‘নুসকা’— এই শব্দটি হিন্দি বলয়ে— গো বলয়ে খুবই প্রচলিত শব্দ। ‘নুসকা’ হল গিয়ে ঠাকমা-দিদিমা-পিতামহী-মাতামহী-দাদি-নানিদের হাতের কেরদানি— ‘গুণ’, আন্দরমহলের হিসাব নিকাশ। আলিফ, বে, তে, সে বলা বা ডান দিক থেকে লেখা উর্দু অক্ষরমালা, ফারসিও ডান দিক থেকেই লেখা হয়, তো সেই উর্দু ভাষায়— উর্দুতে একটা কহাবত বা প্রচলিত কথা আছে— নুকতা কি হেরফের সে খুদা জুদয় হো যাতা হ্যায়। সামান্য— অতি সামান্য ইলেক বা আঁকড়ির বদলা বদলির ফলে ‘খুদা’— বিশ্বাসীদের কাছে সর্বশক্তিমান ‘জুদা’— অলগ— আলাদা হয়ে যেতে পারে বা হয়ে যায়। সে যাই হোক পিতামহী-মাতামহীদের— দাদি-নানিদের যেমন ঘরওয়ালি নুসকা ছিল, তেমনই হিন্দি বলয়ের হেকিম সাহাবরা এই নুসকাকেই সম্প্রসারিত করলেন আরেকটা নিজেদের হেকিমি দাওয়া-দারুর প্রয়োগে। হিন্দি বলয় বা গো বলয়ের ঘরোয়া— ঘরেলু নুসকাই বাঙালি জীবনের টোটকা বা মুষ্টিযোগ। মুষ্টিযোগ একটু ভারি, কেমন যেন দূরবর্তী শব্দ, টোটকা কিন্তু তা নয়। এক সময় রাস্তার ধারে— ফুটপাথের ওপর ‘কোকশাস্ত্র’, ‘কাশ্মীরি কোকশাস্ত্র’, ‘রতিশাস্ত্র’, ‘ভূত ডামর তন্ত্র’-এর পাশাপাশি বিক্রি হত ‘লতাপাতার গুণ’, ঘরোয়া টোটকা চিকিৎসা প্রভৃতি। এইসব কেতাব অধিকাংশই ছাপা চিৎপুরে। ইদানিং ট্রেনে— ইদানিং কেন, গত তিরিশ বছর ধরেই ট্রেনে এইসব লতাপাতার ‘ধন্বন্তরী’ ফর্মুলা বই হিসাবে বিক্রি হয়। চটি, চটি বই তেমন আহামরি— দেখদারি কিছু নয়, কাগজ খারাপ, দামেও বেশ সস্তা, সেইসব চটি বই। তিরিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ দশকে তো বটেই, তথাকথিত বহু বিখ্যাত— অতিবিখ্যাত বাড়ি ছিল, যেখানে চোর ধরার জন্য বাটি চালা, কড়িচালা, হাত গোনা, ইত্যাদি প্রভৃতির পাশাপাশি ‘নখদর্পণ’ ব্যবস্থাও চালু ছিল। ডান হাতের বুড়ো আঙুলে কালো ভুষো মাখিয়ে তারপর যার আঙুলে ভুষো বা ভুষো কালি মাখানো হল, তার কপালের দুপাশে রগড়ে চেপে ধরে— খালি বলতে থাকা, কালি মা-রে ক—কালি মা-রে, ক…। এই প্রবল উচ্চারণ, যিনি নখদর্পণ করাচ্ছেন, তাঁর। ‘নখদর্পণ’ যিনি করাচ্ছেন, তাঁর ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা কালীমূর্তি তো থাকবেই। অবশ্যম্ভাবীভাবেই কালী, নয়তো তারা মূর্তি। তবে তারামূর্তি তলনায় অনেক কম। এছাড়াও পেতলের গামলায় ভর্তি জল দিয়ে, সেখানে জলদর্পণ করা হয়। পিত্তলের গামলায় রাখা জলের ভেতর দুর্জ্ঞেয় এক ছায়া ছায়া ছায়া অবয়ব। তাদের অনুসরণ করেই তো ফলাফল বলা। এরকম ফরচুন টেলার, ‘অমুক বাড়ি’, ‘তমুক বাড়ি’ ছিল, এখনও আছে। তবে ইদানিং টিভি-তান্ত্রিকদের দৌরাত্ম্যে, হাতিবাগান, হাওড়া ইত্যাদি প্রভৃতি স্থানে ভাগ্য ব্যবসা জমানো এইসব জনেদের পাত্তা খানিকটা কেটেছে। আবার কোনো কোনো বিশেষ ‘বাড়ি’ বা বাটীর