মুছে যায় – ৭
আগের পর্বে
‘চন্দ্রায়ণ’ নয়, ‘চান্দ্রায়ণ’। চান্দ্রায়ণ করা হয় তাঁরই যিনি প্রবল অসুস্থ। হয় তিনি এর পর সুস্থ হয়ে উঠবেন অথবা পরলোক গমন করবেন। ১৯৩৪-৩৫-৩৬ সালে বিশ্বযুদ্ধের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে পৃথিবী। সেইসময় বাগবাজারে রায় পরিবারে চান্দ্রায়ণের আয়োজন। সেখানে বসবাস তারানাথ রায়ের পরিবারের। সহোদর ভাই অম্বিকানাথ তাঁর পুত্রের জন্মের মাসখানেক আগেই মারা যান। হয়তো বা খুন হন। তাঁর স্ত্রী বিধবা শিবানী রায়ের চান্দ্রায়ণ হয়। বাঙালি আচারে বাঁধা পড়ে তাঁর জীবন। কিছুদিন পরেই অসুস্থ হন শিবানী। ক্ষয়রোগ। তবে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসায় মানা। কারণ সাহেবদের তৈরি ওষুধে থাকতে পারে মুরগির ডিমের নির্যাস। অতএব কবিরাজিই ভরসা। অসুস্থতার কারণে তাঁর চান্দ্রায়ণ হল। আবার মস্তকমুণ্ডন করা হল তাঁর। অম্বিকানাথের মৃত্যুর পর প্রথমবার এই প্রথার শিকার হতে হয়েছিল তাঁকে। তবে চান্দ্রায়ণের ফল পেলেন শিবানী মাস দুয়েকের মধ্যেই। ১৯৩৬। বিশ্বযুদ্ধ শুরুর বছর তিনেক আগেই তিনি যাত্রা করলেন অসীমের উদ্দেশ্যে।
‘মুছে যায়?' এই পর্বের শিরোনাম দেখে কেউ অন্যধারার কথাকার সুবিমল মিশ্রর একটি আখ্যানের কথা মনে করে ফেলতে পারেন। রামায়ণ চামারের কথা বর্ণনা করে বাংলায় 'অ্যানটি' উপন্যাস লেখা সুবিমল তাঁর একটি আখ্যানের শিরোনামে রেখেছিলেন পাইপগানকে, যা ক্রমশ গরম হয়ে উঠছিল৷ থাক এখন সুবিমল মিশ্র - 'নুয়ে গুয়ে দুই ভাই', 'হারান মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া অথবা সোনার গান্ধীমূর্তি-এর লেখককে আপাতত ছেড়ে দিয়ে আমরা নয় ফিরি, মুখ সরাই। ষাটের দশকের একেবারে শেষ লগ্নে।
পাইপগান, ছিটকিনি পাইপগান। চেনা জানা ঘরোয়া লেদ মেশিন থেকে করালে ষোলো থেকে আঠারো টাকা বড় জোর লাগে। বড়বাজারে হার্ডওয়ার্স এর লোহা-লক্কড়ের দোকানে ঘুরে ঘুরে কার্বন স্টিল নয় মাইল্ড স্টিলের রড কিনে আনা, সেই সঙ্গে অতি শক্ত-পোক্ত মোটা স্প্রিং৷ লোহার।
লেদ মেশিনে থ্রেড কেটে বোর করিয়ে ফায়ার পিন। যা টোটা বা বুলেটের পেছনের গোল, নির্দিষ্ট জায়গায় আঘাত করলেই 'ফায়ার'। ছিটকিনি চেহারার ট্রিগার। 