তাড়বান্না ইলাহাবাদ কোম্পানি বাগ

মুছে যায়?— ৫৯
আগের পর্বে

বাংলায় ‘তাল ঢ্যাঙা’ শব্দটি বহু প্রচলিত। স্বাভাবিকের থেকে খানিকটা লম্বা হলে, এমন আখ্যা দেওয়া হয় কোনো ব্যক্তিকে। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধানচন্দ্র রায় 'ঢ্যাঙা' বলেই অভিহিত করেছিলেন সত্যজিৎ রায়কে। বালি জোড়া অশ্বত্থতলা বিদ্যালয়ের থেকে সামান্য দূরে ভচ্চায্যিদের শরিকানি পুকুরের উল্টো দিকেই ছিল ঢ্যাঙা পুকুর। দুই পুকুরের মাঝে ছিল উঁচু মাটির পথ। ছিল দুটো প্রাচীন তালগাছও। গরমকালে এই পথে মাঝামাঝেই খড়িশ দেখা যেত। তারপর...

তালকে গোবলয়ে— হিন্দি বলয়ে বলে তাড়। ঝাঁক বাঁধা সারি দেওয়া তালগাছকে বলা হয়ে থাকে তাড়বান্না। ‘তাড়’ থেকেই সম্ভবত তাড়ি। বঙ্গদেশে— পশ্চিমবঙ্গে যার নাম ‘তেলোতাড়ি’। ‘তালের রস থেকে ‘নীরা’ নামে একটি নরম পানীয় তৈরি করে বিক্রি করা হত আট ও নয়ের দশকে। বেশ খেতে। খেজুর গাছের রস থেকেও তৈরি হয় তাড়ি। খেজুর গাছ ও তাল গাছে পোড়া মাটির সামান্য লম্বাটে, অনেকটা যেন পুরীর জগন্নাথের ‘প্রসাদ’-এর ডালি— ডাল রাখার পোড়ামাটির পাত্র যেমন হয়, অনেকটা তেমন দেখতে। এই গাছে বাঁধার হাঁড়িকে এই বঙ্গে কোথাও কোথাও বলা হয়ে থাকে ‘ঠিলে’। এই ঠিলেতে মুখ ডুবিয়ে তাল বা খেজুর রস পান করে ফিঙে, বুলবুল। তাই অনেক সময়ই বাঁধা থাকে ঠিলের মুখ। একটি চালু গান আছে দেহতত্ত্ব ভাবের। ‘খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধো মন… খেজুর গাছে… খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধো মন…’।

খেজুরগাছের রস যাঁরা কাটেন, গাছ থেকে তাঁদের বলে শিউলি। শিউলিরা গাছ বেয়ে বেয়ে ওঠেন, রস কাটার জন্য। খেজুর গাছের মাথা কাটেন তাঁরা লোহার ধারালো, চকচকে, প্রায় রুপো রঙের কাস্তে দিয়ে। 

সাধারণত তাঁরা ধুতি খুব জটিয়ে টেনে পরতেন। গরম কালে যাঁরা তালের রস বের করতে গাছ কাটতেন, তাঁদের খালি গা। হঠাৎ করে পাশ দিয়ে গেলে ঘামের সঙ্গে উড়ে আসে তাড়ির ঝিমঝিমে গন্ধ। যত বেলা বাড়ে, তত তালের রস, খেজুর রস ঘোলা হতে থাকে। আমি নিজে মঙ্গল ও উল্লাস নামের দুই তাড়ি বানিয়ে থাকা জনকে বেশ ঘনিষ্ঠভাবে জানতাম এক সময়। উল্লাস হাওড়া জেলার বালির লোক। বালি শান্তিরাম রাস্তার খটখটি বাগানে উল্লাসের তাড়ির ঠেক। উল্লাস ঝাড়খণ্ড বিহারের মানুষ। মঙ্গলও তাই। মঙ্গল ব্রহ্মপুরে অখিল দাসের জমিতে থাকতেন তাড়ির ব্যবসা করতেন। কুঞ্চিত কেশ, সামান্য বড়ো পেট, সামনের পাটির দাঁত সামান্য উঁচু। উল্লাস গাছ জমা নিতেন খটখটি বাগানে। হারা ঘোষ, কেষ্ট ঘোষেদের তাল বাগিচা, সেখানে খরিশ থাকে কাছাকাছি, একজোড়া। এই খরিশের তাড়া খেয়েছি আমি, জোরদার তাড়া। তখন এক বড়ো ভাঁড় তাড়ির দাম পঁচিশ নয়া পয়সা— চার আনা। কাচের বড়ো গ্লাসে দিলেও একই দর। বেঁটে বেঁটে কাচের গ্লাসে তাড়ি খাওয়া হয় উল্লাসের ঠেকে। সঙ্গে ঝাল চানাচুর, কাঁচা লঙ্কা, শীতের দিনে টাটকা মুলো, খটখটি বাগানে হারা ঘোষ, কেষ্টা ঘোষদের চাষ থেকে তুলে আনা সেই মুলো। কখনও বা পুকুরের ছোটো ছোটো চিতি কাঁকড়া— লোকাল মুখে, উচ্চারণ যারা ‘দশরথ’, নয়তো গেঁড়ি-গুগলি বা ঝিনুকের ঝাল।

