পুজোর চারদিন— হ্যাঁ, দুর্গাপুজোর চারদিন— ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, এই চারদিন, ‘ফ্লাই পার্টি’, ‘ভাতি’, যাই বলা হোক না কেন সত্তর দশকের প্রায় শেষ লগ্নে পুজোর কদিন মহিলা সঙ্গিনী, ‘তোলা’-র যে ধারা ছিল কলকাতার উত্তর আর দক্ষিণে, সেই বহমানতা আজও আছে কিনা জানা নেই। তখন মোগলাই পরোটা খুব লোভনীয় খাবার। সেইসঙ্গে কষা মাংস, খাসির, পাঁঠার, খুব ঝাল ঝাল জিভের ছাল তুলে দেয় প্রায় ঘন ঝোলের উস আস, আস, আস— প্রায় শীৎকারপ্রতিম সেই শব্দ ছাগ মাংস ভক্ষণের পর। মোগলাই পরোটার সঙ্গে খানিকটা আলুর তরকারি, কুচো পেঁয়াজ, সাদা পোর্সেলিনের বড়ো ডিশে। ধর্মতলার অনাদি বেশ ছোটো দোকান। কিন্তু ভিড়। ওফ, সব সময় সব সময়। সর্বদা। সকাল, বিকেল, রাত্রি। পুজোর চারদিন বাঙালির বড়ো প্রিয় খাদ্য মোগলাই— মোগলাই পরোটা। পাঁচ সিকে থেকে পাঁচ টাকা, সাত টাকা— মোগলাইয়ের দামের বিবর্তন, পরিবর্তন দেখেছি। কথা হচ্ছিল পুজোর কদিনের জন্য ভিড় টিড়ের মধ্যেও মেয়ে দেখা, ঝাড়িমারা, নানারকম টোন-টিটকিরি ইত্যাদি, হালকা করে, ব্যাপারটা আরও প্রকট হয় নকশালবাড়ির ধারার আন্দোলন খানিকটা নিভে যাওয়ার পর। তখন তো হিপি কাটিং ঘাড় অবধি চুল, বেল বটম প্যান্ট আর একটু পর এল হাতি-পা প্যান্ট— এলিফ্যান্ট, তারপর প্যারালাল। সঙ্গে ডগ কলার— কুকুরের কান যেমন, তেমন বড়ো শার্টের কলার। ‘ববি’-তে ঋষি কাপুর পরলেন। সঙ্গে ডিম্পল কাপাডিয়া। ঋষি রাজের ছোটো ছেলে। আর এক পুত্র রণধীর কাপুর— ডাকনামে ডাব্বু ঢ্যাঁড়শ টাইপ অভিনেতা হয়েও অনেক হিট ছবি। তার মধ্যে একটি ‘রাম্পুর কা লখসমন’। সঙ্গে ‘ভিলু’— ভিলেন শত্রুঘ্ন সিনহা— শত্রুঘ্ন সিংহ— বোম্বাইয়ের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কেউ কেউ তাঁকে সম্বোধন করেন ‘শটগান’ বলে। কেউ বা বলেন বিহারিবাবু। ‘ডগ’ কলার শার্ট পরলেন রাজেশ খান্না। আরও অনেক হিরো, ভিলেন, কমেডিয়ানরা ১৯৭০-৭১-৭২-৭৩-এ। অনিল ধাওয়ান, নবীন নিশ্চল, রাকেশ রোশন— এঁরাও বেশ কয়েকটি ছবি করলেন। ‘হিট’ও দিলেন প্রোডিউসারকে। ‘ববি’ প্রিন্ট গোল গোল ছাপকা ছাপকা জামা সাদার ওপর, ছোটো-বড়ো রঙভর্তি বৃত্ত। মূলত সাদার ওপর সবুজ। ক্ষুদে, বড়ো। ‘হম তুম এক কামরে মে বন্ধ হো/ অর চাবি খো যায়…’। কি হিট কি হিট। শৈলেন্দ্র সিং। তার সঙ্গে চঞ্চল— ‘…মন্দির মসজিদ তোড়ো…’। ‘না মাঙ্গো সোনা