‘ইলাহাবাদী বড়ি ফাসাদি’ নয়

ইলাহাবাদের বড়ো মাসি— রুণু মাসি পুরানা কাটরা বা পুরনো কাটরাকে বলতেন ‘পুরানা কটরা’। ইলাহাবাদের বাঙালি ও হিন্দিভাষীরা কটরাই বলেন। লেখেনও। বর্ষায় বানডা কচু পাওয়া যায়, বেশ বড়ো। বানডা কচুতে গলা ধরে— কুটোয় না। খুব দ্রুত সেদ্ধ হয়, একেবারে আলু যেন। সরু, লম্বা বানডা— বানডা কচুকে ঘোড়ার সুদীর্ঘ লিঙ্গের সঙ্গে তুলনা করা হয়— ঘোড়েকা বানডা। ঘোড়েকা আন্ডা বলতে অবান্তর অলীক, আন্ডার একই সঙ্গে ঘোড়ার অণ্ডকোষও বোঝায়। ১৯৬০-এর দশকে তো বটেই, ১৯৭০-এও ইলাহাবাদে প্রচুর টাঙ্গা বা টাঙা, সেই সঙ্গে ইক্কা বা এক্কা। আর ছিল সাইকেল রিকশা। য়ে রিকশা চলবো কা? কা লেব? এই ছিল রিকশা আহ্বানের লবজ। উত্তরে রিকশাচালক বলতেন, কিঁউ না যাই সরকার? কিঁউ না যাই মালিক। এই ছিল তাঁদের জবাব। ইলাহাবাদে ছিল পুলিশের প্রবল দাপট। খালি হাতে বা লাঠি নিয়ে। তাঁরা যখন তখন রিকশাওয়ালা, টাঙ্গাওয়ালাদের কারণে অকারণে নিগৃহীত করতেন, গালি দিতেন— গালি বকতেন। 

ইলাহাবাদে বাসে কোনো লেডিজ সিট ইত্যাদির রেস্ট্রিকশান ছিল না, সত্তর দশকেও। ‘লেডিজ সিটে’ অনায়াসে বসে থাকতেন পুরুষেরা। মহিলা দেখলেও উঠে সিট ছাড়েন না। এই কালচার আমি দেখেছি ওড়িশা, বিহার এবং ঝাড়খণ্ডে। ‘লেডিজ সিট’ আছে কিন্তু কেউ ছাড়েন না।

ইলাহাবাদে সিনেমা হলেও কোনো সিট নাম্বার নেই। সেট খুললেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে পাবলিক। তারপর যে যেখানে ইচ্ছে, গায়ের জোরে যেখানে পারে, সেখানেই বসে যায়। সে এক হুড়মার, হৈ হৈ। ষাট ও সত্তর দশকে এই ছবি ইলাহাবাদে। এছাড়াও কলকাতা থেকে অনেক অনেক বেশি সিনেমা টিকিটের দাম। বাস ভাড়াও বেশি। এই শহরে— ইলাহাবাদে রানিং বাসে কেউ ওঠে না। সাধারণত বাসে চড়েনই না কেউ। সাইকিল— সাইকেল, স্কুটার— ফটফটিয়া, নয়তো কার— গাড্ডি। মোটরবাইক— ‘রয়্যাল এনফিল্ড’, ‘বুলেট’, পরে কালো রঙের ‘বুলেট’ চড়েন কেউ কেউ। স্কুটার বলতে ‘ল্যামব্রেটা’ আর ‘ভেসপা’। রোমান হলিডে সিনেমাটির কথা মনে পড়ে যায়। সাংবাদিক গ্রেগরি পেক আজ রাজকুমারী— হঠাৎ হঠাৎ সব ভুলে যাওয়া— ভুলক্কড় অড্রে হেপবার্ন। ‘রোমান হলিডে’-র গল্প মাথায় রেখে হয়েছে একাধিক বাংলা সিনেমা। ‘রোমান হলিডে’তে আছে সম্ভবত ‘ল্যামব্রেটা’ স্কুটার-এর পেছনে অড্রেকে বসিয়ে গ্রেগরির ঘুরে বেড়ানো। ইলাহাবাদে থেকেই থাকতে থাকতেই শিখি— চোর কা ডাঢ়ি তিনকা’— ‘চোরের দাড়িতে ঘাস’— এই শব্দটি শিখি বগাবত বা বাগাবত— বিদ্রোহ শিখি ‘বগুলা ভগত’— ‘বক ধার্মিক’ কথাটি। ইলাহাবাদেই বগাবত করেছিলেন জাহাঙ্গীর বাদশার বড়া আওলাদ— জ্যেষ্ঠ সন্তান— পুত্র খসরু। ইলাহাবাদের সঙ্গম— গঙ্গাজি, যমনাজি আর সরসতির— সরস্বতীর মিলন ক্ষেত্রে।

অধেড়— মাঝ বয়সী
পুরখিন— বয়স্কা
নল— নর্দমা
আনোখি— আকাশ থেকে পড়া
মুসাড্ডা— ইসলাম ধর্মের মানুষ
খবিশ— খারাপ, শয়তান লোক
দিনার— অতি বয়স্কা, অতি বৃদ্ধা
ভোঁদ— ভুঁড়ি
তলব – মাইনে
চুতর— পোঁদ
ছুরা— ছোরা
ডামিশ— বদমাইশ
গ্যয়া তেল বেচনে— চিরকালের জন্য চলে যাওয়া
গদাহা বেচকে শো গ্যয়া— গভীর ঘুম
মক্ষিচুষ— কৃপণ
পিয়কুড়— মাতাল
সুম— কৃপণ
ঠেঙ— কচু করবে
ঘোড়া কা বানডা— অলীক
লিচড়— খারাপ লোক
লাফাঙ্গা— লোফার
বড়ি আঁয়ি হ্যায়— খুব এসেছেন যে
টিড্ডা/ টিড্ডারাম— রোগা
ঘুমক্কড়— যে ঘুরে বেড়ায়
পাখি— পুরুষাঙ্গ
সিঙ্গারা— পানিফল
বম্বা— কল
নগর মহাপালিকা— পুর নিগম

আরও পড়ুন
ইলাহাবাদ— পুরানা কাটরা ও অন্যান্য

ইলাহাবাদ শহরে এসে প্রথম চিনলাম মখানা বা মাখানা, চিনতে পারলাম— সোডা, চিনি কাকরি। জানি কীভাবে সিঙ্গারা কি আটা— পানিফলের আটা দিয়ে হালুয়া তৈরি হয়। আর এই ‘শুধ্’ খাবার খেয়ে থাকেন ব্রাহ্মণ আর বিধবারা। ব্রাহ্মণরা, বিধবারা খান একাদশীতে। গমের আটা আর ঘি, চিনি দিয়ে তৈরি হয় পঞ্জেরি। পঞ্জেরিও একইভাবে খেয়ে থাকেন স্বামীহারা ও ব্রাহ্মণেরা। বেসন খুব শুকনো করে মেখে, আটার যেমন হয়, তেমন করে সরু লেচি কেটে তারপর সেই লেচি পিতলের পাত্রে জল বসিয়ে, সেই জল গরম হয়ে সামান্য ফুটতে শুরু করলে তখন এই বেসনের লম্বা সরু লেচ্চি সেদ্ধ করে তাকে ছুরি দিয়ে বা খুন্তির মুখ দিয়ে কেটে কেটে নিলে যেমন চাক চাক তৈরি হল, তাকে আদা-জিরে বাটা, তেজপাতা ফেলে কষতে কষতে তারপর খানিকটা টক দই আর টক দই দিয়ে কষা হয়ে গেলে তখন গরম জল। আলাদা পাত্রে গরম জল করে নিতে হবে। তারপর সেই জল ঢেলে দিলে ফুটতে ফুটতে ঝোল বা রসা গাঢ় হলেই তার মধ্যে ব্যাসনের চাক চাক গোল গোল টুকরোদের ছেড়ে দেওয়া। ব্যস, গা মাখামাখি কঢ়ি-ভাত হয়ে গেল। সুন্দর তার স্বাদ। একবার তো আমি আর আমার পিতৃদেব— অমরনাথ রায়, রেণুমাসি বা খোকনদা— কেউকেই না জানিয়ে বম্বে মেল চেপে হাওড়া থেকে ইলাহাবাদে হাজির। তখন এপ্রিল— ঘন বৈশাখ। বাতাসে গরম। রেণুমাসি— বড়োমাসি আশখাল— রান্নাঘরে কঢ়িভাত বানাচ্ছিলেন। কি তার স্বাদ। বড়োমাসি বলি রেণুমাসিকে। বড়ো মাসিমা উষারানি ভট্টাচার্য। একজন ইলাহাবাদের পুরানা কাটরা। অন্যজন কালিঘাটের ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিট। সত্তর দশকে ধর্মেন্দ্র, মনোজকুমার, ফিরোজ খান, ফিরোজ-ভ্রাতা সঞ্জয় খান— এঁরা সবাই হিরো। মনোজকুমার তো ছবি প্রোডিউসও করতেন পরের দিকে। প্রত্যক্ষভাবে জাতীয় কংগ্রেসকে সমর্থন করতেন তিনি, প্লেব্যাক সিঙ্গার মহেন্দ্র কাপুর, অভিনেতা সুনীল দত্ত, নার্গিসও। পরে নার্গিস সুনীল দত্তর পুত্র সন্তান সঞ্জয় দত্তও কংগ্রেস রাজনীতি করতেন। তখন জাতীয় কংগ্রেসের তুমুল বোলবোলাও। মহেন্দ্র কাপুর প্রচুর প্লেব্যাক করেছেন, নামি দামি হিট ছবি সব। কিন্তু তাঁর গাওয়া দুটি গানই মনে থাকে— ১) চল ইকবার (একবার) ফিরসে/ আজনবি বন যাঁয়ে হম দোনো… ২) এ এ নীলে গগন কী তলে…।

