ইলাহাবাদ— পুরানা কাটরা ও অন্যান্য

ইলাহাবাদ, এলাহাবাদ, প্রয়াগ, প্রয়াগরাজ— যে নামেই তাকে ডাকি না কেন, সেই ডাকাডাকির সঙ্গে সঙ্গে ভিড় করে অজস্র স্মৃতি। হাওড়া থেকে বম্বে মেলে উঠে ইলাহাবাদ। রাত আটটা নাগাদ ছাড়ত গাড়ি, ইলাহাবাদ সকাল দশটায়। ইলাহাবাদের আগে বড়ো জংশন বলতে মির্জাপুর। মির্জাপুর ছাড়লেই বাবা আমাদের তৈরি হতে বলতেন, ইলাহাবাদে নামবার জন্য। মির্জাপুরে বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর মন্দির অতি বিখ্যাত। বিন্ধ্যাচল, বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর মন্দির, মর্জাপুর— সব এক হয়ে গেছে। আমরা যে বম্বে মেলে চেপে হাওড়া স্টেশন থেকে ইলাহাবাদ জংশন পৌঁছাতাম, সেই বম্বে মেল ভায়া ইলাহাবাদ। ভায়া নাগপুরও একটি বম্বে মেল ছিল। এখনও হয়তো আছে। ষাট বা সত্তর দশকেও বম্বে মেল সাধারণত বেশি লেট করত না। তার রাইট টাইমই দেখেছি, যতবার গেছি, এসেছি। 

ইলাহাবাদ আমার কাছে স্মৃতির শহর। ছোটো, সুন্দর, ছিমছাম। দু একটা জায়গা বাদ দিলে বেশ সাজানো। শহুরে সনাতনী হিন্দুদের পাশাপাশি ইসলাম ধর্মাবলম্বী ও খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী— যাঁদের ‘ইশাই’ বলে স্থানীয় মানুষজন, তাঁরা আছেন। আছেন শিখেরাও। ইলাহাবাদে শীত ও গরম খুবই তীব্র, ষাট ও সত্তর দশকেও। গ্রীষ্মে প্রবল লু, আঁধি, আমপোড়া শরবত, দহি, লস্যি। অনেকেই সাইকিল— সাইকিল চালিয়ে দফতর— অফিস যাওয়ার সময় মাথা, কান বেড়িয়ে আঙ্গোছা— আমছা নেন। এমনকি তথাকথিত ভদ্রলোকেরা। ইলাহাবাদে কাটরা, পুরানা কাটরা, সিভিললাইন্স, চওক— চক, তুলারাম বাগ, আলোপি বাগ, মুঠঠিগঞ্জ, সবোতিয়াবাগ, এসবের কথা কম বেশি আগেও বলেছি। ইলাহাবাদে নওরাত্রি— দুর্গাপুজোর চারদিন বিশেষ করে মুঠঠিগঞ্জের আলো ছিল দেখার। পশ্চিমবাংলার চন্দননগর থেকে যেত নানা ধরনের আলো। মানুষজন ভিড় করে সেই আলো— ‘লাইটিং’ দেখতে আসতেন। ইলাহাবাদে হাতে ঘড়ি পরাকে ‘ঘড়ি লেদে নিল’ এমন বলতেন প্রবাসী বাঙালিরা। হিন্দিতে ঘড়ি পহেনকে নয়, ঘড়ি লাদকে চলে যায়। নানা ধরনের ভালো গর্জাস জামাকাপড়কে বলা হত জ্যাকস্যাক ড্রেস। মেয়েদের চুল কাটানোকে বলা হত পরকাটি। লালজিকে ‘লালজিউন’ বলে ডাকার রেওয়াজ ছিল। 

