কাটোয় শহর থেকে যবগ্রাম, খানিকটা তো দূরই, খানিক মানে বেশ খানিকটা। সাবেকি সাদা অ্যামবাসাডার। ইচ্ছে হলে বা অন্য কোনো উপায় না থাকলে ঠাসাঠাসি করে চালক সমেত ছ জন। তারপর তো ‘চল পানসি বেলঘরিয়া’। কাটোয়া রবীন্দ্র পরিষদের উদ্যোগে হাসানদা— হাসান আজিজুল হক— এই উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আখ্যানকার, বিশেষ করে ছোটোগল্পে যাঁর সিদ্ধি প্রায় প্রশ্নাতীত। ‘প্রায়’ বললাম এই জন্য, আমার এই কথা নিয়ে কেউ কেউ হয়তো বা তর্ক ফাঁদতে পারেন, তাই এই প্রয়াস মাত্র। ১৯৯৮ সাল হাসানদা তখনও বেশ টরটরে। খুব ঢোলা— অনেকটা ঢিলে— আমি ঘেরের দিক থেকে বলছি, তার ওপর ঢিলা পাঞ্জাবি। বোধ হয় মুগার। যবগ্রামে হাসান আজিজুল হকের পৈতৃক বাড়ি। ওঁদের ভিটেটা এখনও বর্তমান। ইন্ডিয়া এলে তেমন সুযোগ সুবিধে হলে মাঝে মাঝে নিজের ভিটে দর্শন করে আসেন হাসানদা। আমিও তাঁর যাত্রাসঙ্গী যবগ্রামের পথে, কাটোয়া থেকে। এই সব যাওয়া-আসা— সমস্ত কিছুর দায়িত্ব কাটোয়ার রবীন্দ্রভবন আর তার যাঁরা কর্ণধার, তাঁদের। বিশিষ্ট বুদ্ধিব্রতী, অধ্যাপক, হৃদয়বান তুষার পণ্ডিতই মূল উদ্যোক্তা হাসানদাকে কাটোয়া থেকে যবগ্রাম নিয়ে যাওয়ার।
তখন প্রায় গ্রীষ্ম দিন। আমরা রওনা দিলাম কাটোয়া থেকে, তখন প্রায় মধাহ্ন। পথে গাড়ি থামিয়ে হাসানদা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে পোড়া মাটির, লালচে বড়ো হাঁড়ির দু হাঁড়ি রসগোল্লা কিনলেন ওজন দরে। তারপর যিনি মিষ্টি-বিক্রেতা— ময়রামশাই, তাঁকে হাসানদা বললেন, বেশি করে ঝোল দাও ভাই। ‘ঝোল’ বলতে যে এখানে রসগোল্লার রস, তা বুঝতে সামান্য সময় লেগে গেল। তারপরই বুঝলাম ময়রামশাই ‘ঝোল’ দিচ্ছেন রসগোল্লার হাঁড়িতে। হয়তো দু-একটি ফাউও।
যবগ্রামে পৌঁছে হাসান আজিজুল হক তো খুব খুশি। তাঁদের যে ভিটে ছিল একসময় তার যে খুব একটা চিহ্ন আছে এমন নয়। খানিকটা জমি আছে, ফাঁকা। এই ভিটের ধ্বংসাবশেষ থেকে হাসানদার খালা-খালাম্মা-মাসিমার বাড়ি সামান্যই দূর। আমরা সবাই সেখানে যাই। দোতলা মাঠকোঠা— মাটির দোতলা বাড়ি। চমৎকার নিকনো, ঝকঝকে। দেওয়াল, মেঝে— সব, বোঝা যায় লাতা-ন্যাতা বোলানো হয় নিয়মিত। হাসানদার খালাম্মা-খালা-মাসি হাসিনদাকে দেখে আপ্লুত। অভিমান, আনন্দ, রোদন— যেমন হয়ে থাকে, সাধারণত— আবেগ। কান্না কান্না। ছাপা শাড়িতে খালাম্মা। মাথায় ঘোমটা, নাহ্, কানের পাশে টেনে-টান দিয়ে যে ইসলামি আদলের ঘোমটা-স্টাইল গত তিরিশ-বত্রিশ বছর ধরে পশ্চমবঙ্গে এবং বাংলাদেশেও, তা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত খালাম্মার টানা ঘোমটায়। খালু এলেন। খালি গায়ে, তারপর গেঞ্জি পরলেন তাড়াতাড়ি। কনুই পর্যন্ত সাদা