আরও পড়ুন
কোম্পানি বাগ, আলফ্রেড পার্ক

ইলাহাবাদে আহির কন্যা বাম্মু, পোরেদের বোন গুড্ডি, চল ইকবার ফির সে আজনবি বন যায়ে হম দোনো খুব ভালো গাইত। গানটি ছিল সুনীল দত্তর লিপে। সত্তর দশকে হিরোইন ছিলেন নাকচেপ্টি মুমতাজ। দারুণ নাচতেন। সেইসঙ্গে ছিলেন বিদ্যা সিনহা। অমল পালেকারের সঙ্গে দীনেশ ঠাকুরও অভিনয় করেছেন, হিরোয়িন বিদ্যা সিনহা। ‘গোরি তেরা গাঁও বড়া পেয়ারা’ গানটি খুব চলেছিল একসময়। জারিনা ওয়াব, অনেক ছবি করেছেন সেই সময়। অমল পালেকারের সঙ্গে ‘ঘরোন্দা’— ‘দো দিওয়ানি শহর মে…’। এই গানটি বেশ হিট হয়েছিল তখন, যেসু বা য়েসু দাসের গলায়। শচীন-সারিকা জুটি হিট হয়েছিল ‘গীত গাতা চল’। ‘শ্যাম তেরি বনশি পুকারে রাধা নাম’ বেশ চালু হয়ে গেল মুখে মুখে। সারিকা পরে বেশ কয়েকটি হিট ছবির হিরোইন। শচীনকে আমরা দেখেছি অন্য অন্য সিনেমায়। ‘গুপ্তজ্ঞান’ নামে একটি ‘যৌন শিক্ষামূলক ছবি’ ১৯৭১-এ মুক্তি পায়। ‘চেতনা’ ও ‘দস্তক’-এর পাশপাআশি একটু আগেই ‘গুপ্তজ্ঞান’। রেহানা সুলতানা ততদিনে ‘নঙ্ঘি লড়কি’ বিশেষণ পেয়ে গেছেন, সে তো আগেই লিখেছি। সঞ্জীব কুমার জয়া ভাদুড়ির ‘কৌশিকা’ ও সত্তর দশকের গোড়াতেই মুক্তি পায়। অসামান্য অভিনয় করেছিলেন হরিভাই— সিনেমার নামে সঞ্জীব কুমার। খুব বড়ো অভিনেতা। শোনা যায় ড্রিমগার্ল হেমা মালিনীকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি। হেমা তখন ধর্মেদ্র স্বপ্নে। হেমা মালিনী অস্বীকার করেন— ফিরিয়ে দেন এই প্রস্তাব। হরিভাই— সঞ্জীব কুমার আর বিবাহই করেননি। মারাও যান কম বয়সেই। পরভিন বাবি তেমন নন। কিন্তু চুটিয়ে ছবি করেছেন সত্তরে। অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গেও। শোনা যায় ফিদা ছিলেন ‘বিগ বি’— অমিতাভ বচ্চনের ব্যাপারে। তখনও ‘বিগ বি’ এই অভিধায় ভূষিত হয়নি অমিতাভ। তিনি খুব আক্রান্ত ছিলেন না পরভিনে। তাঁর নজর তখন রেখায়। পরভিন বাবি পাকিস্তানি ক্রিকেটার মহসিন খানকে বিবাহ করেন। সেই দাম্পত্যো দীর্ঘ বা সুখের হয়নি। চূড়ান্ত অ্যালকোহলিক পরভিন মুম্বাইয়ে তাঁর ফ্ল্যাটে একা— নিঃসঙ্গ মারা যান। তাঁর ফুলে ওঠা শরীর উদ্ধার করে পুলিশ। দরজা ভেঙে। ক্মবির বেদী ছিলেন সত্তর-আশির আর এক হিরো, একদা