চিতি কাঁকড়া, গুগলি, ঝিনুক, কদাচিৎ ডাহুকের মাংস বানাত উল্লাস। তার জন্য এক্সট্রা পয়সা দিতে হত, স্বাভাবিকভাবেই। অনেক শুকনো লঙ্কা সেই চিতি কাঁকড়ার প্রিপারেশনে।

আরও পড়ুন
তাল ঢ্যাঙা, ঢ্যাঙা ও আরও কিছু

বালিতে ভটচাযদের পুকুর আর ঢ্যাঙা পুকুরের মাঝখানে যে উঁচু মাটির রাস্তা গোস্বামী পাড়ার দিক থেকে এসে ঢুকে গেছে দুই পুকুরের ঠিক মধ্যিখান দিয়ে পায়ে চলা রাস্তায়। গোস্বামী পাড়া থেকে এই দুই পুকুর— ভট্টাচার্যদের আর ঢ্যাঙা পুকুরের মধ্যিখানের মাটির রাস্তার বাঁদিকে জোড় তালগাছের কথা, তালগাছ থেকে পাকা তাল পতনের কথা লিখেছি আগেই। লিখেছি নাপতে বাড়ির কথা। সেই যে নাপিত বাড়ি। লালুর মা— বড়ো গিন্নি, সেজো গিন্নি, ন গিন্নি, ছোটো গিন্নি। লালুর মা এক গলা ঘোমটা টেনে নামাজের জলপড়া, নুন পড়া দেয়। কাঁসার ছোনো ঘটিতে সামান্য জল নিয়ে যাওয়া লালুর মায়ের কাছে। লালুর মায়ের তো এক গলা ঘোমটা। ব্লাউজহীন বৃহৎ অলাবু সদৃশ স্তন তার নিপলময়তায় মহাঘোরে জাগে। লালুর মা জাঁক করে বলেন, ও বামুন কায়েত যাই বলো, এই নাপতেনির হাতের জল না পেলে কারওরই মুক্তি নেই যে। মুক্তি শব্দটা তিনি বলতেন না হয়তো, বলতেন, এই নাপিতবউয়ের হাতের জল মুখে না ছোঁয়ালে বামুন, কায়েত, বদ্যি— কারওরই যে বেহাই নেইকো, পেটের জল শুদ্ধু হয় না তাদের।

আরও পড়ুন
তাল বিলাইয়া তাল খাইও…

লালুর মায়ের নুন পড়া, জল পড়া, মুখের কাছে জলের ঘটি নিয়ে বিড় বিড় বিড় বিড় করতে করতে নিয়মিত ফুঁক মারা। —ফু —ফু —ফু — করতে করতে বেশ জোরে বাতাস ছাড়া দাঁতে মিশি দিতেন লালুর মা। পাকা— শুকনো নারকেল পাতা পুড়িয়ে, তার সঙ্গে তামাক পাতা, শুকনো খোলায় উনোনে বসানো লোহার চাটুতে ভেজে তারপর তাকে বড়োসড় লোহার হামান দিস্তায় গুঁড়িয়ে দাঁত মাজা আর নেশা— সবই একসঙ্গে।