গেঞ্জির সঙ্গে চেকদার রঙিন লুঙ্গি। কোমরে গামছাটি টেনে বাঁধা। মাথায় নামাজি টুপি। থুতনিতে সাদা দাড়ি, একটু লম্বাই। ঐ যেমন হওয়ার কথা এক মুঠ পরিমাণ, তার বেশি নয়, ইসলামি কেতাবে যেমন সুন্নত, ফরজের কথা বলা আছে, সেই হিসাব মেনেই। পায়ে— হাসানদার খালু—মেসোমশাইয়ের পায়ে জুতো ছিল না। হাওয়াই চপ্পল, বর্ধমানের ধুলোমাখা পথ যাত্রায়। তাঁর পায়ের গোড়ালি ফাটাচটা। সেখানে সময়ের ধূলি। যেরকম ছবি ফুটে ওঠে। মাঠজাগা মাঠচষা কৃষকের পা যেমন হয়, এ পাতা তেমনই। পায়ের গোড়ালি প্রসঙ্গে মনে পড়ল আমার বন্ধু শ্রদ্ধেয় কথাকার শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি বাক্য। বহু বছর আগে। সে হবে ১৯৯২-১৯৯৩। শ্যামল তখন সপরিবারে থাকেন সুনীল ভূঁইয়ার বাড়ি। ভাড়া থাকেন সুনীল ভূঁইয়ার ব্রহ্মাপুর বাদামতলা থেকে একটু ভেতরে নামপাড়ার দিকে— সুনীল ভূঁইয়ার দোতলা বাড়ি। তার একতলাতেই শ্যামল আর তাঁর প্রায় মীনাকুমারী-মুখশ্রীযুক্ত স্ত্রী ইতি গঙ্গোপাধ্যায়। মতী নন্দী আর শ্যামল দুজনে বিবাহ করেন দুই সহোদরাকে। ইতি আর নীতি। ইতি শ্যামলের। নীতি মতির। ইতি বড়ো। সালকিয়াতে তাঁদের বাড়ি, সম্ভবত ভাড়া বাসা। তখনও ‘পারিজাত’ সিনেমা আছে সালকে বা সালকিয়ায়। ‘শিশমহল’ নামের সাজানো গোছানো থিয়েটার হলটি তখনও রূপ পায়নি। ষাটের দশকে দেখেছি ‘শিশমহল’। বেশ ঝকঝকে থিয়েটার বাড়ি। সালকে নিয়ে তখন মুখে মুখে একটা ছড়া চালু ছিল— ‘গাঁজা-গুলি-কলকে— এই তিনে সালকে’। বালি— হাওড়া জেলার বালি নিয়ে প্রচলিত ছিকুলিটি হল—
‘কাগজ কলম কালি
এই তিনে বালি’।
আরও পড়ুন
নুসকা-টোটকা-মুষ্টিযোগ
আবার উত্তরপাড়া নিয়ে চালু ছিকুলিটি হল—
আরও পড়ুন
কালী, মহালক্ষ্মী, দীপাবলি, দিওয়ালি
‘গাড়ি-বাড়ি-ফুলের তোড়া
এই নিয়ে ওতোর পাড়া’
আরও পড়ুন
লক্ষ্মীর পাঁচালি, তারকেশ্বর…
বালির সঙ্গে বালি কাগজেরও নামও যে জড়িত। কইতে কইতে মনে পড়ল বালি নিয়ে ছিকুলি আছে আর একটি—
আরও পড়ুন
পুজোর পার্টি, ভাতি অথবা চারদিনের প্রেম
‘ছিরে-বিরে-শান্তিরাম
এই তিনে বালিগ্রাম’
শান্তিরাম অর্থে যাঁর নামে ‘বালি শান্তিরাম বিদ্যালয়’। একসময়ে যাঁর নাম ছিল ‘টমসন স্কুল’। পরে সেই নাম পরিবর্তত হয়। নাম বদলে শান্তিরাম বিদ্যালয়। এই তো ১৩ নভেম্বর বালির জিটি রোডে নেমে দেখলাম শান্তিরাম বিদ্যালয়ের দেওয়াল। স্কুলের নাম লেখা বোর্ড, নীলের ওপর সাজানো সাদা অক্ষরমালা। শান্তিরাম রাস্তাতেও গেলাম। সেখানে আমাদের এক বন্ধুর বাড়ি— দড়িকলের মধ্যে। দড়িকল তো বন্ধ হয়ে গেছে কবেই। ঝুনো নারকেলের শুকনো ছোবড়া দিয়ে তৈরি হত কাতা দড়ি। যে দড়ির খণ্ড বিড়ি-সিগারেট, পানের দোকানে তার অগ্নিমুণ্ডটুকু নিয়ে জেগে থাকত, সিগারেট