মডেল কবির বেদি একদম পশ্চিমি ছাঁচ, চেহারাতে। বেশ কিছু সিনেমা করেছেন একসঙ্গে। জারিনা এসেছিলেন ছবিতে, দেবানন্দের হাত ধরেই প্রায়— ‘গ্যাম্বুলার’— ‘চুড়ি নহি মেরা দিল হ্যায়/ দেখ দেখ টুটে না’— চিড়ি নহি হ্যায় মেরা…’ দেব সাহাবের তখন পেল্লায় গোঁফ। মুখে সিগার। পিকিউলার ম্যানারিজম— সব ছবিতে যেমন, কাঁধ ঝাঁকিয়ে শ্রাগ করা, যেমন শ্রাগ তিনি প্রায় সব ছবিতেই করে থাকেন। হলিউডের গ্রেগরি পেকের কপি পেস্ট। কাঁধ ঝাঁকিয়ে কখনও কখনও শ্রাগ পর্যন্ত। তাঁর ও সুরাইয়ার প্রবল প্রেম কথায় বোম্বাইয়ের বাজার সরগরম ছিল একসময়। দেব সাহাবের দেওয়া হীরক অঙ্গুরীয় সুরাইয়ার আঙুলে, নাকি সুরাইয়ার দেওয়া হিরের আংটি দেব সাহাবের আঙুলে? সেই আংটি কি শেষ পর্যন্ত পৌঁছায় আরবসাগরের নীল ডুবে। ডুবেই গেল? এর পর দেবানন্দ বিয়ে করলেন অভিনেতা কল্পনা কার্তিককে। সুন্দরী কল্পনা। নলিনী জয়ন্ত, গীতা বালি সকলের সঙ্গেই উচ্চারিত হয় কল্পনার নাম। এর অনেক অনেক বছর পর জিনত আমন। চিরনবীন দেব সাহাবের জীবনে নতুন বসন্ত। সেই জিনতকে উড়িয়ে নিয়ে গেলেন কাপুর সাহাব— রাজ কাপুর। সেই বেদনাকথা লিখে গেছেন দেব সাহাব। ইলাহাবাদে অমিতাভ বচ্চনদের বাস। ‘মধুশালা’-র কবি হরিবংশ রাই বচ্চন, তেজি বচ্চন তাঁদের বাড়ি ইলাহাবাদে। অমিতাভ পড়াশোনা করেছেন ইলাহাবাদের স্কুলে। তেজি, হরিবংশ— দুজনেই নেহরু পরিবারের বিশেষ বন্ধ। পণ্ডিত জবাহর লাল নেহরু। পরে ‘প্রিয়দর্শিনী’ ইন্দিরা গান্ধী। রাজীব গান্ধী দোস্ত অমিতাভর। ভারতীয় রাজনীতিতে এলেন অমিতাভ জাতীয় কংগ্রেসের হয়ে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে সাংসদ হলেন। আবার ছেড়েও দিলেন। ‘গুড্ডি’ জয়া বচ্চন থেকে গেলেন রাজনীতিতে। সাংসদ হলেন, সমাজবাদী পার্টির হয়ে। ইলাহাবাদের দেখার জায়গা বলতে গঙ্গা-যমুনা সঙ্গম, সঙ্গে গুপ্তনদীর ধারা সরস্বতী, একবয়ার বাদশাহর তৈরি কেল্লা বা কিলা, অক্ষয় বইট, ভরদ্বাজ আশ্রম, অলোপিদেবীর মন্দির, চকের সঙ্গে ঘণ্টাঘর— বড়ো টাওয়ার, ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়, খসরু বাগ, মিউজিয়াম, হাথি পার্ক, প্রয়াগ সঙ্গীত সম্মিলনী। সেইসঙ্গে মোতিলাল-জওহর লালদের বাড়ি ‘আনন্দ ভবন’। 

