ও, ও, ঘুড়ি— ঘুড়ি রে

মুছে যায়? — ৫৪
আগের পর্বে

ইজতেমায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষেরা আসেন অংশ নিতে। খোলা মাঠে বিশাল চট বা ছিট কাপড় পেতে আয়োজন হয় ইজতেমার। ইজতেমা শেষ করে তবলিগ জামাতের সঙ্গে অনেকে বেরিয়ে পড়েন চিল্লায়। এক চিল্লা মানে চল্লিশ দিন। জামাতের প্রধান আমির সাহেব এভাবেই মাসের পর মাস ধর্মপ্রচার করেন বিভিন্ন জায়গায়। মূলত সুন্নি সম্প্রদায়ের তবলিগ জামাত হয়। বিশ্ব ইজতেমায় মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ। একসময় বাংলার বিভিন্ন জায়গায় পিরবাবাদের একছত্র প্রভাব ছিল। বর্তমানে তবলিগ জামাতের চাপে ক্রমশ বাংলার পিরতন্ত্র এবং পিরের মুরিদান বা শিষ্যরা। তারপর...

হাওড়া জেলার বালিতে বাজার হিসাবে বালিবাজার খুব পুরনো। ষাটের দশকে, সত্তরের গোড়াতেও বালি বাজারে ঢোকার মুখে বাঁদিকে খুব বড়ো হাড়ি-কলসির দোকান। সেখানে মাটির গ্লাস, ভাঁড়, খুরি। এছাড়া কুজো। গোস্বামী পাড়া হয়ে সোজা গঙ্গার দিকে হেঁটে গেলে ডান দিকে উঁচু টাটের ওপর ঘুড়ির দোকান। সেখানে অস্ট্রেলিয়ান পেপারের একটি কড়ি টানা এক তেল ঘুড়ি, নয়ত কালোয়-সাদায় চাঁদিয়াল। তার পাশে আংটাতে ঝোলানো বড়োসড় সুতোর রিল।

বালিতে বিশ্বকর্মা পুজোয় নয়, সরস্বতী পুজোতে ঘুড়ি ওড়ে। কলকাতায় ঘুড়ি ওড়ে বিশ্বকর্মা পুজোয়। কলকাতার কারখানায় কারখানায় বিশ্বকর্মা পুজোয় বিশ্বকর্মার হাতে ঘুড়ি। বালিতে সরস্বতী প্রতিমার হাতে, নয়তো তাঁর বাহন রাজহাঁসের গলায় রঙিন বড়ো ঘুড়ি। ১৯৬০ থেকে সত্তর দশকে সিকি তে বা সিকিতেল, পোনতেল বা পোনতে, এক তেল বা একতে, দুতেল বা দোতে, তারপরই আড়াই তেল বা আড়াইতে। এরপর ‘ভড়’— বালিতে ‘ভড়’-ই বলা হত এই দৈত্যাকার ঘুড়িকে। অখণ্ড বঙ্গের পূর্বভাগে যার নাম ছিল ঢাউস ঘুড়ি।

অখণ্ড বঙ্গের পূর্বভাগে গরমে ঘুড়ি উড়ত। শ্রীরামপুর— হুগলি জেলার শ্রীরামপুরে দেখেছি পৌষ সংক্রান্তিতে ঘুড়ি উড়তে, একেবারে উৎসব যেন। আর শ্রীরামপুরে টানা প্যাঁচ খেলা হত না ষাটের দশকেও, সব ছাড়াছাড়ি খেলা। ছেড়ে খেলা, টানাটানি নেই।