ষাটের দশকে তো বটেই, সত্তর দশকে সাধনা, আশেপাশের নন্দা, বৈজয়ন্তীমালা, ওয়াহিদা, রেহমান, খানিকটা নার্গিস, মীনাকুমারীরাও তো নায়িকার ভূমিকায়। আছেন সিমি, নূতন, পদ্মিনী, উঠে আসছেন রেখাম যোগিতা বালি, জয়া ভাদুড়ি, ‘নংঘি লেড়কি’— বলে কথিত রেহানা সুলতানা যিনি ‘চেতনা’ ও ‘দস্তক’ নামে দুটি তথাকথিত অ্যাডাল্ট ফিল্ম করেছিলেন। খুব হিট তখন। নতুন হিরো, ভিলেন, কমেডিয়ান, ভ্যাম্প বলতে অমিতাভ বচ্চন, রাজেশ খান্না, অনিল ধাওয়ান, নবীন নিশ্চল। সেইসঙ্গে আশরানি, রণজিৎ, বিন্দু, ড্যানি ডেনজাগাপ্পা। আছেন চির যৌবনা হেলেন। দিলীপকুমার, দেবানন্দ, রাজ কাপুর, শশী কাপুর, শাম্মি কাপুর, সুনীল দত্ত, রাজকুমার, রাজেন্দ্রকুমার তো আছেনই। জয় মুখার্জি, দেব মুখার্জিরা তখন খুব চেষ্ট করছেন। ‘হিট’-ও দিচ্ছেন ছবি। এবং অশোক কুমার (সর্বজনমান্য ‘দাদামণি’)। তথাকথিত আর্ট ফিল্মের মধ্য দিয়ে নাসিরুদ্দিন শা, ওমপুরি, নানা পাটেকার, কূলভূষণ খারবান্দা, অনুপম খেররা আরও খানিক পরে পরে আশ্চর্য অভিনয় প্রতিভা নিয়ে এসেছেন অমল পালেকর। দিলীপসাব, দেবানন্দ সাবদের সঙ্গে ধর্মেন্দ্রে আর প্রাণের নামও করতে হয়। তেমনই অমিতাভ বচ্চন, রেশ খান্নাদের সঙ্গেই ভিলেন হিসাবে শত্রুঘ্ন সিংহ বা শত্রুঘ্ন সিনহার নাম। ‘বিহারিবাবু’ একটু একটু করে নিজেকে ভিলেন ও হিরো প্রামাণিত করেছেন। একটু চড়া— লাইভ অ্যাকটিং কিন্তু সব মিলিয়ে যেন খানিকটা হাটকে। এই সময়টাতেই যখন শত্রুঘ্ন সিনহা, অনিল ধাওয়ান, নবীন নিশ্চল, রাকেশ রোশনরা উঠে আসছেন, তখন প্রিয়া নামের একজন হিরোইন উঠে এলেন। তিনি নবীন নিশ্চল, রাজকুমার-সহ অনেকের সঙ্গেই অভিনয় করে ‘হিট’ ছবি দিয়েছেন। এই সময়েই দেবানন্দের আবিষ্কার জিনত আমন আর রাজকাপুরের খুঁজে পাওয়া ড্রিম গার্ল— দক্ষিণী হেমা মালিনী। মৌসুমী চ্যাটার্জি, রাখী— দুই বঙ্গতনয়া, এই সময়েই বহু ‘হিট’ সিনেমা দিয়েছেন।

শ্যাম বেনেগাল, এম এস সথ্যু, সত্তর দশকের একেবারে শেষ দিকে নিয়ে এলেন অঙ্কুর ‘নিশান্ত’ আর ‘গর্ম হাওয়া’। এম এস সথ্যুর ছবি ‘গর্ম হাওয়া’। সথ্যুর ছবির চিত্রনাট্য লিকেছেন শ্যামা জায়দি, তিনি বড়োই রূপময়ী তখন। সথ্যুর সঙ্গেই কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তাঁকে দেখি আশির দশকে। শ্যাম বেনেগালের ছবি ধরেই কবি ও বুদ্ধিব্রতী— ভাবুক ক্যায়কি আজমির কন্যা শাবানা আজমি। সেই সঙ্গে সঙ্গে স্মিতা পাতিল। সুহাসিনী মূলে এলেন মৃণাল সেনের অবিস্মরণীয় ছবি ‘ভুবন সোম’ সূত্রে। এলেন সাধু মেহের, অমৃশ পুরি, পবন মালহোত্রা এলেন আরও অনেক অনেক পরে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘বাঘ বাহাদুর’ তাঁকে সামনে আনল আমাদের। পবন অবশ্য তেমন বেশি কিছু করতে পারলেন না তাঁর ক্যারিয়ারে। কিছু বিজ্ঞাপন-ছবি করলেন পরে। আর দু-একটা ছবি।