লোকেরা টেলিভিশনের প্রাইভেট— ছোটো, বড়ো, মাঝারি নানা চ্যানেলে এইসব ‘বাড়ি’-র ঐতিহ্য নিয়ে আসেন। এছাড়া বহু নতুন নতুন ভবিষ্যৎ বক্তাদেরও দেখা গেল, যাদের পিছনে সেই ‘বড়োসড় ঐতিহ্যময় বাড়ি’-র আলোকিত কোনো বৃত্ত বা অরা নেই। থাক সে সব কথা। হিন্দি বা গোবলয়ে অতি বিখ্যাত সব হেকিম সাহাবরা নিজেদের ইলাজের চিকিৎসা— তরিকা নিয়ে উপস্থিত থাকেন। ‘তানসেন গোলি’— যৌনক্ষমতা, যৌনশক্তি বর্ধক এই রুপোলি রঙের তবকে মোড়া ‘গোলি’ বহু ‘ধ্বজভঙ্গের’ ধ্বজ উঁচা করে দেয়। এরকম দাবি হেকিমসাহাবদের অনেকের। হেকিম সাহাবরা মূলত ‘কালি মির্চ’— গোল মরিচ, কালি নুন— কালি নমক— বিট নুন ব্যবহার করে থাকেন তাঁদের দাওয়া নির্মাণে। এর সঙ্গে জড়িবুটি তো অবশ্যই থাকে, সেইসঙ্গে আদ্রক— আদা।
নানা ধরনের জড়িবুটি। গাছগাছালির শিকড়বাকড়, পাতা, মধু সবই ব্যবহার করে থাকেন। একটা বিষয় লক্ষ করার, মধু— শহদ কবিরাজি ও হেকিমি— দুই তরিকার চিকিৎসাতেই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে। কবিরাজরা খাওয়ানো ও লেপন পদ্ধতিতে বহুসময়ই ব্যবহার করে থাকেন আমলকি, হরিতকী, পিপুল, বয়রা, বচ, শঙ্খপুষ্পি, গোক্ষুর, অশ্বগন্ধা, অর্জুন গাছের ছাল, নিম— নিমপাতা ও নিমের ছাল, সবই থাকে। এর সঙ্গে সঙ্গে থেকে যায় হরিতাল ভস্ম, মুক্তাভস্ম আরও নানাধরনের ওষুধ তৈরির জিনিস। কবিরাজি চিকিৎসায় আবীর ও সোরা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত একসময়। রোগীর পেচ্ছাপ আটকে গেলে তখন তার নাভির চারপাশে সাদা সোরা ছড়িয়ে দিয়ে অপেক্ষায় থাকা, কখন যেন তলপেট কুলকুল করে পেচ্ছাপের বান ডাকে। তারপর অনায়াসে হুড়হুড় হুড়হুড় করে বেরিয়ে আসে দুর্ঘন্ধযুক্ত প্রস্রাব। এটাকে কি ‘টোটকা’, ‘মুষ্টিযোগ’ বলব? নাকি ‘নুসকা’? এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল আমাদের অনেকের ‘নুসকা’ ইত্যাদি নিয়ে কেন দাঁড়িয়ে থাকে, নুসকা-পন্থীরা কীভাবে, কীভাবেই সমাধানে পৌঁছাবেন, আমার তো একেবারেই জানা নেই। কবিরাজি চিকিৎসায় ‘স্বর্ণপর্পটি’ বলে একটি চিকিৎসা আছে, আমার ‘ছবিতে পৃথিবী’ গল্পে আছে এই চিকিৎসা পদ্ধতির কথা। ‘স্বর্ণপর্পটি’ চিকিৎসা পদ্ধতি যার ওপর প্রয়োগ করা হয়, সেই রোগীকে জল খেতে দেওয়া হয় না মোটে। তিরিশের কলকাতায় এই স্বর্ণপর্পটি চিকিৎসা ধারা প্রয়োগ করতেন কবিরাজরা। জলের বদলে দুধ। সব কিছু দুধে। জল পিপাসার তাড়নায় রোগী অনেক সময় শৌচালয়ের— পায়খানার জল পর্যন্ত পান করেন পানীয় জলের বিকল্প হিসাবে। ‘স্বর্ণপর্পটি’ চিকিৎসা সাধারণভাবে ধনীরাই করাতে পারতেন। প্রয়োজনে বাড়িতে গরু, গোয়াল ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হত। সম্পূর্ণ চিকিৎসাটাই দুগ্ধনির্ভর, সে কথা তো বলেছি আগেই।
