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। সুভাষ বোস। আর তারই পাশাপাশি এই রে, এবার তো আসছে জাপানিরা। চিনেরা আরশোলা, ব্যাং, সব খায়— জাপানিরাও খাবে সব। আমাদের খাওয়াবে যে। এর থেকে ব্রিটিশ ভালো ছিল। ইংরেজরা রাজার জাত। তারা ভদ্র, সব— সব ভালো ভালো জিনিস খায়, গরু, শুয়োর খায়, ম্লেচ্ছগিরি করে, তাতে কী? কিন্তু সাপ-ব্যাঙ, টিকটিকি, ওরে বাবা! খুব খারাপ। পাতে দেওয়া যায় না। ব্রিটিশ প্রশাসন গ্রামের দিকে সমস্ত নৌকো— ছোটো বড়ো নৌকা সিজ করে নিল। তার সঙ্গে সঙ্গে সাইকেল। কলকাতা আর তার গা লাগোয়া শহরতলি, মফঃস্বলেও। সাইকেল— বাইসাইকেল, তখন কজনের কাছেই বা! এদিকে তো দুর্লভ বা দুল্লভি রীতিমতো মাইশোর স্যান্ডাল সোপ দিয়ে স্নান সারেন বাগবাজারের রাস্তায়— রাস্তার কলে। তাঁর কুঞ্চিত কেশে ফুলেল তেল— বাস তেল— গন্ধ তেল। পরনে সেনগুপ্তর কাচিধুতি, পায়ে গ্লেজ কিডের পাম্প শ্যু। নয়তো কাফ লেদার। বেশ মসমসানো কিন্তু নরম— চিনে বাড়ির জুতো সে সব, পাওয়া যায়, চিনে বাজার। পাঁচসিকে— এক টাকা চার আনা থেকে আড়াই টাকা তার দাম। কালো, ব্রাউন, নয়তো অক্সব্লাড কালার সেইসব জুতোর। ওপরে, মানে সেনগুপ্তর কালাপাড় কাচি ধুতির ওপরে আদ্দি নয়তো সিল্কের পাঞ্জাবি। বাফতা, টুইল, টুইড, আলপাকা, কত কত কাপড়ের নাম জামা, পাঞ্জাবি আর কোটের। সেইসঙ্গে লং ক্লথ। লং ক্লথ অবশ্য আম পাবলিকের জন্য। এক খানা মাইশোর স্যান্ডাল সোপ চার আনা বড়ো জোর। তার থেকে ভুরভুরে গন্ধ উড়ে আসে। সেই সুবাস স্থায়ী হয়ে থাকে অনেকক্ষণ, বাতাসে মিলে মিশে থাকে তাঁর সুঘ্রাণ। প্যান্টের জন্য গ্যাবাডিন, জিন, মাখন জিন। সাদা মাখন জিন অনেকেরই পছন্দের। আলপাকার কোট ধুতির ওপর পরেন অনেক অনেক ‘বাঙালিবাবু’। বিশেষ করে মাইনেদার কেরানি কূল। সওদাগরি আপিস— মার্চেন্ট আপিস তখন অনেক। যুদ্ধের বাজারে নতুন নতুন ভুঁইফোড় সওদাগরি আপিস, ব্যাঙ্ক সাপ্লাই আপিস। কত কত সালাই যুদ্ধের বাজারে— সব লাগে, সব কিছু, সর্বগ্রাসী আর্মির তখন লোহায় টান— অস্ত্র আর ব্রিজ তৈরি হবে। নতুন নতুন ব্রিজ— সেতু। আকাশ থেকে পেড়ে যাওয়া বোমায়— পাউন্ডারে ভাঙে সেতু, জনপদ জ্বলে। যুদ্ধের বাজারে তাই আলপিন আর জেমস ক্লিপের বদলে বেলকাঁটা। টমিদের— আর্মির মেয়ে লাগে। সেই ‘কাঁচা চামড়া’ সাপ্লাইয়েরও আপিস আছে। তখন তো টমিদের মনোরঞ্জনের জন্য ওয়াকাই। এই ‘ওয়াকাইদের’ কথা আছে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায়। ‘সপ্তপদী’-তে খুব ডাঁটিয়াল রিনা ব্রাউন ওয়াকাই হয়েছিল। ধর্মান্তরিত হিন্দু থেকে খ্রিস্টান হওয়া কৃষ্ণেন্দু তখন ফাদার। যিশুবাবার উপাসক। যুদ্ধ ইউরোপের সর্বস্ব কেড়েছে। এশিয়াতেও কিছু কিছু প্রভাব পড়েছে তার। কিন্তু আমেরিকায় পার্ল হারবার— জাহাজঘাঁটিতে জাপানি সুইসাইডাল বম্বার— আত্মঘাতী হওয়া— ‘হারিকিরি’ করা জাপানি বোমারু বিমানের পাইলট আর তাদের বিধ্বংসী সুইসাইড স্কোয়াডিয় আচরণ ছাড়া প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধে আমেরিকার ক্ষয়ক্ষতি সেভাবে কোথায়? তারপর তো জাপানের বুকে হিরোশিমা, নাগাসাকি, ‘পরীক্ষামূলক’ পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা। ‘লিটল বয়’ আর ‘ফ্যাট ম্যান’। কালো, ঘন কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেল আকাশ-গগন মণ্ডল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রায় খতমই করে দিল আমেরিকা— হিরোশিমা-নাগাসাকি বোমা বর্ষণ করে। মানে বোমা— পারমাণবিক বোমা ফেলে। আত্মসমর্পণে বাধ্য হল প্রবল ‘প্রতাপান্বিত জাপান’। এশিয়ার সূর্য— নিপ্পন গোলক যারা তুলে ধরেছিল আকাশে।
Powered by Froala Editor