নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, সুভাষজি, সুভাষ বোস, চন্দ্র বোস— যে নামেই ডাকা যাক না কেন তাঁকে, তিনি আদি ও অকৃত্রিম নেতাজি, বাঙালির বীরত্ব গাথার অন্যতম মাউথ অরগ্যান। কোহিমা, ইম্ফল, ‘চলো দিল্লি’, ‘চলো দিল্লি’, ‘চলো দিল্লি’, ‘চলো দিল্লি’, অসামান্য রণধ্বনি তাঁকে ঘিরে, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’। তাইহোকুর তথাকথিত ‘বিমান দুর্ঘটনা’, জার্মানি থেকে জাপানে দীর্ঘপথ সাবমেরিনে পাড়ি, আন্দোলনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, সিঙ্গাপুর— সব-সব যেন আজাদি সৈনিকদের বীরত্ব ব্যান্ডের সে এক নিত্য কদম বঢ়ায়ে যা খুশিকে গীত গায়ে যা…। কদম কদম…। সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে ‘দ্য স্প্রিংগিং টাইগার’ অসামান্য গ্রন্থ। তার সঙ্গে ‘রোল অফ অনার’— এই বইটি অবশ্য সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে নয়। ভারতবর্ষের সশস্ত্র পথের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিয়ে। যদিও ‘রোল অফ অনার’ স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবী ধারা— সশস্ত্র পথের বিপ্লবী, বোমা, পিস্তল, গুলি, দীপান্তর, কালাপানি, ফাঁসি— সব মিলিয়ে যে অহিংস ধারার বিপ্রতীপে স্বাধীনতা সংগ্রাম, তার কথাই প্রধানত আছে ‘রোল অফ অনার’-এ। কিন্তু এই বইটিতেও অনেক অনেক অনেক ভুল তথ্য আছে। একটা সময় গেছে, যখন অন্য অন্য বই— স্বাধীনতা যোদ্ধাদের ওপর আকরগ্রন্থ, বা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জীবনকথা নিয়ে ‘রোল অফ অনার’-এর তথ্য ভুল ধরার চেষ্টা করেছি। লিখেওছি এইসব তথ্য বিকৃতি— ভুলভ্রান্তি নিয়ে। অনেক অনেক টুকরো লেখা। রোল অফ অনারকে এক সময়ে আকর বহ্নি মনে হত। পরে দেখিলাম ইহা ত্রুটিতে পূর্ণ। যাহা হউক— আমার মনে পড়ে আজাদি সৈনিকের গাওয়া গীত—
কদম কদ্ম বঢ়ায়ে যা
খুশিকে গীত গায়ে যা
ইয়ে জিন্দগি হ্যায় কওমকি
তু কওমপে লুটায়ে যা
কদম কদম বঢ়ায়ে যা
খুশিকে গীত গায়ে যা
ইয়ে জিন্দগি হ্যায় কওমকি
তু কওমপে লুটায়ে যা
তু শের এ হিন্দ আগে বঢ়
মরনেসে তু করে না ডর
উড়াকে দুশমনোঁ কা শর
ইয়াশ-এ (যশ) ওয়াতন বঢ়ায়ে যা
কদম কদম বঢ়ায়ে যা
খুশিকে গীত গায়ে যা
ইয়ে জিন্দগি হ্যায় কওমকি
তু কওমপে লুটায়ে যা
হিম্মত তেরি বাঢ়তি রহে
খুদা তেরি শুনতা রহে
যো সামনে তেরে খাড়ে
তু আঁখসে মিলায়ে যা
হিম্মত তেরি বাঢ়তি রহে
খুদা তেরি শুনতা রহে
যো সামনে তেরে খাড়ে
তু আঁখসে মিলায়ে যা
কদম কদম বঢ়ায়ে যা
খুশিকে গীত গায়ে যা
ইয়ে জিন্দগি হ্যায় কওমকি
কওম পে লুটায়ে যা…।
তাঁর— ‘তরুণের স্বপ্ন’ পড়ি বছর ষোলো বয়সে। মনে তখন অন্য ভারতের স্বপ্ন। নকশালবাড়ি। সশস্ত্র কৃষি বিপ্লব। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা। মুক্তাঞ্চল। লাল এলাকা। তখন তো
