‘তার চুড়িতে যে রেখেছি মন সোনা করে’… এমন একটা অসামান্য গান গেয়েছিলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সেই গানের লাইন ভাঙিয়েই যেন গতবারের ‘মুছে যায়?’-এর— পঞ্চান্ন নম্বর কিস্তির শিরোনাম। এবারের হেডিংও ঐ বিখ্যাত রোমান্টিক গানের কথা অনুসরণ করে। তো সে যাই হোক, উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর অঞ্চলের তেলিপাড়ায় বিশ্বকর্মা পুজোর আগে, পরে আকাশভরা রঙিন ঘুড়ি দেখেছি। প্রায় এর ঘাড়ে ও তার ঘাড়ে সে। বড়ো ছাদ ভর্তি লোক, এমনকি অতীব সুন্দরীরাও, অনায়াসে।
দোলের সময় এই সব ছাদেই তো রঙিন আবির ওড়ে, আবির মাখামাখি, গোটা আকাশ যেন বসন্ত দুপুরে হয়ে ওঠে গোধূলি সন্ধির আলো গান। মেয়েরা অধিকাংশই খোলা চুলে। তার ওপর এসে পড়েছে ম্যাজেন্টা বা লাল আবিরের রং। ফাগ, ফাগ, ফাগুয়ার দোলা। ফাগুয়া দিবস যেন, দোল।
৬৪বি তেলিপাড়া লেনে আমার ছোট মাসি— নমিতা ভট্টাচার্যর শ্বশুরবাড়ি। ছোট মাসি প্রয়াত হয়েছেন ২০১১ সালে। সেদিনটিতেই ভোটের ফলাফলে বামফ্রন্টকে হারিয়ে ক্ষমতায় আসে। ১১ মে। ১১ মে, ২০১১। ছোট মেসোমশাই লোকরঞ্জন ভট্টাচার্য মারা গেছেন বেশ আগেই।
ছোট মাসির শ্বশুরমশাই মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য ছিলেন পাবনার মানুষ। দেশভাগের পর চলে আসেন এপারে। পাবনা তাঁর কাছে ‘স্বর্গ’, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। তিনি অতি নামকরা কবিরাজ ছিলেন। পড়াতেন শেয়ালদার কাছে যে আয়ুর্বেদিক কলেজ, সেখানে। ধুতি, হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি, পায়ে পা ঢাকা চামড়ার পাম্প শ্যু। হাতে চামড়ারই ভারি ব্যাগ। জীবনের শেষ দিকে রোজ কলেজ যেতেন না। ঘোর অ্যালপ্যাথি বিরোধী মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য চোখের অসুবিধার জন্য পদ্মমধু সেইসঙ্গে ‘মেড ইন জার্মানি’ একটা হোমিওপ্যাথি ড্রপ দিতেন। আমিও বহুবার তাঁর চোখে ড্রপ দিয়ে দিয়েছি।
আরও পড়ুন
কার ঘুড়িতে যে রেখেছি মন সোনা করে
বন্ধু ও সহচাকরিজীবী জনৈক সেনের সঙ্গে তিনি এই বাড়িটি খরিদ করেন। দোতলা বাড়ি। দোতলায় ছাদ। একতলায় রান্নাঘর, দুটি পায়খানা, একটি ছোট্ট বৈঠকখানা আর একটি ঘর। ওপরে— দোতলায় দুটি ঘর আছে। তার ওপরে ছাদ।
আরও পড়ুন
ও, ও, ঘুড়ি— ঘুড়ি রে
মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যর সহচাকুরিয়া সেন মহাশয়, তিনি খাস কলকাতার জন। যাকে সব অর্থেই ‘ঘটি’ বলা চলে। সেই সেনবাবু ধুতি-আদ্দির পাঞ্জাবি, হাতে চামড়ার ভার ব্যাগ— যেমন হয় কলেজের পোশাক— বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্তর, তথাকথিত ‘ভদ্রলোকের’, তেমনই।