বালি বাজারে ঢোকার আগে যদি গোস্বামী পাড়া রোড ধরে পাঠকঘাট বা কেদারঘাটে যাই, জিটি রোড পেরিয়ে তার খানিকটা আগে ফাঁকা জমি। সেখানে তরকারি আর মাছের বাজার। এ ছবি ১৯৫৯-১৯৬০-১৯৬১। ফাঁকা জমি পেরিয়ে একটা কাঁচা নর্দমা পেরিয়ে মাছের বাজারে ঢুকে আসা যায়, সেখাএন কানাই-বলাইদের অতি বিখ্যাত বাতাসা, খই, মুড়কির দোকান। চিনির বাতাসা, গুড়ের বাতাসা, বিয়ের তত্ত্বে দেওয়ার জন্য বড়ো লাল বাতাসা, যাকে ফেনী বাতাসাও বলা হয়, সেই সঙ্গে চিনির মুড়কি, গুড়ের মুড়কি, নলেন গুড়ের বা খেজুর গুড়ের মুড়কি ঘন শীতে। খেজুর গুড়ের মুড়কিতে হালকা আদার গন্ধ। কী যে ভালো লাগে খেতে। কানাই-বলাই- দুই ভাই-ই গ্রীষ্মে খালি গা, বেশ মোটার দিকে গড়ন, ভুঁড়ি। শীতে গেঞ্জি। ভেতরে জ্বলতে থাকা উনোনে দগদগে আগুন, কাঠের আঁচ। গুড় জ্বাল হচ্ছে, মাটির ফুটো সেই মাঝারি তরল বস্তুটি থেকে বাতাসা তৈরি হবে। পাটির ওপর টুপটাপ করে পড়ছে বাতাসা। গুড়ের, চিনির। গরম গুড়ের বাতাসার কি সুন্দর ঘ্রাণ। বার বার বাতাস শুঁকে খেয়ে নিতে ইচ্ছে করে যেন।

আরও পড়ুন
বিশ্ব ইজতেমা, তবলিগ জামাত, আরও কিছু

এক হাতের প্রায় থাবার মাপের লাল বাতাসা, সেও তো তৈরি হয় এখানে। বিয়ে বাড়ির তত্ত্বে যেমন এই বাতাসা লাগে, তেমনই পশ্চিমবঙ্গের লোকেদের পুত্র সন্তানের আটকড়াইয়ে, পূর্ববঙ্গের সনাতনী জনেদের পুত্র সন্তানের ষষ্ঠী অনুষ্ঠানে লাগে এই লাল বাতাসা। পূর্ববঙ্গের নবজাতিকারও ষষ্ঠী হয়। ষষ্ঠীর সমস্ত অনুষ্ঠানেই কি ছেলে, কি মেয়ে এক। নতুন কাপড়ের টুকরোয় কাঁচা হলুদের একটা অংশ দিয়ে বার বার লেখা হয় রামের নাম। তারপর সেই ন্যাকড়াটি জড়ানো হয় নাবালক বা নাবালিকার গায়ে। পূর্ববঙ্গে নবজাতক বা জাতিকা জন্মালে তার কল্যাণ কামনার জন্য প্রচুর বকুলপাতা পোড়ানো হয়। নবজাতকের আঁতুড় মুক্তি দশ দিনে, এগারো দিনে নখকাটা, গঙ্গা স্নান— মায়ের। এটা তথাকথিত উচ্চবর্ণের ক্ষেত্রে, নাহলে আঁতুড়মুক্তি বা জন্ম অশৌচ অব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে একটু বেশি, এক মাস। নবজাতিকার ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের একুশ দিনে আঁতুড় বা জন্ম অশৈচের মুক্তি। দশ দিনে যে বকুল পাতা পোড়ানো হয়, সেদিনই নাকি ‘বিধাতাপুরুষ’ নবজাতক বা জাতিকার কপালে ভাগ্যলিপি লিখে দিয়ে যান। নবজাতিকার ক্ষেত্রে একুশ দিন।

