লক্ষ্মীর পাঁচালি, তারকেশ্বর…

মুছে যায়?— ৬৫
আগের পর্বে

সত্তর দশকের প্রায় শেষ লগ্নে পুজোর কদিন মহিলা সঙ্গিনী, ‘তোলা’-র ধারা ছিল উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতায়। তবে পুজোর চারদিনের প্রেম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্থায়ী হত না। পাশাপাশি বসে সিনেমা দেখা পর্যন্তই। সেই প্রেমে মোগলাই পরোটা, ফুল প্লেট কষা মাংস, কোল্ড ড্রিংকস, ফুচকা— এসবই ছিল ছোটো-বড়ো অনুঘটক। প্রেমপত্র-নির্ভর ভালোবাসায় অনেক সময়ই গর্ভবতী হয়ে পড়তেন মেয়েরা। অতঃপর বেছে নেওয়া আত্মহত্যার পথ। তারপর...

আশ্বিন মাসে কোজাগরী পূর্ণিমায় কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো একেবারেই পূর্ববঙ্গের। পদ্মাপারের বাঙালদের। যশোর, খুলনার যাঁরা আদি বাঙালি হিন্দু অধিবাসী, তাঁরা তো সেই অর্থে খানদানি বাঙাল নন একেবারেই। পদ্মাপার, ম্যাঘনা, দ্যাশের বাঙালরা অনায়াসে নিজেদের মধ্যে খুলনার ভাষা নিয়ে একটু ঠাট্টা-ঠিসেরা, হ্যাঁ ঠাট্টাফাট্টাই— খানি নাতি বেলা গেল/ হুতি পারলাম না।

যাঁরা সেই অর্থে পদ্মা পার বা ম্যাঘনা পারের বাঙাল নন তাঁরা শ্যামা কালীপুজো বা দীপান্বিতার দিন যে মহালক্ষ্মী পুজো, তা করে থাকেন নিজেদের বাড়ি। ইদানিং গজলক্ষ্মী নামে একটি লক্ষ্মীপুজোর কথা ও সেই দেবীর হিন্দি ঘেঁষা বাংলা পাঁচালি আমরা দেখছি, বেশ কয়েক বছর হল। হিন্দু বাঙালি— পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে প্রতি বৃহস্পতিবার— 

দোল পূর্ণিমা নিশা নির্মল আকাশ
মন্দ মন্দ বহিতেছে মলয় বাতাস
লক্ষ্মী দেবী বামে করি বসি নারায়ণ
কহিতেছে নানা কথা মুখে আলাপন
হেন কালে আসিলেন নারদ মুনিবর
হরিগুণ গানে মাতি হইয়া বিভোর…

এইভাবে লক্ষ্মীর পাঁচালি মা পড়তেন। প্রতি বৃহস্পতিবার, যদি না তাঁর শারীরিক অসুবিধা— মাসিক ইত্যাদির ফের থাকত, তাহলে নিয়ম করে পড়তেন তিনি লক্ষ্মীর পাঁচালি, তার সঙ্গে সঙ্গে তারকেশ্বরের পাঁচালি। সেই যে তারকেশ্বরের পাঁচালি তার মলাটে হাফটোনে ছাপা তারকেশ্বরের লিঙ্গ মূর্তি যাকে ধানভাঙানি পাথুরে গর্তের আকর হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন স্থানীয় গ্রামবাসীরা নিয়ম করে। কপিলা নামে গাভী, মুকুন্দ ঘোষ— সবাই এই পাঁচালির অংশভাগী। তারকেশ্বরের পাঁচালির বিচ্ছিন্ন সব লাইন মনে আছে—

আরও পড়ুন
পুজোর পার্টি, ভাতি অথবা চারদিনের প্রেম

‘শতকোঁড়া দিল রাজা কাটিবারে মাটি
হইলে সবে পুষ্করিণীর জাটি…।’

আরও পড়ুন
মার্কনি সেট, রঘুবাবু ও মহালয়া

‘…জটাধারী ত্রিপুরারী দেখিয়া নিগড়ে
রাজা বলে রাখব লয়ে রামনগরের ঘরে…’

আরও পড়ুন
‘ইলাহাবাদী বড়ি ফাসাদি’ নয়

‘তারকেশ্বর শিব আমি কাননে বসতি
মোর পূজা কর ভক্ত লইয়া সন্ন্যাসী…’