আরও পড়ুন
বিশ্ব ইজতেমা, তবলিগ জামাত, আরও কিছু
আমার ছোটমাসির ছাদ ও সেন মহাশয়দের ছাদে তীব্র ঘুড়িবাজির আয়োজন প্রাক-বিশ্বকর্মা, বিশ্বকর্মা এবং উত্তর-বিশ্বকর্মাদিনে— সকালে, দুপুরে। ছাদে ভাঙা ক্যানেস্তারা, ডালডার খালি টিন, কাঁসর-ঘণ্টা। টানামানি প্যাঁচে অপরপক্ষের ঘুড়ি ‘বলি’ হলেই সমন্বয়ে ভো-কাট্টা, ভো-কাট্টা। তারপর ভাঙা ক্যানেস্তারা, ডালডার টিন, কাঁসর-ঘণ্টার নির্ঘোষ। সেন মহাশয়দের সমস্ত ছাদ জুড়েই ঘুড়ি-বীর-বীরঙ্গনা, ঘুড়ি-ভিড়ও সেখানে। সঙ্গে হালকা খাবার, খাওয়ার জল, সে যেন এক চরম উৎসব-ক্ষণ। বালিতে ঘুড়ি কেটে গেলে ভো-ম-হা-রা, ভো-ম-হা-রা, পে-পে-পে হারা, ভু-ভু-ভুঃ শুনেছি। কিন্তু তেলিপাড়ার সেনবাবুদের ছাদে অধিকাংশ সময়েই ভো-কা-ট্টা। ভো-কা-ট্টা। সেই যে গান আছে না— ভো-কাট্টা তোমার ভালোবাসা… ভো-কাট্টা তোমার অভিলাষা— ‘অভিলাষাই’ কী? মনে হয় ‘অভিলাষাই’ হবে। যাক সে সব প্রসঙ্গ। ঘুড়ি নিয়ে গান বলতে কবীর সুমনের— তখন তিনি সুমন চট্টোপাধ্যায়— ‘পেটকাটি চাঁদিয়াল মোমবাতি বগগা/ আকাশে ঘুড়ির ঝাঁক মাটিতে অবজ্ঞা…’। ‘কাটি পতঙ্গ’ বলে একটি সিনেমা এসেছিল সত্তর দশকে— আশা পারেখ, রাজেশ খান্না। বিধবার সঙ্গে প্রেম— অবশ্যই সনাতনী বিধবা— ‘যিস গলি মে তেরা ঘর না হো বালমা। উস গলি সে হামে তো গুজরনা নহি…’। মুকেশ, মুকেশ…। রাজেশ খান্নার লিপে। এই সিনেমার আরও একটি গান ‘ইয়ে যো মুহব্বত হ্যায়…’।
আরও পড়ুন
বলি, কুরবানি— মাংস
ঘুড়ি ওড়ানোর দৃশ্য ছিল ‘পাকিজা’-তে। আর ছিল তওয়ায়েফ সাজা মীনা কুমারীর ‘কোঠা’তে আটকে যাওয়া কাটা ঘুড়ি। কামাল আমরোহি সাব এই ছবিটির পরিচালক। মীনাকুমারীর অভিনয় করা চরিত্রটির নাম সাহেবজান। এই মুভিতেই মীনাকুমারী ছাড়াও ছিলেন অশোককুমার, রাজকুমার। এই ছবির সঙ্গীত পরিচালকও কামাল আমরোহি সাব। ‘চলতে চলতে য়ুঁহি কঁহি মিল গ্যয়া থা…’। কিংবা ‘ঠারে রহিও ও বাঁকে ইয়ার…’। ‘চলো দিলদার চলো চাঁদকে পাড় চল…’। গানের কথা, সুর, অনবদ্য। সম্ভবত কুঁড়ি বছর পর ছবিটির শ্যুটিং শেষ হয়। সিনেমাটির কাজ চক্লতে চলতে নানা কারণে শ্যুটিং বন্ধ হয়ে যায়। পরিচালক কামাল আমরোহির সঙ্গে মীনাকুমারীর ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর।
সেই পাকিজা— কামাল আমরোহি, মীনাকুমারী আর অশোককুমারদের ড্রিম প্রোজেক্ট— স্বপ্নের তোষাখানা। এই ‘পাকিজা’ জুড়েই ঘুড়ি আর ঘুড়ি, কাটা সুতো কেতে যাওয়া ঘুড়িরা।