চান্দি…’ এও তো হিট গান ‘ববি’-র। ডিম্পল কাপাডিয়ার জন্য ফ্রক, স্কার্ফ। ‘গো গো’ সানগ্লাস, চশমা এল। স্টাইলদার রাজ কাপুর সাব নিজের সিনেমায় হিরোইনকে সাদা পোশাক পরাবেনই। নার্গিস তো বহুবার। সিম্মি, জিনত আমন, তাঁরাও। একটি প্রাইভেট চ্যানেলে ‘রাঁদেভু উইথ সিমি গ্রেওয়াল’— সম্ভবত সেই শো-এর নাম, বেঢপ মোটা হয়ে যাওয়া অ্যালকোহোলিক রাজ কাপুর সাব সিম্মিকে বলেছিলেন, নার্গিস নেই, মুকেশ নেই, শঙ্কর নেই— আমি কার সঙ্গে বাঁচব? কার জন্য। সিম্মি বা সিমি খুব বড়ো অভিনেতা। হ্যাঁ, অভিনেতাই। তাঁর বহু ছবি হিট। দেবানন্দ সাহাবের সঙ্গে ‘তিন দেবিয়া’ আর শশীসাহাব— শশী কাপুরের সঙ্গে ইংরেজি ছবি ‘সিদ্ধার্থ’ ভোলার নয়। ‘সিদ্ধার্থ’ ছবিতে সুর দিয়েছিলেন হেমন্তদা— হেমন্ত মুখোপাধ্যায়— হেমন্তকুমার। এই ছবিতে ‘ও নদীরে…’ এই গানটির অতি চমৎকার প্রয়োজ আছে। সিম্মি বেশ ভালো কাজ করেছিলেন রাজ কাপুর সাহাবের ‘মেরা নাম জোকার’-এ।
মুকেশ চলে যাওয়ার পর রাজ কাপুর সাব বলেছিলেন, ‘মেরা আওয়াজ চলা গ্যয়া’। রাজ কাপুর সাহাবের লিপে বেশিরভাগ গান মুকেশের। তারপর আছেন মান্না দে। তালাত মামুদ সাবও আছেন, রফি সাহাবু। কথা হচ্ছিল ‘মেয়ে তোলা’ নিয়ে। এই ‘মেয়ে তোলা’ কথাটা একদম রকের— কেওড়া ভাইদের। এই তোলা শব্দটাতে আপত্তি করতে পারেন অনেকে। কিন্তু যস্মিন দেশে—। জেলখানার ভাষা, বাজারের ভাষা, রকের ভাষা, বেশ্যাবাড়ির ভাষা, মদখানার ভাষা তো কোনোভাবেই এক নয়, হতে পারে না। সম্ভব নয় হওয়া। আবার বহু মন্দিরে পাণ্ডা, ছড়িদারদের মধ্যে যে সন্ধ্যাভাষা প্রচলিত, তারও তো কোনো অভিধান নেই। বিশেষ করে কালীঘাটের কালীমন্দিরের সেবায়েত, পাণ্ডা, ছড়িদারদের যে ভোকাবুলারি তা নিয়ে তো লিখেওছি আগে, এই সিরিজেই। ১৯৬০-এর শেষ দিকে অথবা ১৯৭০-এর দশকে পুজোর চারদিনের ফিটিং একটা বড়ো ব্যাপার ছিল। মোগলাই পরোটা আর ফুল প্লেট কষা মাংস, কোল্ড ড্রিংস— ‘জুসলা’, ‘জুসলা’-র অরেঞ্জ, পাইনঅ্যাপেল। কোকাকোলা। আর কিছুদিন আগেই ‘ভি মটপ’ উঠে গেছে। ‘বায়রন’-এর সোডা, ঝাঁঝঅলা আর মিষ্টি, চার আনা-পঁচিশ নয়া পয়সা তার দাম, আউট হয়ে গেছে বাজার থেকে। ‘বায়রন’-এর ঝাঁঝাল সোডার বোতলের পেটের ভেতর থাকত একটি সলিড কাচের গুলি, জল রঙের। ষাটের দশকে ঝামেলা মারামারির সময়, বিশেষ করে কলেজ, ইউনিভার্সিটি, সিনেমার টিকিটের লাইনে, এসব জায়গায় সংঘর্ষেও