আরও পড়ুন
কোম্পানি বাগ, আলফ্রেড পার্ক

সত্তর দশকে শর্মিলা ঠাকুর যথেষ্ট পরিমাণে আছেন সমস্ত বোম্বাইয়া ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি জুড়ে। রাখী, মৌসুমী চ্যাটার্জিদের সঙ্গে তাঁর নামও তো করতেই হয়। এই সময়েই ফরিদা জালাল, এই সময়েই অরুণা ইরানি। অরুণা পরে বিবাহ করেন প্রখ্যাত অভিনেতা মেহমুদকে। ছিলেন সুলক্ষণা পণ্ডিত, লীনা চন্দ্রভারকার। সুলক্ষণা পণ্ডিত খুব ভালো গানও গাইতেন। তারপর হিরোয়িন। কিশোরকুমারের সঙ্গে তাঁর ডুয়েট— ‘জাদুগর তেরে নয়না…’ ভোলার নয়। সুমন কল্যানপুর, সুলক্ষণা পণ্ডিত, বাণী জয়রাম, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, হিন্দি গানের আরতি মুখার্জি, অনুরাধা পড়োয়াল, সারদা, চঞ্চল, শৈলেন্দ্র সিং, যেশু দাস, মুকেশ পুত্র নীতিন মুকেশ— সকলেই কেমন যেন বিস্মৃতির প্রায় আড়ালে। এমন কি অসামান্য কণ্ঠের অধিকারী সুবীর সেনও হয়তো খানিকটা। নাজিয়া হাসান কী মনে পড়ে আমাদের? আসলে অ্যাত অ্যাত সব কথা বলা এই জন্য, ষাটের দশকের শেষে সাধনার হেয়ার স্টাইল বদলে গেল। সামনের চুল খানিকটা সোজা কপালে এনে কাটিয়ে নিলেন তিনি, পরবর্তী সময়ের হিরোইনরা একে যে খুব অনুসরণ করেছেন, এমন তো নয় মোটেই। এমনকি ববিতা, নিতু সিং, ডিম্পল কাপাডিয়া, মিথাল কাপাডিয়ারাও নন। রাজ কাপুরের ছেলে রণবীর কাপুর— ডাব্বু তিনিও কয়েকটি হিট সিনেমা দিয়েছেন। তার মধ্যে একটির নাম ‘রামপুর কা লখসমন’। জিনাত আমনকে নিয়ে রাজ কাপুর আর দেবানন্দের মধ্যে যে প্রেম প্রতিদ্বন্দ্বিতা, তার আভাস পাওয়া যায় দেবানন্দের আত্মজীবনীতে। থাক সে প্রসঙ্গ। আবার সাধনায় ফিরি। আশা পারেখ ও সাধনা— দুজনেই বহু হিট ছবি দিয়েছেন সত্তর-ষাট দশকেও। তেমনই বৈজয়ন্তীমালা, ওয়াহিদা রহমান, নূতন, শর্মিলা ঠাকুর, রাখী, মৌসুমী চ্যাটার্জিরাও। 

ইলাহাবাদের পুরানা কাটরার এক বাঙালিনীকে জানি, তিনি আমার বড়ো মাসি— রেণুমাসি আর আশুতোষ মেসোমশাইয়ের মঝলে লেড়কি— মেজো মেয়ে। আশুতোষ ভট্টাচার্য আর রেণু ভট্টাচার্যের (রায়) তিন ছেলে তিন মেয়ে রণজিৎ কুমার ভট্টাচার্য (খোকন/ মঙ্কু), দিলীপকুমার ভট্টাচার্য (বেডু), অশোককুমার ভট্টাচার্য (বাবু)। তিন কন্যা— মঞ্জু ভট্টাচার্য (বুড়ি), রঞ্জনা ভট্টাচার্য (মানু), লিনা ভট্টাচার্য (কুক্কু/ কোক্কা), রঞ্জনা স্কুল ফাইনাল পড়ার সময়ই— ক্লাস টেনে থাকতে অজয় নামে একটি অতি হ্যান্ডসাম, হিরো সদৃশ— চেহারায় যেন অজয় সাহানি বা পরীক্ষিৎ সাহানি যেমন, তেমন। তিনি থাকতেন অ্যালোপি বাগে। রঞ্জনার সঙ্গে তাঁর দেখা বেশ কয়েকবার হয়েছে। কিন্তু গোটা ব্যাপারটা পেকে ওঠার আগেই খোকনদা— রঞ্জিত ভট্টাচার্যর কানে চলে যায় খবরটা। কুক্কু, বুড়ি— সবাই বিষয়টি জানত। কুক্কুকে নাকি সেই হ্যান্ডসাম অজয় সম্বোধন করত ‘নটখট চিটি’— ‘দুষ্টু পিঁপড়ে’ বলে। খোকন— রণজিতের হস্তক্ষেপে এই প্রেম টেকেনি। 