আরও পড়ুন
ইলাহাবাদ— পুরানা কাটরা ও অন্যান্য

‘সকাল হইলে গাভী বন পানে ধায়
পিছু আসি মুকুন্দ ঘোষ গোপনে লুকায়…’

এরকম অজস্র টুকরো টুকরো লাইন— লক্ষ্মীর পাঁচালি ও তারকেশ্বরের পাঁচালির মনে পড়ে। যেমন লক্ষ্মীর পাঁচালিতে আছে—

‘আলস্য ত্যাজিয়া সূতা কাট বামাগণ
দেশের অবস্থা মনে করিয়া চিন্তন…’

‘লক্ষ্মীর ব্রতের কথা হল সমাপন
ভক্তিভরে বর যাচ যার যাহা মন
সিঁদুর সিঁথিতে দাও সব এয়ো মিলে
হরিধ্বনি কর সব অতি কৌতূহলে…।’


এভাবেই সমাপ্ত হয় লক্ষ্মীর ব্রত। এই যে লক্ষ্মীর পাঁচালি বেশিরভাগই কলকাতার চিৎপুরের বটতলায় ছাপা। তখন দাম ছিল চার আনা, তখন মানে ১৯৫৩-৫৪ সালে। মা এই পাঁচালি কিনেছিলেন চার আনা দিয়ে। আড়ে ছাপা। যেমন ড্রইং খাতার শেপ হয়। খেলো অফ হোয়াইট কাগজের ওপর অক্ষর বিন্যাস, লালে। আমি লক্ষ করে দেখেছি, শুধু আমি কেন, নজর করে দেখেছেন অনেকেই, এই যে পূজা-আচ্চার বই-পত্র, পাঁচালি ইত্যাদি, তান্ত্রিক আচার-অর্চনার বইপত্র সমূহ, সবই আসলে খেলো কাগজে লাল রঙের অক্ষরে ছাপা। তারকেশ্বরের পাঁচালি অবশ্য তা নয়। সেই পাঁচালি গ্রন্থটি সাদার ওপরে কালোতে ছাপা হয়েছে। মা সেই পাঁচালি কিনে এনেছেন তারকেশ্বর থেকে। আগেই লিখেছি মলাটের, এই যে তারকেশ্বরের পাঁচালির মলাট, তাতে সাদার ওপর কালোতে ছাপা তারকেশ্বরের লিঙ্গ মূর্তি— এই লিঙ্গ মূর্তি স্বয়ম্ভূ, অর্থাৎ যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁরা মনে করেন ভূমির গভীর থেকেই আপনাআপনি উঠে এসেছে এই লিঙ্গ-মূর্তি। অনেকটা মোটা, যেমন বিশ্বনাথধাম— কাশীর তিলভাণ্ডেশ্বর, তিনি নাকি একটু একটু করে বাড়েন। যাক, সে সব কথা। তারকেশ্বরের পাঁচালির ওপর ‘রাঢ়েচ তারকেশ্বর…’ এই ক্যাচ লাইনটি লেখা। অবশ্য তখন তো ক্যাচ লাইন ইত্যাদি ভাবনাই ছিল না। তারকেশ্বরের এই পাঁচালির একটি লাইন এরকম— 

‘মলিন হয়েছি নাথ কামনা ধূলিতে
তোমার পূজার পুষ্প পারি না তুলিতে…’