আরও পড়ুন
ঘুড়ি তো জানে না সে নিজে ওড়ে না

ইলাহাবাদের কোম্পানি বাগান বা কোম্পানি বাগ। শাখা মৃগ হয়ে একলাফে পৌঁছে যাই কোম্পানি বাগে। সেখানে অজস্র তালগাছ, পেয়ারা গাছও, বেশ গভীর জঙ্গল। প্রাচীন সাপ, শেয়াল, বেজি, বাঁঘডাশা অনেক প্রকাশ্যে, অপ্রকাশ্যে। বৃষ্টি ভেজা ঘন মেঘ যেন, এমনই রঙ বর্ষার কোম্পানি বাগের। তার ভেতরে ভেতরে আঠাল মাটিতে কোথাও কোথাও জল জমে যায়। সেখানে নামে ময়ূর— মোর, ময়ূরনীও। ঝুপঝাপ বৃষ্টি, মেঘ কলরোলে নাচ দেখা পুরুষ ময়ূর। যেন বর্ষা দিন— বৃষ্টিদিনের রাগ মেঘমলহার অথবা মেঘ, নয়তো মিয়াঁ কি মলহারে জেগে থাকে অতুল-অলীক সৌন্দর্য। তাড়বান্না— তালগাহচের সারির ছায়ায় ছায়ায় রোদ নাচে। পুরানা কাটরার আছির পল্লীর রাম্মু— রামুয়া, পোরে, শিউলাল, বাচাউলাল, নিজেদের নিজেদের ভ্যাঁয়স— ভৈঁসি নিয়ে চলে আসে ঘাস চরাতে। অফুরান ঘাস কোম্পানি বাগে, বৃষ্টি দিনে। সেখানে স্বাস্থ্যবতী মোষেরা অনায়াসে ঘাস ছেঁড়ে দাঁতে। ষাটের শেষ দিকে বাচাউ, মিউ— সবাই নিজের নিজের ট্রানজিস্টার নিয়ে আসে। গান শোনে। আকাশবাণী— বিবিধভারতী। সেইসঙ্গে সঙ্গে বুধবারের রেডিও সিলোন। আমিন সাহানি পেশ কর রহে হ্যায়। বিনাকা গীতমালা। পরে যা হয়ে যায় সিবাকা গীতমালা। আমিন সাহানির কণ্ঠে নাজুক মাদকতা। ‘আমিন সাহানি বেশ কর রহে হ্যায়’। হয়তো চকিতে বাজে শাম্মি কাপুরের ‘প্রিন্স’ নামে ছবির গান। 

আরও পড়ুন
কার ঘুড়িতে যে রেখেছি মন সোনা করে

সেই কোম্পানি বাগে বর্ষায় নারকেল নয়, তাল পড়ে ধুপ, ধপাস করে। পাকা তালের মাহাত্ম্য— কীভাবে কীভাবে বড়া— ফুলুরি, তালের পিঠে, তালক্ষীর বানিয়ে খায়, সম্পূর্ণ অধরা। পাকা কাঁচা তাল আর খাওয়া যায়, কত, কতবার। রাম্মুর মা নেই। রাম্মুলাল যাদবের দাদা— পোরে লা যাদব সেই সঙ্গে দুই দিদি গুড্ডি আর ভদাওর। গুড্ডি খানা পাকায়। পোরে, গুড্ডি, ভদাওরদের বাপ রাজা রাম যাদব আকবর বাদশার কিলার ভেতর আরি মেশিন ঠেলে। কাঠ কাটার আরি মেশিন ঠেলে ঠেলে কাটে বড়ো বইড়ো, পাকা গাছের গুঁড়ি, কাণ্ড, ডালপালা। সবাই বলে, রাজারাম বুক দিয়ে দিয়ে ঠেলে আরি মেশিন। রাজারামকে সংক্ষেপে আর আর বলে বদরি। বদরির নানা ইলাহাবাদের ক্লাবে কুক। খানা বানায়। যেমন গুঙি— বোবা লতার বাপ, আরও দুই মেয়ে আশা আর ঊষার বাপ ভুরে লাল এইরকমই কুক— রাঁধুনি ক্লাবের। ক্লাবে খুব ভালো ভালো— ইংলিশ, মোগলাই রান্না, ইংলিশ— আংরেজি শরাব— বিলিতি মদ। বদরি, আশা-ঊষা-সবার বাপ চামার। কিন্তু বড়ো কুক। তখন ১৯৭০-৯৭১। গুঙি লতা আর আঙুল মুদ্রায় যৌন সঙ্গমের কথা বলে রাস্তায়, প্রকাশ্যে। তাদের মা বাবার শারীরিক মিলন। তারা দুই বোন। গুঙি— কথা বলতে পারে না। ডুরেলাল ক্লাব বা কেলাবে কুক হিসাবে অনেক সময়ই খাবারের ছিটেফোঁটা পায়, শরাব-বোতলের তলানি। ‘ওল্ড মঙ্ক’, রাম। সেইসঙ্গে মোহন মেকিংস-এর লিকার— হুইস্কি। কাচের বোতলের তলায় যতটুকু থাকে। ক্লাব থেকে খাসির মাসের তলানি— দু-এক পিস খাসি-মিট। সেইসঙ্গে ঝোল। তিন মেয়ে তাদের, এক ছেলে। তিন মেয়ের মধ্যে দু দুটো বোবা। একটা ছেলে, সে তো কথা বলে।

