লিলুয়া রেল কোয়ার্টার্স, গুলমোহর বা গোলমোর খুবই নামটামঅলা জায়গা। ষাটের দশকে, সত্তরের গোড়ায় গুলমোহর বা গোলমোরে সার্কাস লাগে। ওরিয়েন্ট সার্কাস, জেমিনি সার্কাস, ওরিয়েন্টাল সার্কাস। লিলুয়ার ধ্রুব সিং, কেবল সিংরা ছিল বড়ো তোলাবাজ, বাহুবলী। ষাটের দশকে ‘বাহুবলী’ শব্দটি মিডিয়া-মণ্ডিত হয়ে ওঠেনি। তখনও গুণ্ডা সমাজবিরোধী, মাস্তান, এই সব শব্দাবলিতে চিহ্নিত করা হত এদের। ধ্রুব সিং ও কেবল সিং মূলত লোহার ছাঁট— বাবরি, রেল ওয়াগনের টানা মাল নিয়ে, রেল ওয়াগান ব্রেক করার পর সেই ওয়াগান ব্রেকিংয়ের মাল নিয়ে ‘কাজ’ করত— বিক্রি করত। ওয়াগন ব্রেকার বা ওয়াগন ভাঙিয়েরা ষাট দশকের শেষে আরপিএফ ও রেলওয়ে পুলিশ, এদের মধ্যে নিজেদের রেখে নিজেদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলত। মালগাড়ির ডালা ভেঙে চিনি, প্যান্ট-জামার কাপড় পেয়ে গেলে তো একেবারে সোনায় সোহাগা— সোনে পে সুহাগাও বলা যেতে পারে। সেইসঙ্গে যদি গুঁড়ো দুধ— মিল্ক পাউডার, পাউডার হয়, তাহলেও তো দারুণ। রেলওয়ে পুলিশ আর আরপিএফ-এর মধ্যে একটা অচেনা ও চেনা রেষারেষি ছিল। সেই সঙ্গে সঙ্গে রেল পুলিশের এলাকা, বেঙ্গল পুলিশের এলাকা— এই সমস্ত নিয়েও নানা কাটাকাটি ও যোগবিযোগ ছিল, ক্ষমতার। রেল পুলিশের এলাকা, আরপিএফ-এর এলাকা, বেঙ্গল পুলিশের টেরিটরি। ১৯৫৬-১৯৫৭ সালে যখন আমরা শিবপুরের চাষা ধোপা পাড়া লেনে, ঢ্যাঙ মশাইদের বাড়ি ভাড়া থাকি, তখন খুব কাছেই শালিমার ইয়ার্ড। সেই চাষা-ধোপা পাড়া লেনের যে বাগান ঘেরা বাড়ি, সেখানে খুব বড়ো প্রাচীন একটা পেয়ারা গাছ। তার বেশ মোটাসোটা গুঁড়ি, কাণ্ড। আর ছিল অনেক অনেক ফুল গাছ। নারকেল বৃক্ষ সেই পেয়ারা গাছড়ি বারো মেসে পেয়ারার, খুব স্বাদু। ভোদো বলে এক পাগলা ছিল এলাকায়। সেই ভোদো পাগলা ছিল অতি বিখ্যাত বা কুখ্যাত। আর ছিল এক প্যান্ট-শার্ট পরা পাগল। ফুলহাতা শার্ট ইন করে গুঁজে পরা ফুলপ্যান্টের ভেতর। মাথার চুলে ব্যাকব্রাশ। মুখে বিড়বিড়, হাতে পাকানো ‘স্টেটসম্যান’। এই চাষা-ধোপা পাড়ার ভাড়া বাড়ি থেকে শিবপুর ট্রাম ডিপো আর হাওড়া স্টেশন খুব দূরে নয়। আমার রেল চাকুরে বাবা অমরনাথ রায় গাড়ি ভাড়া বাঁচাতে হেঁটে হেঁটে যেতেন চাষা-ধোপা পাড়া লেন থেকে হাওড়া স্টেশনে, তাঁর অফিসে। আরপিএফ আর