‘মুছে যায়’-এর ৭৭ নম্বর ঘটনা ক্রমিকতায় ‘শৌলমারির সাধু’, সারদানন্দ, উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদ, ‘গুমনামি বাবা’— সব মিলিয়ে কুহকাবৃত্ত যে চারপাশ, সেখানে শৌলমারির সাধু যে সারদানন্দ, সেই বার্তাটুকু খুব একটা স্পষ্ট হয়নি। ‘শৌলমারির সাধু’ সারদানন্দ ও ফৈজাবাদের আরও রহস্যময় গুমনামি বাবা, এক ব্যক্তি নন। সারদানন্দ মুণ্ডিত মস্তক, কপালে লম্বাটে টানা টিপ— সম্ভবত সিঁদুরের। সুভাষ-আদল সেই মুখে তো নিশ্চয়ই, অন্তত ছবিতে। অন্যদিকে গুমনামি বাবা ফৈজাবাদে ‘আত্মগোপন’ করে থাকা সেই তথাকথিত সুভাষচন্দ্র— নেতাজি বোস অথবা চন্দ্র বোস, তাঁর তো মাথা জোড়া চকচকে টাক। ইন্দ্রলুপ্তির বা ইন্দ্রলুপ্তর সঙ্গে মানানসই— ব্যালেন্স করা লম্বাটে পাকা দাড়ি। চোখে গোল গোল সুভাষ-চশমা। ‘জাগৃহি’, ‘কড়া চাবুক’ শৌলমারির সাধুই যে নেতাজি, তা মনে প্রাণে, কায়মনো বাক্যে প্রমাণ করতে চেয়েছিল। ‘কড়া চাবুক’-এ তো ছাপাই হল— ‘সীমান্ত হইতে ভাসিয়া আসিছে নেতাজির নির্দেশ…’। ‘সন্তানদল’, তার প্রতিষ্ঠাতা বালক ব্রহ্মচারী, সংসার আশ্রমে যিনি বীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শ্রীচৈতন্যর বংশলতিকার সঙ্গে যাঁর নাম জড়ানো থাকে, প্রতারণার মামলায় যিনি জড়ান, তখনও তিনি ক্লিন শেভেন, কলপ করা কৃষ্ণ শ্মশ্রুশোভিত নন। কার্তিক মাসের দীপান্বিতা কালীপুজোর দিন তাঁর জন্ম, আর সেই দিনটিকে ঘিরে ‘ভক্তদের’ উন্মাদনা। ‘বর্তমান’-এ এক পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন, সেই অনুষ্ঠান উপলক্ষে। ‘সন্তান দল’-এর প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগে, ‘রামনারায়ণ রাম’ সন্তানদলের কীর্তনকথাও শ্লোগান হয়ে ওঠার আগেই বালক ব্রহ্মচারী বলেছিলেন, ভারতবর্ষে বিপ্লবের জন্য শুধু শ্রমিক-কৃষক হলেই চলবে না। প্রয়োজন প্রচুর, প্রচুর, প্রচুর ভিক্ষুকের অংশগ্রহণ। সত্তর দশকের গোড়ায় বালি শান্তিরাম রাস্তা দিয়ে বালক ব্রহ্মচারীকে বসানো সাদা অ্যামবাসাডার ঠেলে ঠেল নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর ভক্তরা। তখন নকশালবাড়ির আন্দোলন তুঙ্গ অবস্থায়। সেই সময়টাতেই নামে বালক ব্রহ্মচারী না হওয়া বীরেন্দ্র চক্রবর্তী। অখণ্ড চব্বিশ পরগনার সুখচরে আশ্রম করে ফেলেছেন তিনি। স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জবাহরলাল নেহরুর সঙ্গে বালক ব্রহ্মচারীর ছবি। আরও অনেক অনেক রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী জন, তাঁদের মধ্যে পশ্চিমবাংলার বাঙালি যেমন মিশে থাকতে চায়, বালকবাবুও মিশে ছিলেন, ছবির পাশে ছবি হয়ে। তারপর তাঁর পার্থিব