ঝান্ডিমুণ্ডি এক ধরনের জুয়া। হাঁড়িখেলা আর এক ধরনের। কলকাতার বড়োবাজারে ষাট, সত্তর, আশির দশকে বসত হাঁড়িখেলার আসর, আয়োজন। এখনও হয়তো বসে। নাকি ডেইলি লটারি ‘লোটো’ ইত্যাদির আবির্ভাবের পর তাহার কদর কমিয়াছে? ঝান্ডিমুণ্ডি নামের জুয়া খেলা হয় মূলত মেলায়। বিশেষ করে অখণ্ড বিহারের শোণপুরের পশুমেলায়। যেখানে শোণ নদের পাড়ে, বালির ওপর, খোলা মাঠে কার্তিকী পূর্ণিমায় হাতি, ঘোড়া, উট, খচ্চর, গরু, মোষ, ষাঁড়, বলদ— সব বিক্রি হয়। এই মেলাতে বিক্রির জন্য আসা অতিকায় কোনো মহিষ ও বলদের আকার দেখে রীতিমতো বিস্ময় লাগে। হয়তো ভয়ও লাগে কখনও। শোণপুরের মেলায় পঞ্চাশের দশকে বিক্রি হত মানুষও, বিশেষ করে নারী, বালিকা আর বালক। সেসব একেবারেই অন্য অভিজ্ঞতা। আপাতত থাক সেইসব অভিজ্ঞতার বিবরণ। ঝান্ডিমুণ্ডি খেলা হয় মূলত মেলায়। সেই খেলার নানা তরিকা, পদ্ধতি লক্ষ করেছি। ভারত-নেপাল সীমান্ত অখণ্ড বিহার দিয়েও পেরনো যায় সেই সীমান্তরেখা, জনকপুর ইত্যাদি, মৈথিলি কালচার, ভাষার সঙ্গে নেপালের কথ্য ভাষার কখনও কখনও খুব মিল খুঁজে পেয়েছি। পশুপতি বা কাঠমাণ্ডুতেও দেখেছি ঝান্ডিমুণ্ডির নানা আয়োজন। একবার ইন্ডিয়া থেকে নেপাল ঢুকে পড়তে পারলে হল। পশুপতি, কাঠমাণ্ডু— সবখানেই মেলায় মেলায় অনায়াস ঝান্ডিমুণ্ডি। মেলা মানেই ঝান্ডিমুণ্ডির আসর। কলকাতার বড়োবাজারে লোকাল সাট্টা, হাঁড়িখেলা— সবই ছিল। ‘ভূতনাথ’ নাম ছিল একটি লোকাল সাট্টা কোম্পানির। ‘ভূতনাথ’-এর নামে এখনও সাট্টা চলে কিনা জানি না। সাট্টা বোম্বাই বা মুম্বাইয়ের অতি পুরনো জুয়া। বড়োবাজারের যে সাট্টা, হাঁড়িখেলা— তার সঙ্গে মুম্বাই বা বোম্বাইয়ের কোনো সম্পর্কই নেই। এক থেকে নয়, শূন্য থেকে নয়— এই হচ্ছে নম্বর। শূন্য— সাট্টারুদের ভাষায় বিন্দি। এছাড়া চার— চৌয়া, তিন— তিগ্গি, ইক্কা— এক, দুই— দুগ্গি, পাঁচ— পাঞ্জা, ছয়— ছক্কা, সাত— সাত্তা, আট— আঠ, নয়— নয়লা। কলকাতার সাট্টাজগৎ ছিল বহু বিস্তৃত। ‘দৈনিক বিশ্বামিত্র’ ও ‘সন্মার্গ’-এর পাতায় যে ছোটো কার্টুন ছাপা হত, এমন কি ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-য় চণ্ডী লাহিড়ীর আঁকা পয়লা পাতার কার্টুনেও নাকি লুকিয়ে থাকত সাট্টার লাকি নম্বরের সংকেত। জেতার সম্ভাব্য সেই নম্বর ধরে ধরে তৈরি হয়। তবে সাট্টারুদের কাছে হিন্দি খবরের কাগজ ‘দৈনিক বিশ্বামিত্র’, ‘সন্মার্গ’ ও ‘ছাপতে ছাপতে’-ও নাকি খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকত সাট্টা-সংকেত। একজন টাকমাথা বৃদ্ধের হাতে বাঁচানো হাতল সমেত লাঠি থাকলে ওপেন-এ বিন্দি— মানে শূন্য আর ক্লোজে সাত্তা— মানে সাত। এই হচ্ছে হিসেব। বৃদ্ধ মানুষের টাক মাথা মানে বিন্দি— শূন্য। আর বাঁকানো হ্যান্ডেল সমেত লাঠি হচ্ছে সাত্তা— সাত। ওপেন-এ তাই বিন্দি খেলার কথা বলবে পাক্কা সাট্টাবাজরা, যারা গণিত অনুযায়ী নাকি ওপেন টু ক্লোজ— সব মিলিয়ে দেয়। সারাদিন এই হিসেব-নিকেশ চলত। বহু লেখাপড়া জানা মানুষ চলে এলেন সাট্টা-ক্যালকুলেশন— সাট্টার হিসেব-টিসেব করতে। সেটা ১৯৭৩-৭৪। নকশাল ধারার আন্দোলন প্রায় অস্তমিত। দল, উপদল, পারস্পরিক অবিশ্বাসে খণ্ড-বিখণ্ড। তখনই সাট্টা। কলকাতা আর বোম্বে বা বোম্বাইয়ের সাট্টা। বোম্বে বা বোম্বাই তখনও মুম্বাই হয়ে ওঠেনি।
‘নাসপিটে’ বলে একটি সেমি অপশব্দ আছে হিন্দিতে। ‘নাসপিটে’-র অর্থ গর্ভস্রাব। সাট্টাবাজদের হিন্দু বাঙালি মধ্যবিত্ত অনেক সময়েই গর্ভস্রাব বলে সম্বোধন করতেন মনে মনে। কারণ তখন তথাকথিত বহু ভদ্র বাড়ির বধূ— বউ, মেয়েরাও তাদের বাড়ির কর্ম, সহায়িকা— কাজের লোকদের মুখে মুখে চলা— তখনকার ‘ঝি’-দের দিয়ে সাট্টা খেলান। প্লেন— সাধারণ জিত হলে এক টাকায় সাত টাকা। আবার পাত্তি সে পাত্তি, পাত্তি সে ফিগার হলে অনেক, অনেক টাকা। সব চাইতে বেশি পেমেন্ট জুড়ি মিলিয়ে দিতে পারলে। কলকাতা সহ সারা দেশেই প্রায় তিন তাসের জুয়া চলে। সেইসঙ্গে ফ্ল্যাসা, কিটি, রামি— এইসব তাসের জুয়া।
উত্তরপ্রদেশের ইলাহাবাদে দেখেছি কাট পাত্তিতে জুয়া চলে, তাসের জুয়া। নারীরা তাসে বিন্তি, কাটপাত্তি খেলেন। ব্রে, কনট্রাকট ব্রিজ, ব্রিজ— এসবই তাসের খেলা। জুয়া নয়। তাতে, মানে কম্পিটিশনে জিতলে পুরস্কার ছিল কনট্রাকট ব্রিজে। হরতন, রুইতন, চিড়েতন, ইস্কাবন বা ইস্কাপন। হার্ট, স্পেড ইত্যাদি ইত্যাদি। টেক্কা মানে এক, সেইসঙ্গে বাদশা, বেগম বা বিবি, গোলাম। বিষ্ণুপুরের দশাবতার তাস একদম আলাদা। এরই কাছাকাছি, আবার কাছাকাছি নয়ও, এক ধরনের তাসের খেলা চালু ছিল রাজস্থানে। এখনও আছে, খুব অল্প কিছু জায়গায়। সেই খেলার নাম গঞ্জিফা। গঞ্জিফা নামের তাস খেলার তরিকা একেবারেই স্বতন্ত্র। আর সেই তাসবাজি চলে সে মোঘল-ভারতের সময় থেকেই। গঞ্জিফা বা দশাবতার তাসের প্রসঙ্গ এখন থাক। আমরা বরং সত্তর-আশির দশকে যে