‘সেনা’— তথাকথিত সেনারা ও অন্যান্য

আদালতে— পুলিশ কোর্ট, জাজেস কোর্ট— জজ কোর্ট এইসব বিচারালয়ে সেরেস্তাঘর তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়েই থাকে। পুলিশ কোর্ট চত্বর, জাজেস কোর্ট চত্বরে মিষ্টির দোকান— ময়রা পরিচালিত রসগোল্লা, পান্তুয়া, সন্দেশ। এছাড়াও আলাদা সিঙারার দোকান, সেখানেই কচুরি, নিমকি। কচুরির পাশাপাশি লুচিও কোথাও কোথাও। লুচি বা কচুরির সঙ্গে নারকেল কুচো দেওয়া ছোলার ডাল— যাকে পূর্ববঙ্গের বাঙালরা বলেন বুটের ডাইল, আবার গ্রাম ডালও বলা হয়ে থাকে ছোলার ডালকে। অখণ্ডবঙ্গের পূর্ব ভাগের বাঙালরা ছোলাভাজাকে বলতেন বুটভাজা, সেই ‘বুট ভাজা’ শব্দটি নিয়ে বহু বহু রসিকতা আছে। যাক সেসব কথা। ‘বাঙাল’ বিয়েবাড়িতে তিন খান ডাইল— তিন রকমের ডাল খাওয়ানোর মধ্যে এক ধরনের কেত্ বা কেতা ছিল। —অরা অগো মাইয়ার বিয়াতে তিন খান ডাইল করসে— তিতার ডাইল, ঝালের ডাইল, বুটের ডাইল। যাঁরা তিনখান ডাইল খাওয়াইলেন, তাঁরা যে বেশ ধনী ব্যক্তি, এমন একটা হওয়া প্রচলিত ছিল সেই সময়কার সমাজে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে, পরেও। কাঁচা লঙ্কাকে ‘মরিচ’ বলেন বাঙালরা। একটা গানই তো আছে, বাউলাঙ্গের গান— ‘ডাইল পাক কর রে কাচা মরিচ দিয়া/ গুরুর নাম কর আইস্যা নিরালায় বসিয়া/ ডাইল পাক কর রে… ডাইল পাক কর রে…’। সকাল সকাল বেলা দশটা নাগাদ কোর্ট বসে। জজ সাহেবরাও আসেন ঐ সময়। জেলখানা থেকে ‘আবাসিক’— জেলবন্দিদের আনা হয় এজলাসে। কোর্ট লকআপ অতি ভয়ঙ্কর। সেই লকআপ দেখার অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে, তাঁরাই জানেন। হাওড়া পুলিশ কোর্টের কোর্ট লকআপ ১৯৭০-১৯৭৫-৭৬, একই রকম। তখনও জেলখানারা সংশোধনাগার হয়ে ওঠেনি। জেল কয়েদি— আন্ডারট্রায়াল প্রিজনার— বিচারাধীন বন্দি আর সাজাপ্রাপ্ত বন্দি— তাঁদের ‘আবাসিক’ বলার কোনো রীতি-রেওয়াজ তখনও চালু হয়নি। ফলে জেলখানা। তখন ‘মামাবাড়ি’, ‘হরিণবাড়ি’, ‘ভিত্তর’— এমন নানা নামে জেগে আছে। জামিন পাওয়াকে অনেকেই ‘বেড়া পার’ বলে থাকেন, আর অ্যাকুইটেড মুক্তিপ্রাপ্তরাও ‘বেড়া কর দিয়া’ বলা। কথা হচ্ছিল কোর্ট লকআপ নিয়ে। গিজি গিজি ভিড়— আন্ডারট্রায়ালদের। সকাল দশটার এক ঘণ্টা পরই গিসগিসে ভিড়। গরমের দিনে মাথার ওপর কোনো সিলিংফ্যান নেই। কারণ একটাই— যদি কেউ হঠাৎ করে— আচমকাই গলায় দড়ি দিয়ে দেন, তার জন্য সতর্কতা। বেলা এগারোটার মধ্যেই সমস্ত কোর্ট লকআপ জুড়ে থই থই পেচ্ছাপ, ফলে সেই পেচ্ছাপের সঙ্গে সঙ্গে তীব্র দুর্গন্ধ। ভয়ানক ঝাঁঝালো সেই কুৎসিত গন্ধ। এর মধ্যেই প্রবল ঝাড়পিট কখনও কখনও। হাতাহাতি। লুকনো ক্ষুর, ভাঙা ব্লেডের টুকরো তা দিয়ে রক্তারক্তি। জাঙিয়া প্যান্টের নিচে পরার ‘বাইক’, তাতেই লুকিয়ে আনা ধারাল ক্ষুর। আর জিভের নিচে ভাঙা— আধভাঙা ব্লেড, তা দিয়েই রক্ত বার করে দেওয়া আক্রমণ। লকআপবাবু— পুলিশ কর্মচারি— খুবই তাগড়া, সাধারণত। বেঙ্গল পুলিশের ইউনিফর্ম পরা সেই লকআপবাবুরা মুহূর্তের মধ্যে হয়ে ওঠেন আক্রমণাত্মক। কোর্ট লকআপের ভেতর ঝামেলা— হুজ্জতি শুরু হলেই দু চারবার হুমকে-হামকে চিৎকার করে তিনি বারণ করেন। তাতেও যদি কথা না শোনে কেউ, তাহলে প্রবল বিক্রমে কোমরে পেটি— চামড়ার পোক্ত, চওড়া, কালো ভারি বেল্ট খুলে তিনি লাফ দেন লকআপের ভেতর। তারপর গেট বন্ধ করে দিয়ে আনধাধুনধ— এলোপাথাড়ি ঝাড়— মার। পেটিতে না কুলোলে হাতের পোক্ত পুলিশী লাঠি। বেতের তৈরি সেই লাঠি দিয়ে দে ভড়াভড়। দে দনাদন। দে দনাদন। তখন লকআপের ভেতর প্রবল চিৎকার, মারামারি। ‘হুজুর মাই-বাপ’— ‘হুজুর মাই-বাপ’— ‘সরকার মুঝে ছোড় দো’— ‘সরকার মুঝে ছোড় দো’— ‘গোল লাগি সরকার’— ‘গোল লাগি সরকার’। এর বাংলাটা এরকম— পায়ে পড়ি সরকার— পায়ে পড়ি সরকার— ‘পায়ের পাকড়াতা হুঁ মালিক’। ‘পায়ের পাকড়াতা হুঁ মালিক’— ‘পায়ের পাকড়াতা হুঁ—’। সে এক ভয়ানক আর্তনাদ ঘেরা সময়। কোর্ট লকআপের ভেতর লকআপবাবু ঢুকে পড়ে এই যে গণপিটাই দেন, তার বিপরীতে কখনও কখনও অন্য ছবিও তৈরি হয়ে যায়।