শরীরের মৃত্যুর পর বালক ব্রহ্মচারী তো ‘পচা বাবা’ হলেন কালে দিনে। শরীরটি রাখা থাকল, পচন ধরল, ম্যাগট— মৃত মাংসখোর পোকারা কিলবিল করতে থাকল তাঁর কালো হয়ে যাওয়া শরীরটি জুড়ে। সেই সময়ে ‘আজকাল’ পত্রিকা খুবই ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছিল ‘পচাবাবা’-র গলে যাওয়া, ম্যাগট— মৃত মাংস খোঁটা, খাওয়া কিলবিলে পোকা সাজানো শরীরটি সুখচরের আশ্রম থেকে— সন্তান দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে তখনকার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুলিশ-প্রশাসনের পূর্ণ সহযোগিতায় বার করে নিয়ে আসতে। ‘আজকাল’ সম্পাদক অশোক দাশগুপ্তর সঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর তুমুল ঝামেলা থাকলেও এই সময়টায় তাঁরা— অশোক দাশগুপ্ত ও সুভাষ চক্রবর্তী সাময়িকভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। আমাদের অনেকেরই হয়তো মনে নেই তখনকার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য— লবির প্রভাব খর্ব করতে, ‘আজকাল’-এর পাল্টা একটি বাংলা দৈনিক সংবাদপত্র সুভাষ চক্রবর্তী পেছনে থেকে, মিঠুন চক্রবর্তীকে সামনে রেখে করেছিলেন। সেই পত্রিকা অবশ্য বেশিদিন চলেনি। সুভাষ চক্রবর্তীকে মিঠুন চক্রবর্তী ‘সুভাষ কাকু’ বলে সম্বোধন করতেন সুভাষ চক্রবর্তী বেঁচে থাকতে আর সুভাষ চক্রবর্তী মারা যাওয়ার পরও। সুভাষ চক্রবর্তী ক্ষেত্র গুপ্তর ছেলে পূষণ গুপ্তকে ভাঙিয়ে এনে এই দৈনিকটি করেছিলেন। অসীম চট্টোপাধ্যায়— কাকা তখন সেই বাংলা দৈনিকে কলাম লিখতেন নিয়মিত। অসীম চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুভাষ চক্রবর্তীর সম্পর্ক খুবই ভালো ছিল। আর দুজনেই ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বিরোধী লবির লোক। রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ডঃ অশোক মিত্রও প্রবল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বিরোধী ছিলেন। আপাতত থাক, এইসব প্রসঙ্গ। সুভাষ চক্রবর্তীর কথা উঠে এল সুভাষচন্দ্র বসু প্রসঙ্গে। প্রবল বাধার মধ্যে সুভাষ চক্রবর্তী বালকবাবা— ‘পচাবাবা’-র সৎকার করেছিলেন ত্রিশূল ঘেরা সন্তান দলের মধ্যে থেকে তুলে এনে। সন্তান দল-এর কীর্তন— নামগান— ‘রামনারায়ণ রাম’-এর পাশাপাশি তাঁদের পতাকায় ত্রিশূলের ছবিও থাকে। কেন ত্রিশূল, তা নিয়ে বালক ব্রহ্মচারীর নানা যুক্তি ছিল, তা নিয়ে আর বিস্তারে যাচ্ছি না। শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে অতি বিশ্রী ল্যাজ ওঁচানো ঘোড়ার পিঠে সুভাষচন্দ্রের মূর্তি বসানোর পর, তা নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। ষাটের