কালীঘাটে মেজোখোকন-বড়োখোকনদের লাল-নীল মাছের দোকান, তাকে ঘিরে আড্ডা, এসব কথা লিখেছি। রাসবিহারী বাসস্টপে নেমে সো-ও-জা চেতলার দিকে যেতে গেলে ডান দিকে অতি বিখ্যাত— বড়ো গুরুদোয়ারা বা গুরুদ্বার। তারপরই গুরুদ্বার পার্ক। এরপরেই একটা হরিণঘাটার দুঘের ডিপো বা বুথ ছিল ষাটের দশকে। তখন কলকাতার চেহারাই পুরোপুরি অন্যরকম। রাসবিহারী থেকে চেতলা যেতে গেলে ডান দিকের ফুটপাতেই বড়োখোকন-মেজোখোকনদের মাছের দোকান। বড়োখোকন মেজোখোকনদের বাবা আর্টিস্ট। তিনি বলেছিলেন শান্তিনিকেতনে নন্দলাল বসুর ছাত্র হিসাবে তিনি আর্ট ইত্যাদি শিখেছেন। আসলে তাঁকে আমি যখন দেখি তাঁর ছবি-রিটাচ করা, ছবি তোলার দোকানে, তখন ১৯৭৩-৭৪। তখন তো ছবি রিটাচ করে ঠিকঠাক বানিয়ে তোলার যুগ। সাদা ছবিকে কালার করা, এরকম একটা সময়। আমার মা— গায়ত্রী রাতের মৃত্যুর পর টাচ দিয়ে দিয়ে সাদা-কালো ছবিকে রঙিন করে তুলেছিলেন মেজোখোকন-বড়োখোকনদের বাবা। সব সময় প্রায় মুখে বিড়ি। গরমের দিনে লুঙ্গির ওপর গেঞ্জি। হাতাঅলা গেঞ্জি কনুই পর্যন্ত। মাথার কাঁচা-পাকা চুল কিঞ্চিৎ অবিন্যস্ত। গালে কখনও কখনও হালকা, সাদা সাদা দাড়ির প্রলেপ। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। মেজোখোকনরা তিন ভাই— বড়োখোকন, মেজোখোকন, ছোটোখোকন। সম্ভবত ওদের এক বোনও ছিল। কালিঘাটে পাথরপট্টি ছাড়িয়ে কালীঘাট জনমঙ্গল সমিতি। জনমঙ্গল সমিতির পাশেই ভুজঙ্গবাবুর পাঠশালা। ভুজঙ্গবাবুর পাঠশালা বহু বছরই নেই। সে ছিল এক নিরানব্বই বছরের লিজের বাড়ি। ভুজঙ্গভূষণ ভট্টাচার্য ছিলেন ভালো হোমিওপ্যাথ। চেহারাটি পাকা আম সদৃশ। দুচোখে চাঁদির ফ্রেমের গোল গোল চশমা। পরনে খাদির রঙিন পাঞ্জাবি, ধুতি। সেটিও খদ্দরের। পায়ে চপ্পল। হাতে ঘড়ি। বেশ শৌখিন মানুষ ছিলেন। এরই কাছাকাছি মেজোখোকনের বাবার স্টুডিও। ক্যামেরা, তুলি। ছবি রিটাচ, পুনরুদ্ধার। সিপিয়া কালার, ভিগনেট। তখনও ফিল্মে তোলা ছবিরই যুগ। ডার্করুম। তার ভেতর লাল আলো। ফিল্মে আলো লেগে গেলেই ছবি নষ্ট। ছবির নেগেটিভ। হাইপো। হাইপোর জল কলাইকরা লম্বাটে চৌকো ট্রের ওপর। সেই জলে ফিল্ম নেগেটিভ ওয়াশ করে তারপর ছবি প্রিন্ট। হাইপোর চেহারা অনেকটা যেন টুকরো ফটকিরি। ক্রিস্টাল শেপ এই হাইপো দানা গায়ে, হাতে, মুখে ছুলি সারানোর নাকি অব্যর্থ ওষুধ। তখন ক্যামেরা বলতে বাঙালির অতি চেনা ইয়াশিকা— মেড ইন জাপান। কো থাইজেন্ডে, আশাই পেনট্যাক্স এল একটু পরে। জার্মান মেড রোলিকড, রোলিফ্লেকস ক্যামেরার যুগ শেষ, এছাড়া আছে বক্স ক্যামেরা— আগফা গেভাবক্স, খুব সস্তার আফগা ক্লিক। তিরিশ টাকায় পাওয়া যেত আগফা ক্লিক। ক্যাসেট ফিল্মের মার্কিন ক্যামেরা, ‘জেনিথ’ নামের সোভিয়েত মেড ক্যামেরা, যার লেন্স তৈরি হত তখনকার সোভিয়েত ব্লকের ইস্ট