নেতাজি এসেছেন

পুনরায় আজাদ হিন্দ বাহিনী।
আবারও আজাদ হিন্দ সরকার।
ভারতবর্ষকে মুক্ত করতে আসা সেনাদল। জাপানি সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে বন্দি হয়েছিলেন যে ভারতীয় সেনারা, অনেক অনেক জন, তাঁদের নিয়েই আজাদ হিন্দ বাহিনী— আজাদি সেনা— ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি— আইএনএ। ‘কদম কদম বঢ়ায়ে যা’। জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের কাছে তিনি তো ভালো ব্যবহার পাননি কখনোই। তবু গান্ধী ব্রিগেড, তবু নেহরু ব্রিগেড— সুভাষের— নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ঔদার্য দেখার, বারবার দেখার। তিনি স্বপ্নে ছিলেন মুক্ত, স্বাধীন, সার্বভৌম ভারতবর্ষের। সাম্প্রদায়িকতার কলুষমুক্ত ভারতবর্ষ— অখণ্ড ভারতবর্ষ। সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন তাঁর দুচোখে। সেই সমাজতান্ত্রিক ভাবনায় ‘হিটলারি ছোঁয়া’— ‘হিটলারি স্পর্শদোষ’ কতটা ছিল, তা খুবই তর্কসাপেক্ষ। এই নিয়ে অখণ্ড ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি— সিপিআই-এর সিদ্ধান্ত যে কতটা ভুল ছিল, তা তো প্রভাতী আলোর থেকেও পরিষ্কার। ১৯৪২-এ সিপিআই-এর জনযুদ্ধর লাইন, ‘পিতৃভূমি— ফাদার ল্যান্ড সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রান্ত’, এই যুক্তিতে ব্রিটিশকে সমর্থন, ১৯৪২-এর ৯ আগস্ট যে ঐতিহাসিক আগস্ট বিপ্লব বা ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধ অথবা জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম শুরুয়াত, তাকে— সেই চলমান বি-ই-শা-ল বিপ্লবী প্রচেষ্টা থেকে দূরে রইল না ভাঙা সিপিআই— ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। আর বহুবছর পর কমিউনিস্ট ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির এই ভুল ভূমিকাকে সমালোচনা করার সুযোগ পেয়ে গেলেন অরুণ শৌরি— সাংবাদিক— একদা এনডিএ সরকারের মন্ত্রী— অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রীত্বেও চলমান মন্ত্রীসভার বিলগ্নীকরণ দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন অরুণ শৌরি। কেন্দ্রে বিজেপি— ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতায় এসেই রাষ্ট্রীয় সংস্থাদের বিক্রমপুর করতে শুরু করে। যা ছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও পণ্ডিত জবাহরলাল নেহরুর ‘সমাজতান্ত্রিক’ ধাঁচের চিন্তার একেবারে বিপ্রতীপ। সুভাষচন্দ্র অবশ্য কোনোদিনই বলতে চাননি ‘সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজ’-কে তিনি স্বাগত জানাবেন। কিন্তু ‘সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজ’ তত্ত্বের প্রবক্তা পণ্ডিত জবাহরলাল নেহরু। তিনি ইউরোপ ফেরত— অক্সফোর্ড পার করা তত্ত্বের ফেবিয়ান সোসালিস্ট। যার থেকে মহাত্মাজি— মহাত্মা গান্ধীর গ্রাম-স্বরাজ কয়েক কোটি মাইল দূরে অবস্থান করছে। হ্যারো, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, রজনীপাল দত্ত, কেউ কেউ রজনীপালকে দত্তও বলে থাকেন, সবই ভারতের তথাকথিত এলিট কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সুভাষ ও জবাহরলালের সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের ভাবনা অনেকটাই দূরত্বে— পরস্পরের থেকে। সুভাষচন্দ্র কিছুদিনের জন্য গলেও সামরিক একনায়কতন্ত্র যাত্রা করেছেন, খানিকটা খানিকটা হলেও সেইভাবেই বলেছেন তাঁর লেখায়, চিঠিপত্রে। অন্যদিকে পণ্ডিত নেহরু সব অর্থেই প্রবল গণতন্ত্র প্রিয়। ইউরোপের— বিশেষ করে ব্রিটিশ মডেলের গণতন্ত্র তাঁর পছন্দের। সকলের কথা বলার অধিকার, সর্বজনীন ভোটাধিকার, সংসদ, বিরোধীদের কথা, সমালোচনা অতি মন দিয়ে শোনা। এসবই জবাহরলাল নেহরুর ভাবনা ও বোধে আটকে আছে। কিন্তু তেলেঙ্গানায়— নিজামের অন্ধ্রের তেলেঙ্গানায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির— অখণ্ড ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে যে কৃষক বিদ্রোহ— সশস্ত্র কৃষক সংগ্রাম শুরু হয়, যা নিয়ে কিষাণচন্দর লিখেছিলেন ‘যব ক্ষেত জাগে’-র মতো আখ্যান, পি সুন্দরাইয়ার বি-ই-শা-ল গ্রন্থ আছে তেলেঙ্গানা আপরাইজিং নিয়ে, তাকে— সেই সশস্ত্র বিদ্রোহকে নির্মমভাবে দমন করে নেহরু সরকার। এই বিষয়টি নিয়ে গৌতম ঘোষের অসামান্য ছবি— ‘মা ভূমি’। গণতন্ত্রের প্রায় কোনো বিধিই মানা হয়নি সেখানে। ‘লৌহমানব’ সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। নিজামের অন্ধ্র, জুনাগড়— সবই একে একে ভারতযুক্ত হল। আর পণ্ডিত নেহরু উদারমনা ফেবিয়ান সোসালিস্ট প্যাটালের এই তথাকথিত সম্প্রসারণবাদকে বাধা দেননি, কোনোভাবে। তেলেঙ্গানা, কাকদ্বীপ, তেভাগা পর্বেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব ঢোলা খাকি হাফপ্যান্ট পরা শুরু করেন। বিটিআর— বিটি রণদিভে, পি মুন্দরাইয়া, একে গোপালন, পি রামমূর্তি— সকলেই খাকি হাফপ্যান্ট। 

পশ্চিমবাংলা ও কেরলের কমিউনিস্ট নেতৃত্ব খানিকটা খানিকটা হাফপ্যান্ট, জ্যোতি বসু হাফপ্যান্ট পরতেন রেলওয়ে শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করার সময়। কানু সান্যাল পরতেন হাফপ্যান্ট, নকশালবাড়ি-উত্তর পর্বে। ১৯৬৯-এর ১ মে মনুমেন্ট ময়দানে তাঁর রেড বুক হাতে গোল গলা, সাদা গেঞ্জি ও ঢোলা হাফপ্যান্ট পরে ছবিটি এখনও মনে আছে অনেকের। যদিও চারু মজুমদার, সরোজ দত্ত, সুশীতল রায়চৌধুরী— কেউই হাফপ্যান্ট নন, সকলেই ধুতি-শার্ট। সিপিআই, সিপিআই (এম)-এর সমস্ত নেতৃস্থানীয় জনেরা, নয়তো পাজামা শার্ট অথবা মুণ্ড ভাঁজ করা দক্ষিণী ধুতি ও শার্ট। সুভাষচন্দ্রকে জিওসি-র বদলে ‘গক’ সুভাষ বলে ব্যঙ্গ করেছিল সজনীকান্ত দাসের কলম। সুভাষ সামরিক পোশাকে মার্চ পাস্ট করেছিলেন কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে, তাঁর অনুগামীদের নিয়ে সমালোচনা ও সমর্থনের ঝড় তখন জিওসি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকি ঘিরে। এইসব কথা মনে পড়ল আমার শ্বশুরমশাই প্রয়াত আনন্দগোপাল ভট্টাচার্যর স্মৃতিতে বিঁধে থাকা আইএনএ-তে যোগদানের স্বপ্ন মনে রেখে। ১৯৮৫ সালের ৭ জুন তিনি প্রয়াত হন শ্রীরামপুরের মিলন রায়ের নার্সিং হোমে। তখন বর্ষার বিকেল মুছে আসছে। আনন্দবাবু— আনন্দগোপাল ভট্টাচার্য তাঁদের বরানগরের বড়াল পাড়ার বাড়ি থেকে সো-ও-ও-জা ব্রিটিশ মিলিটারিতে। তারপর মনে বাসনা যোগ দেবেন আইএনএ-তে, যে আইএনএ-র বন্দি যোদ্ধাদের হয়ে সওয়াল করতে নেমেছিলেন দিল্লির লাল কিলা— লাল কেল্লায় পণ্ডিত জবাহরলাল নেহরু আর ভুলাভাই দেশাই। তাঁরা দুজনেই ব্যারিস্টার। দিল্লির দূরদর্শন— দিল্লি না বলে তাকে জাতীয় দূরদর্শন— ন্যাশনাল টেলিভিশন বলাই ভালো, যেখানে একটি টানা সিরিয়াল হয়েছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে। সেখানে এই ট্রায়াল দেখানো হয়। আর দেখানো হয় সুভাষচন্দ্র মদ্যপান করছেন। সঙ্গে সঙ্গে রে রে রে রে। সুভাষ বোস— নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু কখনও মদ খেতে পারেন? তাঁর পক্ষে মদ টানা সম্ভব? সেই নিয়ে একেবারে ঢিল ছোঁড়াছুঁড়ি। পরে সম্ভবত বন্ধ হয়ে যায় এই সিরিয়াল। শ্যাম বেনেগালের নেতাজি ফরগটন হিরো দেখেছি। খুব ভালো মেকিং। নেতাজির ভূমিকায় শচিন খেদকার অনবদ্য। ক্যামেরা দুর্ঘর্ষ। কিন্তু তাইহোকুর দুর্ঘটনায় সুভাষের মৃত্যু— নাহ, মানতে পারিনি। পারিনি। পারব না। বিশ্বাস করি না। বাংলায় নেতাজির ওপর একটি সিনেমা এসেছিল ষাটের দশকের শেষে। তাতে আবহ হিসাবে লতা মঙ্গেশকারের বাংলা গান— ‘একবার বিদায় দে মা/ ঘুরে আসি… একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি… আমি হাসি হাসি পরব ফাঁসি, দেখবে ভারতবাসী… একবার বিদায় দে মা…।’ এই গানটি শহিদ ক্ষুদিরামের। 

অন্ধ্রের অত্যাচারী নিজামশাহির বিরুদ্ধে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে যে সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ, তা নিজামের পুলিশ, সৈন্য, রাজাকার ইত্যাদি দিয়ে আটকানো যাচ্ছিল না কোনোভাবেই। ভারত সরকার জেনারেল জয়ন্তনাথ চৌধুরী— জেএন চৌধুরীর নেতৃত্বে হায়দরাবাদ অপারেশন ও কমিউনিস্ট বিদ্রোহ উৎখাত— দুটোই একসঙ্গে করে। নিজাম তার হারেম, অসংখ্য কোম, রক্ষিতা, সালারজঙ মিউজিয়ামের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি, বিলাস-ব্যসন— এইসব কিছু নিয়ে বেশ ছিল। অনেক অনেক ধরনের ঘড়ি, হায়দরাবাদের সোলারজঙ মিউজিয়ামে, সেইসঙ্গে আরও অনেক অনেক অনেক টাকার মহার্ঘ্য অ্যান্টিক বস্তু। হায়দরাবাদ মানেই ‘চারমিনার’ গেট, হায়দরাবাদী বিরিয়ানি, সালারজঙ মিউজিয়াম আর তার অ্যান্টিক পিস-রা নয়। হায়দরাবাদের নিজামকে— সম্ভবত শেষ নিজামকেই নাকি হদকুচ্ছিত দেখতে ছিল। তিনি নাকি স্নানফান প্রায় করতেনই না। গাত্র বদবু আতরে মারতেন। দামি দামি সব খশবু— ইত্তর— আতর। গুলাব, বেলি, জেসমিন— যুঁই, স্যান্ডাল— চন্দন, খশশ, বদবুকে লিয়ে বু। সেইসঙ্গে ল্যাভেন্ডার। তো সেই যাই হোক, এমারেল্ড বাওয়ার— মরকত কুঞ্জে— ঠাকুরবাড়ির জমিতে এসে বসলেন নিজাম বাহারি তাঁবু খাটিয়ে, সঙ্গে তার কয়েক গণ্ডা হারেমজাত বিবি, বেশ চলছিল সব ঠিকঠাক। ইংরেজ রাজত্বে এমারেল্ড বাওয়ারে— মরকত কুঞ্জে নিজামি রওনক। কিন্তু মাঝখান থেকে সেই আনকুত— কুৎসিত দর্শন নিজামের হারেমজাত এক বিবি হারিয়ে গেল। ব্যাস। অবস্থা সঙ্গীন। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। নিজামের নিজস্ব দেহরক্ষী, পুলিশ— সবাই মিলে ভয়ানক তৎপর হয়ে উঠল। খুঁজতে খুঁজতে খুঁজতে খুঁজতে বিবির আর কোনো হদিশ পাওয়া যায় না। তালাশি চলছে সর্বত্র। নিজাম স্বাধীন রাজা— নবাব, করদ রাজ্য, ব্রিটিশের অধীন ফাইনালি, তবু শেষ পর্যন্ত তাঁর কথা— ক্ষমতা অনেক অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত। তো সে যাই হোক, হিজামের হারেম নন্দিনীকে পাওয়া গেল অবশেষে। এই কাহিনি আমার শোনা বাবু কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়— কল্যাণদার কথা আগেও বহুবার লিখেছি। তাঁর বাবা কবি করঞ্জতাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়, এল সালভাদোর-এর কন্সাল জেনারেল। কলকাতাতেই থাকেন, এল সালভাদোরের ‘কাজ’ করে— দূতিয়ালি ইত্যাদি জাহাজ-টাজাহ যদি আসে, তাহলে কিছু নগদ নারায়ণ। কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা শুভ্রজা দেবী। তিনি খুবই অল্প বয়সে মারা যান। তাঁর ছবি দেখেছি পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটে ‘প্রাসাদ’ নামের বড়োসড় আলিশান বাড়িতে, যেখানে যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, প্রদ্যোৎকুমার ঠাকুর— যাঁকে মহারানি ভিক্টোরিয়া বলতেন ‘রুবি প্রিন্স’, যাঁর কোর্ট অফ আর্মস, মেহগনির তৈরি কারুকার্যদার মদের সেলার— ওয়াইন সেলার, তার ভেতর খুব দামি দামি ড্রিংকস, সবই ফরেন লিকার, আমি এই কোর্ট অফ আর্মস দেখেছি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি প্রখ্যাত শিল্পী ও আর্ট কালেকটর সুভো ঠাকুর— সুভগেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। প্রদ্যোৎকুমার ঠাকুর— মহারানি ভিক্টোরিয়ার অতি আদরের রুবি বিশ্বাস, তাঁরই কোর্ট অফ আর্মস, তাঁরই মেহগনি ও বিদেশি কাচের নকশাদার মদের সেলার। সবই সুভো ঠাকুরের সংগ্রহে, যেমন নেপোলিয়ঁ— ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের— নেপোলিয়ন বোনাপার্টের বাহারি দোয়াত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শেষযাত্রার শুকনো ফুলের মালা। সাদা ফুল। রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল। রবার্ট ক্লাইভের কাচের তৈরি হুঁকো। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোর্ট অফ আর্মস, উইল। সেইসঙ্গে দেবেন্দ্রনাথ পিতা দ্বারকানাথের উইল, তাঁর স্বপ্নের কার অ্যান্ড টেগোর কোম্পানির ব্যবসাপাতি, জাহাজের যাওয়া আসার নানা ডকুমেন্ট। আরও কত কি সুভোবাবু— সুভো ঠাকুরের সংগ্রহে— পুরির জগন্নাথ মন্দিরের বি-ই-শা-ল বি-ই-শা-ল তালাচাবি, সান পেইনটিংস, বিদরির কাজ করা হুঁকো, কালীঘাটের পট, যে যে পটের মধ্যে হুক্কা বা হুঁকোর ছবি ছিল না, তা আবার চলে গেল আরপি— রাধাপ্রসাদ গুপ্ত— শাঁটুল বাবুর কাছে। কেন কীভাবে সেই পট দেওয়া নেওয়া হল, সে এক ইতিহাস। বারান্তরে কখনও সে কথা বলা যাবে। সেই কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়, পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরদের দৌহিত্র বংশ, প্রবীরেন্দ্রমোহন ঠাকুরের স্ত্রী সুরীতিদেবী, তিনি নিঃসন্তান, তাঁর কোলে-পিঠে ঘাড়ে সর্বদা কুকুর— দামি, ছোটো, লোমদার। সুরীতি দেবীকে করঞ্জাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্ক