আরও পড়ুন
১ মিনিটে ২৯ জন বলি-অভিনেতার মিমিক্রি, বিশ্বরেকর্ড জলপাইগুড়ির ময়ূখের

আঁতুড়ঘরে মায়েরা কালোজিরে ফেলে ফোটানো গাওয়া ঘি খেতেন ‘নাড়ি’ শুকনোর জন্য। এটি সম্ভব হত সম্পন্ন, তথাকথিত উচ্চবর্গীয় পরিবারে। বাকিরা তো ‘রাজার এঁটো’, নয়তো ‘নোটোর দল’। পোয়াতি খালাস হওয়া মায়েরা খেতেন ‘অশোকা রিষ্ট’, ‘মুলা রিষ্ট’— সবই প্রায় ‘সাধনা ঔষধালয়’, ঢাকার তৈরি।

আরও পড়ুন
শাঁকনি সাপের মালা, কালিকানন্দ অবধূত

কথা হচ্ছিল বালি বাজার, কানাই-বলাইয়ের গুড় বাতাসার, মুড়ি-চিড়ে-খই-মুড়কির দোকান নিয়ে। স্থূলকায় দুই ভাইয়ের খলখলে, কৃষ্ণবর্ণ ভুঁড়ির নাভির নিচে প্রায় নেমে আসা রঙিন লুঙ্গি। ঘাম চপচপে গা। শীতে লুঙ্গির ওপর গেঞ্জি। দোকানের ভেতরে গনগনে তাপ দেওয়া উনোনের কথা তো আগেই বলেছি।

আরও পড়ুন
শিবাভোগ ও সাদা শেয়াল

বালি বাজারে ঢোকার ঠিক আগে, ওই চৌকো— বাজার বসানো জমি ডান দিয়ে রেখে দুপা এগোলেই মনুদার বিখ্যাত দোকান। মনুদার দোকানে মাছ ধরার নানা রকম সরঞ্জাম, হুইল ছিপ, হাত ছিপ, ছোটো হুইল, বড়ো হুইল, মুগা সুতো, নাইলন সুতো, জাপানি নাইলন সুতো, নানা মাপের, দামের বঁড়শি, ছিপের ফাতনা তৈরি করার ময়ুরপাখা, যার লম্বা সাদাটুকু দিয়ে ফাতনা হয়, সেইসঙ্গে মাছের সুগন্ধী চার, একটা কানা উঁচু থালায় পিঁপড়ের ডিম, টোপ বানানোর জন্য সব রেডি।

ঘিয়ের গাদ দিয়ে আঠা মেখে, পিঁপড়ের ডিম মিশিয়ে কাতলা-রুইয়ের টোপ তৈরি করতেন ওস্তাদ ছিপ বাজেরা। চারেতে— মাছ দাকার জন্য ছড়ানো হত মদের ঘ্রাণ মেশানো সর্ষের খোল অথবা গাওয়া ঘিয়ের গাও মিশ্রিত ভাজা খোল। বাড়িতে মাছ ডেকে আনার চার ভাজা হলে তার গন্ধ অপূর্ব।

মনুদার দোকান ছিল সরস্বতী পুজোর আগে ঘুড়ি, লাটাই, ঘুড়ি ওড়ানোর সুতোর আড়ত। তেমনই আতশবাজি কালীপুজোয়। তখন অবশ্য মানে ষাট-সত্তরের দশকে কলকাতার ক্যানিং স্ট্রিটে খুব বড়োসড় বাজির বাজার বসে দীপান্বিতা কালীপুজোর আগে আগে। বেঙ্গল পটারিজ তখনও বন্ধ হয়নি। সেখানে তৈরি পোর্সেলিনের কাপ, ডিশ— চায়ের কাপ, টি-পট, প্লেট কেমন করে যেন চলে আসে ফুটপাথে বিক্রির জন্য, একটা কাগজ-পাতলা ভালো দুধ সাদা চায়ের কাপ প্লেট দেড়টাকা বড়োজোর। তখন অবশ্য মানুষের মাস মাইনেও অনেক কম।