দশকের শেষ লগ্নে অথবা সত্তর দশকের গোড়ায় গোড়ায় আনন্দবাজার পত্রিকা শিল্পী পূর্ণেন্দু পত্রী ও ভাবুক-ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজকে নিয়ে কলকাতার নবনির্মিত কয়েকটি মূর্তির কাটা-ছেঁড়া করায়। তার মধ্যে শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে সুভাষমূর্তি দেখে রামকিঙ্কর— কিঙ্করদার প্রধানতম মন্তব্যটি ছিল— ওটা কী? ওটা কী? ঘোড়ার বিচি! তার পরপরই হাঃ হাঃ হাঃ— সরব হাস্য। এসবই ছাপা হয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকায় পূর্ণেন্দু পত্রী— পূর্ণেন্দুদা ও রামকিঙ্কর বেইজ— কিঙ্করদার ছবিসহ। সম্ভবত শেষ পাতায়— আট নম্বর পাতায়। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল ১৯৩০-এর ১৮ এপ্রিল যে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ— সেই বিদ্রোহে, ২০ এপ্রিল ১৯৩০, জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে সেনাপতির ভূমিকায় ছিলেন লোকনাথ বল। লোকনাথ বলকে ‘লোকাদা’ বলে ডাকতেন হিন্দুস্থান রিপাবলিকান আর্মির বয়সে ছোটো সহযোদ্ধারা। লোকনাথ বলের প্রিয় ছোটো ভাই ছিলেন হরিগোপাল বল (টেগরা)। তিনি লোকনাথ বলকে ‘সোনাভাই’ বলে ডাকতেন। ২০ এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে ব্রিটিশ ফৌজের লুইস গান ঝাঁঝরা করে দেয় টেগরাকে। কারণ টেগরা মাঝে মাঝেই তার মাস্কেট— সিঙ্গেল শট রাইফেল নিয়ে লাগিয়ে লাফিয়ে উঠছিলেন ‘লোড-ভলি-ফায়ার’— এই রণধ্বনির মধ্যে। টেগরা জালালাবাদ পাহাড়ের আড়াল থেকে লাফ দিয়ে দিয়ে নিজের মাথা বের করে ব্রিটিশ আর্মির লুইস গানকে থামিয়ে দিতে চাইছিলেন। হল না। টেগরা— হরিগোপাল বলই থেমে গেল। যাওয়ার আগে এপ্রিলের গরম সূর্যের দিকে মুখ তুলে হয়তো সে বলতে চেয়েছিল, সোনাভাই, আমি চললাম। আর সেই কথার উত্তরে টেগরার সোনাভাই লোকাদা— লোকনাথ বল বলেছিলেন, সোনাভাই, কে সোনাভাই! সৈনিকের ধর্মই মৃত্যু। ডু অর ডাই, চালিয়ে যাও। সেদিনের ভয়ানক গরমে জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে ব্রিটিশ ফৌজ ও ব্রিটিশ বাহিনীতে চাকরি করা গোর্খা ভাইরা হেরে গেছিলেন বাঙালি স্বাধীনতা যোদ্ধাদের বিক্রমের কাছে।
লোকনাথ বলের কথা সুভাষচন্দ্র বসু প্রসঙ্গে উঠে এল, তার কারণ একই ধরনের চশমা পরা, ফর্সা লোকনাথ বলের একদম সুভাষচন্দ্র বসুর চেহারা। ফলে আত্মগোপন করতে বেশ অসুবিধা হত লোকনাথ বলের, অন্য অন্য যুব বিদ্রোহীদের তুলনায়। স্বাধীনতার পর— ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্টের পর লোকনাথ বলরা মুক্তি পেলেন। অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষরা গেলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে। লোকনাথ বলরা জাতীয় কংগ্রেস দলে। জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার পর লোকনাথ বল বড়ো ধরনের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন, কলকাতা পুরসভার বড়োসড় আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়ালেন এমন অভিযোগ ছিল। তিনি, কিন্তু আজকের সময়ে কোটি কোটি টাকার যে স্ক্যাম, তার সঙ্গে কোনো তুলনাই হয় না সেই আর্থিক কেলেঙ্কারির। লোকনাথ বল ও সুভাষচন্দ্রের চেহারার আশ্চর্য মিল। সে জন্যই চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ, শহিদ হরিগোপাল বল— টেগরা, জালালাবাদ পাহাড়ের সংগ্রাম— এইসব প্রসঙ্গে উঠে এল। অধ্যাপক সমর গুহ ছিলেন ঘোর কমিউনিজম বিরোধী নেতাজি পন্থী। প্রজা সোসালিস্ট পার্টি— পিএসপি-র হয়ে তিনি নির্বাচনে দাঁড়াতেন, লোকসভার আসনের জন্য। সম্ভবত অখণ্ড মেদিনীপুরের কোনো কেন্দ্র থেকে। প্রজা সোসালিস্ট পার্টির নির্বাচনী প্রতীপ কুঁড়েঘর। ডাঃ কাশীকান্ত মৈত্র এক সময় ছিলেন পিএসপি— প্রজা সোসালিস্ট পার্টির নেতৃত্বে। তিনি জড়িয়েছিলেন ভুষি কেলেঙ্কারিতে। ততদিনে কাশীকান্তবাবু অবশ্য জাতীয় কংগ্রেস ভেঙে তৈরি করেছেন ইন্দিরা কংগ্রেস। সুভাষচন্দ্রের মেজদাদা— শরৎচন্দ্র বসু ছিলেন খুব বড়ো ব্যারিস্টার, বিপ্লবীও। শরৎচন্দ্র বসু ও সুভাষচন্দ্রের চেহারা, মুখের আদলে অনেক অনেক অনেক মিল। মাথার নিখুঁত টাক, চশমাটি পর্যন্ত। সেই শরৎচন্দ্র বসুর ধুতি-পাঞ্জাবি পরা ছবির ধড় ও সুভাষচন্দ্র বসুর মুণ্ডু সুপার ইমপোজ করে জুড়ে সমর গুহ একটি ছবি নির্মাণ করে পেশ করলেন লোকসভায় আর একই সঙ্গে সাংবাদিকদের সামনে। নেতাজি সুভাষচন্দ্রের এমনিতেই ‘সুপার হিরো’ ইমেজ। তুখোড় বুদ্ধিমান, অনুমান নির্ভরতা, সুদর্শন, ‘অকৃতদার’, সাহসী। ‘অকৃতদার’ বললাম সারা ভারত ফরওয়ার্ড ব্লক আর সুভাষপন্থী কিছু মানুষ এখনও বিশ্বাস করেন সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে এমিলি শেঙ্কেলের প্রণয় ও বিবাহ, তারপর অনিতা বসু পাফ নামে কন্যাটির জন্ম— সবই সাম্রাজ্যবাদের ‘অপপ্রচার’ মাত্র। আর কিচ্ছু না। ফলে অতি সুদর্শনা এমিলি শেঙ্কেলের সঙ্গে ‘চিরবিদ্রোহী’, সন্ন্যাসী কাম সর্বত্যাগী বিপ্লবী সুভাষচন্দ্রের প্রেম ও বিবাহ তাঁরা মানতে পারেননি। আজও পারেন না। ফলে আনন্দবাজার পত্রিকার মলাট-কাহিনি রবিবারের সাময়িকীর মলাট-কাহিনিতে এমিলি-সুভাষের প্রেমকথা ছাপা হলেই ফরোয়ার্ড ব্লকের আনন্দবাজার পত্রিকা অফিস ব্লকেড— ঘেরাও করা আবিশ্যিক হয়ে দাঁড়ায়। যদিও শরৎচন্দ্র বসু ও তাঁর পুত্র ডাঃ শিশির বসু তাইহোকুর