সুভাষজি সুভাষজি য়ো জান-এ হিন্দ আ গ্যয়ে
হ্যায় নাজ জিসপে হিন্দ কো
য়ো শান-এ হিন্দ আ গ্যয়ে
সুভাষ জান-এ হিন্দ হ্যায়
সুভাষ শান-এ হিন্দ হ্যায়
সুভাষ মান-এ হিন্দ হ্যায়
সুভাষজি য়ো জান-এ হিন্দ আ গ্যয়ে
সুভাষজি সুভাষজি য়ে নাজ-এ হিন্দ আ গ্যয়ে
সুভাষজি সুভাষজি
সুভাষজি সুভাষজি
তুফান হিন্দ লায়েঙ্গে
য়ো শান হিন্দ লায়েঙ্গে
ফিরঙ্গিয়ো কে কাম পর
য়ো কেহের বানকে ছায়েঙ্গে
সুভাষজি সুভাষজি সুভাষজি সুভাষজি
সুভাষজি সুভাষজি…।
আরও পড়ুন
বাঙালির সুভাষ পালক, নেতাজি উড়ান
এই গান পাড়ায় তেইশে জানুয়ারির প্যারেডে। পাড়ায় পাড়ায় উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতার কোনো কোনো পাড়ায় তখনও বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স— বিভি-র লোকজন। মেজর সত্য বক্সি। সুভাষচন্দ্রের আবেগ নিয়ে, তীব্র আবেগ নিয়ে তখনও বাঙালির একটা বড়ো অংশ মথিত। এর মধ্যেই বরানগরের বড়াল পাড়ায় ডাক্তারবাবু প্রফুল্লকুমার ভট্টাচার্যের দুটি বাড়ি,পাশাপাশি। মাঝখানে দরজা, দুটো উঠোন। প্রফুল্লকুমার ভট্টাচার্যর একেবারে কনিষ্ঠপুত্র আনন্দগোপাল ভট্টাচার্য বাড়ির কাউকে না জানিয়ে আইএ পড়তে পড়তে চলে গেলেন ব্রিটিশ আর্মিতে। বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র তিনি। একেবারে পালিয়েই গেলেন বাড়ি থেকে ফওজে। কাউকে না জানিয়ে। তার আগে বাড়িতে কিছু মনোমালিন্য, মান অভিমান। আনন্দগোপাল ভট্টাচার্য, ডাক্তারবাবু প্রফুল্লকুমার ভট্টাচার্যর আদরের সন্তান চলে গেলেন মিলিটারিতে। স্থল বাহিনী। পোস্টিং কোহিমাতে। নাগাল্যান্ড। তার আগে সামান্য ট্রেনিং, প্রশিক্ষণ। অস্ত্র ইত্যাদি চালানো শেখা। নাগাল্যান্ডের কোহিমা তখন দুর্গমতম অঞ্চল। সাধারণ নাগা মানুষরা খুব গরিব। আঙ্গামি, আও। নানা উপজাতির ক্ল্যান। নাগা নেতা ফিজো আরও পরে। সেই সময় ব্রিটিশ আর্মি অফিসার আর তাদের বুট চাটা ভারতীয় সুবেদার ব্যাঙ্কের লোক ভীষণ খারাপ ব্যবহার করত অন্য অন্য ভারতীয় সিপাহিদের সঙ্গে। সাধারণ সেপাই বা সিপাহিরা ছিল ‘কামানের খোরাক’— ‘ফডার অফ দ্য ক্যানন’। ফলে তাদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে চলত নানারকম গালি-গালাজ, খারাপ ব্যবহার, উঠতে-বসতে জাত তুলে অপমান। আনন্দগোপাল ভট্টাচার্যর স্মৃতি থেকে জেনেছি জুম্মা খাঁ আর বাচ্চি খাঁ নামে দুজন সুবেদার ব্যাঙ্কের পাঠান আরও আরও বেশি অত্যাচার করত ভারতীয় সিপাহিদের ওপর। ভারবাহি গাধার সঙ্গে যে ব্যবহার করে তার মালিক, তার থেকেও অনেক অনেক অনেক বদ আচরণ। জুম্মা আর বাচ্চি— দুজনেই অখণ্ড ভারতের পাঠান। ভয়ানক তাদের প্রতাপ। আর তাদের