জিআরপি— এদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, রেষারিষি ছিল বরাবরই। বেঙ্গল পুলিশ, আরপিএফ, জিআরপি-এর মধ্যে ক্ষমতার টানা-পোড়েন দেখেছি বহুবার। শিবপুর ট্রাম ডিপো বন্ধ হয়ে যায়, সম্ভবত সত্তর দশকের শেষ লগ্নে, নয়তো আশির গোড়ায়। তখনও কলকাতায় দুই দরজাওয়ালা ট্রাম। এরকম ট্রাম দেখেছিলাম চার্লি চ্যাপলিনের ‘পে ডে’ নামের ছবিতে। যাঁরা চেকার, ট্রামের, তাঁদের মাথায় কালচে-নীল ফরাসি স্টাইলের টুপি। অনেকটা যেমন একদা ফরাসি রাষ্ট্রপতি দ্যগল বা ডিগল যেমন টুপি পরতেন। এই টুপিতে আবার সুতোর কাজ। তখন কলকাতার ট্রামে অল ডে টিকেট। ট্রামের ফার্স্ট ক্লাস মানে গরমের হাওদাখানা। গাড়ির সিলিংয়ে লোহার খাঁচার ভেতর ফ্যান। সেই ফ্যান রীতিমতো ঘোরে। ট্রাম কোম্পানির টিকিট চেকারদের কথা বললাম, সটুপি। কিন্তু যাঁরা কন্ডাকটার তাঁদের মাথায় কোনো টুপি নেই। তবে তাঁদের বুকে চামড়ার কালো ক্রসবেল্ট। সেই বেল্টের গায়ে পেতলের তৈরি পাঞ্চিং মেশিন, অনেকটা যেন পিস্তল, এভাবেই ফিট করা। পরে আশি-নব্বইয়ের দশকে এই টিকিট পাঞ্চিং মেশিন পেতলের বদলে লোহার হয়ে যায়। ট্রাম কোম্পানি— কলকাতার ট্রাম কোম্পানি, ব্রিটিশ পুঁজি পরিচালিত সিটিসি— ক্যালকাটা ট্রাম কর্পোরেশন— যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর অধিগ্রহণ করা হয়। অধিগ্রহণের এই পদক্ষেপ তখনকার দিনের নিরিখে শুধু কেন, এখনকার প্রেক্ষিতেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমাদের অনেকের স্মৃতিতেই কলকাতার ট্রাম আন্দোলনের স্মৃতি মনে আছে। পঞ্চাশের দশকে— স্বাধীনতার পর পরই ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে সারা কলকাতা জুড়ে সে ছিল এক খুব বড়ো আন্দোলন। না ভাঙা কমিউনিস্ট পার্টসহ অন্যান্য বামপন্থী দলও এই আন্দোলনের সঙ্গে ছিল। আপাতত থাক, সেসব কথা। আমরা ছিলাম ষাট-সত্তর দশকে হাওড়ার লিলুয়ায় বেড়ে ওঠা নানা ‘বাহুবলী’দের প্রসঙ্গে। যদিও ‘বাহুবলী’ শব্দটা তখনও মিডিয়া আমাদের সামনে নিয়ে আসেনি, সে কথা তো আগেই বলেছি। গুন্ডা, মাস্তান, রুস্তম— এমন সব নামেই চিহ্নিত করা হত এই সব শক্তিদের। লিলুয়ায় ছোটন গুপ্ত আর খোকন গুপ্ত ছিলেন দুই ভাই। খোকনদা বড়ো, ছোটনদা ছোটো। ওঁদের মা ছিলেন বিআরসিং হাসপাতালের নার্স। তাঁর সঙ্গে কেন্দ্রীয়ভাবে যোগাযোগ ছিল নেতা-মন্ত্রীদের। কংগ্রেসি নেতা-মন্ত্রীদের। ছোটনদা, খোকনদা ১৯৬৭-র ২৪-২৫ মে নকশালবাড়ির ঐতিহাসিক কৃষক অভ্যুত্থানের পর নকশাল রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, প্রত্যক্ষত। ছোটনদা পাতলা পাতলা চেহারা, গালে সুন্দর করে ট্রিম করা কালো দাড়ি। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। খুব সিগারেট, ঘন ঘন সিগারেট, প্লেন চারমিনার। ছোটন গুপ্ত লিলুয়ার নকশালবাড়ি ধারার যে আন্দোলন, তার অন্যতম সংগঠক। প্রেসিডেন্সি কনসোলিডেশন, অসীম চট্টোপাধ্যায়— ‘কাকা’, চিকি— ছোটো চিকি, বড়ো চিকি— এঁদের সঙ্গে যোগাযোগ। দীপাঞ্জন রায়চৌধুরী, রণবীর সমাদ্দার, বিপ্লব হালিম— এঁরা সকলেই ছোটনদার খুব কাছের লোক। বিশেষ করে অসীম চ্যাটার্জি— ‘কাকা’। ছোটনদা দুর্দান্ত সাহসী। বোমা-পিস্তল-পাইপগানে অসম্ভব দড়। তুখোড় নিশানাবাজ। ছোটনদা— ছোটন গুপ্ত ফুলহাতা শার্টের কলার তুলে হাঁটতেন। খুব রেলাবাজ যাকে বলে। ছোটনদা, খোকনদাদের সঙ্গে ছিলেন রবিন ভট্টাচার্য। রবিনদা খুব হ্যান্ডসাম। ফর্সা। ব্যায়াম করা গুলো পাকানো চেহারা। ডাম্বেল, বারবেল। ডন, বৈঠক। বুক ডনের সঙ্গে প্যারালাল বার, বেঞ্চপ্রেস, ল্যাটারাল, পুলওভার, কার্লিং। রবিন ভট্টাচার্য চাকরি করতেন বেলুড়ে। লোকজন কলোনিয়াল হ্যাংওভারে অনায়াসে বাংলার শেফিল্ড বলত হাওড়াকে। হাওড়ার বেলুড়, লিলুয়া, কদমতলা, বেলিলিয়াস রোড— এইসব জায়গা ছিল ছোটো, বড়ো কারখানাতে ভর্তি। এইসব অঞ্চলের থানায় পোস্টিং পাওয়ার জন্য হাজার হাজার টাকার ঘুষ দেওয়া-নেওয়া চলত পুলিশ মহলে। বিশেষ করে বেলিলিয়াস রোড অঞ্চলে। লক্ষ লক্ষ টাকার লোহার ছাঁট— যাকে ‘বাবরি’ বলা হত, সে কথা বলেছি আগেই, সেই ‘বাবরি’ বিক্রির টাকা, সেই বাবদ ‘হিস্যা’, ভাগাভাগি— ‘হিস্যা’ নিয়ে কামড়াকামড়ি— সব নিয়েই হাওড়ার শিল্পাঞ্চল। বোমা, গুলি, তলোয়ার, চাকু, ছুরি, ডাণ্ডা— লাশ ফেলাফেলি, লাশ পড়াপড়ি। ‘বদলা’, খুন, পাল্টা খুন। লিলিয়ায় এই যে লোহা সাম্রাজ্য, ওয়াগানের রেল থেকে ভেঙে বার করা হাজার হাজার টাকার চোরাই মাল— সব, সব কিছুর ওপরই প্রায় ধ্রুব সিং আর কেবল সিংদের একচেটিয়া দখলদারি। সেই দখলদারি একচেটিয়া টাকা-পয়সা ‘পয়দা’— আমদানির সবটা ভেঙে দিলেন ছোটনদা-খোকনদা-রবিনদারা। কেবল সিং আর ধ্রুব সিংরা এলাকা ছেড়ে প্রায় পালিয়ে গেল প্রবল জন প্রতিরোধ আর মারে। মার— মার