বাড়ির লোকেদের ‘ঝি-মাগি’, ‘ঝি’, ‘কাজের লোক’ বলার রেওয়াজ ছিল, তা খুব স্বাভাবিকভাবেই অবসৃত। ‘ঝি-মাগি’ ছাড়াও ‘মেথর-মাগি’ এসে কামিয়ে গেল, পায়খানা, এবার ওকে জল দে। ষাটের দশকের গোড়ায় কলকাতার গা-লাগোয়া মফসসল শহরেও খাটা পায়খানা। পায়খানার নিচে পোড়া মাটির তৈরি বড়ো ডাবায় গুজসা হয়। বর্ষায় তার ভেতর সাদা সাদা কিলবিলে বড়ো বড়ো গুয়ের পোকা। তখন তো একটি প্রচলিত কথাই ছিল— ‘শুনে শুনে কতা কয়, গুয়ের পোকা বেছে খায়’। লোহার, বড়ো ডাবু হাতা দিয়ে ডাবা থেকে মল তোলা হত। তখন কোথায় হ্যান্ড গ্লাভস, কোথায় মুখ ঢাকনি। সপ্তাহে একদিন বা দুদিন সাফ করা হত গুয়ের ডাবা। ইলাহাবাদে সত্তর দশকেও দেখেছি খাটা পায়খানা। আর তাতে কোনো পাত্র— ডাবা রাখার ব্যবস্থা নেই। ত্যাগ করা বর্জ্য পড়ে ছিটকে, ছেতরে থাকে শুকনো, পাতলা, আধ শুকনো। তাদের কাচিয়ে নিতে হয় লোহার তৈরি বেঁটে ও লম্বা হ্যান্ডেল অলা এক বস্তু দিয়ে। অনেকটা যেন বন্দুকের বাঁট। ওইরকমই শেপ প্রায়, তবে বেশ খানিকটা চওড়া, পোক্ত। ইলাহাবাদ বা পশ্চিমবঙ্গ— সর্বত্রই প্রায় মেথর-মাগি কামিয়ে নিয়ে গেল পায়খানা, এই কথা বলার রেওয়াজ ছিল বাঙালিদের মধ্যে, ইলহাবাদ প্রবাসী, বেনারস প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যেও। পায়খানা থেকে গু পরিষ্কার করা মানে পায়খানা কামানো। এ যেন দাড়ি কামানো, এরকম একটা ব্যাপার। কিন্তু ‘নাম কামানো’ বা ‘টাকা কামানো’ নয়। ‘ঝি-মাগি’, ‘মেথর-মাগি’-র সঙ্গে অবধারিত ভাবেই প্রচলিত ছিল ‘বেশ্যা-মাগি’, তার সঙ্গে ‘গয়লানি-মাগি’, ‘ফুলওয়ালি-মাগি’ ইত্যাদি। মাগি, মিনসে, পোঁদ, গু, মুত, ড্যাকরা, ফলনা, এইসব শব্দ অনায়াস উচ্চারিত ও প্রচলিত ছিল পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালিদের মধ্যে। সেই সঙ্গে সকড়ি-এঁটো— বাঙালরা যাকে বলে ‘আইঠা’, যেমন আস্তাকুঁড়কে বাঙালরা বলেন ‘ছিটাল’, তেমনই পশ্চিমবঙ্গবাসী অনায়াসে ‘হেগো’, ‘মতো’ ইত্যাদি বলতেন। হিন্দু বাঙালির ভেতর এই উচ্চারণ প্রচলিত ছিল। ‘হেগো-লগ্নে’ বিয়ে হওয়ার কথাও বলা হত। শেষ রাতে, প্রায় ভোরে বিয়ের লগনসা বা লগ্নকে পশ্চিমবঙ্গবাসী ঘটিরা বলতেন, বলেন, হেগো লগ্নে বিয়ে। হেগো লগ্ন। মনে আছে খুবই নামকরা ফুটবল কোচ, ততটা নামি ফুটবলার একেবারেই নন, অমল দত্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমার বিয়ে হয়েছিল