বায়রনের চার আনা দামের সোডার বোতল খুব ঝাঁকিয়ে চার্জ করা। তখনও হাতবোমার— সুতলি দড়িতে বাঁধা পেটোর এত বিপুল ব্যবহার শুরু হয়নি। ‘জুসলা’ কোম্পানির অরেঞ্জ, পাইনঅ্যাপেল উঠে যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন বাদ দিয়ে এল ‘গোল্ডস্পট’। ষাট সত্তরে পুজোর বাজারে ‘গোল্ডস্পট’-এর চাহিদা খুব।
‘ভাতিরা’ অনেকেই পছন্দ করে ‘গোল্ডস্পট’। তখন নর্দমা প্যান্ট— ড্রেনপাইপ ফুল প্যান্ট বিলীয়মান ক্রমে। পয়েন্টেড শ্যু মাথা ছুঁচল ফিতে বাঁধা বুট অবলুপ্ত প্রায়। তার বদলে মাথা ধ্যাবড়া— থ্যাবড়া গো গো বুট। পয়েন্টেড শ্যুতে হাইহিলই বেশি। মেয়েরা হাইহিল পরছে স্টিলেটো। লো কাটের ফ্রক বেরিয়েছিল ষাটের দশকে। ফ্রকের লোয়ার পোরশান ছোটো, ফ্রিলকার— ফ্রিল সমেত। ছেলেদের ‘রাজকুমার’ শার্ট এল ষাটের দশকেই। ‘রাজকুমার’ ফিল্মের অনুকরণে। ‘রাজকুমার’-এর হিরো ফ্ল্যামবয়েন্ট শাম্মি— শাম্মি কাপুর। হিরোয়িন সাধনা। এই ফিল্মে আমার প্রিয় মহিলা কণ্ঠ সুমন। সুমন কল্যানপুর অসামান্য গেছেন। আর আছেন রফি সাহাব। হো হো বলে একটা বাচ্চাদের শার্ট ডিজাইন ছিল ষাটের দশকে। অতি বাচ্চাদের টাকারবোকার, আমরা বলতাম ন্যাকার বোকার। গ্যালিস দেওয়া প্যান্টও ষাটের দশকের গোড়ায়, হাফ প্যান্টে। তখন একটা চামড়ার ভালো বেল্টের দাম একটাকা চার আনা-পাঁচ সিকে বড়োজোর দেড়টাকা। নাইলন বেল্ট, প্লাস্টিকের বেল্ট এল ষাটের দশকে। সত্তর দশকে বেলবটস বা বেলবটমের সঙ্গে চামড়ার চওড়া বেল্ট। বেল্টের যে ধাতব অংশটুকু, তাও বেশ বড়ো আর গোলগাল।
তখন বাংলা সিনেমা রিলিজ হয় দুর্গা পুজোকে কেন্দ্র করে। হলে হলে বড়ো বড়ো হোর্ডিং। উত্তর-পূরবী-উজ্জ্বলা। শ্রী-প্রাচী-ইন্দিরা। রাধা-পূর্ণ-অরুণা। মিনার-বিজলী-ছবিঘর। নতুন নতুন সিনেমা রিলিজ হয়। রিলিজের— মুক্তির দিন শুক্রবার শুক্রবার। তখনও সিনেমার বই বিক্রি হয় সিনেমা হলে। তাতে সেই চলচ্চিত্রটির গান আর সংক্ষিপ্ত কাহিনি। সঙ্গে কিছু স্টিল ছবি ওই সিনেমাটির। দক্ষিণ কলকাতার ইন্দিরাতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সন্ধ্যা রায়, রবি ঘোষের ‘বাঘিনী’ মুক্তি পেয়েছিল ষাটের দশকে। পরিচালক— বিজয় বসু। ‘জোড়া দিঘির চৌধুরী পরিবার’, ‘মণিহার’ও কি পুজোতে মুক্তি পেল? দুটি ছবিরই হিরো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ‘চৌরঙ্গী’ মুক্তি পেল পুজোর