‘দিল্লি সিক্স’ বলে একটা সিনেমা এসেছিল দু হাজার সালের একটু পরে হয়তো। সেই সিনেমায় ছিলেন অমিতাভ-তনয়, অভিষেক বচ্চন আর সোনম কাপুর। উত্তরপ্রদেশ বা দিল্লির পটভূমিকায় তোলা সেই সিনেমাতে ঘুড়ি, ঘুড়ি আর ঘুড়ি— রঙিন ঘুড়ি সব। পতঙ্গ লড়ান। অনেক, অনেকক্ষণ। সত্যজিৎ রায়ের শতরঞ্জ কে খিলাড়িতেও পুরনো আওধ— লখনউ শহরের আকাশজোড়া ঘুড়িবাহার।
পুনরায় উত্তর কলকাতার তেলিপাড়ার ছাদে ফিরি। মনোরঞ্জন কাব্যতীর্থ— মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যর গা-লাগোয়া সেন মহাশয়ের বাড়ির ছাদে উঠে তাঁদের বাড়ির বৌমারাও ঘুড়ি ওড়াতেন। ‘ছোটি’ ইত্যাদি নামে সম্বোধিত হয়েছেন কবিরাজ সেন মহাশয়ের দুই বধূমাতার ছোটজন। বড়ো বউ চুপচাপ নন কিন্তু মেপে কথা বলেন, সামান্য। ছোট বউ বেশ তড়বড়ি। কথার ফুল তাঁর মুখে ফুটে থাকে সর্বদা।
কবিরাজ মশাইয়ের দুই ছেলে। তাঁরা একেবারেই প্রায় চুপচাপ। চোখে পাওয়ারদার চশমা, দু’জনেরই। ধুতি-পাঞ্জাবি। কোনো সাহেব কোম্পানি— অবশ্যই প্রাইভেট মার্চেন্ট আপিসে চাকরি করতেন তাঁরা। এঁদের একজন কী ওকালতি করতেন? সম্ভবত নয়। সেই বাড়ির ছেলে টুটুন আর মেয়ে পুটপুটি, তারাও রীতিমতো ঘুড়িতে, বিশ্বকর্মায়।
ওকালতির কথায় মনে পড়ল শ্যামপুকুরে ঘাতকের ছুরিকাঘাতে নিহত জননায়ক হেমন্তকুমার বসু হত্যা মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত পাণ্ডবেশ্বর মুখার্জির হয়ে মামলা লড়েছিলেন— অর্থাৎ ডিফেন্স কাউন্সিল প্রখ্যাত অভিনেতা ব্যারিস্টার সন্তোষ দত্ত এবং সোমরাজ দত্ত। সোমরাজবাবুও ছিলেন খুব নামকরা ব্যবহারজীবী। কলকাতার ব্যাঙ্কশাল কোর্টে সেই হত্যা মামলা— মার্ডার কেসের সেশন— শুনানি হত। জননেতা হেমন্ত বসুকে হঠাৎ করে কেন হত্যা করা হল, কারা খুন করল, সেসবই রহস্যের মোড়কে, আজও। অকুতদার জননেতা, জনগণে নিবেদিত প্রাণ হেমন্ত বসু যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী ছিলেন। তিনি ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, সর্বভারতীয় ফরোয়ার্ড ব্লক নামে সুভাষচন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠিত দলটি করতেন। তখন ফরোয়ার্ড ব্লকে অশোক ঘোষ, কমল গুহ, চিত্ত বসু প্রমুখ আছেন। হেমন্ত বসুর পর বহু বছর নলিনী গুহ শ্যামপুকুর বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক ছিলেন বেশ কয়েক বছর। নলিনীবাবুও ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। তাঁর প্রয়াণের পর নেতাজি পরিবারের সুব্রত বসু বিধায়ক হন। নলিনী গুহ, সুব্রত বসু— সবাই ফরোয়ার্ড ব্লক। সম্ভবত আশির দশকে সুভাষবাদী ফরোয়ার্ড ব্লক বলে একটি সংগঠন তৈরি হয়। তার অন্যতম সংগঠক ছিলেন শীলভদ্রযাজি, ধীরেন ভৌমিক। ধীরেন ভৌমিক ‘দৈনিক বসুমতী’তে উত্তর সম্পাদকীয় লিখতেন। খদ্দরের সাদা পাঞ্জাবি, ধুতি, পা ঢাকা পাম্প শ্যু। বেঁটে, পেটানো স্বাস্থ্য, মাথার চুল ঘন, কালো, কলপায়িত।