আরও পড়ুন
তাড়বান্না ইলাহাবাদ কোম্পানি বাগ

ইলাহাবাদের লোকজন সম্পর্কে কহাবত— ‘প্রচলিত কথা ইলাহাব্দী/ বড়ি ফাসাদি’। কথাটা সর্বক্ষেত্রে ঠিক নয়। লাঠি, ছুরা— পিস্তলের ব্যাপার আছে, ছিল। তবে হাতবোমার ব্যবহার নেই-ই প্রায়, ব্যতিক্রম নকাশকোনা। সেখানে তৈরি হত ধুঁয়াধার— ধোঁয়াদার হাতবোমা। স্কুল ফাইনাল পাশের প্রায় সমতুল ‘বিদ্যাবিনোদিনী’ পরীক্ষা। সাধারণত, সাধারণত কেন মেয়েরাই দিতেন, মূলত বিবাহের বাজারে দাম বাড়াবার জন্য। তো সেই ‘বিদ্যাবিনোদিনী’ পাশের সার্টিফিকেট নাকি কিনতে পাওয়া যেত অর্থের বিনিময়ে। ক্লাস টেন বা লোকাল জিভে টেনথ পাশের শংসাপত্র। পুরানা কাটরা থেকে ইলাহাবাদের সঙ্গম হেঁটে চল্লিশ মিনিট, একটু খর পায়ে হাঁটতে হবে। শীতে যমুনা, গঙ্গা দুই-ই রোগা। সেই শীর্ণ ধারায় স্বচ্ছতা। বর্ষায় তা উত্তাল, জল বাড়ে। গঙ্গাজি-যমনাজি— দুজনেই স্ফীতা। ইলাহাবাদে ইক্কা, তাঙ্গা— টাঙা, সবই সত্তর দশকেও। ষাট দশকের শেষে বড়োমাসি— রেণু মাসি আর বড়ো মাসিমা, সেইসঙ্গে আরও দু একজন। ইক্কার চাকা ভেঙে গেল, কাঠও, একেবারে রেণুমাসির বাড়ির সামনে। সে কী অবস্থা। ইলাহাবাদে বর্ষায় প্রচুর তাজা ভুট্টা। গল্লেকা দুকান— রেশন দোকানে ভিড় হয় সাধারণ জনেদের। সামান্য অর্থবাণরা কেউ রেশন তোলেন না, ষাট সত্তর দশকে রান্নার গ্যাস পাওয়া যায় অবাধে। কোনো বুকিং ইত্যাদির বালাই নেই। সামনের রাস্তা দিয়ে রিকশা ভ্যানে করে লাল লাল গ্যাস সিলিন্ডার— ঢনঢনাঢন শব্দ করতে করতে সিলিন্ডার বাজাতে বাজাতে চলে যায় লোকজন। লোহার মোটা হসিক দিয়ে সিলিন্ডারের গায়ে মেরে মেরে শব্দ— শব্দ। পুরো ভর্তি সিলিন্ডার, আধভর্তি গ্যাস সিলিন্ডার। সত্তর দশকের গোড়ায় পুরো ভরা সিলিন্ডারের দাম বেয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ টাকা। মানুষের আয়ও তখন অনেক কম। ইলাহাবাদে জাতীয় কংগ্রেস রাজনীতির আধিপত্য বরাবর। তবে সোসালিস্ট পার্টি ও অখিল ভারতীয় কনসঙ্ঘর কিছু প্রভাব ছিল। ইলাহাবাদে এস এস পি— সংযুক্ত সোসালিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন ছিন্নানগুরু। ছিন্নানগুরু সম্বন্ধে ছড়া/ছিকুলি এরকম ছিল— ‘ছিন্নানগুরু কা কেয়া পহচান/  হাত মে ডাণ্ডা মু মেঁ পান’। ইলাহাবাদে সম্বোধনে কা-শ মে-এই উচ্চারণ উঠে আসত। বন্ধ ইয়াররা ‘বে’ বলেও সম্বোধন করত। এখনও করে। কিন্তু ‘বে’ খুব শোভন শব্দ নয় একেবারেই। ‘বতাও কাহে নহি’ এটা ছিল একটা কথার মাত্রা। ‘গুরু’— ‘কা-বে গুরু’। ‘কা হো গুরু’। বাঙালি পুরুষদের ‘দাদা’, বাঙালি মেয়েদের ‘দিদি’ আর একটু বয়স্কদের মাসি— ‘মৌসি’। ছোটোদের ‘খোকা’ আর ‘খুকি’। পুরানা কাটরায় পরেটে দুর্গাপুজো হত ষাটের দশকে। সেখানে প্রবাসী বাঙালিদের থিয়েটার। রিহার্সাল। আমার ‘মামু’ খগেশচন্দ্র রায় সেই থিয়েটারের একজন অন্যতম অভিনেতা। তিনি তাঁর ‘বন্ধু’ পোনুদাকে ‘রাজন’ বলে ডাকতেন, কারণ কোনো একটি নাটকে তিনি— মামু পোনুদাকে চরিত্র অনুযায়ী ‘রাজন’ বলে ডেকেছিলেন। সেই থেকে ‘রাজন’। 