বিড়ি ধরানোর কাজে। এছাড়াও পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকানে কাচের শেড ঘেরা ছোট্ট ল্যাম্পো। তার ভেতরও হলুদ রঙের কেরোসিন আগুন। সেই অগ্নিশিখায় খালি সিগারেটের খোল লম্বায়— কুচো কুচো করে কেটে, তা দিয়েই তামাক-অগ্নির আয়োজন। সিগারেট, বিড়ি ধরিয়ে নেওয়ার কাজ। পান-ব্রি-সিগ্রেটের দোকানে এখন আর মাথায় নিভু নিভু আগুন নেওয়া কাতাদড়ি বা মোটা নারকেল ছোবড়ার দড়ি থাকে না। দড়িই তো তখন কতরকমের পাটের দড়ি, তারও নানা সরু মোটা আছে। অতি পোক্ত শনের দড়ি। যা মোটা হতে হতে কাছি। যে কাছি দিয়ে জাহাজ ঘাটায় জাহাজ, নৌকো ঘাটে নাও বাঁধা হয়, মানে হত আরকি। এই কাছি দিয়েই গুণটানা। স্রোতের বিপরীতে, নৌকোকে নিয়ে যেতে গেলে ‘গুণটানা’ ছিল অবশ্যম্ভাবী, তাও ভাঁটারবেলায়, জোয়ারের সময় নয়। উজান নয়, ভাটি বাইতে গেলে কাঁধে কাছি ফেলে টেনে নিয়ে যাওয়া ক্রমাগত। নগ্নপদ মাঝি-মাল্লারা, তাঁদের সমবেত পেশিশক্তির জোরে, হাত, বুক, পিঠ, কোমর আর পায়ের ভরে, ব্যালান্সে টেনে নিয়ে যান নৌকো ভাটিবেলায়— ভাঁটার টানে, গুণটেনে টেনে। তো সে যাই হোক, এছাড়া ছিল শুকনো নারকেল ছোবড়ার তৈরি ‘কাতাদড়ি’। যার মোটাত্ব নানা সাইজের। কাতা দড়ি দিয়ে টালি ছাওয়া, ছিটেবেড়ার ঘরের বাঁশ ইদ্যাদি বাঁধা হয়। বাঁধা হয় খাপরার ঘরের বেড়াও। থাক ওসব কথা আপাতত। পরে আরও নয় বেশি করে বলা যাবে দড়ি-বৃত্তান্ত। দড়ি নিয়েই তো একটা ‘মুছে যায়’ হতে পারে। তো সেই বালি শান্তিরাম রাস্তার দড়ি কল থেকে আমাদের ৫৯/১৩ শান্তিরাম রাস্তা— এই নম্বরে কনার প্লটের ওপর কমবেশি সোয়া দু কাঠা জমিতে দোতলা বাড়ি। একেবারে রাস্তার ওপর। বাড়ি না বলে এখন তাকে ‘খণ্ডহর’ বা ‘ভূতের বাড়ি’ বলাই হয়তো ঠিক। আমি বাড়িটিকে দেখলে পরে তার ক্রন্দন শুনতে পাই। মা— গায়ত্রী রায়, বাবা— অমরনাথ রায়ের ঐকান্তিক চেষ্টাতে তৈরি হয়েছিল এই বাড়ি, ১৯৬১-৬২ সালে। ইট-বালি-ঘেঁষ-সিমেন্ট-সুরকি। বড়ো ঘরে আটটা জানালা ছিল আমাদের। আজ আর কিছুই তার অবশিষ্ট নেই। সব কারা কারা যেন খুলে নিয়ে গেছে বা খোলানো হয়েছে পরিকল্পনা করে। থাক সেই প্রসঙ্গ।
নীতি আর ইতির মধ্যে নীতি ছোটো, ইতি বড়ো। সে কথা তো আগেই লিখেছি। ইতি ছাত্র পড়িয়ে সংসার খরচ নির্বাহ করার চেষ্টা করতেন। সে তো অনেক দিনের কথা।