মনে পড়ে। সব মনে পড়ে যায়। আমাদের ৫৯/১৩ শান্তিরাম রাস্তার এক তলায় মায়ের ঠাকুরের আসন। সস্তার, খেলো, প্লাই জাতীয় কাঠের ওপর, তখন বলা হত ‘কেরোসিন কাঠ’, ফলের পেটির কাঠ, তাই দিয়েই হয়তো এই লক্ষ্মীর ব্যাক গ্রাউন্ড। তার ওপর কাগজে ছাপা লক্ষ্মীদেবী। তার মাথার খানিকটা তেল-সিঁদুর ডগডগে। তেল-সিঁদুর গড়িয়ে লক্ষ্মীর মুখও খানিকটা আবছা। তার পাশেই গাছকৌটো, হয়তো আমার মা-বাবার বিবাহচিহ্ন। তার মধ্যে  সিঁদুর, একটি আস্ত রুপোর টাকা। রানি মার্কা। লক্ষ্মীর আসনে আরও দু-চার জন দেবতা। আসনের বাইরে কাশী থেকে কিনে আনা পাথরের গণেশ, বাবা এনেছেন, কাশী থেকে। তারপাশে বেনারস থেকে বাবারই কিনে আনা পেতলের অন্নপূর্ণা মূর্তি। সুন্দর। এইরকম অন্নপূর্ণা মূর্তি কাশীতেও আর দেখি না আজকাল। বাবা এই পিতল নির্মিত অন্নপূর্ণা কাশী থেকে কিনে এনেছিলেন ১৯৫২ সালে। দশটাকা দিয়ে সম্ভবত। সেই অন্নপূর্ণা আমাদের বালির বাড়ির একতলা থেকে চুরি হয়ে গেছে। ২০০৪ সালে। সেইসঙ্গে মায়ের বিয়ের দানের বাসনকোসন। দুটো পেতলের বালতি, খুব বড়ো একটি পেতলের হাঁড়ি, যাতে মা ভোগ রান্না করতেন, ভোগের খিচুড়ি। তার গায়ে— পেটের ওপর খুব বড়ো করে গায়ত্রী লেখা। গায়ত্রী আমার মায়ের নাম। 

তারকেশ্বরে গেছি বহু, বহুবার আমাদের বালির বাড়ি থেকে। বাবা পিটিও কাটাতেন। তিনটে পাস, ছটা পিটিও পান রেলকর্মচারীরা। হলুদ, লাল, সবুজ— এই হল পাসের রং। তখন সবে ইন্টারক্লাস উঠে গেছে। ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস, থার্ড ক্লাস আছে। ইন্টারক্লাস ছিল সেকেন্ড আর থার্ডের মধ্যে। তখন রেল স্টেশনে স্টেশনে পানি পাঁড়ে। যাঁরা জল দিয়ে যান। বিনা খরচে— পয়সা না নিয়ে। তখন ছিল বিশেষ সেলুন, রেলের কর্তাব্যক্তিদের জন্য। কাঠের কামরা ছিল, থার্ডক্লাসে ছিল ছারপোকা কাঠের সিট। খুব, খুব ছারপোকা— হিন্দির খটমল। বাবা আমাদের নিয়ে তারকেশ্বর যেতেন পিটিও ভাঙিয়ে, লোকাল ট্রেনে। তারকেশ্বর স্টেশন থেকে নেমে সোজা হাঁটা। হন্টন যাকে বলে। তখনও তারকেশ্বরের পিলখানায়— হাতিশালায় হাতি। তখনও তারকেশ্বরে ‘হত্যা’ বা ‘হত্তে’ দিয়ে পড়ে থাকেন মানুষজন, দৈববাণী শোনার জন্য। ‘ওষুধ’ও— ‘দৈব ওষুধ’ও নাকি পেতেন তাঁরা। হাতের মুঠোয় কোথা থেকে যেন উড়ে আসত কোনো শেকড়। তখনও দুধ পুকুরে অনেক অনেক স্নানার্থী। কালী মন্দির, কালী মন্দিরের বাইরে যোগিনীদের জোড়া মূর্তি, যেন দেওয়ালে খোদাই করা। তাঁরা দুজনেই বেশ ভীষণদর্শনা। 