আন্ডারট্রায়ালরা নয়, সাজাবালারা— কনভিকটেডরা কখনও কখনও লকআপবাবুকে তিন-চার জন মিলে জাপটে ধরে তারপর তার গলার কাছে ধারাল ক্ষুর বা ভাঙা ব্লেড ঠেসে ধরে। তখন তো লকআপবাবুর মহাপ্রতাপের চিত্তির দশা একেবারে যাকে বলে। এরকম ছবি বদল অবশ্য দু-একবারই হয়। ফলে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হয় লকআপবাবুকে। হাওড়া কোর্ট লকআপে মামলার জন্য দমদম জেল থেকে নিয়ে আসা হয় আন্ডারট্রায়ালদের। এদের মধ্যেই অতি বলশালী দু-একজন। তাদের গ্যাং-দল সেই গ্যাং ভার্সাস গাং। ঝাড়পিট। পুরনো দুশমনির হিসাব নেওয়া। হিসাব কিতাব বোঝা, বোঝানো। কয়েদিরা সব ‘সরকারি মেহমান’ নামেই পরিচিত। অথবা খাট্টু, নয়তো পুরনো বার্ড বা জেলঘুঘু। এদেরই নাম খাট্টু। হাওড়া মল্লিক ফটক, দমদম সেন্ট্রাল জেল, উলুবেড়িয়া জেল— সব জায়গাতেই দেখেছি বদলিবালা জেল খাট্টু। অর্থাৎ একজনের হয়ে অন্য জন বেনামে জেল খাটছে। সাজা ভোগ করছে, তার বদলে সে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পাবে। একদম যাকে বলে কনট্রাক্ট বেসিস। চুক্তি অনুযায়ী টাকা প্রাপ্তি।