বিমান দুর্ঘটনা ও সেই দুর্ঘটনায় সুভাষের মৃত্যু, এমিলি শেঙ্কেলের সঙ্গে সুভাষের প্রেম, প্রণয়ান্তে বিবাহ, অনিতার জন্ম— সবই মেনে নিয়েছেন। এ নিয়ে অবশ্য অন্য অনেক কথাও আছে। যেখানে বলা হচ্ছে, ডাঃ শিশির বসুর কারাবাস— সুভাষচন্দ্রকে কাবুল যাওয়ার পথে ‘মহানিষ্ক্রমণে’ সাহায্য করা সবই নাকি অর্ধসত্য, অতিরঞ্জিত স্বকপোলকল্পিত। অমিয়নাথ বসু, সুরেশচন্দ্র বসু, সুব্রত বসু, এঁরা তাইহোকুর বিমান দুর্ঘটনা তো মানেনইনি। সুভাষকন্যা এমিলিকে সুভাষের স্ত্রী ও অনিতা বসু পাফকে সুভাষ-এমিলি তনয়া হিসাবে স্বীকারই করতে চাননি। সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে কত কত গর্বের জায়গা বাঙালির। পঞ্চাশের দশকে তো নেতাজি সেলুন বহু জায়গায়। কলকাতা শহরে, কলকাতা লাগোয়া মফঃস্বলেও। এছাড়াও ক্লাবের নাম ‘নেতাজি সঙ্ঘ’, নেতাজি পাঠাগার— কত আর বলা যায়। পুরনো কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট, এখন বিধান সরণী বহু বছর ধরেই শ্যামবাজার-হাতিবাগানের আগে, কলেজস্ট্রিট থেকে হেঁটে শ্যামবাজার— আসা-যাওয়ার পথের ধারে বাঁদিকের ফুটপাতের ওপর বি-ই-শা-ল তেলেভাজার দোকান। সেই দোকানে সুভাষচন্দ্রের একাধিক ছবির কোলাজ। সুভাষচন্দ্র সাইনবোর্ডে বিরাজমান, উল্টোদিকের গলির ভেতর বিশিষ্ট বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর বাড়ি। ল্যাম্পপোস্ট— স্ট্রিট লাইটের আলোয় সাবেক কালের মোটা গ্যালভানাইজড তারে বোনা ডিম রাখার খাঁচা চেহারার যেন আলো ঢাকনি। এই গলির মধ্যেই সুকুমার সামন্তর বাণী প্রিন্টার্স— কত কত দিনের পুরনো লেটার প্রেস। সুকুমার সামন্ত আর তাঁর কাকা মিলে প্রেস চালান, সে অনেক দিন আগের কথা। বহু বছর হল সুকুমার সামন্তর বাণী প্রিন্টার্স নেই। সুকুমারদা অসুস্থ— কিডনির অসুখে। তাঁর কাকা প্রয়াত হয়েছেন বহু বছর। এতসব কথা বলা এই জন্য, নেতাজি-ছবিঅলা সেই তেলেভাজার দোকান— যেখানে আলুর চপ, বেগুনি, ফুলুরি, পেঁয়াজি, কুমড়ি, পটলি, শীতে ধনেপাতার বড়া, আলুরি। শাকের বড়াও ছিল বোধ হয় বা আছে হয়তো সেই দোকানে, এখন আর মনে পড়ে না। সেই ছবিতে নেতাজি সমন্বিত দোকান থেকে সুভাষচন্দ্রের জন্মদিনে বিনা পয়সায় তেলেভাজা বিতরণ, লাইন দিয়ে। আর তেলেভাজা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডান হাতের আঙুলে আলতার ছাপ দিয়ে দেওয়া, যেমন কিনা সাধারণ নির্বাচন অথবা কর্পোরেশন— মিউনিসিপ্যালিটি ভোটের পর বাঁ হাতের আঙুলে কালির ছাপ। সুভাষ মার্কা বিড়ি, লুঙ্গি— সবই দেখেছি। সব ছবিতেই যোদ্ধা বা যুদ্ধের সেনাপতি বেশে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। যাঁকে চন্দ্র বোস