শ্যামলের মুখে শোনা বর্ণনায় এরকম পেয়েছি, সালকে— সালকিয়ায় বিয়ের আগে শ্যামল গেছেন ইতির বাড়ি। সেখানে মেঝের ওপর সুতির সাদা চাদরে আপাদমস্তক ঢেকে শুয়ে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাবি বড়ো শ্যালক। কিঞ্চিৎ আসব আক্রান্ত। ফরসা, দীর্ঘদেহী, রূপবান এই বড়ো শ্যালককে নিয়ে পরে গল্পও লিখেছেন শ্যামল, শারদীয় ‘কথাসাহিত্য’ পত্রিকায় ‘বড়কুটুম’ নামে। সেই গল্প লেখার পর শ্যামল আমায় দিয়েছিলেন ‘কথাসাহিত্য’ দপ্তর মিত্র ও ঘোষ-এ পৌঁছে দিতে। শ্যামল তখন ভাড়া থাকেন ব্রহ্মপুরে প্রখ্যাত ভাবুক, কথাকার ও কবি সমীর রায়চৌধুরীর বাড়ি ভাড়া থাকতেন। সমীরদা তখন পাটনায় পোস্টেড। মৎস্য বিভাগ— ফিশারিজে তিনি সরকারি চাকরি করতেন। বড়ো চাকরি। সমীরদার পৈতৃক বাড়ি পাটনায়। তাঁর ছোটো ভাই মলয় রায়চৌধুরী। শান্তিদার ‘আংলা বাংলা’ নামে ছোটোদের বইটি মনে পড়ে। বহু বছর হল ‘আংলা-বাংলা’ ছাপা নেই। আনন্দ পাবলিশার্স-এর বই ছিল, ছোটো সাইজের বই। শান্তিদাই কবিদের কণ্ঠে কণ্ঠে কবিতা আবৃত্তির রেকর্ড করিয়ে বাজারে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। এইচ এম ভি ছিল কি সেই রেকর্ড কোম্পানির নাম? নাকি ‘সোনেলা’ অথব ‘মেগাফোন’? তখনও তো বাজারে ‘ইনরেকো’ কোম্পানির রেকর্ড আসেনি। কি দাপাদাপি তখন কলের গান— গ্রামোফোনের। লং প্লেয়িং রেকর্ড। দু পিঠে দুই দুই— মোট চারটে গান। গ্রামো রেডিও-ও আছে তখন। ছোটো আলমারি চেহারার সেই কাঠের তৈরি গ্রামোফোন রেকর্ড বাজানোর যন্ত্রে একদম ওপর দিকে পর পর পর পর রেকর্ড রাখার ব্যবস্থা। পরের পর রেকর্ড সাজিয়ে ওই মেশিন চালু করলে তখন একে একে রেকর্ডরা অটোমেটিকভাবে নেমে আসে বাজাতে পার ভূমির ওপর। এই মেশিনে রেকর্ড বাজানোর পিন লাগে না। তখন— মানে ষাটের দশকেও পিন দিয়ে বাজানো হত গ্রামোরেকর্ড। ছোটো ধারালো স্টিলের পিন। পাওয়া যায় হলুদ রঙের অতি ছোটো, হাতের পাঞ্জায় ছোটো করে নিয়ে নেওয়া যায় এমন বাক্সে। তখনও রেকর্ডের সাইজ বেশ বড়ো, অনেকটা প্রায় ভাত খাওয়ার ছোটো থালা সাইজ। কালো। তখনও কি রেকর্ড হাত থেকে নিচে পড়লে ভেঙে যায়? না কি তার একটু আগে আগে? তারও আগে তো গালার রেকর্ড। ক্ষণ ভঙ্গুর। ষাটের দশকের বাতিল— কাটা, ফাটা রেকর্ড দিয়েই তো পরে তৈরি হল ডিজাইনদার ফুলদানি। যা টাঙিয়ে রাখা যায় দেওয়ালেও। ১৯৬৭-৬৮ সালে একশো পঁচাত্তর টাকায় পাওয়া যেত ‘ফিলিপস’ কোম্পানির ‘ফিয়েস্তা’। ইলেকট্রিক রেডিওর সঙ্গে তার দিয়ে জুড়ে বা প্রায় আধ হাত লম্বা লাল রঙের ব্যাটারি দিয়ে বাজানো যেত সেই ‘ফিয়েস্তা’। তাতে ঘুরে ঘুরে সেই রেকর্ড বাজত। এইচ এম ভি-র চোঙদার গ্রামোফোনের সামনে বসা ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’-সারমেয়টি পেতলের চোঙদার রেকর্ড প্লেয়ার থেকে কত কি যেন শুনছে। তারপর মেগাফোন-এর পিঠেপিঠ ঠেকানো বাঁশি বাজানো দুই দেবদূত প্রতিম শিশু। এছাড়াও হরিণমার্কা রেকর্ডও তো ছিল। তিরিশের কলকাতায় বাড়ি বাড়ি এসে গ্রামোফোন রেখে যাওয়ার অফার দিতেন গ্রামোফোন— কলের গান কোম্পানির লোকজন। তাঁরা এই যন্ত্রটি রেকর্ড-সহ কয়েকদিন সেই সম্ভাব্য গ্রাহকের বাড়ি রেখে যাওয়ার প্রস্তাবও দিতেন। বাড়ির কত্তা-গিন্নি মিলে শলা করে সেই কলের গান রেখে দিলে, দিন সাতের পর বহু বাড়িতেই ঢুকে যেত গ্রামোফোন। তখন তো,