মানে প্রবল মার। খোকন গুপ্ত, ছোটন গুপ্তদের আড়ালে আড়ালে বেড়ে উঠছিল রাখাল দাস। রাখাল দাস সত্তরে নকশালবাড়ির আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। আর ‘লুম্পেন প্রলেতারিয়েত’, তারাও তো বিপ্লবের অংশ। সিপিআই (এম-এল) কেন্দ্রীয় কমিটির এই সিদ্ধান্তে লিলুয়ার সুরেশ, পুঁইসারা খুব সাহসী, ঈষৎ খর্বকায়, চৌকো, দৃঢ় মুখ ও চোয়াল। তামাটে রং গায়ের, চওড়া বুক। ঈষৎ খর্বকায়। সুরেশ শ্যামলাই। থুতনিতে, গালের এপাশে ওপাশে ভুলভুলে কালো দাড়ি। সুরেশের সঙ্গে শেষ দেখা হাওড়া মল্লিক ফটক জেলে, ১৯৭৫-এর মার্চে। সেটা হোলি আর দোলের সময়টময় দোলের দু এক দিনের মধ্যে। সুরেশ তখন একটা খুনের মামলায় কনভিক্ট মার্ডারের ব্যাপারে সাজা খাটছে। সেইসঙ্গে ডাকাতি আর রায়টিংয়ের মামলাও। সুরেশ পাতলা পাতলাই ছিল। ১৯৭৫-এর মার্চে প্রায় বছর চারেক পর হাওড়া মল্লিক ফটক জেলে তার সঙ্গে দেখা। ১৯৭৫-এ রাখাল দাসের তীব্র— রকেট প্রতিম উত্থান। হু-হু, হু-হু, হু-হু করে। নকশালবাড়ির আন্দোলন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার পর প্রথমে জাতীয় কংগ্রেস, তারপর ভারতীয় জনতা পার্টি। আর ভারতীয় জনতা পার্টি— বিজেপি-র বিশেষ কার্যকর্তা রাখালের নামে অনেক, অনেকগুলো খুনের মামলা, ডাকাতি আর রায়টিং। সব মামলা থেকেই রাখাল মুক্তি পায় ভারতীয় কংগ্রেস নেতাদের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে। হাওড়ার আইএনটিইউসি-র নেতা ছিলেন লালবাহাদুর সিং। তাঁর সঙ্গে এই আনডার ওয়ার্ল্ড জগতের ‘অতি বডিদের’ খুব যোগাযোগ ছিল। লালবাহাদুর সিংয়ের সঙ্গে রাখালের সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো ছিল। সুরেশ একসময় ছিল রাখাল দাসের সঙ্গেই। পরে তাদের দূরত্ব তৈরি হয়। দূরত্ব থেকে ফাটল। তীব্র ফাটল। সংঘর্ষ। খিদিরপুর ডকে যেমন ফরোয়ার্ড ব্লকের কলিমুদ্দিন শামস ও আর-এক কংগ্রেস নেতার গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, ‘তোলা’ ইত্যাদি নিয়ে ঝামেলা ছিল ভয়ানক, লিলুয়াতেও তাই। লিলুয়ার এই যে পারস্পরিক মারামারি, খুনোখুনি, ছোটো ছোটো গ্যাংয়ের ভেতর গ্যাংওয়ার, তা সীমাবদ্ধ ছিল একসময় কেবল সিং, ধ্রুব সিংয়ের সঙ্গে ছোটন গুপ্ত, খোকন গুপ্ত, রবিন ভট্টাচার্যদের লড়াইয়ে। রবিনদাকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করি ২০১৯-এর ভাঙড়ে, কৃষক আন্দোলনের সময়। অলীক চক্রবর্তী, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, মির্জা হাসান-সহ মূলত সিপিআই(এম-এল)‘রেডস্টার’-এর নেতৃত্বে আন্দোলন। তার সঙ্গে সিপিআই(এম-এল)লিবারেশান-এর ছেলেমেয়েরাও ছিলেন। সেইসঙ্গে তৃতীয় ধারাও র্যা ডিক্যাল ফোর্সের ছেলেমেয়েরা। ভাঙরের কৃষকদের জমিগ্রাসী— পাওয়ার গ্রিড বিরোধী আন্দোলনের সমর্থনে বহুবার যাওয়া-আসার সূত্রে নতুন করে আলাপ পরিচয়। রিনিউ হল শ্রীরামপুরের মুরারীদার সঙ্গে, দেখা হল রবিনদা— রবিন ভট্টাচার্যর সঙ্গে। রবিনদা তখন বলতে গেলে কিছুই করেন না, মানে যাকে ‘অর্থকারী করা’ বলে। বেলুড়ে রবিনদার বড়ো পৈতৃক বাড়ি বেশ জীর্ণ। বহু শরিকের সেই বাড়ির একভাগ রবিন ভট্টাচার্যর। রবিনদা আবার তার সেই এজমালি বাড়ির অংশ লিখে দিয়েছেন তাঁর একমাত্র কন্যাসন্তানকে। কন্যাই রবিনদার একমাত্র সন্তান। কন্যা-জামাতা যথেষ্ট হিসেবি। আর তাদের সঙ্গে রবিনদার স্ত্রীও জুড়ে গেছেন। ব্যস, যাকে বলে ‘সোনায় সোহাগা’। রবিনদা পাওয়ার গ্রিড বিরোধী ভাঙড় আন্দোলনের সময় প্রায় নিয়মিত আসেন ভাঙড়ে। তখন তিনি সিপিআই(এমএল) রেডস্টার-এর সঙ্গে। প্রদীপ সিং ঠাকুর যার অন্যতম নেতা। কুশল দেবনাথও ছিলেন ভাঙড় আন্দোলনে। তো সে যাই হোক, লিলুয়া-বেলুড় অঞ্চলে কাজ করা রবিন ভট্টাচার্য মাঝে মাঝে আসতেন উত্তরপাড়া রাজা প্যারীমোহন কলেজেও। সেখানে পল্টু সেন— অমর সেন, নিশীথ পালধি, অজয় ভট্টাচার্যদের সঙ্গে তাঁর খুবই সুসম্পর্ক— কাজ, রেডশিপ। পল্টু সেনদের সিপিআই(এম-এল)-এর অফিসিয়াল নেতৃত্ব, যার শীর্ষে ছিলেন অমর নন্দী— তাঁদের সঙ্গে যথেষ্ঠ দূরত্ব ও তকরার ছিল। সেসব কথা উত্তরপাড়া রাজা প্যারীমোহন কলেজের একশো তিরিশ বছর উপলক্ষে প্রকাশিত যে পৃথুল স্মারকগ্রন্থ, তাতে সব কথা— গোটা ব্যাপারটাই খুলে— বিস্তারিত ভাবে লিখেছি। সেই বইটি একটি চমৎকার আকরগ্রন্থ। আবার এই লেখাটিই আমার সম্প্রতি প্রকাশিত কেতাব— ‘দেশভাগ থেকে নকশালবাড়ি’-তে আছে। বইটি বেরিয়েছে দে’জ পাবলিশিং থেকে। রবিনদাকে দেখেছি ২০১৯-এই ভাঙড়ে, মুরারীদাকেও। মুরারীদা সত্যনারায়ণ সিং, পরে কানুদা— কানু সান্যালের সঙ্গে বোধ হয় ছিলেন। রবিনদা ২০১৯ সালে ছন্নছাড়া। আর্থিক সঙ্গতি প্রায় কিছুই নেই। ফর্সা, উজ্জ্বল চেহারায় কল