আরও পড়ুন
তাড়বান্না ইলাহাবাদ কোম্পানি বাগ

বলে নেওয়া ভালো, ষাট ও সত্তর দশকেও ইলাহাবাদে নারী পুরুষের প্রেম একেবারে ভয়ঙ্কর অপরাধ। কোনোভাবে ধরতে পারলে প্রহার— গুরুতর মারধর অপেক্ষা করে আছে ছেলেটি ও মেয়েটির জন্য। কোনো সময় ছেলেটিকে ন্যাড়া পর্যন্ত করে দেওয়া হয় আর মেয়েটিকেও। শারীরিকভাবে হেনস্থা করা হয় দুজনকেই। কাউকে— কোনো নারীকে ‘রক্ষিতা’ হিসাবে রাখলে তেমন কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু প্রেম করলেই বিপদ। ধরা পড়লে তো বিপদের শেষ নেই।

মানুদি-রঞ্জনা সাধনা স্টাইলে চুল কাটিয়েছিলেন অজয়ের সঙ্গে প্রেম করার সময়। ‘ব্যাক কম্ব’ বলে পেছন দিকে টেনে চুল আঁচড়ে তারপর বাঁধার একটা স্টাইল তখন খুব চলত হিন্দি বলয়ে। ফলে মানে এই স্টাইলে কেশ বিন্যাস করলে গাদা গাদা চুল উঠে আসে। খুব সামান্য চুল সামনে— কপালের ওপর এনে সোজা করে তারপর সমান সমান— ‘সাধনা’ স্টাইলে কাটিয়ে বা কেটে নেওয়া। তো মানুদি সাধনা স্টিয়ালে রইল। আর খোকনদা— বেড়ুদার প্রত্যক্ষ আপত্তিতে সেই প্রেমের ইতি ঘটল। ইলাহাবাদে একই জাত— সেম কাস্টে প্রেম হলেও আপত্তি। হিন্দু-মুসলমান, হিন্দু-খ্রিস্টান, মুসলমান-খ্রিস্টান হলে তো কোনো কথাই নেই। সেই ধারাতেই সম্ভবত ‘যোগী’-র উত্তরপ্রদেশ ‘লাভ-জিহাদ’ ইত্যাদি প্রভৃতি, আমার মনে হয়।

আরও পড়ুন
তাল ঢ্যাঙা, ঢ্যাঙা ও আরও কিছু

ইলাহাবাদে ষাট-সত্তর দশকে কোম্পানি বাগে ধোবি— ধোপাদের কাপড় কাঁচা ও শুকনোর জায়গা। প্রত্যেক ধোবি বা ধোপারই গাধা থাকে, ময়লা আর কাঁচা কাপড় বহন করার জন্য। পুরানা কাটরায় ছিলেন লাখনোয়া ধোবি। তাঁরও ছিল পালতু— পোষা গাধা। লাখনোয়াকে সবাই বলতেন ‘মেহরুল’ বা ‘মেহেরা’। হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জিতে বা শার্ট পরা লখনোয়া ছিলেন একাই। তাঁর পুরুষত্বহীনতা নিয়েই কথা বলতেন মহল্লার মানুষ। হাসি, মজাক ওড়াতেন খুব। আওয়াজা তাওয়াজা মারতেন। ‘রুল রুল মেহেরুল’। ইলাহাবাদে বর্ষায় লাল বিলৌটি আর খিল্লিখোরি নামে দুধরনের পোকা খুব দেখা যেত। লাল বিলৌটি সম্ভবত কেন্নো বা কেন্নাই। ‘লাল বিলৌটি পাঞ্জা খোল/ তেরি নানি আয়ি হ্যায়’, কোনো স্পর্শ বা আঘাত লেগে লাল কেন্নো গুটিয়ে গেলে তখন এই ছিকুলি।