'দানা' বা গুলি বলতে মূলত পুলিশ নয়তো আর্মির থ্রি নট থ্রি। লোহার কালো ক্লিপে আটকে চলে আসে সোনার বরণ থ্রি নট থ্রি। কাশীপুর গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরি বা ইছাপুর গান অ্যান্ড শেল থেকে চোরা পথে- ব্ল্যাকে সরকারি বুলেট৷ চ্যানেল আছে পার্টি চ্যানেল, তাতে আসে পটাশ – মোমছাল – লাল – শাদা – পেটো - হাতবোমা বানানর জন্য৷ সেইসঙ্গে গন্ধকও - সালফার, তৈরি হয় গান পাউডার। সুতলি দড়ি, প্লাস্টার অফ প্যারিস, কতই বা তার আবরণ। ভেতরে জাল কাঠি, দুমুখো পেরেক, লোহার নাটবল্টু৷ বোমা ছোড়ার পর বোমা বিদীর্ণ হলে তারা - এই লোহা-লক্কড় মুহূর্তে বুলেট। একটা পয়েন্ট থ্রি নট থ্রি বুলেট সাড়ে তিনটাকা, এক পিস পয়েন্ট থ্রি এইটের দাম তিনটাকা।
পাইপগানের কোনো অনুশীলন - যুগান্তর, বি ভি-- বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স ঐতিহ্য নেই। অর্থাৎ বাংলার 'বিপ্লবী'- 'গুপ্তসমিতি', স্বদেশি করা ছেলেমেয়েরা এই বস্তুটি ব্যবহার করেননি। তাঁরা মূলত বিদেশি রিভলবার-পিস্তল ব্যবহার করেন অ্যাকশনে। আর তা আসত চোরাপথে। 'রডা কোম্পানির' চালান থেকে পেটি ভর্তি জার্মান মাউজার পিস্তল হাওয়া করে দিয়েছিলেন বাংলার বিপ্লবীরা, মূলত বাঘাযতীনের করা পরিকল্পনা মাফিক।
আরও পড়ুন
চান্দ্রায়ণ
জার্মান মাউজার পিস্তলের ভেদ শক্তি সাধারণ রিভলবার- পিস্তল থেকে অনেক বেশি। খানিকটা রাইফেল করেও ব্যবহার করা যেত তাকে। ওড়িশার বুড়িবালায় নদীর তীরে গুলিযুদ্ধ হয়েছিল চার্কাস টেগার্টের নেতৃত্বে চলে আসা বি-ই-শা-ল পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যতীন্দ্রনাথ বা জ্যোতিন্দ্রনাথ, চিত্তপ্রিয়, মনোরঞ্জনরা তৈরি করেছিলেন পলকা প্রতিরোধ।
চাঁদের মরা আলোয় ঘাসজমির ওপর ক্রমে ক্রমে ঝকঝকে ওঠা মাইল্ড স্টিলের পাইপগান অনেকটা যেন শিয়েরচাঁদা সাপ।
আরও পড়ুন
পান-বিড়ির গুমটি
পাইপগানের রেঞ্জ, টার্গেট এবিলিটি, অর্থাৎ যাকে মারব ঠিক করেছি, বা করছি, তার কাছে সগুলি-পাইপগান থেকে ছোড়া 'দানা' - বুলেট কীভাবে পৌঁছাবে তা তো শেষ পর্যন্ত জানে 'ভগায়'।
ছ-সাত হাত বড়জোর, তারপরেই টার্গেট মিস। সত্তর দশকে পরে পাইপগান ইমপ্রোভাইজড - উন্নততর করা হয়। ভারতের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি - আআর সি পি আই থেকে ভেঙে বেরিয়ে আসা হিরন্ময় গঙ্গোপাধ্যায় - হেনা গাঙ্গুলি - বহুজন মান্য হেনাদা বা হেনাবাবু এই পাইপগানের নলের ভেতর থ্রেড কাটিয়ে বাঁক তৈরি করে প্রায় খানিকটা পুরনো মাস্কেট রাইফেলের জায়গায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, এমন অভিজ্ঞতা কারও কারও স্মৃতিতে আছে।