মনুদার দোকানে ‘চেন’, ব্লু বার্ড, ‘কিষান’, ‘রেড কাইট’, ‘জেপি কট’— সব ধরনের ঘুড়ি ওড়ানোর সুতো পাওয়া যায়। ‘চেন’ মার্কা সুতো বেশ মোটা। তার হাত্তা বা ফেত্তি পড়ে অনেক বেশি। ‘ব্লু-বার্ড’-ও সামান্য মোটা। জেপি কট বেশ সরু। এদের মধ্যে সবচেয়ে সরু।

‘চেন’ দেড়টাকা, ‘ব্লুবার্ড’ দশ আনা, ‘কিষান’, ‘রেডকাইট’, জেপি কট— সবই আট আনা। এটা এক রিলের হিসাব। হাজার মাঞ্জা দেওয়া যাবে এমন। দশ আনা মানে বাষট্টি নয়া পয়সা, আট আনা মানে পঞ্চাশ নয়া পয়সা।

বালিতে ঘুড়ি বলতে মুখপোড়া— কলকাতায় তার নাম পেটকাট্টি, চাঁদিয়াল— কলকাতায় মুখপোড়া, বাউনটেক্কা— কলকাতায় বেগদা, রসগোল্লা— কলকাতায় বল, বালিতে সবুজ— সিমপেতে, সাদা— চিন, কালো— কালো, লাল— লাল, বালিতে মোমবাতি— কলকাতায় মোমবাতি, বালিতে চৌরঙ্গী— কলকাতায় চৌখপিপ।

মনুদার দোকানে পাওয়া যায় টোন বা টঙ সুতো। খুব শক্ত, মোটা। ‘চেন’ মার্কা সুতোকে ‘গরুর দড়ি’ বলা হত বালিতে। টোন বা টঙ সুতো তার থেকেও মোটা।

পূর্ববঙ্গে ঘন গ্রীষ্মে বড়োসড়— দৈত্যাকার ঢাউস ঘুড়িকে টোন সুতোয় শক্ত করে বেঁধে তারপর কোনো পোক্ত গাছের মগডালে বেঁধে দেওয়া হত। হাওয়ায় হাওয়ায়— বাতাসের টানে ঘুড়ি উড়ত আপন খেয়ালে, দিব্যি। বালিতেপ ‘ভড়’-ঘুড়ি বা ‘ভড়’ ওড়ানো হত মোটা সুতোতেও, সেই টোন বা টঙ সুতোয়।

এক তেল ঘুড়ির দাম এক আনা— ছ নয় পয়সা, দু তেল দু আনা— বারো নয় পয়সা, সিকি তেল দু পয়সা— তিন নয়া পয়সা। অস্ট্রেলিয়ান পেপার— কড়িটানা অস্ট্রেলিয়ান পেপার, যা সাধারণভাবে কালো আর লালে হত, তার দাম বেশি। অনেক সময়ই লাল ঘুড়ির হত কালো ল্যাজ।

উত্তর চব্বিশ পরগনার সোদপুর-খড়দায় ঘুড়ি ওড়ে সরস্বতী পুজোর দিন— শ্রীপঞ্চমীতে। ইলাহাবাদে সরস্বতী পুজোতে আর পৌষ সংক্রান্তির দিন— খিচড়িনাহানবেলায়। অখণ্ড বঙ্গের পূর্ববঙ্গে ঘুড়িকে বলা হত ঘুড্ডি। আর হিন্দিতে ঘুড়িকে বলে পতঙ্গ। লখনউয়ের ঘুড়ি ওড়ানোর ব্যাপারটা বেশ জবরদস্ত ছিল ওয়াজেদ আলি শাহর আমলে। ভেড়ার লড়াই, কবুতরবাজি, বুলবুলির লড়াই— এসবে লখনউ ছিল খুবই নামকরা। ইলাহাবাদে— শীতে বুলবুলির লড়াই অতি বিখ্যাত। শক্ত পেয়ারা কাঠের গুলেল বা গুলতি চেহারার— ইংরেজি ওয়াই অক্ষরের বুলবুল বসানোর জায়গার নাম ছিল ‘আড্ডা’। পায়ে শক্ত কালো কার বাঁধা লড়াই করার জন্য ঝুঁটি খাড়া করা পুরুষ বুলবুল। এই কালো কাপড় বেশিরভাগই হত সিল্কের। ইলাহাবাদে ঘুড়িবাজি বা প্তঙ্গ লড়ানো একটা বড়ো উৎসবের ব্যাপার ছিল।