জার্মানিতে। বন, বার্লিন— ইস্ট আর ওয়েস্ট জার্মানির রাজধানী। তারপর তো ভাঙা পড়ল বার্লিন ওয়াল। সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। দুই জার্মানির সংযুক্তিকরণ হল। উঠে গেল কাঁটাতার। মানে কেটে দেয়া হয় কাঁটাতার। বন্ধ হল সার্চ লাইট, পাহারাদারি, সেন্ট্রিবক্স। গ্লাসনস্ত, পেরেস্ত্রোইক। সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইস্ট ইউরোপ ছিন্নভিন্ন, ভেঙে টুকরো টুকরো। পশ্চিম জার্মানিতে পালিয়ে আসার চেষ্টা, পূর্ব জার্মানি থেকে, কোনোভাবে পশ্চিম জার্মানিতে ঢুকে পড়ে পূর্ব জার্মানিতে আর না ঢোকা। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে ‘গুড বাই লেনিন’ ছবিটি, যা বেশ কয়েক বছর আগে দেখেছিলাম কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে, সম্ভবত ২০০৮-২০০৯ হবে। তখন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে রোজ সকাল নটা থেকে রাত নটা-দশটা পর্যন্ত সিনেমা দেখি। পাঁচটা-ছটা সিনেমা নিত্য দর্শন।
পূর্ব জার্মানি, পশ্চিম জার্মানি এক হয়ে গেল। ভাঙা পড়ল ‘বার্লিন ওয়াল’। তার টুকরো খণ্ড, প্রায় অ্যান্টিক মহিমায় ফ্যানসি প্রাইসে বিক্রি হল। যেমন বিক্রি হয়েছিল ১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর ভেঙে দেওয়া বাবরি মসজিদের দেওয়াল, গম্বুজ, মিনারের টুকরো-টাকরা, খণ্ড। তো সে যাই হোক, কালীঘাটের সরু সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় মেজোখোকনের বাবার কাজের জায়গায়— স্টুডিও। তাঁর আঁকাটুকু বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ফোটোগ্রাফিকে— ছবি তোলাকে পেশা হিসাবে রেখেছে বড়োখোকন। বড়োখোকন, মেজোখোকন পায়রাবিদ। পায়রা পোষায় এক্সপার্ট। কালীঘাটে সত্তর দশকের গোড়ায় শিবা মার্ডার হয়ে গেল, শুধু পায়রা নিয়ে রেষারেষিতে। অসিত বসু, গদাই চক্রবর্তী— ধ্রুবদাস চক্রবর্তীরা অভিযুক্ত হয়েছিল শিবা মার্ডার কেসে। এই মামলায় খুনের— খুনের মামলা থেকে সবাইকে বার করে নিয়ে আসেন গুরু ঘটক নামের প্রখ্যাত আইনজীবী। তাঁর মুহুরি ছিলেন বিশুদা। গুরু ঘটক ক্রিমিনাল সাইড করতেন। বিশুদা ছিলেন তাঁর মুহুরি। ধুতি, হাফশার্ট পরা বিশুদা, মাথায় ব্যাকব্রাশ করা কোঁচকানো চুল। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। মুখে সর্বদা হাসি। মুখশ্রীটা বেশ। চেহারা— পেটাই স্বাস্থ্য। আইনবাজ বলতে যা বোঝায়, বিশুদা ছিলেন তাই। অসম্ভব ভালো আইন বুঝতেন, ফৌজদারি আইন। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। আমার ওপর রাষ্ট্রের চাপানো একটি মিথ্যা মামলায় বিশুদা ছিলেন পরামর্শদাতা। দক্ষিণ কলকাতার ‘ভারতী’ সিনেমার পেছনে আলিপুর পুলিশ কোর্ট বা জজকোর্ট থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে বিশুদা চলে আসতেন ‘ভারতী’ সিনেমার পেছনের সেই সাবেক দোতলা বাড়িতে। সেখানে বেশ সুশ্রী, কৃষ্ণবর্ণা, সামান্য পৃথুলা, আদ্দির ধরনের পাতলা, সাদা কাপড়— তার কালো পাড়, বিশুদা আমায় আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর ‘বৌদি’-র সঙ্গে। এই ‘বৌদি’ বিশুদার নিজের ‘তুতো’ না ডাকের টের পাইনি। ‘বৌদি’ বিধবা। আর এই ‘বৌদি’-র সঙ্গে বিশুদার যে বিশেষ সম্পর্ক আছে, তা টের পেতাম আমার নিজস্ব অনুভবে। আসলে সেই সময়টায় ১৯৭৫-৭৬ সালে আমার ওপর রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া কিছু মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে লাইন অফ ডিফেন্স গড়তেই আমার বিশুদা সন্নিধান। বিশুদার পদবি এখন আর খেয়াল নেই। আসলে সেভাবে বিশুদার পদবির খোঁজও নিইনি তখন। কারণ আমি তখন এই জজকোর্টের উকিল, পুলিশ কোর্টের উকিল আর মুহুরি, কোর্টের পেশকার— সবাইকে জড়িয়ে একটা কাজ করছি। শুনেছি, সত্যি মিথ্যে বলতে পারব না, এই ঘটনাকে সত্য বলে প্রমাণের কোনো দায়ও আমি নিচ্ছি না। জজসাহেবের সামনে বসা পেশকার বাবুদের নাকি ঘটি থাকত, পেতলের ঘটি দস্তুরি পাওয়ার জন্য। থাক সেসব কথা। সেই যে ‘খড়িরগণ্ডী’-তে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর মুখে একটা ডায়ালগ ছিল না— ‘আদালত পেয়ে থাকে’ তখনও ভুলিনি। হাওড়া কোর্টের গুরুপদ মুহুরি, তাঁর সেরেস্তা, সেও তো দেখার মতোই। হাওড়া কোর্টে সনাতন মুখার্জি ছিলেন নামকরা আইনজীবী। বরাবরই জাতীয় কংগ্রেস। বালি কেন্দ্র থেকে একবার নির্বাচনেও দাঁড়িয়েছিলেন। জিততে পারেননি। হাওড়া কোর্টের নামকরা ক্রিমিনাল লইয়ার ছিলেন প্রফুল্ল রায়, কিরণবাবু— এঁরা সবাই পুলিশ কোর্ট। সেশানসও লড়তেন এঁরা। ছিলেন সুব্রত মুখার্জি নামে একজন নামকরা আইনজীবী। সম্ভবত তিনি হাইকোর্টও করতেন। মানে হাইকোর্টে মামলা করতেন। ভালো নামকরা আইনজীবী। গুরুপদ মুহুরি অপুত্রক। ফলে ভাইপো দেখাশুনো করে সেরেস্তার। যদিও গুরুপদ মুহুরিই সেরেস্তাদার। প্রতিটি আদালতের মুহুরিদের সেরেস্তা, সেরেস্তাঘর প্রায় একই চেহারার। গুরুপদ মুহুরির সম্ভবত তিন কন্যা। নাকি একটু হাতা গোটানো আদ্দির শার্ট, শার্টে ডবল ঘর, তাতে মিনে করা সোনার বোতাম, সচেন। বুক পকেটে ‘ফিলটার উইলস’-এর প্যাকেট। সরু পাড় নয়, মাঝারি পাড় মিলের ধুতি। খুব লম্বা না। আমার একটি মামলার মুহুরি ছিলেন গুরুপদ। মাথার কোঁচকানো থাকদার চুল নারকেল তেল দিয়ে পরিপাটি আঁচড়ানো। ঘন ঘন বিড়ি, কখনও সিগারেট। ভাইপো মুহুরি ও কালতনামায় সই করাতে না করাতেই গুরুপদ মুহুরি টাকা চান। ভয় দেখান আজ কিছু জজসাহেব খুব কড়া। জামিন কেটে যেতে পারে তোর। তখন তো আবার নতুন করে বেলবন্ডে সই করানো। জামিন-বেলের ব্যবস্থা করা। নতুন করে মুভ করো। জামিনের টাকা দাও। টু বা থ্রি পার্সেন্ট।