আরও পড়ুন
ঋতু, ঋতুবন্ধ – ঋতুসংহার
হেনাবাবু ছিলেন অত্যন্ত সূক্ষ্ম মস্তিষ্কের সমরবিদ, পান্নালাল দাশগুপ্তও৷ যদিও পরে পান্নাবাবু - পান্নালাল দাশগুপ্ত সশস্ত্র পথ ছেড়ে দিয়ে মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ ও রবীন্দ্রনাথের দেখান পথে ব্রতী হন গ্রাম উন্নয়নে৷ বীরভূমের 'আমার কুটির' ইত্যাদির ব্যাপারে মন দেন।
পাইপগান পয়েন্ট থ্রি নট থ্রি, পয়েন্ট থ্রি এইট, বার কোরের হতে থাকে। সত্তরে সি পি আই (এম), সি পি আই (এম-এল) ও তারকাটা পার্টি, মালগাড়ির ওয়াগন ভাঙিয়েরা 'অস্ত্র' হিসাবে পাইপগানের ব্যবহার করতে থাকে যথেচ্ছ।
আরও পড়ুন
শুকুত – জিহ্বান্তরে আড়-বেগুন
ষাটের শেষ, সত্তরের গোড়ায় তামার তার কাটা ও ওয়াগন ভাঙা, ওয়াগন ব্রেক করে চিনি, কাপড়, ইত্যাদি দামি জিনিস নামান, তারপর তা বিক্রি করা বেশ কয়েকজনের নিয়মিত আয়ের বন্দোবস্ত হয়ে ওঠে।
আর পি এফ ও জি আর পির গুলিতে মৃত্যু হতে থাকে ওয়াগন ব্রেকারদের৷ তা নিয়ে লেখা হয় গল্প। নাটক।
আরও পড়ুন
বর্মা বার্মা বার্মিজ
পাইপগান প্যাঁচ খুলে ছোট করে ফেলা যায়। সিপিআই(এমএল)-এর নেতা চারু মজুমদার 'খতম', অ্যাকশানে আগ্নেয়াস্ত্র বাদ দিয়ে প্রচলিত অস্ত্র - দা, কাতান, ছুরি, ভোজালি, নেপালা, চপার, গুপ্তি, বাঁশপাত্তি, কান পুরিয়া, রাম পুরিয়া, টাঙি, তলোয়ার, ইত্যাদির ওপর নির্ভর করতে বলেন। এমনকি প্রয়োজনে আধলা ইট, পাথর ইত্যাদি দিয়ে 'শ্রেণীশত্রু'কে থেঁতো করার কথাও বলেন। কিন্তু ততদিনে পাইপগান কালচার, ওয়ান শটার সংস্কৃতি সিপিআই(এমএল) - এর অ্যাকশন পরিকল্পনায় মিশে গেছে।
রগে মাথা ঠেকিয়ে না মারলে, পাইপগানের হত্যা নিশ্চিত হয় না, 'খতম' আরো নিশ্চিততর করার জন্য পাইপগানে গুলি করে ধারাল বাঁশপাত্তি - ধারাল দু মুখো ছুরিতে নলি কাটার রেওয়াজ ছিল সত্তর-এর।
পাইপগানে কাঠের হ্যান্ডেল লাগিয়ে টার্গেট ভেদ করার ব্যাপারটা আরো পরে আসে। পাইপগান, একটা দুটো ফায়ারিং এর পরেই আগুন আগুন। তখন রুমাল দিয়ে চেপে ধরতে হয় তাকে। তারপর আছে ফায়ারপিন অকেজো হওয়ার সমস্যা।
বারবার ছিটকিনি লাগিয়ে ও যদি গুলি না ফোটে, ছোটে তাহলে যে পাইপগান বাজি করছে তার তো ধাত ছেড়ে যাওয়ার দশা। গরম হয়ে গিয়ে পাইপগান বার্স্টের ঘটনাও ঘটেছে।