হাওড়া জেলের সেরু ওস্তাদ ছিল এমনই এক খাট্টু। অন্যের হয়ে পেশাদার জেল খাটিয়ে। কালো হাড়হাড় চেহারা, শিরা বার করা হাত, পা। তেমন লম্বা নয় একেবারেই। কিন্তু চওড়া পিঠ, কাঁধ, মজবুত গর্দান। সেরুর মুখটা অনেকটা রাতে বেরনো বনবেড়াল বা ভাম যেমন হয়, তেমন। সেরুকে দেখেছি ততবার, যতবারই নকশালবাড়ির পথ ধরে আন্দোলন করতে গিয়ে গোপন শেল্টার থেকে জেলে গেছি। সেরুর গলার স্বর ছিল খুবই ফ্যাঁসফ্যাঁসে— ঝাঁঝাল, হঠাৎ শুনলে মনে হবে বাতাস যাওয়া-আসা করছে ফাটা বাঁশের ভেতর দিয়ে। অতিরিক্ত গাঁজা খেলে ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় যেমন হয় আরকি। সেরু একটা গান খুব বেসুরো গলায় মাঝে মাঝেই গেয়ে উঠত— 

‘আহা কি যে আরাম সে তো মনই জানে
চায়ের গন্ধে যেন আমেজ আনে
চায়ের পেয়ালা যদি সাগর হতো
মনে সুখে তায় সাঁতার দিতাম…’

আরও পড়ুন
সেরেস্তা ও অন্যান্য

‘শুভদা’ সিনেমার এই গানটি হিন্দিভাষী সেরু উস্তাদ কেন গাইত, জানি না। সেরু আরও একটা গান গাইত— ‘জমাদার কো জয় জয় বোল জেলারসাহাব বা বস্তি কম্পাউন্ডার কো মা— লান্ড পে হোগে মস্তি। যব মক্ষি গিরি গরম তেলমে/ বহেনা পড়ে সেন্ট্রাল জেল মে/ যব মক্ষি গিরি গরম তেলমে/ রহেনা পড়েগা সেন্ট্রাল জেল মে…।’ আবার কোর্ট লকআপের ঝাটপিট— মারামারিতে ফিরি। দমদমাইয়া— দমদম জেলের বহু পুরনো, নাম করা খাট্টু পণ্ডিত ও তার গ্যাংয়ের সঙ্গে হাওড়া জেলের বিলা সন্তু, কাশিয়াদের দুশমনি— ঝামেলা। পণ্ডিত অবাঙালি। সম্ভবত বিহারের ঝা, দ্বিবেদী বা ত্রিবেদী— দুবে চৌবের চতুর্বেদীর বদলে মিশ্রাও হতে পারে। হতে পারে শুকুল বা শুক্লা। তখন এবং এখন বিহার, উত্তরপ্রদেশে জাতপাতের কঠিন বলয়। আবার ঠাকুর, সিং, ইত্যাদিরা হলেন ঠাকোর বা ক্ষত্রিয়। ভূমিহার বা ভূঁইহার ব্রাহ্মণরা আছেন বিহারে। তাঁদের একাংশও খুবই ডামিশ— বদমাশ— বদমাইশ, এরকম কথা প্রচলিত আছে বাইরের দুনিয়ায়। সত্তর দশকে যে ভূমিসেনা তৈরি হয়, মূলত নকশাল আন্দোলন ঠেকাতে ও তথাকথিত দলিত— চামার, কুনরি, পাশি, গড়েরিয়া, খটিক, নিষাদদের হত্যা করার জন্য, তার পেছনে ভূঁইহার বা ভূমিহারদের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। শুধু তথাকথিত দলিত হত্যাই নয়, দলিতদের বধূ-কন্যাদের নির্বিচার ধর্ষণ, ঘরবাড়ি— টোলিতে আগুন দেওয়া, আগুন দিয়ে জ্বালানোর পর দনাদ্দল দনাদ্দন রাইফেল, ডাবল ব্যারেল গান চালানো— সবই ছিল এই ভূমিহার বা ভূঁইহার ব্রাহ্মণদের দুষ্কর্ম তালিকায়। সাধারণত রা হত এদের পদবি। অন্য পদবিও ছিল। ভূঁইহার ছাড়াও ঠাকুর— ক্ষত্রিয় আর বামহন— ব্রাহ্মণরাও ছিল এই হত্যা— পাল্টা হত্যার যে লড়াই, ফাস্ট ওয়ার তার মধ্যে পড়ে এইসব অশুভ। 