বলেও চিহ্নিত করত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। সেলুনের দেওয়ালে দেওয়ালে গাঢ় নীল ব্যাকগ্রাউন্ডে ঘাড়ের কেশর ছাঁটা সাদা ঘোড়ার পিঠে নেতাজি। কোমরে তলোয়ার। ফুল মিলিটারি ইউনিফর্মে তিনি, কেন যে সেই সামরিক পোশাক নীল, জানি না। তবে সবুজও তো ছিল, মানে থাকত। নেতাজির নামে— সুভাষচন্দ্রের নাম জড়িয়ে গ্রন্থাগার, বইয়ের দোকান, জবরদখল উদ্বাস্তু কলোনি— রিফিউজি কলোনি হামেশাই। নেতাজি কলোনির পাশাপাশি অবশ্য গান্ধী কলোনি, নেহরু কলোনি, লেনিন নগর— সবই আছে। সুকান্ত কলোনি, রবীন্দ্র কলোনিও। এসব কথা আগেও লিখেছি অন্য অন্য প্রসঙ্গে। বাঙালিকে ‘নন মার্শাল রেস’ হিসাবে চিহ্নিত করেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। বাঙালি যে ‘নন মার্শাল’ রেস নয়, তার প্রমাণ দিয়েছেন বালেশ্বরে বুড়িবালাম নদীর তীরে ট্রেঞ্চ যুদ্ধে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়— বাঘাযতীন, চিত্তপ্রিয়, মনোরঞ্জনরা। পরে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ— মাস্টারদা সূর্য সেন ও তাঁর সহযোদ্ধারা, বিনয়-বাদল-দীনেশদের রাইটার্স অভিযান। এবং অবশ্যই আজাদ হিন্দ ফৌজের বীরত্ব গাথা। তবু বাঙালি পল্টন বা বাঙালি রেজিমেন্ট নেই, ভারতীয় সেনাবাহিনীতে, যা ছিল বহু বছর আগে, পরাধীন ভারতে। বাঙালি রেজিমেন্ট তৈরির দাবি জানিয়েছে বিজয় সেনা ও আমরা বাঙালি। সেসব দেওয়াল লিখনে কিচ্ছু হয়নি। আসলে বাঙালি রেজিমেন্ট বিদ্রোহী হতে পারে, এই ভয় শাসকের, আছেই। আজও আছে। ছোটোবেলায় কতগুলো কথা শুনেছিলাম। সত্যি-মিথ্যে জানি না। সেনাবাহিনীর কোনো জায়গায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর কোনো ছবি বা মূর্তি রাখা নিষেধ। পণ্ডিত জবাহরলাল নেহরু নাকি বলেছিলেন, সুভাষ যদি ভারতে ঢোকে, তাহলে আমি তাকে তরবারি হাতে নিয়ে স্বাগত জানাব। এই কথারও সত্য-মিথ্যা জানা নেই। আসলে বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও মুসলমান বাঙালির একটা অংশ নেতা মেনেছেন নেতাজি— সুভাষচন্দ্র বসুকে। এই মানা না মানার মধ্যে কাজ করেছে অনেক অনেক আবেগ, কিছু অঙ্কও। প্রকৃতপক্ষে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। নেতা অনেক কিন্তু নেতাজি তো একজনই। সামনের এপিসোডে— ‘মুছে যায়?’-এর ৭৯ নম্বর কথাযাত্রায় থাকবে কোহিমাতে ব্রিটিশ মিলিটারিতে থাকা আমার শ্বশুরমশাই আনন্দগোপাল ভট্টাচার্য আর তাঁর কয়েকজন বাঙালি সঙ্গীর— তাঁরাও সেনাদলে ছিলেন, নেতাজির সঙ্গে দেখার করার চেষ্টা। আর থাকবে বাগবাজারে নেতাজিদাদুর দুর্লভ থেকে নেতাজি দাদু হয়ে ওঠার কাহিনি।
Powered by Froala Editor