ফরোয়ার্ড ব্লকের তিনটি ভাগ তাহলে— সর্বভারতীয় ফরোয়ার্ড ব্লক, রাম চট্টোপাধ্যায় ও সুহৃদ মল্লিকচৌধুরীদের মার্কসবাদী ফরোয়ার্ড ব্লক, তারপর শীল ভদ্রযাজিদের সুভাষবাদী ফরোয়ার্ড ব্লক।
হেমন্ত বসু হত্যা মামলায় মূল অভিযুক্ত পাণ্ডবেশ্বর মুখার্জি— ডাকনামে পাণ্ডে, তাঁর ডিফেন্স কাউন্সিল বা কৌঁসুলী ছিলেন সন্তোষ দত্ত ও সোমরাজ দত্ত। সন্তোষ দত্ত খুবই বড়ো অভিনেতা ছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের ‘তিনকন্যা’, ‘সোনারকেল্লা’, ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’, ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’— সবেতেই তিনি। যতদিন বেঁচে ছিলেন ফেলু মিত্তির সিরিজের পার্মানেন্ট ‘জটায়ু’। তাঁকে বাদ দিতে সত্যজিতের ফেলু সিরিজের ‘জটায়ু’— লালমোহনবাবু ভাবাই যায় না ‘সাহারায় শিহরণ’, ‘কলার কুম্ভীর’, এরকম সব গ্রন্থ প্রণেতা জটায়ুজি। প্রদোষ মিত্র— ফেলু মিত্তর সিরিজে রবি ঘোষ জটায়ু হয়েছেন, হিন্দি ফেলুদায়। পরে বিভুবাবু, পছন্দ হয়নি একেবারেই। যেমন পধন্দ হয়নি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছাড়া শশী কাপুর বা সব্যসাচী চক্রবর্তী ও টোটা রায়চৌধুরীদের ফেলুদা। মোহন আগাসে কি জটায়ু হয়েছিলেন কোনোবার?
কলকাতায়, কলকাতার গা-লাগোয়া মফঃশ্বলে রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রতীকসহ ঘুড়ি উড়তে শুরু করে। জাতীয় কংগ্রেসের হাত, সিপিআই(এম)-এর কাস্তে-হাতুড়ি-তারা, পরে তৃণমূল কংগ্রেসের ঘাস-জোড়াফুল। কিন্তু সেই প্রচার ইত্যাদি খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তৃণমূল কংগ্রেস অবশ্য আরও অনেক পরে— আশির দশকের অনেক পরে দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে ও তৃণঘুড়ি ওড়ায়। ততদিনে বাজারে প্লাস্টিক আর চিনা কাগজের জল নিরোধী ঘুড়ি ও চিনা মাঞ্জা এসে গেছে।
ঘুড়ি আকাশের অনেকটা উঁচুতে বেড়ে থাকলে বৃষ্টি হলে, বাজ পড়লে সেই পুরনো দিনের ঘুড়ি ও মাঞ্জার দফারফা। চিনা মাঞ্জা বা ঘুড়িতে, তা হয় না। আমরা তো বিদ্যুৎ আবিষ্কারের ‘ব্যাংনাচান’ পণ্ডিত মাইকেল ফ্যারাডে অবতারের সেই বৈজ্ঞানিক ঘুড়ির কথা আমরা ভুলে গেছি। মাইকেল ফ্যারাডে, টমাস আলভা এডিসন, জেমস ওয়াট, এঁদের নাম কি ভোলা যাবে?