আবির— পুরনো আবির ব্যবহার করে বহু সময়েই কবিরাজ মশাইরা হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া রোগীর শরীরে উত্তাপ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতেন। তখন তো বটব্যাগ ইত্যাদি নেই। ফলে মরণোন্মুখ মরিজ-রোগীর শারীরিক উত্তাপ ফিরিয়ে আনার জন্য অভ্র মেশানো আবির। কবিরাজ মশাইরা তখন আবির ব্যবহার করতেন কাপড়ের পুঁটলির মধ্যে দিয়ে, তখন তো এত এত সিনথেটিক আবির তৈরি হয়নি, হয় না। এইসব আবিরে অনুপস্থিত সবধরনের কেমিক্যাল। কাপড়ের পুঁটলির ভেতর আবির— লাল আবির। তখনও বাজারে ম্যাজেন্টা, সবুজ, হলুদ, গেরুয়া— কোনো আবিরই তো নেই। কবিরাজি চিকিৎসা পথে সূচিকাভরণ বলে একটি তরিকা ছিল। সে বড়ো কঠিন চিকিৎসা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি অসামান্য গল্প আছে— অন্তর্জলী— এই গল্পটির কথা অনেকেই তেমন করে জানেন না। অসাধারণ সেই গল্প। আপাতত থাক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প প্রসঙ্গ। পুনরায় ফিরি হেকিমসাহাব ও ঘরোয়া নুসকা, টোটকা বা মুষ্টিযোগের বিষয়ে। মুষ্টিযোগ শব্দটি বহুপ্রাচীন। কবিরাজি দাওয়াখানা, চিকিৎসালয়ে বড়ো ও ছোটো পাথরের খল-নুড়ি, পিতল, পাথর ও লোহার হামানদিস্তা চোখে পড়ে। পুরনো ঘি, প্রাচীন পকু, তিন্তিড়ি— পাকা তেঁতুল শেকড়-বাকড়ের বনজ ঝাঁঝালো ঘ্রাণে সমস্ত কবিরাজখানা এক ঝিমঝিমে গন্ধেভরা। বইঘরের দেওয়াল আলমারির কাচে সময়ের ধুলো ও মাকড়সার জালও কখনও কখনও। প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক ও গল্পকার— সাদা ঘোড়া, ডমার চিতা, যৌবন, খোসা ইত্যাদি গল্পের লেখক রমেশচন্দ্র সেন ছিলেন কবিরাজ। তাঁর কবিরাজখানা ঘিরে আড্ডাও বসত। সেই আড্ডায় যেতেন অনেকে। বালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর কাছাকাছি একটি কবিরাজি চিকিৎসালয় ছিল নব্বই দশকেও। প্রধীর দাশগুপ্ত নামে একজন খুব নামকরা চিকিৎসক চালাতেন এই কবিরাজখানা। প্যান্ট-শার্ট পরা কবিরাজ মশাই সেই আমি প্রথম দেখলাম। কবিরাজ মশাইরা সাধারণভাবে পাড়ছাড় ধুতি, সুতির দচাদর, গরমে এই তাঁদের পোশাক। ধুতি-চাদর, পায়ে কাঠের বউলাদার খড়মে এইসব খটখটে কবিরাজ মশাইরা বেশিরভাগই বৈদ্যকূলজাত। সেনশর্মা, সেন, সেনগুপ্ত, দাশগুপ্ত ইত্যাদি প্রভৃতি তাঁদের পদবি। বৈদ্য সম্প্রদায়ের কবিরাজরা ছাড়াও ছিলেন পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ কবিরাজ। মূলত নাড়িজ্ঞান, নাড়িচর্চার ওপর তাঁরা তাঁদের চিকিৎসা পদ্ধতি চালাতেন। নাড়ি ধরে তাঁরা কেউ কেউ বলতে পারতেন কতদিন— আর কতদিন বাঁচবে এই রোগী। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরোগ্য নিকেতন উপন্যাসে আছে নাড়িবিজ্ঞানী জীবন মশাই— জীবন মহাশয়ের কথা। ‘মহাশয়’ বংশের এই মানুষটি নাড়ি ধরে— নাড়ির স্পন্দন অনুসরণ করে চিকিৎসা করতেন। এই ‘আরোগ্য নিকেতন’ নামের আখ্যান নিয়ে সিনেমা— চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। সিনেমাটিতে বিকাশ রায় ছিলেন ‘মহাশয়’ বংশের জীবন মশাইয়ের চরিত্রে। জীবন মশাইয়ের স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ছায়াদেবী। আরও ছিলেন রুমা গুহঠাকুরতা আর শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের সিনেমা-মা রুমা গুহঠাকুরতা, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় সিনেমা-নাতি বিকাশ রায়ের। পণ্ডিতমশাইদের, পুরোহিতদের স্টাইলে ‘শিখা’ বা টিকি রাখা থাকত কবিরাজ মশাইদের— বিশেষ করে তাঁরা যদি বৈদ্যবংশজাত না হয়ে ব্রাহ্মণ হন। তখন তো শিখা— টিকি অবশ্যম্ভাবী।
কবিরাজি ও ইউনানি— হেকিমি চিকিৎসা বহু জায়গাতেই প্রায় বিলুপ্ত। ইউনানি চিকিৎসার মূল শিকড় আরবে। পরে তা ইসলাম ধর্মীয় মানুষদের আগমনের পাশাপাশি চলে আসে। আর এই ইউনানি মতে রোগ সারানোর কাজ করে থাকেন হেকিম সাহাবরা। কবিরাজ, ডাক্তাররাও অখণ্ড বঙ্গের পূর্ববঙ্গে ঘোড়ায় চেপে রোগী দেখতে আসতেন। কবিরাজ মশাই ডাক্তাররা সবাই হিন্দু। প্রতাপও ছিল তাঁদের অনেক। অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, কবিরাজি, ইউনানি, ঝাড়ফুঁক, তেল পড়া, জল পড়া, সবই পাশাপাশি থেকেছে, থাকছেও আমাদের এই দেশে। ইউনানি চিকিৎসায় আদা ও শুকনো আদা— শুঁটের খুব কদর। ইলাহাবাদে আমার বড়ো মাসি— মায়ের জ্যাঠতুতো বোন রেণুমাসির বড়ো ছেলে খোকনদা— রঞ্জিত কোনো এক হেকিম সাহাবকে ধরে নিজের কিছু কিছু চিকিৎসা ইউনানি মতে করেছেন। ইলাহাবাদের হেকিম সাহাব তাঁর— তাঁদের স্বভাবসিদ্ধ বোলি এবং শকল— চেহারা একেবারে ছকে বাঁধা যাকে বলে। লম্বা ঝুলের শেরওয়ানি, ঢিলে পায়জামা, সঙ্গে ব্যাকবেল্ট অথবা কাবলি শ্যু। কাবলির বদলে অনেক সময়ই থাকে ফিতে বাঁধা বুট জুতো। ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত বা ধ্রুপদী সঙ্গীতের যেমন ঘরানা স্টাইল আছে তেমনই কবিরাজ মহাশয়— কবিরাজমশাই, হেকিম সাহাবদের জন্যও রয়েছে ‘থাক’ যা ঘরানার ইস্টাইল। মনে পড়ে শোনা গল্পে কবিরাজ মশাইদের অখণ্ড পূর্ববঙ্গের এখানে-ওখানে-সেখানে যেতে ঘোড়া— অশ্বারোহণ ছাড়াও নৌকো নিয়ে রোগী দেখতে যাওয়া। নদী দুর্গম অখণ্ড বঙ্গের পূর্বভাগে সেইসব অতিবিখ্যাত কবিরাজ কোবরেজ মশাই বা কবিরাজ মশাই নৌকা যোগে রুগী বাড়ি। তখনকার দিনে রাজপণ্ডিত— দ্বার পণ্ডিতের মতোই রাজ-কবিরাজও হত বলে শুনেছি। তাদের সঙ্গে থাকত বেশ বড়োসড় কবিরাজি বটুয়া। সেই বটুয়ার ভেতর রাজ্যের কবিরাজি মতে চিকিৎসা সংক্রান্ত জিনিস— ‘জিনিস’ মানে ‘রাজ্যের জিনিস’। সেখানে খল-নুড়ি, পিতলের ছোটো