গুরুপদবাবু প্রায় থাবা দিয়ে যাকে বলে টাকা কেড়ে নিতেন ক্লায়েন্টের কাছ থেকে। তাঁর নাকের নিচে সরু গোঁফ। নাকটি প্রায় ঈগল হেন— যাকে বলে ঈগলনাসা একটু কঠিন মুখ। আর পয়সার ব্যাপারে অসম্ভব সচেতন। আসলে গুরুপদবাবুদের এই প্রফেশান— মুহুরি আর হাইকোর্টের বাবু— এঁদের নিয়ে একটি বড়ো আখ্যান নির্মাণের ইচ্ছেও ছিল, হয়নি। প্রায় প্রতিটি জেল ভিত্তিক উপন্যাসে— অখ্যানে। এমনকি আমার ‘কাছেই নরক’ যা আমি আমার সত্তর দশকের জেলবাস নিয়ে লিখেছি, সেখানেও একটি গাছের কথাই আছে। বিশুদার বাঁচা একদম গুরুপদ মুহুরির বিপরীত। খুব ঠাটবাট নিয়ে থাকতেন বিশুদা। পোশাক, হাতের ঘড়ি, সে তো একইরকম। সর্বদা হাসিমুখ। উকিলবাবুদের সঙ্গে প্রচুর খাতির, জানাশোনা লোয়ার কোর্ট, হাইকোর্ট— সব জায়গাতেই বড়ো বড়ো আইনজীবীদের সঙ্গে ওঁর খুব ভাল জানাশোনা। ওঠা বসা। বিশুদা পুরো কন্ট্রাক্টে নিতে মামলা। অর্থাৎ তাঁকে এই টাকা দিতে হবে। বাকিটা উনি বুঝে নেবেন। সার্টিফায়েড কপি তোলা টাইপ করানো, পি পি— পাবলিক প্রসিকিউটার, মামলার আই ও, প্রয়োজনে উইটনেস-সাক্ষী ওল্টানো কায়দা করে, সাফাইদার যোগাড়— সব বিশুদা, একাই করতেন, চুপচাপ, ঠান্ডা মাথায়, হাসিমুখে। টেনশনের কোনো বালাই-ই নেই। মুখ দেখে কেউ বুঝতে পারবে না, বড়ো মামলা। বিশেষ করে খুনের মামলা— ভারতীয় পিনাল বা পেনাল কোড— আই পি সি সেই ধারা অনুযায়ী ৩০২ বা ৩০৪ ধারা, সেই সব ধারা গুলে খেয়েছেন বিশুদা। এই আদালত ইত্যাদি লাইনের অনেকেই বলতেন বিশুদার আইন ভগন অনেক লইয়ারের থেকে বেশি। সত্যিই বিশুদা আইন বিষয়ে— ল পয়েন্টে জ্ঞান অসাধারণ। মামলা সাজিয়ে দিতেন তিনি রীতিমতো চার্জশিট দেখে দেখে, দাগ দিয়ে দিয়ে। পুলিশ ফাইনাল রিপোর্ট দিলে তো আর কথাই নেই। কিন্তু চার্জশিট— দায়রায় সোপর্দ করা হলে তখন তো ইয়া মোটা চার্জশিট। তাতে সেই কার্বন কপিতে সবটা স্পষ্টও থাকত না সবসময়। আমি ১৯৭০-৭৫ সালের কথা বলেছি। নিজের বিরুদ্ধে অজস্র মিথ্যা মামলা, রাষ্ট্রের চাপানো, সেইসব মামলার চার্জশিট, তাতে সাক্ষীদের নামও। মার্ডার কেস অর্থাৎ খুনের মামলা হলে সেই মামলার আই ও পি পি— সবাই এই মামলার চার্জশিট ইত্যাদি জানেন। তার ভিত্তিতেই মামলার ‘মেরিট’ দেখেন। ক্রিমিনাল মামলা— বিশেষ করে খুনের মামলায়, যত লম্বা লম্বা তারিখ বা ডেট পরে, তত বোঝা যায় মামলাটি অ্যাবিউটাল— খালাস হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সাক্ষী যদি ঠিক মতো সাক্ষ্য না দেন, তাহলে তাঁকে হস্টাইল ডিক্লেয়ার করতে পারেন বা করেন পাবলিক প্রসিকিউটার বা পি পি— যাকে সরকারি আইনজীবীও বলা হয় বাংলায়। একুশজন সাক্ষীকে একের পর এক হস্টাইল ডিক্লেয়ার করা, তেতাল্লিশজন সাক্ষীর