তখন তো নাসবন্দির বাজার। নাসবন্দি করলে— পুরুষের যৌন ক্ষমতা— বীর্যপাতের নলিতে ছেদ করলে নগদ টাকা। কাউকে নাওবন্দি করাতে নিয়ে গেলেও সরকারি টাকা। সম্ভবত একশো, নগদে। কড়কড়ে পাত্তি— নোট একটা। সেই বাজারে একশো টাকা খুব কম নয়। 

বদরি তার পাকা চুলঅলা মাথায় ‘কোলগেট’ তেল দেয়। বদরির বন্ধু রাম— মুখ-নকশায় অনেকটা যেন ট্র্যাজেডি কিং দিলীপকুমার। রামু তেমন লম্বা নয়। অযোধ্যা, ফৈজাবাদের আগে এটাওয়ায় রামুদের দেশ। এই রামু ইনটার পাশ। তেমন লম্বা নয় মোটেই। খাকি ধরনের প্যান্ট আরপ টেরিকটের সাদা ফুল শার্ট পরে রামু। এটাওয়াকে মুখে মুখে ইলাহাবাদের লোকজন বলে থাকে এটা। সেই এটায় রামুর বাবা-মা, বৌদি-দাদা।

ইলাহাবাদ থেকে ইনটার— ইনটার মিডিয়েট পাশ রামু দিনে একটা হয়তো ‘পানামা’ সিগারেট খেয়ে থাকে। এজি অফিসে, ইলাহাবাদেই তার নিশ্চিন্ত চাকরি। এই রামুই তার বিবাহের পর নিজের ভাবি— ভৌজির সঙ্গে সম্পর্ক-র কথা স্বীকার করে। এই গল্পটায় প্রায় কোনো মোচড়ই নেই। রামুর দাদা মেহেরা— নপুংসক। ফলে বৌদি— ভৌজি গ্রাস করে রামুকে। এর একটা ফেমিনিস্ট টেকশট অবশ্য হয়। রামু কী ধোঁয়া বিল্বপত্র বা তুলসীপত্র নাকি? তারও তো ইচ্ছে থাকে এবং ইচ্ছের মুক্তি— রিলিজ।