পয়েন্ট টোয়েন্টি বোরের হামবর, ওয়ান শটার সত্তরের দশকে যা পাওয়া যেত একশো টাকায়, নল কাটা রাইফেল যাতে লুকিয়ে রাখতে সুবিধে হয়, এইজন্য ব্যারেল কেটে ছোট করা, এসবই সত্তরের বজ্রনির্ঘোষী অস্ত্রভান্ডারের অঙ্গ।
বাঙালি গাদা বন্দুক দেখেছে অনেক অনেক বছর আগে, ছোট-বড় তোপ-- কামান, সেই সঙ্গে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলার সাত নলিয়া, সাত নলা বন্দুকই ইম্প্রোভাইজড গাদা বন্দুক যাকে ম্যাচলক বন্দুকের মধ্যেই ফেলা যায়। ম্যাচলক বন্দুক, তমানচা-- পিস্তল, সবই। অখণ্ড বিহারের মুঙ্গেরে তৈরি মুঙ্গেরি গাদা বন্দুক অতি বিখ্যাত বহু বছর ধরে। শরৎচন্দ্রের লেখায় শ্রীকান্তের প্রথম পর্বে মুঙ্গেরি গাদা বন্দুকের কথা আছে। স্বদেশি অনুশীলন, যুগান্তর, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স- বিভি, শ্রীসঙ্ঘ দেশি কামার দিয়ে কখনো কখনো কামারশালায় গোপনে তৈরি করাতেন গাদা বন্দুক, রিভলবার, সেই তথ্য আমাদের অনেকেরই জানা। কিন্তু পাইপগান একেবারেই সত্তরের ফসল।
সত্তর দশকে এক ধরণের দিশি রিভলবারও তৈরি করানো হত লেদ কারখানায়৷ কিন্তু তার চেম্বার হুইল ঘোরাতে হত হাতের আঙুল - তর্জনী দিয়ে৷ সেই প্রয়োগও খুব ঝুঁকিদার। ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকত রিভলবারের, চেম্বারের - জ্যাম হয়ে যাওয়ারও থাকত সম্ভাবনা। ফায়ার পিনে গোলমাল হওয়া, ট্রিগারে টান ধরা, সবই আসত সমস্যা হয়ে।
প্রায় এক হাত লম্বা পাইপগানের লম্বাই দু-আড়াই হাত করে, তার ব্যারেল-নলের ভেতর প্যাঁচানো, প্যাঁচানো ঘাট তৈরি করে, সত্তর দশকেই এর একটা উন্নততর চেহারা হাতে এসেছিল অ্যাকশনিস্টদের।
যাদবপুরে বিপ্লবী যুব-ছাত্ররা দেশী কামান, যাকে 'ধাসা'-কামানও বলা হত তার ব্যবহার শুরু করেন সত্তর দশকে। এই নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট বেরোয় তখনকার আনন্দবাজার পত্রিকা।
মনে পড়ে সিপিআইএম-(এল) নেতা চারু মজুমদার স্বপ্ন দেখেছিলেন ২০০টি পাইপগান আর ৭০টি রাইফেল নিয়ে মার্চ করবেন। 'পিপলস আর্মি'-- গণ ফৌজ।
মাগুরজান, রূপসকুন্ডী হয়ে যাওয়ার পর তিনি-- চারুবাবু এই গণফৌজের স্বপ্ন বুনে দিতে চেয়েছিলেন সাধারণ মানুষের মধ্যে।
বালিতে তাপসদার লেদ মেশিন কারখানায় গোপনে তৈরি হত পাইপগান। যা নক্সালপন্থীরা কিনতেন ১৬ নয়তো ১৮ টাকায়। কার্বন-স্টিল নয়, মাইল্ড-স্টিলে তৈরি সেই পাইপগান নানাভাবে ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে।
অলংকরণ – প্রণবশ্রী হাজরা
Powered by Froala Editor