এইভাবে কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশ অফিসারদেরও সোয়াস্তি। কোহিমাতে প্রবল পোকা-মাকড়ের উপদ্রব, মশা। তারই মধ্যে ফাঁকা মাঠে ক্যামোফ্লেজ জড়ানো ব্রিটিশ আর্মি জিপের যাতায়াত। প্রায় নিভু আলো। জিপের গর্জনে সাইলেন্সার। অনেক নিচু দিয়ে উড়ে যায় জাপানি বম্বার— বোমারু বিমান। ‘নিপপন’, উদিত পূর্ণ সূর্য, তোজো— সব মিলিয়ে একটা অন্যরকম ছবি। জাপানি বোমারু প্লেনদের তাড়া করে ব্রিটিশ ফাইটার— সম্ভবত ‘স্পিটফায়ার’ তার নাম। কোহিমাতে খবর ভেসে আসে। আসছেন আসছেন নেতাজি— নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। সুভাষচন্দ্র বসু আর খালি হাতে আসছেন না। তাঁর সঙ্গে সশস্ত্র আজাদি সৈনিক। তাঁরাও আসছেন ইত্তিমাদ-ইনকিলাব-কুরবানি-র মন্ত্র নিয়ে। তাঁরা আজাদি সৈনিক। —কদম কদম বঢ়ায়ে যা…। কদম কদম বঢ়ায়ে যা…। কদম কদম বঢ়ায়ে যা… ইয়ে জিন্দগি হ্যায় কওমকি… কওমপে লুটায়ে যা। কদম কদম বঢ়ায়ে যা…। কদম কদম বঢ়ায়ে যা…। আজাদি সৈনিকরা আসছেন। সুভাষচন্দ্র বসু তাঁদের নেতাজি। নেতাজি। নেতাজি। কোহিমায় পোস্টেড ব্রিটিশ আর্মিতে থাকা বাঙালি ফওজিদের দু চোখে বিদ্যুৎ। স্বপ্ন। স্বপ্ন। সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যোগাযোগ করতে হবে। করতেই হবে যোগাযোগ। যেন তেন প্রকারেণ। যেভাবে হোক যোগাযোগ করতেই হবে। করতেই হবে। আনন্দগোপাল বাবু এবং তাঁর দুই বন্ধু, দুই বন্ধু পেয়েছেন তিনি আর্মিতে এসে, সেই বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে তিন বাঙালি যুবক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন যে করেই হোক, পিছিয়ে না গিয়ে, কোনো না কোনোভাবে তাঁরা যোগাযোগ করবেন— আজাদ হিন্দ ফওজ বা আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে। ইয়ে শের-এ হিন্দ তু আগে বঢ়… ইয়ে শের-এ হিন্দ তু আগে বঢ়… ইয়ে শের-এ হিন্দ তু আগে বঢ়…। আনন্দবাবু আর তাঁর ফওজি বন্ধুরা ধীরে ধীরে ঠিক করলেন যেভাবেই হোক আইএনএ— আজাদ হিন্দ ফওজ— আজাদি সেনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেই হবে। যুক্ত হতে হবে তাঁদের সঙ্গে। বাচ্চি খাঁ, জুম্মা খাঁ— দুই সুবেদারের খারাপ ব্যবহার, ব্রিটিশ অফিসারদের অতি খারাপ ব্যবহার, তার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স, মিলিটারি গোয়েন্দা— সামরিক গোয়েন্দারা অতিতৎপর বাঙালি সৈনিকদের গতিবিধির ওপর নজর রাখার ব্যাপারে। সমরক্ষেত্র, তার নিত্য বিপদ, জীবননাশের ঝুঁকি, ব্রিটিশ বাহিনীর তিন সৈনিক ক্রমাগত বিনিময় করছেন নিজেদের ভেতর, সকলের চোখ এড়িয়ে, নিভৃতে। প্রায় একক চেষ্টায়। সমরক্ষেত্র— যুদ্ধক্ষেত্র— রণাঙ্গন সরগরম। প্রতি মুহূর্তে আজাদি সৈনিকদের আগমন বার্তা ভেসে আসছে