হামানদিস্তা, নানা ধরনের শিকড়-বাকড়, মধুর বোতল, সে এক এলাহি যজ্ঞ যেন। বাগবাজারে প্রখ্যাত কবিরাজ ছিলেন হেরম্ব কবিরাজ। প্রায় সকলেই তাঁকে সম্বোধন করতেন ‘কবিরাজ মশাই’ বলে। হেরম্ব কবিরাজের বাড়ি উত্তর কলকাতার বাগবাজারে, লক্ষ্মী দত্ত লেনে। সেই বাড়িতেই একটি ঘরে ভাড়া থাকতেন আমার বহুগুণের গুণী দাদামশাই— হরিপদ রায়। একটিই ঘর। সেখানে দেশভাগের অনেক আগেই— ১৯৪২-এর ‘গ্রেট ফেমিন’— মহাদুর্ভিক্ষের বছর অখণ্ড বঙ্গের পূর্ব ফরিদপুরের আকসা-ভোকেশ্বের থেকে চলে আসেন হরিপদ রায়। কোনো অভিমানে কী? তাঁর এই কলকাতা আগমন নাকি ভাগ্যান্বেষণে? নতুন চাকরি ‘বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিল’-এ। সুন্দরী স্ত্রী লীলাবতী, ঊষা, গায়ত্রী অচিন্ত্য আর নমিতাকে নিয়ে তাঁর চলে আসা। অখণ্ডবঙ্গের শ্রীরামপুরে। হুগলি জেলার শ্রীরামপুরে পর পর দুটি বাড়ি ভাড়া নেন হরিপদ। প্রথম বাড়িটি ছেড়ে পরের বাড়িটিতে সপরিবারে উঠে আসেন হরিপদ রায়। এই বাড়িতেই সূতিকায় অতি অল্প বয়সে— বছর তেত্রিশ-চৌত্রিশ হবে বড়োজোর— লীলাবতীর মৃত্যু হয়। জ্বর আর জ্বর। সেই জ্বর আর কমেনি। খানিকটা উদাসীন, অলস, প্রচণ্ড প্রতিভাবান, বহুদর্শী হরিপদ রায়ের যখন স্ত্রী বিয়োগ হয় তখন তিনি বছর পঁয়তাল্লিশ। রূপবান, মেধাবী, প্রচুর খামখেয়ালী হরিপদ রায় ছিলেন খুব শৌখিন মানুষ। কোনো চাকরিতেই তিনি থিতু হতে পারতেন না। ঘন ঘন চাকর বদলে ফেলতেন তিনি। আবার পেয়েও যেতেন। হরিপদ রায়ের জন্ম ১৮৯৯ বা ১৯০০— ইংরেজি সালের হিসাবে। তাঁর প্রয়াণ ১৯৭৮ সালে— পশ্চিমবঙ্গের মহাবন্যা— মহাপ্লাবনের বছরে। এ রাজ্যে তখন নবীন বামফ্রন্ট সরকার। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। অ্যাত অ্যাত কথা বলা এই জন্য— হরিপদ রায় কবিরাজি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন পরীক্ষা দিয়ে। ‘শাস্ত্রী’ উপাধি ছিল তাঁর। তিনি এন্ট্রান্সে সম্ভবত সাতটি লেটার পেয়েছিলেন। আটটিও হতে পারে। তারপর বিএ পাশ করেন অখণ্ড বঙ্গের ‘স্কটিশ চার্চ কলেজ’ থেকে। কবি ও আখ্যানকার, ‘পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ’ রচনাকার অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ছিলেন তাঁর সহধ্যায়ী। কলেজে পড়ার সময় কলকাতায় মেসে থাকতেন তিনি ভাড়ায়। তিনি কী কখনও থাকতেন দক্ষিণ কলকাতায় নাকি উত্তর ও দক্ষিণ মিলিয়ে থাকতেন উত্তর কলকাতা— বৌবাজার অঞ্চলেই তাঁর মেস করে থাকা স্বাভাবিক। অথবা আমহার্স্ট স্ট্রিটে। তখন কলকাতায় ঢাকা মেস, বরিশাল মেস। অখণ্ড বঙ্গের সব স্মৃতিমালা। সেটা তিরিশের শেষ হবে হয়তো। নাকি মাঝামাঝি? গোটা বাংলা তখন বোমা-পিস্তলের লাইনে থাকা আগুনগাথার স্রষ্টাদের সঙ্গে ফুটছে।
Powered by Froala Editor