সময়েই। বিগ কাস্টিং ছবি— উত্তমকুমার, অঞ্জনা ভৌমিক, বিশ্বজিৎ, সুপ্রিয়া দেবী, উৎপল দত্ত, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। পুজোর চারদিনের প্রেম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্থায়ী হত না, অন্তত নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে। ওই সিনেমা দেখা পাশাপাশি বসে। তখন তো ব্যালকনি, ড্রেস সার্কেল, রিয়ার স্টল। ‘নিউ এম্পায়ার’-এ গ্যালারি। ‘মেট্রো’, লাইট হাউস, গ্লোব, নিউএম্পায়ার, টাইগার, রক্সি, রকি শো হাউজ। নতুন বাংলা, হিন্দি সিনেমা রিলিজ করে ‘উজ্জ্বলা’ আর ‘বসুশ্রী’তে। তখন ওপেনিং ডে, ওপেনিং শো-তে সিনেমা দেখা খুব কেত। গড়পাড়ের মিলের ধুতি, সাদা বা ঘি রঙের, টেরিকটের ফুল শার্ট হাত গুটিয়ে পরে, মোজা ছাড়া ফিতে বাঁধা কালো বুট পায়ে লাইন সামলান, সিনেমার ব্ল্যাকার সামলান, ব্ল্যাকার ধরা এইসব থানা কনস্টেবল— ‘খোচড়’। বাংলা ‘অমানুষ’ রিলিজ করেছিল ‘উজ্জ্বলা’-য়। ওহো, কত কত টাকা তখন রোগজার করছে ব্ল্যাকাররা। দশকে পচাশ, পাঁচকে ত্রিশ— এভাবে হাঁক পাড়ত সিনেমার টিকিট ব্ল্যাকররা। তখনও যমুনা সিনেমা চালু হয়নি। যমুনা চালু হল, বন্ধও হয়ে গেল। টাইগার বন্ধ হল। মিনার্ভা হল চ্যাপলিন। তারপর বন্ধও হয়ে গেল। ষাট-সত্তরে এই পুজোর প্রেম বড়োই অভিনব। তখন ভাবলে বেশ অবাকই লাগে। এই প্রেমে মোগলাই পরোটা, ফুল প্লেট কষা মাংস, জুসলা, ফুচকা, নতুন বই— সিনেমা দেখা, সবই ছোটো-বড়ো অনুঘটক। ড্রেস সার্কেল-এ বসে কিছু স্পর্শ ছোঁয়াছুঁয়ি, বাদামভাজা ভাঙার শব্দ, কী করছ কী, এই কী হচ্ছে— এইসব শব্দ ছিল অতিপরিচিত। আবার কেউ কেউ প্রতিমা দর্শনে যেতেন। উত্তর কলকাতা, দক্ষিণ কলকাতা, পূর্ব কলকাতা। দক্ষিণ কলকাতার সঙ্ঘশ্রী, সঙ্ঘমিত্র। সঙ্ঘশ্রীর সাতটা অসুর সমেত দেবী, আলোর খেলা, সঙ্ঘমিত্রর শোলার সাজ সবই তখন মনে রাখার। দক্ষিণ কলকাতায় ফরোয়ার্ড ক্লাব, ছেষট্টি পল্লী, চব্বিশ পল্লী, সবজিবাগান, উত্তর কলকাতায় কলেজস্কোয়ার, কুমারটুলি, বাগবাজার সর্বজনীন, মহম্মদ আলি পার্ক, সিমলা ব্যায়াম সমিতি। পূর্ব কলকাতায় পার্ক সার্কাস ময়দান। তখন পাতা জোড়া দেবীপ্রতিমার ছবি বাংলা দৈনিকে। ইদানিং কয়েক বছর হল আবার দৈনিকে ফিরে এসেছে সেই প্রতিমা-চিত্র। বাংলার ‘আর্ট’-এর ঠাকুরের প্রবক্তা রমেশ পাল। এক চালির প্রতিমা, একই চালি— চালচিত্রের মধ্যে থাকা দুর্গা, কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী এবার ছেন্ন হলেন, আলাদা আলাদা। ডাকের সাজ, শোলার সাজ সামান্য পিছু হটল, সাময়িকভাবে। আবার তা নতুন করে ফিরল ষাট দশকে। অনন্ত মালাকার, তিনি সরকারি পুরস্কার পেলেন ষাট দশকে।