হেগো লগ্নে। অর্থাৎ প্রায় ভোর ভোর। ‘হেগো কাপড়’, ‘মুতো কাপড়’, ‘বাসি কাপড়’, ‘এড়া কাপড়’— এইসব নিয়ে ঘটিদের— পশ্চিমবঙ্গবাসীদের চিন্তা বেশি। তাঁদের চিন্তা ‘হেগো পোঁদ’, ‘হেগো কাপড়’ ইত্যাদি নিয়ে। বাঙালরা এসব নিয়ে অত ভাবিত নন মোটেই। তাঁরা স্নানে বিশ্বাসী। ঘটিরা ‘ছোঁয়া’, ‘ন্যাপা’ ইত্যাদি নিয়েও খুব ভাবিত। সে সব কথা নিয়ে খুব বেশি লেখা টেখা হয়নি। যা আছে তা মুখে মুখেই— ওরাল টেক্সট। তবে সত্তর শকেও মাথায় মল বহনকারী নারীরা ছিলেন সর্বত্র, শহরে কম, প্রায় নেই-ই, কিন্তু কলকাতার গা-লাগোয়া মফসসলে তাঁরা অনেক, অনেক। বালিতে তো মেথর পট্টি বা মেথর পাড়া ছিল। সেখানে খাটা পায়খানা পরিষ্কার করা নারী-পুরুষ। মাথায় করে মোটা টিনের তৈরি মাথাকাটা শঙ্কু চেহারার মলভাণ্ড বহন করে নিয়ে যান তাঁরা। তাঁরা শাড়ি রঙিন— রঙদার শাড়ি পরেন। নয়তো সুতির খাটো ঘাগরা। যার ঢাকা-চাপা থেকেও অনেকটাই দেখা যায় পা। পায়ের গোছ। এঁদের হাতে, পায়ে, এমনকি পেটেও উল্কি— বড়ো, নীলচে, গা শিরশিরোনো। এঁদের মাথায় ‘ভদ্র’ বাবু-বিবিদের মলভার। তার ভেতর— সেই দুর্গন্ধময় বর্জ্যের ভেতর সাদা সাদা কিলবিলে পোকা। ইলাহাবাদে যে মেথরানি— এমনই সম্বোধনের রেওয়াজ ছিল তাঁদের। ভাঙ্গি, মেতর, হরিজন— এইসব বলার চালু রেওয়াজ। তখনও সাফাইকর্মী শব্দটি চালু হয়নি। যেমন চালু হয়নি যৌনকর্মী শব্দটিও। এইসব মলবহনকারী নারীদের মুখে, কানের পাশে নীল উল্কি। থুতনিতে তিনটে বিন্দু শুধু। হাতে ঈগল— ডানা মেলা, নয়তোবসা, সেইসঙ্গে ছোরা। এঁরা বাশের কাজ করতেন। বাঁশ থেকে তার সরু অংশটি বার করে ঝুড়ি— বড়ো ঝুড়ি, ছোটো ঝুড়ি, বেতের ঝুড়ি, বাঁশের ঝুড়ি— ছোটো, বড়ো। মুড়ি-বাতাসা খাওয়ার বেত বা বাঁশের ছোটো ছোটো ঝুড়ি। বেতে বোনা ঝুড়িকে বলা হত ধামি। বড়োসড় ঝুড়িকে ঝোড়া। ধামির অনেক অনেক বড়ো চেহারার ধামা। জুয়ার কথা হচ্ছিল। শুরু হয়েছিল সেই জুয়া দিয়েই। ষাট ও সত্তর দশকে বালি স্টেশনের নিচে জুয়ার ঠেক বসত। অসতর্ক, কিছু লোভী, কৌতূহলী ও অচেনা লোককে ডেকে এনে তাকে প্রথম দু এক হাত জিতিয়ে দিয়ে, পরে থাকে পুরোপুরি মুরগি করা। সর্বস্ব নিয়ে নেওয়া লুটপাট করে। বালিতে— বালি স্টেশনের কাছে জুয়ার ঠেক ছিল গোটা দুই। তিনও হতে পারে। এই ঠেক চালাতেন গোলাম। গোলামদা বলে তিনি পরিচিত। অনেক টাকার ডিল। তখনকার দিনে, ষাট, সত্তর দশকে। গোলামের