একটা গান শুনেছিলাম বহু বছর আগে— ‘উড়িয়ে দে তোর মন ঘুড়িটা…’। খুবই আত্মদর্শনের গান।
শুনেছি কুমার শচীনদেব বর্মণ ঘুড়ি, গান ও ফুটবলে অসম্ভব শৌখিন ছিলেন। মুম্বাইয়ে— তখনকার বোম্বাইতে রোভার্স কাপে ইস্টবেঙ্গলের খেলা থাকলে যাবেনই মাঠে, পাঁড় ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টার। খেলা দেখতে যেতেন, সঙ্গে পানের— খুব ছোট ছোট পানের খিলি।
বালির ঘুড়িয়াল— মিস্টার, মহিনদাস, রাধু-কালু, বুলন-সূদন, হরিমোহন— সকলের কথাই মনে আসে। মহিনদাসের মাঞ্জা ছিল অতি বিখ্যাত। মিস্টারেরও তাই। মিস্টার থাকতেন বালি ঘোষপাড়া লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে। সেকেন্ড হ্যান্ড মাল— ‘টানা মাল’ বিক্রি করতেন। সম্ভবত হিন্দিভাষী। মাথার মাঝখানে টাক। গালে খাপচা দাড়ি, মাঝে মাঝেই মনে আছে যতবার মিলিটারি বুশিং অপারেশন হচ্ছে ১৯৭০-এ। মিস্টার দূরে দাঁড়ানো নকশাল ছেলেদের দেখে বলছেন, প্লিজ ইন কাম… প্লিজ ইন কাম— তখন অতিভোর। বলতে গেলে প্রায় শেষ রাত। এই মাস্টারের মাঞ্জাও ছিল খুব বিখ্যাত।
আমার বড়ো মাসিমার ন ছেলে পার্থসারথী ভট্টাচার্য ভারতবিখ্যাত ব্যায়ামবীর। সম্প্রতি ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে প্রয়াত পার্থ কালীঘাটে ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটের বাড়ির তিনতলায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঘুড়ি ওড়াত।
ঘুড়ির চেত্তা ভাঙা, তেলভর্তি মাথায়, ঘুড়ির গা ঘষা, ঘষতে ঘষতে চেত্তা ভাঙা, কাঁচকাঠির এক দিকে কাগজ পাকিয়ে কান্নিক দেওয়া, ভেঙে যাওয়া কাঁচকাঠি এসবই খুব ক্যারিশমার ব্যাপার। সাবু, আটা দিয়ে তৈরি আঠা, পাকা তেঁতুল বীজ সেন্ধ করে তৈরি আঠা, কাঁচা দিশি গাবফলের আঠায় ছেঁড়া ঘুড়ি জোড়া হত। ফাঁসাফাঁসি, হাত্তা কাটা, ফেত্তি ধরা, ঢিল লঙ্গর, ঘুচো ঘুচি প্যাঁচ— সবই জড়িয়ে আছে ঘুড়ির ইতিহাসের সঙ্গে।
আমাদের স্কুল— বালি জোড়া অশ্বত্থতলা বিদ্যালয়ের সামনে ঘুগনি বিক্রি করতেন নিতাইদা, রঙিন ছিটের হাফ শার্ট, ধুতি একচোখ মণিহীন— তাঁকে তো ‘কানা নিতাই’ বলতেন সবাই পেছনে, তো সেই নিতাইদার ‘ছেলে-রোগ’ ছিল। মুখে মুখে ছড়া বানাতেন। অনায়াসে তার মধ্যে ঢুকে যেত তথাকথিত অশ্লীল শব্দ— খিস্তি। অতিযত্নে বাচ্চা ছেলেদের প্যান্টের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিতেন, পুরুষাঙ্গে হাত দিতেন তাদের। কানাইদার মুখে সর্বদা রসের কথা। খুব ভালো তেঁতুল মাখতেন, সঙ্গে মটর-ঘুগনি, শালপাতায়। সঙ্গে পেঁয়াজ, কুচো লঙ্কা, পাতিলেবুর রস। তিন নয়াতেও ঘুগনি পাওয়া যায়। নিতাইদা শৌখিন আগেই বলেছি। তাঁর চোখে রিমলেস সোনালি ফ্রেমের চশমা। আগে— বিয়ের আগে ধুতি-পাঞ্জাবি, মাথায় ঘুগনির অ্যালুমিনিয়াম হাঁড়ি। সাইকেল রিকশায় করে বিয়ে করা নতুন বউ নিয়ে এলেন নিতাইদা। শুনেছি পরে তাঁর টিউবারকুলোসিস ধরা পড়ে— টিবি— যক্ষ্মা— ক্ষয়রোগ— নানা নাম তার। টিবি হওয়ার পর নিতাইদার বিক্রি কমে যায়। সরস্বতী পুজোর সিজনে ঘুড়ি বিক্রি করতেন নিতাইদা, ঘুগনি ক্রমশ ক্রমশ যক্ষ্মাদোষ নিয়ে দূরে চলে যাচ্ছিল। আর নিতাইদা— যিনি থাকতেন বালি ঘোষপাড়া লেভেল ক্রসিংয়ের একেবারে গায়ে, তিনি ঘুড়ি, সুতো লুটে— ধরে রেখে দিতেন তাঁর কাছে, পছন্দের ছেলেটিকে দেওয়ার জন্য।
Powered by Froala Editor