এই রামুর টাইটেল প্রসাদ। বদরি, বদরির নানাও প্রসাদ। ভুরেলালও পদবিতে প্রসাদ। বদরির নানা গাল ভর্তি পাকা দাড়ি। মাথায় তেমনই পাকা চুল। শীতে প্রায় পা পর্যন্ত কালো লং কোট। মাথায় কালো টন্দি, গলায় মাফলার। এই কোট টুপি, মাফলার— সবই ইলাহাবাদের গুদরি বাজার থেকে কেনা। গুদরি বাজার হল পুরানা জিনিস কেনাবেচার জায়গা। বিশেষ করে ফৌজি আর পুলিশ ডিসপোজাল। মিলিটার আর পুলিশওয়ালাদের ছেড়ে আসা জিনিস। কোট, জামা, প্যান্ট, বেল্ট— কোমরের পট্টি, খাকী জামা, সবুজ জামা, খাকী প্যান্ট, সবুজ প্যান্ট, হুইসিল, ব্যাজ। সেইসঙ্গে ব্যাগ, বুট— একদম উর্দি মাফিক— যেমন হয়ে থাকে। এছাড়া কম্বল, কলের গান, কাচের মাসন কোসন— সবই মেলে গুদরি বাজারে। যেমন কলকাতায় শেয়ালদার কাছে চোরাইবাজার। সেখানে রেকর্ড, গ্রামোফোন, রেডিও, ঘড়ি, আজামা-কাপড়, পোশাক-আশাক, জুতো— সব কিছু। গুদরি বাজারে সেলাই করা ভেড়ার কম্বল বিক্রি হয়, কুড়ি টাকায়, দশ টাকায়। ইলাহাবাদ থেকে খানিক দূরে বমরৌলি এয়ারপোর্টে তখন পাকিস্তানজয়ী ‘ন্যাট’ বিমানের প্রদর্শনী। সেইসঙ্গে ‘ন্যাট’-এফিট করা মেশিন গানের বড়োসড় গুলি। দেখতে অনেকটা যেন থ্রি নট থ্রি রাইফেলের পেতল মোড়ানো বুলেট। তবে সাইজে অনেক অনেক বড়ো। গুদরি বাজার, ‘গজধর’-এর আইসক্রিম, চাঢঢার হালুয়া— খুবই মশহর ইলাহাবাদে। সঙ্গে দুধকে লাড্ডু— ক্ষীরের লাড্ডু, মুঙ্গকে লাড্ডু, বেসন কে লাড্ডু— সবই খুব মশহর। প্রসিদ্ধ। গজধর, চাঢঢা— সবই সিভিল লাইনস।

ইলাহাবাদে, চওক আর সিভিল লাইনস অতি বিখ্যাত জায়গা। চওক বা চক মানে বড়ো বাজার হিন্দি বলয়ে প্রায় সব বড়ো শহরেই চওক বা চক আছে। ইলাহাবাদের চওকে আছে ঘণ্টাঘর। বাসন, জামা-কাপড়, হারমোনিয়াম-বেহালা, তবলা— সবই পাওয়া যায় চওকে। ২০০ টাকা দ্ম একটা ভায়োলিনের ১৯৭০ সালে। সিভিল লাইনস খুব পশ এলাকা। ভালো রেস্তোরাঁ সিভিল লাইনস-এ। বইয়ের দোকান, যাকে বুক শপ বলে। ইলাহাবাদে সিনেমা হল বলতে প্ল্যালেস, প্লাজা, পুষ্পরাজ, লছমি টকিজ, মান্সরোবর, নীলকমল নামে কোনো পিকচার হল— মানে সিনেমা হল ছিল কি? এইসব হলে কোনো সিট নম্বর নেই। ফলে শো শেষ হয়ে নতুন শো আরম্ভ হওয়ার আগেই হুড়মুড় ভিড়। যে যেখানে পারে বসে পড়ে। সিনেমা-টিকিটের দামও কলকাতার তুলনায় বেশ বেশি অন্তত ১৯৬৮-৬৯ সালে। রিয়ার স্টল, ড্রেস সার্কেল, ব্যালকনি— সব ছিল কি? 