হাওয়ায়। ইত্তিমাদ-ইনকিলাব-কুরবানি— আজাদ হিন্দ সৈন্য দল— ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি— যাদের গতিবিধি ক্রমশ ছিন্নভিন্ন করছে ব্রিটিশের প্রতিরোধ— সেই আজাদি সেনাদের জীবন তুচ্ছ করা অভিযান, জয়যাত্রা— শাহদত— মৃত্যুবরণ— অগ্নিআখরে লেখা হচ্ছে যেন ইতিহাসের পাতায়। আজাদ হিন্দ রেডিও— আজাদ হিন্দ বেতার। আজাদ হিন্দ বাহিনীর নোট— কারেন্সি। তাতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ছবি। স্বপ্নের ফওজ— স্বপ্ন দেখানো সেনাবাহিনী ক্রমশ ক্রমশ এগিয়ে আসছে— ভারতবর্ষের দিকে— ভারতের মূল ভূখণ্ডের দিকে। মেন ল্যান্ড— মূল ভূখণ্ড। তারপর? তারপর? তারপর— চলো, চলো, চলো দিল্লি। এই রণধ্বনি সুভাষচন্দ্রের— এই রণ আহ্বান আইএনএ-র। আনন্দগোপাল ভট্টাচার্য আর তাঁর দুই বন্ধু— ব্রিটিশ মিলিটারির সহযোদ্ধা তাঁরা নিজেদের মধ্যে গোপন মিটিং করে ঠিক করলেন তাঁরা যেভাবে হোক মিট করবেন আজাদি সেনাদের সঙ্গে। ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স— আরও স্পষ্ট করে বললে, ব্রিটিশ মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স বনাম আজাদ হিন্দ বাহিনীর মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স, খবর-পাল্টা খবর, খবরের ওপর খবর। খবরের বাইরে খবর। মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স— সামরিক গুপ্তচর দল। তিন যুবক ব্রিটিশ মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের শ্যেনচক্ষু, কড়া নজর এড়িয়ে তাঁরা যোগাযোগ করলেন আজাদ হিন্দ ফওজের মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের সঙ্গে। আজাদি সেনার যে গিপ্তচর বিভাগ, গুপ্তচর বাহিনী তাদের সঙ্গে এই তিনটি বাঙালি ছেলের যোগাযোগ একসময় অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়াল। আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার তীব্র কামনাবোধ, তাদের মনের অতি জোরালো ইচ্ছে কেন যেন সফল হবে, হয়ে উঠবে সাকার, এমন একটা সার্বিক বিশ্বাস নিয়ে তিন যুবক এগোতে থাকলেন অনিশ্চিত অন্ধকারের দিকে। অতি বিপদসঙ্কুল সে পথ। পদে পদে বিপদ, প্রাণ হাতে করে পথ হাঁটা। চলাচল। ঠিক করে বললে, আরও নিশ্চিতভাবে বললে অনির্দেশ্য, অনির্দিষ্ট পথে তাঁদের যাত্রা। সেই যাত্রাকথা নাগাল্যান্ডের নিভৃত বনভূমি, পোকামাকড়, কোহিমা— সব, সব যেন মিশে যেতে চাইল এক বিন্দুতে। অস্থিরতা ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে তিন যুবকের সামনে। অতি অনিশ্চিত সেই পথ, সেই রাস্তায় ছড়িয়ে রয়েছে পদে পদে মৃত্যু আর প্রাক-মৃত্যুর আতঙ্ক।
আরও পড়ুন
বাঙালির নেতাজি বীজ
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
জুয়া মেলা, মেলার জুয়া, ঝান্ডিমুণ্ডি