পড়েছে। এখানিকটা তামাটে, বিবর্ণ। চুলেও পাক, স্বাভাবিক। সময়, সময়, সময়। বয়স। মহাকাল। রবিনদা যথেষ্ট বিপন্ন, দেখে মনে হয়। চির অভ্যস্ত চা ও সিগারেট, বিড়িতে। লিভারের সমস্যা, লিভার প্রবলেম। সুমিত ভট্টাচার্য— রবিন ভট্টাচার্যের বিশিষ্ট বন্ধু আর একদা কমরেড, রবিন ভট্টাচার্যের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন নানা সময়ে।
যতদূর মনে পড়ছে বেলুড়ের ইন্দো-জাপান ছাড়া ‘ক্রাউন অ্যালুমিনিয়াম’ নামে আরও একটি বড়ো কারখানায় চাকরি করতেন রবিনদা। ইন্দো-জাপান-এর ম্যানেজার মালিকের সঙ্গে যে বিরাট সংঘর্ষ হয়, তার অন্যতম নেতৃত্বে ছিলেন রবিন ভট্টাচার্য। পুলিশি, মালিকের গুন্ডা, প্রোডাকশান ম্যানেজারের সঙ্গে ঝামেলা— রবিন ভট্টাচার্য— সব কিছু পুইয়েছেন নিজের জোরে। এঁদের কথা আজ কেই বা মনে রাখে? বেলুড়ের ইন্দো-জাপান-এ যখন শ্রমিক-মালিক সংঘর্ষ শুরু হল, তখনও সিপিআই(এম-এল) তৈরি হয়নি। রবিন ভট্টাচার্য, খোকন গুপ্ত, ছোটন গুপ্তরা অসীম চ্যাটার্জিদের প্রেসিডেন্সি কনসোলিডেশনের সঙ্গে। তখন সিসিসিআর আছে। ‘দেশব্রতী’— সাপ্তাহিক দেশব্রতী তাদের বাংলা মুখপত্র। তখন পাক্ষিক, নাকি সাপ্তাহিক ‘দক্ষিণ দেশ’-ও বেরোয় এমসিসি— মাওবাদী কমিউনিস্ট কেন্দ্রর। অমূল্য সেন, কানাই চ্যাটার্জি, চন্দ্রশেখর দাস (দাদু) তাঁদের সংগঠন। সেটা ১৯৬৮-১৯৬৯ সাল। উৎপল দত্তর ‘ঘুম ভাঙার গান’ নামে সিনেমাটি, যার অনেকটাই ‘ব্রেথওয়েট’ ইত্যাদি কারখানার শ্রমিক জীবন নিয়ে তোলা, যা থেকে অনেক অনেকটাই কেটে নেওয়া হয়েছে সেন্সর বোর্ডের কাঁচিতে, সেই সিনেমা রিলিজ করার সময়। উৎপল দত্ত ‘দিন বদলের পালা’ করে ছিলেন, নাটক। সে নাটকও তো ইতিহাস তৈরি করেছিল। নেহাতই তথাকথিত অ্যাজিট প্রপ— প্রোপাগান্ডা ড্রামা সেটা। খুব ভিড় হত উৎপল দত্তর এই নাটক দেখতে, ১৯৬৬-৬৭ সালে। সে কথায় পরে আসছি।
সুরেশ— সুরেশ সাউয়ের সঙ্গে ১৯৭৫-এর মার্চে— জরুরি অবস্থা আসব আসব সময়ে দেখা হল হাওড়া মল্লিক ফটক জেলে। আমার তখন মিসা চলছে। মিসাকে— কুখ্যাত সেই কালা কানুনকে ‘মিছা’ বলতেন বিরোধীরা। ভিআইআর— ডিফেন্স অফ ইন্ডিয়া রুল— ভারত রক্ষা আইন পিডি অ্যাক্ট, পি ভি অ্যাকট, মিসা— সবই তখন অঙ্গলঙ্গের বোঝা— জাতীয় কংগ্রেস বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির কাছে।
Powered by Froala Editor