সঙ্গে, আমাদের সঙ্গে পড়ত মিলন— মিলন ব্যানার্জি, তার ভালো র্যা পো ছিল। মিলন বালি ঘোষপাড়ায় থাকত। বাড়ির অবস্থা ভালো। সামান্য রগচটা। কথায় কথায় প্রায়ই হাত চালিয়ে দেয়, সেই মিলন গোলামের সঙ্গে খুব ক্লোজ। গোলামের গ্যাংয়ের পাক্কা জুয়াড়িরা বালি স্টেশনের কাছাকাছি বা স্টেশনের আশেপাশে সব সাজিয়ে বসত। কাগজ পেতে তারপর— তার ওপর কার্বাইডের আলো, সন্ধের মুখে মুখে। তাস, তাস, তাস। জুয়ার আয়োজন। গোলাম-গ্যাংয়ের লোকেরা জুতোর চওড়া ফিতে আর উড পেনসিল দিয়ে একটা ফাঁসের খেলা খেলত। পুরোটা ট্রিক আর জোচ্চুরি। কাঠ পেন্সিলের সঙ্গে ঘেসো রঙের জুতোর চওড়া ফিতে বাঁধিয়ে দিতে পারলে ব্যস, জিতে গেলে টাকা। কিন্তু টাকা গচ্চা যাবে, যদি জুতোর সেই চওড়া ফিতে ফসকে যায় পেন্সিলের গা থেকে। তাহলে তো চিত্তির, সব টাকা, টাকা তো নয়, পয়সাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, গেল। পুরোটাই জলে চলে গেল। ভরল জুয়াড়িদের পকেট। গেঁজেও। এই জুতোর ফিতে আর উড পেন্সিলের খেলা খুব হত বেলুড় রাসবাড়িতে— রাসের মেলায়। কার্তিকী পূর্ণিমায় রাসের মেলা— রাস পূর্ণিমায় শুরু হয় রাস। প্রথম পনেরো দিন পূর্ণ রাস। তারপর পনেরো দিনের ভাঙা মেলা। বালি নয় বেলুড় রাসবাড়িতে বি-ই-শা-ল রাসের মেলা। বড়োসড় রাসমণ্ডপ। তারপর নানা ধরনের দোকান। ছুরি, কানপুরিয়া, নেপালা বা ন্যাপলা, বাঁশপাত্তি, গুপ্তি, কানপুরিয়া। রামপুরিয়া, টাঙি। টাঙি আবার দুরকমের, ফেঁউসা— যার চেহারা পাকানো গোঁফ যেন, আর একটা অর্ধেক চাঁদ যেন। সেইসঙ্গে তলোয়ার। ইয়েস, শোর্ড। আর আছে চিড়িয়াখানা। সেখানে শেয়াল, হায়না, বাঘরোল, মেছো বিড়াল, বাঘের বাচ্চা, লজ্জাবতী বাঁদর, হনুমান, বাঁদর, ময়াল সাপ, শিম্পাঞ্জি। বাইরে একটা বড়োসড় ব্যানার, তাতে পাহাড়, নদী, আফ্রিকার জঙ্গল হেন বনানী। সবুজ। জীবজন্তু। এই সার্কাসে চার আনা টিকেট কেটে ঢোকার মুখে একটা খুব বড়োসড় পেলিক্যান, ধূলি-মলিন সাদা গা ময়লা, লম্বা, চওড়া শক্ত ঠোঁট দিয়ে ক্রমাগত নিজের গায়ের— পাখনার পওকা খুঁটে চলেছে। পাশেই একজন জোকার কালো পোশাক পরে মুখ থেকে বার করে আনছে আগুনের স্রোত। অনেক পরে জেনেছি মুখের ভেতর কেরোসিন তেল রেখে এই আগুনবাজি করতে হয়, খেলতে হয়। সেই জোকারের হাতে একটা সরু গলা সমেত কাচের কালো শিশি। এই মেলাতে মৎস্যকন্যা আছে। কাটামুণ্ডু, কাটা শরীর, হাত-পা জোড়া