অনুযায়ী ‘মামি’ বলতেন। আবার কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়ও সুরীতি দেবীকে ‘মামি’-ই বলতেন। বাবার মাসিমাকে মামি। সুরীতি দেবীকে দেখেছি আমি খুব কাছ থেকে। লম্বা নন মোটেই। গায়ের রং ময়লা, তবে তার ওপর ফেস পাউডারের প্রলেপ। তাঁকে ‘প্রাসাদ’–এর ভেতর দোতলা বা তিনতলায়, সম্ভবত তিন তলাতেই হবে, তিনি বসেছিলেন বেশ উঁচু একটি চেয়ার— যাকে সাধারণভাবে থ্রোন বলা হয়, সেই থ্রোনে তিনি বসেছিলেন। সেইখানেই তাঁর মুখোমুখি। তাঁর সঙ্গে একটি কোল-কুকুর— ল্যাপ ডগ। খুবই ছোটো, প্রায় পুতুল-সারমেয় যেন, এমন সাদা। সেই সাদাকে— শ্বেতময়তাকে দেখলেই রীতিমতো আদর করতে ইচ্ছে হয়। আর নিচে একটি স্পিটজ, একটি পমেরিয়ান, সবই সাদা, তিনটি সরমা-সন্তানই সম্ভবত বিচ। সেই কুক্কুরিদের সৌন্দর্য ও প্রতাপ দেখার। প্রতাপ বলতে তাদের গলার জোর। খুব জোরে জোরে চিৎকার করার ক্ষমতা। গোটা ‘প্রাসাদ’ একেবারে মাথায়। পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরেরা ব্রাহ্ম ছিলেন না। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, প্রফুল্লকুমার ঠাকুর, প্রদ্যোৎকুমার ঠাকুর, বিলাসে-বৈভবে, একেবারে অগ্রগণ্য ছিলেন। জারের— রুশ সম্রাট জার নিকোলাসের কাচের তৈরি অতিবাহারি ঝাড়বাতি— ঝাড়লণ্ঠন কিনে নিয়েছিলেন মহারানি ভিক্টোরিয়ার ‘রুবি প্রিন্স’ প্রদ্যোৎকুমার ঠাকুর। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর ছিলেন নাট্য-উৎসাহী। মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাটক মঞ্চস্থ করানোর ব্যাপারে তাঁর ভূমিকা ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। যতীন্দ্রমোহন, প্রফুল্লকুমার, প্রদ্যোৎকুমার এঁদের কথা— পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরদের কথা খুব বেশি জানা যায় না। কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, লিখবেন পাথুরিয়াঘাটার রাজবাড়ির ইতিহাস— পাথুরিয়াঘাটার গভীরেই লুকিয়ে আছে ইতিহাসের ছেঁড়াপাতার গন্ধ ও রং। সেইসব কিছুকে জুড়ে, জোড়াতাড়া দিয়ে একটা বড়োসড় কাজ দাঁড় করান, হয়নি। ‘মরিস ফাইভ’ আর ‘ওপেন’— এই দুটি গাড়ি ছিল করঞ্জাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তিনি শুভ্রজা দেবীকে বিবাহ করেছিলেন। শুভ্রজার অতি অকাল মৃত্যুর পর তিনি আর দারপরিগ্রহ করেননি। ছিলেন অসম্ভব রবীন্দ্র অনুরাগী। হাতের লেখাটাও রবীন্দ্রনাথ যেন, তেমনই স্টাইল। তখন তো এরকমভাবে অনেকেই পোশাকে, দাড়িতে উচ্চারণ, তাকানোয়, হস্তাক্ষরে, সবই যেন রবীন্দ্রনাথের, রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ। এরকম তো হয়ই। রবীন্দ্রনাথ আসার আগে বঙ্কিমচন্দ্রের হস্তাক্ষর, অনুসরণ করতেন তথাকথিত শিক্ষিত, বাঙালি সমাজ— বাঙালিবাবু সমাজ— বাঞালি ‘বাবু’-রা। কথায় কথায় একটু দূরে পেছনে চলে গেলে নিজামের হারেমজাত বিবি, নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া বিবি। বাগবাজারের নেতাজি দাদু আর আনন্দগোপাল ভট্টাচার্য আর তাঁর বন্ধুদের নেতাজি অভিযান।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
ইয়ে শান-এ হিন্দ আ গ্যয়ে