‘সুখী গৃহকোণ
শোভে গ্রামোফোন’
তিরিশের দশকে কলকাতায় এই ছবি ছিল চেনা। তখন হাতল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দম দিয়ে চালানো হত ‘কলের গান’। দম ফুরিয়ে গেলে আবার নতুন করে দম দেওয়া। পিনের স্পর্শে বাজে রেকর্ড পেতলের চোঙা হয় তখন। ঝকঝকে সোনা প্রায়, ব্রাসো দিয়ে পরিষ্কার করলেই। এছাড়াও সামান্য খেলো— সস্তা লালচে-গোলাপি কাচ বা প্লাস্টিক জাতীয় ভঙ্গুর কোনো মেটিরিয়াল দিয়ে তৈরি চোঙা। কলকাতায় শেয়ালদার কাছে চোরা বাজারে হরেককিসিমের চোরাই জিনিসের সঙ্গে— ঘড়ি, চশমা, ঝর্ণা কলম, আরও সাত-সতেরোর সঙ্গে চোরাই বা কোনো ‘বড়ো-বাড়ি’ থেকে বেচে দেওয়া গ্রামোফোনও থাকত। সেখানে বিক্রি হত কে মল্লিক, কমলা ঝরিয়া, মানিকমালা, ইন্দুবালা, আঙুরবালা, হরিমতি, কাননবালাসহ অনেকের গাওয়া গানের রেকর্ড। থাকতেন রেকর্ডবন্দি বুন্দু খাঁ। জ্যোতি সিনেমার উল্টোদিকের ফুটপাথ ধরে আর একটু এগিয়ে গেলে রাস্তার ওপর— ফুটপাথেই পুরনো বই আর পুরনো রেকর্ডের দোকান। ওই যে খান দুই তিন পুরনো রেকর্ডের দোকানে মূলত হিন্দি আর ইংরেজি গান ও সুরের রেকর্ড। ‘কাপ সেপ্টেম্বর’— ওফ হো। সেই সঙ্গে সঙ্গে ‘সাউন্ড অফ মিউজিকে’। যার কাহিনি ভেঙে বাংলায় আর হিন্দিতে কাহিনি চিত্র নির্মিত হয়েছে। বাংলায় ‘জয়জয়ন্তী’। উত্তমকুমার, অপর্ণা সেন, ললিতা চ্যাটার্জি। জমজমাট মিউজিক্যাল ছবি। ইংরেজি টিউন আর গানের লং প্লেয়িং রেকর্ড, সেইসঙ্গে পুরনো হিন্দি গানের লং প্লেয়িং। গ্লোরিয়াস ফর্টিজ, ফিফটিজ, সিক্সটিজ। পরে সেভেনটিজও। কীসব গান। সেই সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সঙ্গীতের মায়াস্ত্রোদের সেতার, সরোদ, বাঁশি, শাহনাই বাদন। উস্তাদ বিলায়েত খাঁ সাহাব। পণ্ডিত রবিশঙ্করজি, পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্নপূর্ণা দেবী, উস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহাব, উস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ সাহাব, পণ্ডিত মণিলাল নাগ, শিশিরকণা ধর চৌধুরী, পণ্ডিত রাধিকামোহন মৈত্র, পান্নালাল ঘোষ। এছাড়াও রাধারানী দেবীর কীর্ত্তন। কীর্ত্তন রমীনবাবুর। ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ও আছেন। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় শেয়ালদার এই চোরাবাজার থেকেই উস্তাদ খালে খাঁ সাহাব ও বুন্দু খাঁর রেকর্ড কিনেছিলেন। সঙ্গে কে এল মল্লিক।
Powered by Froala Editor