আরও পড়ুন
মার্কনি সেট, রঘুবাবু ও মহালয়া
সত্তর দশকের গোড়ায় গোড়ায় ১৯৭৩-৭৪ সালে পেরেক, স্ক্রু, নাটবল্টু, কাঠের ভুষি, বাদামের খোসা, বিড়ি, সিগারেট, সিগারেটের খোল, বরফ, বোতাম, মোমবাতি— সব কিছু দিয়ে দুর্গা ও সরস্বতী প্রতিমা বানানো শুরু হয়ে গেল। সেইসঙ্গে কাচের টুকরো দিয়েও প্রতিমা। কোথাও ঠাট্টা করে বলা হতে লাগল, এখানে হাওয়ার ঠাকুর হয়েছে। ‘হাওয়ার ঠাকুর’ নিয়ে বেরল কার্টুনও বিভিন্ন ম্যাগাজিনে। এই যে বোতাম ইত্যাদি দিয়ে দুর্গা ও সরস্বতী প্রতিমার সামনে মাটির তৈরি ছোটো প্রতিমা ও ঘট রাখা হত। বাঙালির এই হুজুগ— বাদামখোসা, কাগজ ইত্যাদি দিয়ে প্রতিমা নির্মাণ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। বাঙালি আবার তার পুরনো মেজাজ একচালা বা এক চালির ঠাকুরে ফিরে গেল। যার চালচিত্রে মদেশ ইত্যাদি দেব পরিবার। সুধীর চক্রবর্তীর একটি বই আছে— ‘চালচিত্রের চিত্রলেখা’ এই দেবী দেবতার চালচিত্র নিয়ে চমৎকার গ্রন্থটি বাঙালি ‘আর্ট’, বাদামখোসা ইত্যাদি পর্ব পেরিয়ে বাংলার সাবেক ডিজাইন, একচালা, ডাকের সাজ, শোলার সাজ, মাটির সাজে ফিরে এল। বিদেশে শোলার তৈরি প্রতিমা পাঠানো শুরু করলেন শোলা শিল্পী অবন্ত মালাকার। পরে তা থার্মোকলে পরিবর্তিত হল। মাটির ঠাকুরদের বদলে শোলা বা থার্মোকলের ঠাকুরের ওজন অনেক, অনেক কম। ফলে বিমানে চাপিয়ে বিদেশে ঠাকুর পাঠানোতে খরচ অনেক অনেক কমে গেল। বাঙালি এখন— মানে কয়েক বছর ধরে মেতেছে থিম পুজোয়। লক্ষ লক্ষ টাকার বাজেট। শিল্পের নানা ধরনের উদ্ভাবনী খেলা। ভেতরে প্রকাশ্যে চোরা ও খোলা পথে থিম কম্পিটিশন, থিমচুরি, নানারকম কিছু হচ্ছে এই থিমপুজোয়। আসলে কর্পোরেট পুঁজি, রাজনৈতিক ক্ষমতা, পেশি ও পুঁজির প্রতিযোগিতা সব মিলিয়ে সে যেন আরও আরও অতিকায়, মহাকায়।