লাগানোর খেলা দেখায় জাদুকর। তার তাঁবুতেই আছে নর রাক্ষসের খেলা। যে নররাক্ষস জ্যান্ত মুরগি ছিঁড়ে ছিঁড়ে কাঁচা খায়। বেলুড় রাস মেলায় আছে ছবি তোলার জায়গা। পিসবোর্ডের মোটরবাইক, তাজমহল। তার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার ব্যবস্থা। এছাড়াও নিজের ডাবল রোল— নিজের সঙ্গে নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, বক্সিং হতে পারে, হতে পারে অন্য কোনো দাও পেঁচ। বেলুড় রাসবাড়ির রাসের মেলায় ভাজা বাদ্ম, মটর, ছোলা আর ভুট্টার খই ভাজার শব্দ, গন্ধ। কালচে হয়ে যাওয়া বালির ওপর জেগে ওঠে ভুট্টার খই, ফুটে ওঠা ভুট্টার খই। যা কিনা হালফিলের বেশ দামি হয়ে ওঠা পপকর্ন। আর একটু বেশি মশলাদার, সল্টি, ভালো প্যাকেজিং গেটআপ হলেই পপকর্ন। পপকর্ন। পপকর্ন। কুড়মুড়। কুড়মুড় রসনার। নিবিড় পুলক। বেলুড় রাসের মেলায় ইলেকট্রিক আলো সামান্য। বেশিরভাগ দোকানেই পেট্রোম্যাক্স, হ্যাজারক, ডে লাইট, নিদেনপক্ষে কার্বাইডের আলো। মেলায় এসেছে কবিরাজি, হেকিমি, জড়িবুটি, যৌনশক্তি— যৌন ক্ষমতা— সেক্স পাওয়ার বর্ধক সাঁডার তেল, সাঁডে কা তেল। বাতের ব্যথা মারার জন্য ধনেশ পাখির হাড়ের তেল। সঙ্গে আবার একটি জ্যান্ত ধনেশ পক্ষী, তানসেন গুলি, তাতেও বাড়ো যৌন ক্ষমতা, শিলাজিত বা শিলাজতু, কস্তুরী মৃগের নাভি— মৃগনাভি, যা অধিকাংশ কেন, সবক্ষেত্রেই আসলে ছাগলের চামড়া জড়ানো। সতার সেই বাহারs, যাকে তো গন্ধবাহার— অগর ইত্যাদি অথবা আরও কোনো কোনো অতি উগ্র ঘাণ, যা নাকে দিলে প্রায় নাক জ্বালা করে ওঠে। বন্ধ হয়ে আসে ঘ্রাণেন্দ্রিয়র সূক্ষ্মতম অনুভূতি কোষ। বেলুড় রাসবাড়ির রাসের মেলায় বিক্রি হয় বাঁধানো ছবি। নেতাজি সুভাষচন্দ্র, মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত জবাহরলাল নেহরু, রাজেন্দ্রপ্রসাদ, ডঃ সর্বোপল্লী রাধাকৃষ্ণণ, ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়, এরকম আরও অনেকে। সমস্ত মেলাজুড়ে ডে লাইট, পেট্রোম্যাক্স, হ্যাজাক, কার্বাইডে জ্বলা বাতি। হ্যাজাকের শোঁ শোঁ শোঁ আওয়াজ, পাম্প দেওয়ার শব্দ— অনেকটা যেন প্রাইমাস স্টোভে পাম্প দেওয়া হচ্ছে। পেতলের প্রাইমাস স্টোভ। যা বেশি পাম্প দেওয়া হয়ে গেলেই ধু-উ-উ-ম করে ফাটে, দুর্ঘটনা ঘটায়, জীবনহানিও হয় হয়তো।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
মিসা ছিল ‘মিছা’-র নামান্তর