হাইমা নামে এক সাউথ ইন্ডিয়ান রমণী— বেশ কালো কিন্তু সুচারু-সাজানো দাঁত, হাসলে আরও ভালো লাগে, সুন্দর। কালো সালোয়ার কামিজের ওপর গোল্ডেন— সোনালি সুতোর কাজ। তাঁর সাউথ ইন্ডিয়ান ডিশের— ইডলি, প্লেন ও মশলা দোসা, বড়া, সম্বরম। সঙ্গে হাইমার হাসব্যান্ড। হাইমা মলয়ালি খ্রিস্টান। তাঁর সহজীবনের মানুষটি হাইমার তুলনায় কিঞ্চিৎ বয়ক্স। টেরিকটের ফুলপ্যান্ট, ফুলশার্ট। ক্লিন শেচেন। মাথার চুলে নারকেল তেলের নিবিড় প্রলাপ। জোরালো আলো পড়লে সেই পাট পাট কেশ বেশ চকচক করে। ভদ্রলোককে দেখতে অনেকটা যেন বহু হিন্দি ছবির নায়ক রেহমান। গুরু দত্ত সাহাবের সাহেব বিবি গুলাম, গুরু দত্তরই ‘কাগজ কে ফুল’-সহ নানা সিনেমায় রেহমানসাব। হাইমা সম্ভবত সিভিল লাইনস-এরই কোনো সিনেমা হলে, ‘প্যালেস’ অথবা ‘প্লাজা’-য় তাঁর ও তাঁর হাসব্যান্ডের যৌথ ব্যবসা চালাতেন। ইলাহাবাদে সিভিল লাইনস, টেগোরটাউন, জর্জটাউন, এলেনগঞ্জতে, সবোতিয়া বাগ, নকাশকোনা, পুরানা কাটরা, তুলারাম বাগ, সুলেম সরায়, চওক, খানিক দূরে ফাপামউ। ফাপামউয়ে হাট বসে প্রতি সপ্তাহে মঙ্গলবার, মঙ্গলবার। সেখানে শীটে যমুনার চমৎকার আড়, বোয়াল, রুই, মৃগেল, কাতলা। লোকাল চাষের বড়ো বড়ো ফুলকপি, বাঁধা কপি, টোম্যাটো, পালং। খাসির ভালো মাংসও পাওয়া যায় সেখানে, দামে বেশ সস্তা। কোয়ালিটি খুব ভালো। ইলাহাবাদ শহর থেকে মোটরবাইকে, বাইকে ফাপামওয়ে হাট করতে যায় অনেকেই। আড়কে টেংরা মাছ বলে ইলাহাবাদে, ট্যাংরাকে তো ট্যাংরা বলে। ছোট পাবদার নাম বাঁশপাতি। রুইকে রহু মচ্ছি, চিংড়ি মাছকে ঝিঙা মচ্ছি। ইলাহাবাদের সেই ফাপামও ১৯৯০-এর দশকেই বেশ ঘিঞ্জি হয়ে উঠল। বাড়ি। বাড়ি। রবিবার রবিবার ইলাহাবাদে সকালে— মর্নিং শোয়ে দশটা থেকে বাংলা সিনেমার শো হত। ১৯৭১ সালে এখানে এখানে পিঞ্জর দেখেছেন অনেক বাঙালি। ১৯৬৭-১৯৬৮তে ইলাহাবাদের ‘প্যালেস’ অথবা ‘প্লাজা’-য় ‘চৌরঙ্গী’-র রেগুলার শো। উত্তমকুমার, বিশ্বজিৎ, রবি ঘোষ, উৎপল দত্ত, শুভেন্দু চ্যাটার্জি, অঞ্জনা ভৌমিক, সুপ্রিয়া দেবী। এই অঞ্জনা ভৌমিক-ই প্রচুর সিনেমা করেছেন উত্তমকুমারের সঙ্গে— ‘রাজদ্রোহী’, ‘চৌরঙ্গী’, ‘শুক-সারি’, ‘নায়িকা সংবাদ’। আরও সিনেমা আছে ওঁর। অঞ্জনা ভৌমিক ও আরতি ভট্টাচার্য দুজনেই বেশ কয়েকটি ছবি করেছেন উত্তমকুমারের সঙ্গে। আরতি ভট্টাচার্য, উত্তম-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়দের সঙ্গেই করেছিলেন ‘স্ত্রী’। খুব হিট ছবি। আরতি ভট্টাচার্য তপন সিংহ’র মিউজিক্যাল ছবি ‘হারমোনিয়াম’-এও গুরুত্বপূর্ণ রোল করেছিলেন। খুব জানতে ইচ্ছে করে কেমন আছেন অঞ্জনা ভৌমিক, আরতি ভট্টাচার্যরা। অঞ্জনা ভৌমিকের কন্যা নীলাঞ্জনা টিভি সিরিয়াল করেছেন, সিনেমাও। পরে বিবাহ করেন যিশু সেনগুপ্তকে।

Powered by Froala Editor