মধ্যে এ আমার চোখের সামনে দেখা আলিপুর কোর্টে সুরূপা গুহ হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার কোর্ট রিপোর্ট করতে গিয়ে আদালত সংবাদদাতা নয়, দক্ষিণ শহরতলির সংবাদদাতা হিসাবে, যেখানে এক কলাম খবর লিখলে পাঁচ টাকা পেতাম ১৯৭৭-৭৮ সালে আর সুরূপা গুহ হত্যা মামলার রিপোর্ট করলে দশ টাকা। তখন ‘যুগান্তর’-এর কোর্ট রিপোর্ট করতেন কানাই দত্ত— যাঁকে ‘যুগান্তর’-এর অনেকেই পেছনে বলতেন কানাই কুমির। কানাই দত্ত সাগরমেলা বিশারদ ছিলেন— একথা আগেও একবার লিখেছি। ‘স্টেটসম্যান’-এর কোর্ট রিপোর্ট করতেন মুখার্জিদা। তাঁর নাম জানি না। পদবি জানি না। সাদা কেডস, সাদা মোজা, সাদা ফুলপ্যান্ট, সাদা শার্ট— সম্ভবত তিনি পাশ করা আইনজীবী। আনন্দবাজারের হয়ে কোর্ট রিপোর্ট করতেন দাস পদবিধারী একজন। তাঁর ছোটোভাই তাপস দাস ছিলেন ‘দৈনিক বসুমতী’-র সাব এডিটর। যতদূর মনে পড়ছে, তাঁর নাম তরুণ দাস। তরুণদা খুব ভালো আদালত সংবাদদাতা ছিলেন। তাঁর বহু বাই লাইন স্টোরি— নামসহ বেরিয়েছে ১৯৭৯-৮০, ১৯৭৮ সালে। কানাই দত্ত খুব শৌখিন। চোখে সোনালি ঘের দেওয়া চশমা, মাথার পাতলা হয়ে আসা চুলে ঘন কলপ। মিলের ধুতি-পাঞ্জাবি, টেরিকটের রঙিন পাঞ্জাবি, সাধারণত, সঙ্গে ডাবল ঘরের পাঞ্জাবিতে সোনার বোতাম, পায়ে মসমশানো পাম্প শ্যু। নয়তো চামড়ার চকচকে ব্যাক বেল্ট। দু হাতের আঙুলে সিলোনি গোমেদ, পলা— হিন্দিতে যাকে বলে মুঙ্গা। তো সে যাই হোক, কানাইদা খুব লাগতেন মুখার্জিদার পেছনে বলতেন, মুখার্জিদাকে খুব স্মার্ট লাগছে। ব্যস মুখার্জিদা তো খুবই গদগদ। আর আমাকে মাঝে মাঝেই বলতেন, কিন্নরের খুব নাম হয়েছে। খুব নাম। এই সব চলত। অমৃতবাজার পত্রিকার একজন ল রিপোর্টার ছিলেন মুখে শ্বেতী, হাতেও। তাঁর নাম মনে নেই। আসতেন সুরূপা গুহ হত্যা মামলা রিপোর্ট করতে। এ ছাড়া দৈনিক ‘ছাপতে ছাপতে’, ‘দৈনিক বিশ্বমিত্র’, ‘সন্মার্গ’ এর সাংবাদিকরাও। আমার মায়ের এক কাকা— শ্যামাচরণ রায় ষাটের দশকে ‘যুগান্তর’-এর ল রিপোর্টার ছিলেন। সম্ভবত অমৃতবাজার পত্রিকাতেও। শ্যাম দাদু— শ্যামাচরণ রায়, তাঁর স্ত্রী রাধাদিদা, অসামান্য। গায়ের রং কালো, বড়ো বড়ো চোখ। কি যে স্নেহ তাঁর, দেখা হলেই মানে ওঁর বাড়িতে— ওঁদের বাগবাজারের বাড়ি গেলেই পাশে বসিয়ে আদর করতেন, সমানে হাত বুলিয়ে দিতেন। সে সব স্মৃতি অনেক দূরের নদী। কথা বলছিলাম উকিলবাবু-মুহুরিদের সেরেস্তা নিয়ে। আদালত চত্বরে এই যে সেরেস্তা ঘর সব, মুহুরিদের কিংবা হাওড়া কোর্ট বা আলিপুর পুলিশ কোর্টে যেমন, তেমন ছড়ানো ছেটানো নয়, বড়ো টানা, সামান্য উঁচু লম্বা জায়গাতে কাঠের বড়ো ডেস্ক। যা বাঁধা থাকত মোটা শেকল দিয়ে, তালা-চাবি মেরে। সামনের সপ্তাহে মুহুরিদের সেরেস্তা ঘর নিয়ে আরও বলব।
Powered by Froala Editor