দিঘাপতি ভট্টাচার্যর ধর্মশালা একদম তারকেশ্বর মন্দিরের একটু আগে। তখনও দিঘাপতিবাবু বেঁচে। মিশকালো গায়ের রং। গরমের দিনে খালি গা, তাতে বেশ ঝকঝকে একটি উপবীত। দিঘাপতি ভট্টাচার্যর মালকোঁচা মারা ধুতি। মাথার চুল ফকফকে পাকা, গোঁফও সাদা, একই রকম। হঠাৎ দেখলে জাতীয় কংগ্রেসের একদা প্রবল প্রতাপান্বিত কামরাজ নাদাবের কথা মনে হতে পারে। কামরাজ নাদাব ছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের সিন্ডিকেট প্রধান। তাঁর সঙ্গে অতুল্য ঘোষ, সঞ্জীব রেড্ডি, মোরারজি ভাই দেশাই। এঁরা অনেকেই লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর পর জবাহরলাল নেহরুর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হন, এমনটি চেয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তো তা হয়নি। ইন্দিরা গান্ধী অনায়াসে অগ্রাহ্য করেছিলেন এঁদের। পরে ভারতীয় রাজনীতিতে সিন্ডিকেট কংগ্রেস আদি কংগ্রেস ও ইন্দিরা কংগ্রেসের বিভাজন হয়ে গেল। যে বিভাজনের রাজনীতি যথেষ্টভাবে জাতীয় কংগ্রেসের রাজনীতিকে প্রভাবান্বিত করে। আদি কংগ্রেস, নব কংগ্রেস বা ইন্দিরা কংগ্রেস— এই ভাগ ফুটে ওঠে ভারতীয় রাজনৈতিক মঞ্চে। সে সব কথায় নতুন করে না গিয়ে ফিরি দিঘাপতি ভট্টাচার্য প্রসঙ্গে। দিঘাপতিবাবুর এই দর্মশালাটি তারকেশ্বর মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়। এই ধর্মশালার পেছনে একটি পুকুর, সেটিও দুধপুকুর ছিল কী। তারকেশ্বরের প্রসাদ বলতে চিনির রোলা আর নকুলদানা। রোলা হল সাদা রঙের খুব শক্ত বাতাসা বাতাসা চেহারার একটা জিনিস। এছাড়াও তারকেশ্বরের শিবের— তারকেশ্বরের পুজো দিলেও পোড়া মাটির সরায় রোলা, নকুলদানা, প্রসাদী ফুল বেলপাতার সঙ্গে সাদা সুতোর সঙ্গে লাল সুতো দিয়ে তৈরি, লাল সুতোটি অনেকটা যেন পুরনো দিনের রাখীতে যেমন থাকত, তেমনই কায়দার লাল সুতো সামান্য জড়িয়ে তারকেশ্বরের প্রসাদী ‘ডোর’। তারকেশ্বরে পুজো দিয়ে এই ‘ডোর’ পাওয়া বা না পাওয়া— সবটাই বেশি ভক্তি ও বিশ্বাস মেশানো ছিল। তারকেশ্বরের বাবার মাথায় চড়ানো প্রসাদ, প্রসাদী ডোর সবই যেন কোনো অলৌকিক নানা কথা— মাহাত্ম্য গাথায় গাঁথা। অনেক অনেক গল্প, কাহিনি, কথা, উপকথা, তাদের ঘিরে। সে যাই হোক, একটি বিশেষ চেহারার পোড়া মাটির ঘটে ফুল, বেলপাতা সমেত দুধ পুকুরের খানিকটা জল আর তার সঙ্গে জোলো দুধ মেশানো একটি তরল, তাই হল বাবার চরণামেত্ত। বাবা তারকনাথের চরণের সেবা লাগে— মহাদেব। মহা-দে-এ-ব— চৈত্র মাসে গাজনের আগে শিবগোত্র পেয়ে ব্রাহ্মণ হতেন ভক্তরা। এই একমাস, মাসে গোটা চৈত্র মাস তাঁরা গলায় পৈতে নিতেন। চুল, দাড়ি কাটতেন না। চুলে তেলের বাষ্প নেই। নিরামিষ আহার তখন। নিষিদ্ধ নারীসঙ্গম। চৈত্র মাসের পয়লা থেকে সংক্রান্তি— চড়ক বা গাজনের দিন পর্যন্ত এই ব্রত। এসব কথা এখন থাক। তারকেশ্বরের মোহান্ত— এলকেশী সংবাদ, তা নিয়ে গান, ছড়া, চটি বই, মোহান্তর বিরুদ্ধে মামলা— সবই হয়েছে। সে ব্যাপারে আর বিশদে যাচ্ছি না। মোহান্ত— এলোকেশী কেচ্ছা নিয়ে বিপুল উদ্দীপনা-উৎসাহ চোখে পড়ে সেই সময়ে বাংলার মানুষের। পরাধীন দেশ তখন। ‘তারকেশ্বর সত্যাগ্রহ’ সেই সময়ের খুবই নামকরা ঘটনা, যা আলোড়িত করেছিল তখনকার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলকে। দিঘাপতি ভট্টাচার্যর ধর্মশালাটি এখন আছে কিনা জানি না। বালি থেকে ট্রেনে— ‘বাবার লাইন’-এ ট্রেনে চেপে— তারকেশ্বর লোকালে প্রায় ঘণ্টা তিনেক। মনে আছে তারকেশ্বর মন্দিরে পুজো দেওয়ার পর একটি ভাতের হোটেলে ভাত, ডাল, ছ্যাঁচড়া, সেই সঙ্গে সঙ্গে ন্যাদশ মাছের ঝাল— ন্যাদশ মাছকে দেশে-দেশান্তরে নানা নামে ডাকা হয়ে থাকে। পূর্ববঙ্গে তার নাম ভ্যাদা মাছ। রয়না মাছও বলা হয় ন্যাদশ মাছকে। একটি প্রচলিত ছড়ায় আছে—