বালি বাজারের মনুদার দোকানে নানা রকম লাটাই। বোমা বা ভোমা লাটাই, চারপেকে, দুপেকে। বাঁশের পোক্ত কাঠি দিয়ে তৈরি ব্যোম লাটাই, যার দুপাশে কোনো চাকা নেই। ছ আনা, আট আনা থেকে ছোট লাটাইয়ের দামের শুরু। আট টাকা, দশ টাকা, বারো টাকা। যেমন বড়ো লাটাই, তেমন তার দাম।

উত্তর কলকাতার ফতিয়াপুকুরে ঘুড়ি তৈরি হত যেমন, তেমনই এখনও হয়। অতি বিখ্যাত ঘুড়ি কারিগররা থাকেন এখানে। লখনউয়ের ঘুড়ির শৌখিনদারির কথা আগেই বলেছি। তার ওড়নদারিতে কি বাহার, কি বাহার। ঘুড়ির বাড়তি ল্যাজ— লম্বা করে কাঁটা ফিতে চেহারার রঙিন কাগজে ল্যাজ লাগানোর রেওয়াজ দেখেছি ষাট-সত্তরে। তবে নামি ঘুড়িবাজরা এভাবে ল্যাজ লাগাতেন না কখনও। বালিতে দেখেছি তাঁরা পছন্দ করছেন এক রঙা কালো অথবা লাল একতেল ঘুড়ি। এইসব ঘুড়িবাজেরা ঘুড়ি, লাটাই, সুতো সবই কিনতেন যুদ্ধাস্ত্র কেনার স্টাইলে।

ঘুড়ির কাঁচকাঠি, বুক— সবই তৈরি হত তলতা বাঁশে। তখন মোবাইল, ফেসবুক ঘাঁটা নেই, নেই মানে স্বপ্নেরও বাইরে, তাই বাজি তৈরি করা, ঘুড়ি ওড়ানো, ঘুড়ি তৈরি করা, ঘুড়ি ওড়ানোর সুতোয় মাঞ্জা দেওয়া। হিন্দিতে মাঞ্জাকে বলে ‘মান ঝা’। মাঞ্জার জন্য কাচ গুঁড়নো, ন্যাকড়ায় ছাঁকা, আরও মিহি করা হয় তাকে। লোহার হামান দিস্তায় চূর্ণ হচ্ছে ভাঙা শিশি-বোতল। তারপর সেই গুঁড়ো ছাঁকা হবে ন্যাকড়ায়। সেই মাঞ্জা বানানোর সময় বেলের আঠা, ফোটানো সাবুর আঠা, তেঁতুল বীজের আঠা, শিরীষের আঠা, নাকি কাকডিমের মাঞ্জা দেওয়া হবে, তা নিয়ে তর্ক ও ধন্দের কোনো শেষ নেই। মুরগির ডিম দিয়েও মাঞ্জা হত। কাকডিম পাওয়া কঠিন, পেলেও সেই মাঞ্জার আয়ু নাকি এক রাত। পচে যায়, সব সুতো। সত্যি মিথ্যা বলতে পারব না। মুরগির ডিমের মাঞ্জাও তাই, শিরিষের মাঞ্জাও ক্ষণস্থায়ী।