ইলাহাবাদে বহু বাড়িতেই পোষা হত টিয়া, চন্দনা। লোহার খাঁচার ভেতর পাখি। টিয়াকে ‘মিঠঠু’ বলে ডাকার রেওয়াজ ছিল তখন। তখন নিশ্চয়ই আর দেশী পাখি পোষা যায় না। চড়াইকে বলা হত গৌরাইয়া। কাককে কাউয়া। পাহাড়ি রোমদার কুকুর খুব দেখা যেত ইলাহাবাদে পুষতেনও অনেকে। আর পোষা হত পাটনাই ছাগল ও বর্বরি ছাগল। বর্বরি ছাগলের মাংসর কথা আছে আইন-ই-আকবরিতে। বর্বরি ছাগল দেখতে একদম হরিণ। তাদের গায়ে কোনো ছাগুলে ছাগুলে গন্ধ নেই। যা সাধারণত অজ গাত্রে হয়ে থাকে। বর্বরি ছাগলের দুধ চমৎকার। কোনো দুর্গন্ধ নেই। খুব ভালো চা হয়। ভালো করে জ্বাল দিলে খুব ভালো সর পড়ে। বেশ মোটা। খোকনদা ৮৫৩/৭৩২ পুরানা কাটরার দোতলায়, খাপয়ার ঘরের পাশে ছাদের ওপর বর্বরি ছাগল পুষেছিলেন। একদম হরিণ যেন চেহারা। পুং বর্বরির দাড়ি নেই, একটুও। কোনো কোনো ব্রিডের যেমন দেখা যায়। পশ্চিম বাংলার ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল’ ব্রিডের যে অজরা, তাদের মাংস খুবই স্বাদু। বর্বরির মাংস তাঁর থেকেও ভালো স্বাদে। খোকনদা ছাদে ৮৫৩/৭৩২ পুরানা কাটরার বাড়ির ছাদে পুষেছিলেন বর্বরি ছাগল। বেশ কয়েক মাস কেন, কয়েক বছরও ছিল সেই ছাগল। তার দুটো বাচ্চাও হয়েছিল। সে সব কথা পরে হবে আবার। পুরানা কাটরার ৮৫৩/৭৩২ ঠিকানার এই বাড়ি ছিল পাথরের খানিকটা আর কাদা আর চুনের গাঁথনি। ফলে মাঝের ঘরটা ছিল খুব ঠাণ্ডা, গরমেও। 

আরও পড়ুন
তাল বিলাইয়া তাল খাইও…

ইলাহাবাদে ষাটের দশকেও দেখেছি প্রবল গরমে খসখস— নারকেল ছোবড়ার তাতে পিচকিরির জল দিয়ে ভালো করে ভেজানো ও একেবারে মালগুডি ডেজ। সেইসব কথা লিখব পরপর। ইয়াহাবাদের গল্লি, পাশিয়ানা, পাতল গল্লি, সে বড়ো স্মৃতিময়।

শীতে ইলাহাবাদে বুলবুলির লড়াই। কাঠের বা লোহায় তৈরি ওয়াই চেহারার দাঁড়, তার ভেতর পায়ে কালো কার বাঁধা পুরুষ বুলবুল। যার ঝুঁটি অন্য পুং বুলবুলকে দেখলেই ‘লড়াই খ্যাপা’ রাগে ফুলে ওঠে। লাল কার দিয়ে কখনও বাঁধতে দেখিনি বুলবুলের পা, কেন কে জানে? কালো কার, শক্ত, সিল্কের। শীতে বুলবুল লড়ায় মূলত আহির, পাশি, চামার, কুনবি— ইত্যাদি তথাকথিত ‘ছোটো’ জাতেরা। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, ক্ষত্রিয়রা নয়। 