আরও পড়ুন
মুহুরি, সেরেস্তাঘর ও আরও কিছু

লাইসেন্স করা ও বেআইনি ফায়ার আর্মস— বন্দুক, রাইফেলে সজ্জিত থাকত তারা— ভূমিসেনারা। তার সঙ্গে কুনওয়র বা কুয়াঁর সেনা, আরও পরে আসে রণবীর সেনা। বাঘৌরা, দালালচক্র, ছেটকি— ছেছানি, হারের বর্ণযুদ্ধের এক একটি অঞ্চল। তার বহু আগে অরোয়াল বা আরোয়াল হত্যাকাণ্ড। আরোয়াল বা অরোয়াল হত্যা নিয়ে উদ্বেলিত হয়েছিল প্রায় সমস্ত দেশ। অরোয়াল বা আরোয়াল গণহত্যা— পরিকল্পিত বর্ণভিত্তিক হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে উদ্বেলিত, উত্থিত, মথিত হয়েছিল সমস্ত পশ্চিমবাংলা। বহু গান, গল্প, কবিতা, নাটক লেখা হয়েছে আরোয়াল বা অরোয়াল হত্যাকাণ্ডর প্রতিবাদে। এই জঘন্য হত্যার বিরুদ্ধে পথে নেমেছেন ছাত্ররা। নারীরা। সে এক বি-ই-শা-ল বিদ্রোহী সময়। অরোয়াল বা আরোয়াল হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিরাট সমাবেশ হয়েছে পাটনায়। পাটনার গান্ধী ময়দানে। ষাটের দশক থেকেই লাচিত সেনা, ভূমিসেনা, ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের অন্যতম নায়ক কুঁয়র সিংয়ের নামে কুঁয়র বা কুনওয়ার সেনা, ব্রহ্মর্ষি সেনা ও অন্যান্য নানা ধরনের প্রাইভেট আর্মি ভারতীয় রাজনীতি আর সংবাদ মাধ্যমে বড়ো বড়ো খবরের শিরোনাম হয়ে ওঠে। কমিউনিস্ট বিরোধী শিবসেনা— বালাসাহেব ঠাকরের শিবসেনা তো আগেই ছিল। বোম্বাই— পরবর্তীকালে মুম্বাই, মহারাষ্ট্র জুড়ে বালাসাহেব ঠাকরের শিবসেনা একটু একটু করে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। বিশেষত কলে-কারখানায়, মধ্যবিত্ত মানসে, সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে। বোম্বাইয়া সিনেমা জগতে দাউদ ইব্রাহিম ও তার গ্যাংয়ের বিপুল প্রভাব, সেইসঙ্গে সঙ্গে মহেশ গাউলি, ছোটা রাজন— এইসব নামও উঠে আসতে থাকে। মনে রাখতে হবে হাজি মস্তান বা হাজি মাস্তান, বোম্বাইয়া— মুম্বাইয়া সিনেমার ‘ডন’। তার জীবন কথা নিয়ে সিনেমা তৈরি হয়েছে একাধিক। সে প্রসঙ্গে আর যাচ্ছি না। একেবারে কাচরা বস্তি থেকে উঠে আসা হাজি মাস্তান বোম্বাইয়ের আনডারওয়ার্ল্ডে এক নম্বর হয়ে ওঠে ক্রমে। ‘ধারাভি’ নামে বস্তিটির কথা মনে পড়ে যায় এই প্রসঙ্গে। মহেশ গাউলি পরে নিজের রাজনৈতিক দল খোলে। দাউদ ইব্রাহিম হয়ে ওঠে দুবাই কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক গ্যাংস্টার। তাকে নিয়েও— তার ছায়া আদল সামনে নিয়ে এসে তৈরি হয় একের পর এক ছবি। ছোটারাজন বনাম দাউদ ইব্রাহিম, তা নিয়েও তৈরি হয় সিনেমা। বালাসাহেব ঠাকরে— বাল ঠাকরে ছিলেন শিবসেনা প্রধান। ‘সামনা’ নামে পত্রিকা চালাতেন তিনি। ছিলেন কার্টুনিস্ট— খবরের কাগজের ব্যঙ্গচিত্রী। তারপর শিবসেনা। লাচিত সেনা ছিল আসামে, যতদূর মনে পড়ছে।