আরও পড়ুন
তাল ঢ্যাঙা, ঢ্যাঙা ও আরও কিছু

ইলাহাবাদে ভাঙের নেশা ঘরে ঘরে। ভাঙ কা গোলা নিয়ে ‘বুত্’— মস্ত— ঝিমিয়ে থাকার একটা ধারাবাহিকতা ছিল এই শহরে। ভাঙের শরবত, শিলে-সিদ্ধিপাতা পেষা, সবই চলত। ভাঙ খেয়ে বওরান— বাজে বকা একটা ব্যাপার। ভাঙের নেশা খুব বিপজ্জনক। মিষ্টি খেলে তা আরও চড়ে বসে। গাঁজার নেশাতেও তাই। ভাঙের গভীর নেশায় মনে হয় শূন্য থেকে পড়ে যাচ্ছি, একদম নিচে, ধপাস করে। সিদ্ধির নেশা যদি খুব পেয়ে ধরে, তাহলে অড়হড় ডাল ফুটিয়ে নিয়ে তার জল, ঠান্ডা করে যার নেশা চড়ল, তাকে খাওয়ানো। সেইসঙ্গে তেঁতুল গোলা জল— ইমলিকে খাট্টা। এই তেঁতুলজলে— তেঁতুলজল খেয়ে বমি হয়ে গেলে রিলিফ— শান্তি। 

ইলাহাবাদে একসময় প্রবাসী বাঙালিদের খুব প্রভাব ছিল। বারাণসী, মধুপুর, জসিডি, ঘাটশিলা, দেওঘর, মিহিজাম, পুরী, ম্যাকল্যাক্সি গঞ্জ, পাটনা, পূর্ণিয়া, কাটিহার, সর্বত্র ছিল বাঙালিদের অনেকখানি আধিপত্য— প্রভাব। সেইসব দিন বহু বছরই ‘বেতে হুয়ে দিন’। তা কেউ আর লওটা— ফিরিয়ে দেবে না। সত্তর দশকে ইলাহাবাদে ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ নাম বদলে ‘নর্দার্ন ইন্ডিয়া’ পত্রিকা, সব চেয়ে চালু ডেইলি। কলকাতার ‘যুগান্তর’, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ ডাক এডিসন পাওয়া যায় বেলা তিনটের পর। ডকটর ব্যানার্জির চেম্বারে পাওয়া যায় ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র ডাক সংস্করণ। এছাড়াও হিন্দি দৈনিক ‘আজ’, ‘হিন্দুস্তান টাইমস’, ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’, ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’, ‘স্টেটসম্যান’, ‘পাইওনিয়ার’। কিছুদিন পরে পাওয়া যেতে থাকল হিন্দি দৈনিক ‘গাণ্ডীব’।

Powered by Froala Editor