তিরখের স্পিরিটের— দিশি মদের দোকান ছিল পুরানা কাটরায়। ছিল মিশ্রাদের মিশ্রা কম্পানি— আংরেজি দাওয়াখানা। তিরভুবন বা ত্রিভুবনের জেনারেল স্টোর— মনিকা স্টোর্স। ত্রিভুবনের ঠাকুরদা ছিলেন রইস আদমি, অনেক টাকা। তাঁকে ‘দাউ’ বলতেন তিরভুবন। তিরভুবন ছিলেন বেড়ুদার বন্ধু। বেড়ুদার বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন রমেশ, তিরখ, তিরভুবন, ইন্দে, লাল্লন। লাল্লন বা লাল্লনরা বানিয়া। হুবলাল জয়সোয়াল ছিলেন কালোয়ার। তাঁর ছিল ‘জয়সওয়াল’ ইলেকট্রিক নামে বিদ্যুতিন সরঞ্জামের দোকান। খুব সুন্দর সুন্দর টেবল ল্যাম্প, বালব, টিউব। টেবল ক্যাম্প আসত আলিগড় থেকে। একটা সাপ জড়ানো রয়েছে আলোর গোল শেড ঘিরে, দারুণ দেখতে। মনে আছে এখনও। 

হুবলাল ঘন কৃষ্ণ বর্ণ। মাথায় পাকা চুল। বুক কাটা হাফ শার্ট, ফুল প্যান্ট— সবই টেরিকটের। ‘ল্যামব্রেটা’ স্কুটার ছিল হুবলালের। একটু সাইজে বড়ো অন্য চালু স্কুটার ‘ভেসপা’-র থেকে। তখনও ‘ভেসপা- বাজাজ’ হয়নি। হুবলাল জয়সওয়ালের ছেলে বাপের ‘ল্যামব্রেটা’ চালায়। ছেলেটা বাবা যেমন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, তেমন তো একেবারেই নয়। সেই হুবলাল-পুত্রের ‘ল্যামব্রেটা’র পেছনে বসে বহু ঘুরেছি। আমার মামু— খগেশচন্দ্র রায়, ডাকনামে ‘কালু’, উনি চাকরি করতেন ‘জওসওয়াল ইলেকট্রিক’-এ। জওসওয়াল বানান জয়সোয়ালও হতে পারে। মামুর পোস্টটি গাল ভরা— ‘ম্যানেজার’। খুব বিড়ি খেতেন মামু, ঘন ঘন। দিনে চার পাঁচ বান্ডিল। সেইসঙ্গে সিগারেটও। আর দিনে চল্লিশ-বেয়াল্লিশ কাপ চা। ভাত খেতেন না। ভাইফোঁটার দিন, বছরে একদিনই তিনি বড়দি রেণুর দেওয়া থালা সাজানো ভাত, ডাল, মাছ, মাংস, দই, মিষ্টি সব গ্রহণ করতেন। তারপর গলায় আঙুল দিয়ে বম্বা— কলঘরে হড় হড় করে নয়, ওয়াক তুলে তুলে প্রতিটি খাদ্যকণা বমি তুলে তুলে বার করে তবে নিশ্চিন্ত হতেন। খগেশচন্দ্র রায় ছিলেন মায়ের বড়ো জ্যাঠামশাই শ্রীরাম রায় ও রাজরাজেশ্বরী দেবীর সন্তান। দীনেশ চন্দ্র রায়, খগেশচন্দ্র রায়, পরমেশচন্দ্র রায় (মানিক) এই তিনটি পুত্রসন্তান ওঁদের। তবে সবার বড়ো রেণু— কন্যা হিসাবে। আর ছিলেন পেনটু বা পেনঠু। পেন্ট থেকে পেন্টু। এমনই সুন্দর ছিলেন তিনি তাঁর দু চোখের মণি ছিল কানজা— মানে বেড়াল বেড়াল। তাঁর বিয়ে হয়েছিল গঙ্গা নামের যুবকের সঙ্গে। পরমেশচন্দ্র রায়— মানিক মামা অকালপ্রয়াত। ৮৫৩/৭৩২ পুরানা কাটরার এই দোতলা বাড়ির একতলায় তিনখানা ঘর। বৈঠক— বৈঠকখানা, মাঝের ঘর, মামুর ঘর। সেইসঙ্গে ভাঁড়ার ঘর, সামনে আখশাল— রান্নাঘর। একতলায় বড়োসড় কলঘর ও খাটা পায়খানা। দোতলায় দুটো ঘর। তার মধ্যে একটা খাপরার— খোলার ছাউনি। সামনে বি-ই-শা-ল পেটাই ছাদ, রেলিং দেওয়া।

Powered by Froala Editor

Latest News See More