সেই মোবাইলবিহীন পৃথিবীতে, প্রেমপত্র নির্ভর ভালোবাসায়, যখন অতি সহজেই তথাকথিত ‘বোকা’ মেয়েরা হয়ে পড়ে গর্ভবতী। যখন ‘নিরোধ’, ‘কপারটি’ কিছুই আসেনি। ‘ক্যাপ’ পাওয়া যায়, কিন্তু তার খবর রাখে কজন? সামর্থই বা কোথায় কেনার? আজও গ্রামে ওসবের প্রশ্নই নেই। বিয়ে না হয়ে গর্ভসঞ্চার মানেই রেললাইন, কলসি-দড়ি নিয়ে নামা। উদ্বন্ধনে আত্মহত্যা— গলায় দড়ি, তুঁতে খাওয়া, ইঁদুর মারা বিষ, ক্ষার ও পরে ফলিডল— পোকা মারার বিষ। ধানের শত্রু মানে পোকা মারে ফলিডল। ষাটের দশকে ফলিডলের প্রচুর ব্যবহার করেন চাষিরা। এছাড়াও কেরোসিন খেয়ে নেওয়া, মশা মারার ফ্লিট, পরে পোকা মারার বেগন স্প্রে। মৃত্যুর কত কত নিবিড় আয়োজন। ফলিডল খেয়ে সুইসাইড করলে খবরের কাগজ হয়তো লেখে কোনোসময়— কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা। যত দায় তো নারীর, মেয়েদের। পুরুষ তো ফুর্তির বীজ ঢেলেই খালাস। তারপর তো দিনে দিনে বাড় কালকেতু। যেমন হয় আর কি। ট্রেনের লাইনে ‘গলা দেওয়া’র ঘটনা ঘটে তখন ‘মরিবার হল তার সাধ’— বাধ্য হয়ে। রোজ কত কি ঘটে যাহা তাহা। ‘পুজোর প্রেম’ দশমীর পরই ভাসানে। তখন যে যার সে তার। আর কোনো ভাতি খোঁজা নেই, আবার পরের বছর, আবার। নতুন কোনো ইশারায়। তখন তো মুখে কোনো মেয়েকে প্রেমপ্রস্তাব দিলে তার মুখ থেকে শোনা যেত প্রায়শই— আমি এনগেজড। এই কথাটির অর্থ আমার একজন প্রেমিক আছে। বয়ফ্রেন্ড নয়, প্রেমিক। সেই প্রেম ঠিক কতদিন টিকবে, তা তো কেউ জানে না। অনেকে আবার আমি এনগেজড— এই বাক্যটির আগে স্যরি যোগ করে দিত। ইংলিশ মিডিয়াম— লোরেটো, কারমাইকেলের মেয়ারা। খুব ডাঁটিয়াল ছিল ডায়াশেসন আর সাখোয়াত মেমোরিয়াল— সাখোয়াতের ছাত্রী— মেয়েরা। থাক এসব কথা সপ্তমী থেকে নবমী, কখনও কখনও ষষ্ঠী থেকেই শুরু হয়ে যেত ‘পার্টি’ তোলা। সেইসব ফ্লাইং যারা তুলত, তারা কী— উভয়পক্ষ থেকেই, পরস্পর পরস্পরকে মনে রাখত আদৌ? তখন সেলফোনশূন্য, মিসড কলহীন পৃথিবীতে খানিকটা প্রেমপত্র নির্ভর পিরীতি ওয়ার্ল্ডে সময় আর সময় যাপনের টাইম মেশিন— তাতে চড়ে বসতে পারলেই তো কত কী! একবার চাপতে পারলেই হল। শার্ট-প্যান্ট তো অনেকেরই হত না, চারদিন ধরে বা তিন দিন ধরে চারটে নতুন বা তিনটে নতুন পরব, এমন মাপ করে। হওয়া সম্ভবও ছিল না। ক্বচিৎ কদাচিৎ কারও কারও হত, যাদের আর্থিক অবস্থা যথেষ্ট ভালো। পুরনো শ্যু বা চটি ক্রিম পালিশে— বিল্লি, কোবরা, চেরিব্লসম কালিতে ঝকঝকে করে নেওয়ার একটা ব্যাপার ছিল। চেরিব্লসম খুব কম। বিল্লি আর কোবরাই বেশি। বিল্লি বুট ক্রিমও ছিল। এখনও আছে।
আরও পড়ুন
‘ইলাহাবাদী বড়ি ফাসাদি’ নয়
Powered by Froala Editor