দাদাভাই চালভাজা খাই
রয়না মাছের মুড়ো
হাজার টাকার বউ এনেছি
খাঁদা নাকের চুড়ো।

ন্যাদশ খুবই স্বাদু মাছ, এখন অতীব মহার্ঘ্য। একটু বড়ো সাইজ হলে চারশো টাকা কিলো। বড়ি দিয়ে ন্যাদশ মাছ দারুণ। শীতে সবুজ ধনেপাতা চলতে পারে। কাঁচা লঙ্কা, কালোজিরে দিয়ে রান্না করা রয়না মাছও খুব ভালো খেতে। তার ওপর ধোঁয়া ওড়ানো ভাত। পাশে নুন, পাতি লেবুর টুকরো, কাঁচা লঙ্কা— সব মিলিয়ে পাঁচ সিকে— এক টাকা চার আনা খরচা। সেটা ১৯৫৮-৫৯ সালটাল হবে। তখন ভাতের হোটেলে কলাপাতার পাশাপাশি শালপাতার থালাও এসে গেছে। কাঠি দিয়ে আটকানো থাকে সেইসব পাতার থালা। অনেক ভাতের হোটেলেই তখন মাটির গ্লাস, জল খাওয়ার জন্য, কলকাতা আর মফস্বলেও। মাটির গ্লাস, কলাপাতা তখন বিয়ে বাড়িতে অবশ্যম্ভাবী। শালপাতা বাঙালি জীবনের নিমন্ত্রণ অনুষ্ঠানে ঢুকে পড়ল ষাটের দশকে। কলাপাতার থেকে তুলনায় তা দামে সস্তা। কলাপাতা বিক্রি হয় কুড়ি দরে। অর্থাৎ, কুড়িটা করে হিসাব। শালপাতা শ-এর হসাবে। একশোর দাম এই।

তারকেশ্বরে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে খুব ভালো তরমুজ পাওয়া যায়। সেইসঙ্গে কুমড়ো। পাওয়া যায় পোড়া মাটিতে তৈরি চমৎকার কুঁজো, ছোটো, বড়ো। কালো আর লাল তাদের রং। সেই সঙ্গে পোড়ামাটির খেলনা, একেবারে কুমোর ঘরের। ঘোড়া, রান্নাঘরের খেলনাবাটি— উনোন, শিলনোড়া, হাঁড়ি, কড়াই, গামলা, গেলাস, ঘটি। মেয়েরা অনেকেই তখন ছেলেবেলায়, বালিকা বেলাতেও খেলনাবাটি নিয়ে খেলে। লোহা, পেতলের খেলনাবাটি। লোহার খেলনাপাতি ভালো পাওয়া যায় দেওঘরে, জসিডি, মধুপুরে। পেতলের খেলনা খুব ভালো পাওয়া যায় কাশীতে। আমার বাবা— অমরনাথ রায় আমাদের একমাত্র কন্যা সৃজনী রায়কে পেতলের খেলনাবাটির সেট কিনে এনে দিয়েছিলেন কাশী থেকে, ১৯৯৩ সালে। এছাড়াও কাঠের খেলবাটি বিক্রি হতে দেখেছি। তারকেশ্বর থেকে আমরা গরমের দিনে দিশি তরমুজ, সাইজে বেশ বড়ো, তার সঙ্গে কখনও কখনও বড়ো কুমড়ো নিয়ে ফিরেছি। তারকেশ্বরে কুমড়ো অনেকটাই সস্তা, তরমুজও। এই তরমুজ দিয়ে খুব ভালো শরবত তৈরি হয়। ফৈজাবাদ বা ফয়জাবাদের তরমুজ অতি বিখ্যাত। তার শরবতও অতুলনীয়। বরফ দিয়ে গরমের দিনে, তার সঙ্গে চিনি। তরমুজের মুখ ফুটো করে ভেতর খানিকটা— মাপ মতো তার ভেতরে দিয়ে দিলে বেশ খানিকক্ষণ রাখার পর চমৎকার সরবত তৈরি করার ব্যবস্থা হয়ে গেল।

Powered by Froala Editor