আরও পড়ুন
হাসান আজিজুল হক, খালাম্মা, পাখি শিকারের বন্দুক

পশ্চিমবাংলায় ষাটের দশকের শেষে তৈরি হয়েছিল বিজয়সেনা। শ্রীলঙ্কা অভিযানকারী বিজয় সিংহের নাম অনুসারে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর অতি বিখ্যাত ‘আমরা’ কবিতায় লিখেছেন— ‘বাঙালির ছেলে বিজয় সিংহ হেলায় লঙ্কা করিল জয়/ বাঙালির ছেলে ব্যাঘ্র-বৃষভে ঘটাবে সমন্বয়…’। ছন্দের জাদুকর বলা হয় সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে— ‘ছিপখান তিন দাঁড় তিনজন মাল্লা/ চৌপর দিন ভর দেয় দূর পাল্লা’। সতেন্দ্রনাথ দত্তর সঙ্গে ছন্দ যেন জড়িয়ে আছে। ষাটের দশকের একেবারে শেষ লগ্নে ‘আমরা বাঙালি’ ও ‘বিজয়সেনা’-র গাবদা গাবদা দেওয়াল লিখন চোখে পড়ত ধর্মতলা অঞ্চলের বহু দেওয়ালে দেওয়ালে আলকাতরায় বোনা কালো কালো অক্ষরে লেখা হত— ‘বাঙালি গর্জে ওঠো’। তার নিচে বদ রসিকতা করে কারা যেন লিখে দিয়েছিল— ‘বাঙালির কাঁচা ঘুম ভাঙাইও না’। রণবীর সেনার জন্ম বিহারে— অখণ্ড বিহারে— আরও বেশ কয়েক বছর পরে। সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। মূলত ভূমিহাররাই দায়িত্ব নেয় এই সেনা সংগঠনে— সেইসঙ্গে ঠাকোর— ঠাকুর ও বামহন— ব্রাহ্মণেরা। শিবসেনা বোম্বাই— মুম্বাইতে একের পর এক কারখানা ইউনিয়ন দখল করতে থাকে কমিউনিস্টদের হাটিয়ে দিয়ে, হত্যা করে। বাল ঠাকরের ‘বাঘ’ গর্জন করতে থাকে। শিবসেনার রাজনৈতিক সিম্বল গর্জমান— মুখ ব্যাদানকারী ব্যাঘ্র। আমরা জানি দত্তা সামন্ত নামে একজন তথাকথিত ‘নির্দল’ ট্রেড ইউনিয়ন নেতা বোম্বাই ও মহারাষ্ট্রের কল-কারখানা থেকে কমিউনিস্ট বিতাড়নে মূল ভূমিকা নেন। আশির দশকের গোড়ায় বোম্বাইয়ের সমস্ত সুতোকল জুড়ে যে ঐতিহাসিক ধর্মঘট শুরু করেন শ্রমিকরা তাঁদের বিভিন্ন ন্যায্য দাবি-দাওয়া নিয়ে, তার নেতৃত্বে ছিলেন নির্দল দত্তা সামন্ত বা দত্ত সামন্ত। সমস্ত আন্দোলনের রাশ তাঁর হাতে। সেই আন্দোলনও খুব বড়ো সাফল্য পায়। অনেক পরে আততায়ীর হাতে নিহত হন ‘নির্দল’ শ্রমিক নেতা দত্তা বা দত্ত সামন্ত। সে এক অন্য ইতিহাস। এক সময় বোম্বাইতে সুতোকল ইউনিয়নে এ আই টি ইউ সি-র পাশাপাশি ট্রটস্কিপন্থী বা ট্রটস্কাইটদের শ্রমিক সংগঠন ছিল। সব ভেঙে যায় দত্তা সামন্ত বা শিবসেনা তরঙ্গে। শিবসেনা বোম্বাইতে বিহারী শ্রম্মিকদের কাজ— চাকরিরও বিরোধিতা করে। সেও এক দীর্ঘ ইতিহাস। সেই বিষয়ে আপাতত বিস্তারে যাচ্ছি না। 

আরও পড়ুন
হাসান আজিজুল হক, গান ও গানের বাগান

পুনরায় হাওড়া জেলের কোর্ট লকআপে পণ্ডিত প্রসঙ্গে ফিরি। পণ্ডিত— নাকের নিচে পাকানো, মোটা কালো গোঁফ। গোঁফের দুটি প্রান্ত বেশ সরু করে ছুঁচলো করা। পণ্ডিত তিরিশ-বত্রিশ। মাথা ন্যাড়া, ফরসা, পেশি সমৃদ্ধ হাত-পা-বাহু-বুক। দেখলেই বোঝা যায় ব্যায়াম করা চেহারা। শরীরের তুলনায় সামান্য ছোটো কান, চওড়া কাঁধ। দুচোখের মণিতে ধূর্ত আর হিংস্র বেড়াল। পরের বার পণ্ডিতের কথাই— আরও বিস্তারিতভাবে।

Powered by Froala Editor