মাঞ্জা দেওয়া, তার সঙ্গে পুরনো ন্যাকড়ার টুকরো দিয়ে টিবনি ধরা, সব ব্যাপারটাই খুব শৈল্পিক। খুচ না থেকে যায়, এটা দেখার, নজর করে। হাতে করে মাঞ্জা রোজার একটা ব্যাপার ছিল। বার বার করে ঘষা। এক হাজার গজ রুজতে হাতের নড়ার দফারফা।

বাজারে মনুদার দোকানেও রেডিমেড মাঞ্জা পাওয়া যেত। তার কদর তেমন ছিল না। মাঞ্জা দেওয়ার পর শুকিয়ে গেলে তার ধার ঠিক আছে কিনা পরীক্ষা করা হত নাকের নিচে গোঁফ বরাবর ঠেকিয়ে। 

সাধারণত হলুদ, গোলাপি, কালো আর লাল রঙের মাঞ্জা হত। রেডিমেড মাঞ্জায় কালো থাকতই না প্রায়। হলুদ আর গোলাপি রং, সাধারণত। রং ছাড়া সাদা মাঞ্জাও হত। লাটাইয়ে সুতো গোটানোকে বালির রাধু-সুতো গোড়ানো বলতেন। ষাটের দশকে ধুতি মালকোঁচা দিয়ে বেঁধে, ওপরে হাত গোটানো টেরিকটের ফুলশার্ট পরে, চোখে কালো সানগ্লাস দিয়ে তাঁরা ঘুড়ির প্যাঁচ খেলতেন। ঘুচোঘুচি নয়, লং প্যাঁচ। বেড়ে বেড়ে খেলা। তাঁরা দুই ভাই ভোকাট্টা, ভো-ভো-ভো-কাট্টা-র বদলে রণধ্বনি দিতে ভো-ভো-ভোখাব্য— পে-পে-পে-পেহারা, ভু-ভু-ভ্ভু, ভো-ভো-ভ্ভু— সেসব এক আধিভৌতিক, ভৌতিক রণধ্বনি, যেন দিনে দুপুরে। প্রতিপক্ষের ঘুড়ি কেটে গেলে। কেউ বেড়ে না খেললে তাঁরা বলতেন, দুয়ো, দুয়ো, দুয়োহহো— বাড়ে নাকো। বাড়ে নাকো।

হাতা গোটানো ঘিয়ে রঙের ফুলশার্টের নিচে মালকোঁচা মারা ধুতির কোঁচা, নয় কাছা খুলে যেত অনেক সময়, তাঁদের টানামানি করতে করতে পিছিয়ে যেতে যেতে। তাতে তাঁদের কুছ পরোয়া নেই। বালির অতি বিখ্যাত ঘুড়িবাজদের মধ্যে ছিলেন মিস্টার মহিন দাস, আধু-কালু, সূদন ও বুলন। রাধু-কালু যেমন দুহি ভাই, সূদন-বুলনও দুই ভাই। বুলন খুব ভালো ঘুগনি তৈরি করে এনে অ্যালুমিনিয়ামের বড় হাঁড়িতে করে এনে পেঁয়াজ কুচো আর পাতিলেবুর রস দিয়ে শালপাতায় দিতেন। গরম গরম ঘুগনি, শালপাতায় তিন নয়া পয়সা— দু পয়সায়। তখনও বাজারে তামার এক নয়া পয়সা, মিকসড অ্যালয়ের দু নয়া পয়সা। আর আমাদের স্কুলের সামনে ধুতি, রঙিন হাফ শার্ট পরা ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ, এক চোখের কানাইদা ও বেশ ‘বাবু বাবু’ চেহারার নিতাইদা। বুলন শার্ট, প্যান্ট প[অরতেন। সূদন সাহসী, কোনো একটি কারখানায় চাকরি করতেন, পরে ১৯৭০ সালে তিনি বালির সি পি আই (এম)-এর মার্সেনারি, অ্যাকশন স্কোয়াডের জন হয়ে যান।

Powered by Froala Editor